আমাদের জাতীয় জীবনের যে কয়টি ঘটনা আছে এর মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যতম। তাইতো একুশ আমাদের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে মিশে আছে একাকার হয়ে। বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যে যেমন অপরিসীম গুরুত্বের দাবিদার, তেমনি বাংলা সাহিত্যের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্মৃতিময় ইতিহাসও বটে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আমাদের জীবনের নানা অধ্যায় এ সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে।

একুশের ছোঁয়ায় আমাদের সাহিত্য কানায় কানায় ভরপুর। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে একুশের ছোঁয়া লাগেনি। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, নাটকসহ সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় এ চেতনাকে তুলে ধরেছেন আমাদের কবি-সাহিত্যিকগণ।

ভাষা আন্দোলনে কবি ফররুখ আহমদের অবদান অনস্বীকার্য। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবির সেই অমর সৃষ্টি ‘ভাষার গান’ থেকেই বুঝা যায় বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর কতটা দরদ ও ভালোবাসা ছিল। কবির এ গানটিতে সুরারোপ করেন আব্দুল হালিম চৌধুরী। গানটিতে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
‘মধুর চেয়ে মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা/
এই ভাষাতে ফোটে আমার দুঃখ দরদ আশা।
এই ভাষাতে পুঁথি গাথা মারেফতী শিখি/
এই ভাষাতে ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া গান শিখি।
এই ভাষাতে মেটে আমার মনের পিপাসা/
এই ভাষাতে ফোটেরে ভাই সকল কান্না হাসি/
এই ভাষাতে সুখে দুঃখে গাইযে বারমাসী/
এই ভাষাতে যায়রে ভাবের আঁধার কুয়াশা’।

একুশের প্রথম কবিতাটি লিখেছেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সেই কবিতার চরণে আছে, ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।’
কবি আহসান হাবীবের মিছিলে অনেক মুখ কবিতায় লিখেছেন ‘মিছিলে অনেক মুখ/ দেখো দেখো প্রতি মুখে তার/সমস্ত দেশের বুক থরো থরো/উত্তেজিত/শপথে উজ্জ্বল!’/সূর্যের দীপ্তিতে আঁকা মিছিলের মুখগুলি দেখো/ দেখো দৃপ্ত বুক তার/ দেখো তার পায়ের রেখায়/ দেশের প্রাণের বন্যা উচ্ছল উত্তাল।’
একুশের কবিতা মানেই যখন যুদ্ধজয়ের কাব্য, তখন আল মাহমুদের কবিতায় একুশ হয়ে উঠেছে ছইওয়ালা নাও। আল মাহমুদ লিখেছেন,
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত/
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে/
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে/
মুক্ত বাতাস কিনতে?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন/
পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি/
জন্মেছি এই বঙ্গে।

ছোট্টবেলায় অবুঝ মনে যে ছড়াটি মুখস্থ করতো সবাই সেটি অতুলপ্রসাদ সেনের ছড়া ‘বাংলা ভাষা’। কতো সুন্দর করেই না তিনি লিখেছেন,
‘মোদের গরব, মোদের আশা,
আ-মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে,
তোমার বোলে,
কতই শান্তি ভালোবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে!
গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
গেয়ে গান নাচে বাউল,
গান গেয়ে ধান কাটে চাষা!’
ছড়াকার আবু সালেহ লিখেছেন, ‘পেরিয়ে সিঁড়ি রক্তের সেই ফেব্রুয়ারি/ স্বাধীনতা লাভ করলাম যেই/ দেখতে পেলাম বাপ দাদাদের হায়/ আকুল করা সেই ভাষা আর নেই।/ মুখে মুখে ভিন দেশীদের ভাষা/ দেশ ত্যাগের রয় মনের ভিতর আশা/ ভাবতে গেলেই হারিয়ে ফেলি খেই।’
একুশ নিয়ে কবি আসাদ চৌধুরী লিখেছেন, ‘নদীর জলে আগুন ছিল আগুন ছিল বৃষ্টিতে/ আগুন ছিল বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে।/ আগুন ছিল গানের সুরে/ আগুন ছিল কাব্যে, মরার চোখে আগুন ছিল এ কথা কে ভাববে!/ কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায় ফোঁসে সাপের ফণা/ শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা।/ আগুন ছিল মুক্তিসেনার স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-/ প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে কাঁপছিল সব অন্যায়।/ এখন এসব স্বপ্নকথা দূরের শোনা গল্প,/ তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প।’

ছড়াকার সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী তার ছড়ায় একুশকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
‘শহীদ দিবস অমর হোক’/
ফুল যে হাতে রাখা,
বর্ণমালার বর্ণগুলি অই/
আলপনাতে আঁকা।
শহীদ দিবস ভাষার দিবস/
অমর ভাষার দান,
আগুন ঝরা ফাগুন এলে/
বয় যে শোকের বান।
পলাশ শিমুল ফুলগুলো ঐ/
ঝিলমিলিয়ে হাসে,
ফাগুন এলে বীর শহীদের/
ছবি চোখে ভাসে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি কেমন ছিল তা কমবেশি আমাদের সবারই জানা। ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলো সেদিন বাংলার দামাল ছেলেরা। তাদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। প্রতি বছর একুশ এলেই আমরা জেগে উঠি আমাদের শহীদদের স্মরণ করতে। তাইতো একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে এতো মূল্যবান। বাংলাভাষা এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে গৌরবের আরেক ধাপ উত্তীর্ণ হয়েছে। ভাষার জন্য তাদের এ অবদান জাতি কখনো ভুলবে না, তারা আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন চিরস্মরণীয় হয়ে।

Share.

মন্তব্য করুন