পৃথিবীর বুকে কত দেশ। দেশে দেশে কত মানুষ। মানুষের মুখে মুখে কত না ভাষা! আবার ভাষায় ভাষায় কত যে ব্যবধান! ভাবলে অবাক হতে হয়! বিস্ময়ে হা হয়ে যায় মনের জগৎ!
মানুষে মানুষেও কত রকমফের। কত রঙ। কত রূপ। কত অবয়ব। কেউ ফর্সা। কেউ কালো। কেউ সাদা। কেউ বা শ্যামলা। লম্বা কেউ। কেউ খাটো। কেউবা মাঝারি। কারো নাক খাড়া। কারো বোঁচা। কারো চিকন। কারো মোটা। গোলগাল মুখ কারো। কারো লম্বাটে। কারো ফের ত্রিকোণী। এমন করে ভাবলে কত কত ব্যবধান মানুষ থেকে মানুষে। কত না আশ্চর্য আলাদা একজন থেকে আরেকজন। ভাষার বিষয়টি তেমনি বিস্ময়ের।
হাজার রকম মানুষ। হাজার রকম ভাষা। হাজার ধরণ। হাজার প্রকরণ। একেক জাতির একেক ভাষা। একেক ভাষার একেক বৈশিষ্ট্য। একই ভাষারও আছে নানান আঞ্চলিক রূপ। অঞ্চল ভেদে একই ভাষার রূপ বদলে যায়। বদলে যায় শব্দগত। অর্থগত এবং উচ্চারণগত। এ বদল খুব সহজে কানে বাজে। সহসা বোঝা যায় আলাদা। সহজে বুঝে নেয়া যায় ব্যবধান।

আমাদের বাংলা ভাষার কথাই ধরা যাক- নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আকাশ পাতাল ব্যবধান। আবার চট্টগ্রাম আর সিলেটের ভাষার মিল নেই একদম। সিলেট থেকে বরিশালের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। বরিশাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিংবা রাজশাহীর ভাষা ভিন্ন। রাজশাহী থেকে যশোরের ভাষা পৃথক। যশোর থেকে কুমিল্লার ভাষা একেবারে অন্যরকম। এভাবে প্রতি বারো কিলোমিটার অন্তর ভাষার রূপ বদল হতে থাকে। বিস্ময়ের বিষয় হলো- আঞ্চলিক ভাষায়ও ব্যবধান হয়ে যায়। নোয়াখালীর এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলের ভাষার পার্থক্য বেশ বোঝা যায়।

সারা পৃথিবীতে ভাষার এ বিস্ময় বৈচিত্র বিদ্যমান। একই জাতির লোক। অথচ মুখের ভাষা আলাদা। গোত্রে গোত্রে আলাদা। একই দেশ অথচ ভাষাগত পার্থক্য অবাক করার মতো। এটি আসলে সৃষ্টি বৈচিত্র। মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে যেমন বিভিন্নতা দিয়েছেন। বিস্ময় বৈচিত্র দিয়েছেন তেমনি দিয়েছেন মানুষের ভাষার বিভিন্নতা। মানুষের ভাষা তো আছেই। দেশে দেশে। জাতিতে জাতিতে। কিন্তু মানুষ ছাড়া তো পৃথিবীতে হাজারও প্রাণী আছে। উদ্ভিদ আছে। বৃক্ষরাজি আছে। আছে ফুল ফল। আছে নদী ও ঝর্ণা এবং আছে পাহাড় ও সমতল। মাঠ জুড়ে আছে ফসলের সমাহার। আছে সময় ও সময়ের তারতম্য। সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা। আছে রাত্রি। আছে রাতের প্রথম প্রহর ও মধ্যরাত। তারপর আছে ভোরের স্নিগ্ধ প্রকাশ। নতুন দিন এবং নতুন সূর্যের উদয়। এভাবে সময় বদলে যায়। এতো কিছুর সমাহার এই পৃথিবীর বুকের ওপর। এতো এতো জাতি প্রজাতি। এসব কিছুরই আছে নিজস্ব ভাষা। সে ভাষা মানুষের মতো নয়। নয় শব্দের সমাহারে উচ্চারিত। পরিচয়ের আনন্দ নিতে মানুষই ভাষা দিয়েছে এসবের। মানুষের ভাষা ব্যবহৃত হয় সকল সৃষ্টির পরিচয়ে! মানুষই নাম ধরে ডাকে সকল জিনিসের। সকল প্রাণীর। সকল উদ্ভিদ ও সকল বৃক্ষের।

কিন্তু মানুষের ভাষা ছাড়াও এসবের নিজস্ব ভাষা কি নেই? এর জবাব, হ্যাঁ এবং হ্যাঁ। নিশ্চয় আছে। আছে সর্বব্যাপী। জগতের প্রতিটি প্রাণ অপ্রাণের ভাষা আছে। প্রতিটি পদার্থ অপদার্থের ভাষা আছে। আছে প্রতিটি উদ্ভিদ ও বৃক্ষের ভাষা। প্রতিটি জিনসের নিজস্ব অবয়বই এদের নিজস্ব ভাষা। একটি প্রাণীর নাম নেবার সাথে সাথে তার যে অবয়ব দাড়িয়ে যায় মনের ভেতর তা ই তার প্রথম ভাষা। এর সাথে আছে তার সাংকেতিক শব্দ। যা তার সমগোত্রীয় সবাই বোঝে। সমস্ত প্রাণীরই আছে আচরণ। আছে কষ্ট ও আনন্দের অনুভূতি। একটি উদ্ভিদের নাম নিলে যে পরিচিতি প্রকাশ পায় তা-ই তার ভাষা। একটি বৃক্ষের নামে তার যে চিত্র দাঁড়ায় তা-ই তার ভাষা। একটি পদার্থ নামের সাথে তার দৃশ্যটিই তার ভাষা।

একটি ফুলের ভাষা আছে। ফুল নাম নিলেই নানা রঙ নানা অবয়বের সুন্দর ছবি মনের ভেতর ভাসতে থাকে। আবার যদি বলি গোলাপের কথা কিংবা পদ্মের কথা তো আরেকটি নির্দিষ্ট আকার দাঁড়িয়ে যায়। এ আকার আকৃতিই হলো গোলাপ ও পদ্মফুলের ভাষা। তারপর আসে তার রঙ রূপ এবং সৌরভের কথা। এসবও ফুলের ভাষার প্রকাশ।
ফুলের পাপড়িতে দোল দেয়া বাতাসেরও আছে ভাষার কারু। প্রজাতির রাঙা ডানায় শিল্পের যে কাজ তাও এক ভাষার রূপ। ভোমরের গুঞ্জন ভোমরের ভাষা। পাখির কুজন পাখির ভাষা। নদীর কল্লোল নদীর ভাষা! মৌনতায় থাকে আকাশের ভাষা। পাহাড়ের দৃঢ়তায় থাকে পাহাড়ের ভাষা। এভাবে শস্যের ভাষা আছে। ফসলের ভাষা আছে। আছে মাঠের পর মাঠের ভাষা।

আমাদের ভাষা বাংলা। দেশও বাংলাদেশ। বাংলা ভাষার আনন্দটি অন্যরকম। এর ইতিহাস গৌরবের। বীরত্বের। সংগ্রামের। ভাষার জন্য লড়াই বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষায় নেই। আর কোনো ভাষার শরীরে নেই রক্তের দাগ।
পৃথিবীর কোনো ভাষার জন্য কাউকেই প্রাণ দিতে হয়নি। দিতে হয়নি জীবন এবং হতে হয়নি শহীদ। এ ইতিহাস কেবলই বাংলা ভাষার ইতিহাস। এ লড়াই কেবলই বাংলা ভাষার লড়াই।

সুতরাং বাংলা ভাষা আমাদের গৌরবের। আমাদের মর্যাদার। আমাদের সম্মানের। আমরা ভালোবাসি আমাদের ভাষা। গৌরব বোধ করি ভাষার জন্যে। আনন্দ করি ভাষার আনন্দে। আমরা আমাদের স্বপ্নের কথা বলি। আশার কথা বলি। আকাংখার কথা বলি। বলি বাংলা ভাষায়। বলি বাংলার সৌন্দর্যে। আমাদের সব ইচ্ছে জাগে বাংলায়। সব কল্পনা জন্মায় বাংলাতে। সব সম্ভাবনার কথাও ফোটে বাংলা ভাষার সৌরভে।

বায়ান্ন আমাদের রক্তাক্ত সংগ্রামের বছর। আমাদের ভাষা রক্ষার দুরন্ত লড়াইয়ের বছর। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার বছর। মুখের ভাষা মানুষের জন্মগত। ভাতের অধিকারের মতো ভাষার অধিকারও প্রকৃতি দিয়েছে। বাতাসে নিশ্বাস নেবার মতো ভাষাও প্রাকৃতিক। জন্মের সাথে সাথে বাঁচার অধিকার। খাওয়া পরার অধিকার এবং বসবাসের অধিকারের মতো মাতৃভাষারও আছে অধিকার। এ অধিকার কেড়ে নেবার অধিকার কিন্তু কারো নেই। নিতে পারে না। পারবে না। পারার পদক্ষেপও অপরাধ! এ অপরাধ থেকে দূরে থাক মানুষ। দূরে থাক ক্ষমতাধর ব্যক্তিগণ।
আমরা লড়াই করে সংগ্রাম করে ভাষা পেয়েছি। এখন আমাদের রক্ষা করতে হবে ভাষার মান। শুদ্ধ চর্চা করতে হবে ভাষার। তবেই ভাষা হবে সম্মানের। ভাষা হবে মর্যাদার। ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতেই হবে আমাদের। পৃথিবীর সবার ভাষা সবার মতো। আমার ভাষা বাংলা ভাষা।

Share.

মন্তব্য করুন