ছোট্ট চড়–ই পাখি দেখতে খুব সুন্দর। ফুড়–ত ফাড়–ত উড়ে বেড়ায় চোখের সামনে। বাগানে, গাছের ডালে, ঘরের ছাদে, বারান্দায়, কার্নিশে, জানালার ফাঁকে নীড় বাঁধে ওরা। সারা দিন এখানে ওখানে অহর্নিশ ঘুরে বেড়ায়। একসময় নীড়ে এসে আশ্রয় নেয়।

ছোট্ট পাখি। ছোট্ট শরীর। শক্তি-সামর্থ্যও কম। কিন্তু নিজেদের ঘর নিজেরাই তৈরি করে। একটি একটি করে খড়-কুটো সংগ্রহ করে। নিপুণ শৈল্পিক হাতে নিখুঁতরূপে ঘর বাঁধে। মনে হয়, ঘর নয় যেন এক সুন্দর আশ্চর্য শিল্পকর্ম। যেমন রুচি, তেমনি ধৈর্য। ওদের খড়-কুটোর ঘর দেখলে বোঝা যায়, ওরা কত বড় শিল্পী, কি সুন্দর রুচিবোধ নিরলস শ্রম আর অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে ওরা নিজেদের ঘর তৈরি করে। অনেক দিন লাগে এ ঘর তৈরি করতে।

এ রুচিবোধ, ধৈর্য ও শিল্প-কৌশল ওরা শিখেছে কার কাছে? কত দিন-মাস কেটেছে প্রশিক্ষণ কাজে? এটা কেউ জানে না। এটা ভেবেও দেখেনি কেউ কখনো। মূলত সৃষ্টিগতভাবেই ওরা এসব কিছু শিখেছে। প্রত্যেক সৃষ্টির একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। আরবিতে এটাকে বলে ‘ফিত্রাত’। প্রত্যেক সৃষ্টিকেই মহান আল্লাহ্ এ ফিত্রাতের উপর সৃষ্টি করেন, তা সে সৃষ্টি যত বড় অথবা যত ছোটই হোক না কেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা রূমে স্বয়ং আল্লাহ এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

হঠাৎ মনে হতে পারে, চড়–ই পাখি নিয়ে আমার এত ভাবনা কেন? মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ চড়–ই কেন, প্রাণিজগৎ নিয়ে ভাবনা করার কথা নয় আমার। এমনকি এ নিয়ে ভাববার কোন প্রয়োজন আছে বলেও আমার কখনো মনে হয়নি। কিন্তু একটা ছোট্ট চড়–ই পাখি কী জানি, কিভাবে আমার মনে অকস্মাৎ এ ভাবনার উদ্রেক করে। অবাক বিস্ময়ে আমি চড়–ই পাখি সম্পর্কে ভাবতে শুরু করি। শুধু ভাবনা নয়, চড়–ই পাখি নিয়ে আমি লিখতেও শুরু করি। এভাবেই এ গল্পটির অবতারণা।

আমার স্ত্রী একদিন আমাকে আঙুল উঁচিয়ে বাথরুমের ভেন্টিলেটরের দিকে দেখিয়ে বললো- ‘ওদিকে দেখ।’ আমি তাকালাম। ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে কিছু খড়কুটো চোখে পড়লো। সে বললো, ‘দেখ, খড়কুটোর মধ্যে চড়–ই পাখি বসে আছে। হয়তো পাখিটা ডিম পেড়েছে, ডিমে তা দিচ্ছে। ক’দিন পর ডিম থেকে বাচ্চা হবে।’
আমি তো অবাক! এভাবে আমাদের বাসগৃহে একটি নিরীহ ছোট্ট পাখি এসে বাসা বেঁধেছে, থাকার জন্য মনোরম শয্যা পেতেছে। শীত-কুয়াশা, রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কত আয়োজন, কত সুন্দর নীড় তৈরি করেছে। নীড় তো নয়, যেন এক সুদৃশ্য নিপুণ শিল্পকর্ম!

ছোট্ট চড়–ই পাখির এতসব আয়োজন দেখে আমি ও আমার স্ত্রী খুব আনন্দ অনুভব করলাম। মনে মনে কৌতুক বোধ করলাম। স্ত্রীকে বললাম, পাখিটাকে বিরক্ত না করতে। বিরক্ত করলে হয়তো পাখি উড়ে যাবে। ভয়ে আর কখনো এদিকে আসবে না। আমার স্ত্রীও আমার সাথে একমত হলো। আমরা দু’জনই পাখিটার প্রতি খেয়াল রাখতে শুরু করলাম। যাতে তার কোনো অসুবিধা না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ দৃষ্টি। ধীরে ধীরে চড়–ই পাখিটার প্রতি কেমন মায়া জন্মালো। মাঝে-মধ্যে দূর থেকে সন্তর্পণে পাখির বাসার দিকে দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু তাকে বিরক্ত করি না।

আমি চড়–ই পাখিটাকে কোনভাবে বিরক্ত করি না। বরং সব সময় তার প্রতি দৃষ্টি রাখি। পাখির যাতে কষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখি। নানা কাজের ফাঁকে মাঝে-মধ্যে গভীর আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে চড়–ই পাখির বাসার দিকে তাকাই। আমাদের দিন-রাত্রির ভাবনার মধ্যে ছোট্ট চড়–ই পাখিটা বেশ খানিকটা স্থান দখল করে নিলো। আমরা আমাদের নাতি-নাতনি, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যখন কথা বলি, তখনও অনেক সময় চড়–ই পাখির প্রসঙ্গটা উঠে আসে। ওরাও অনেকে আমাদের কুশল জিজ্ঞাসা করার সময় চড়–ই পাখির কুশলও জানতে চায়। আমাদের নিকট এখন সে প্রসঙ্গটা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। আমরাও খুব আন্তরিকতার সাথে চড়–ই পাখির কুশলাদির খবর সরবরাহ করে পরম প্রশান্তি অনুভব করি। সে যেন এখন আমাদের পরিবারেরই একজন।

রাতে ঘুমাতে যাবার সময়ও অনেক সময় আমার স্ত্রীর সঙ্গে চড়–ই পাখিটা নিয়ে কথা বলি। কথা বলতে বলতে এক সময় নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ি। ঘুমটা ভালোই হয়। ছোট্ট পাখিটার সাথে এভাবে আমাদের জীবনটা কেমন যেন এক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অনেকটা আমাদের মনের অজান্তেই যেন এক নতুন অতিথি এসে আমাদের দু’জনের জীবনের গল্পের সাথে যুক্ত হয়েছে।

এখন আমাদের ভাবনা, এ ছোট্ট পাখিটা আর কত দিন থাকবে এখানে? এ অতিথি কত দিনের জন্য আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছে? তার বাচ্চাগুলো বড় হলে একদিন সে বাচ্চাগুলো নিয়ে পাখা মেলে ফুড়–ত করে উড়ে যাবে না তো! হারিয়ে যাবে না তো এ কোলাহলময় পৃথিবীর নিবিড় অরণ্যে! কে জানে, দুনিয়ায় কোনো কিছুইতো স্থায়ী নয়। আমরাই বা আর কতদিন আছি এ পৃথিবীতে। এ ঘর, এ সংসার সবকিছুই পড়ে থাকবে, আমরা হয়তো থাকবো না, পাখির মতো আমরাও একদিন হারিয়ে যাবো।

Share.

মন্তব্য করুন