নতুন বছর। দু’হাজার একুশ সাল। প্রতিটি নতুন বছরের ঊষালগ্নেই আমাদের প্রত্যাশা থাকে সুন্দরের, কল্যাণের। কত কত কিছু যে আমরা করতে চাই, কতকিছু যে আমরা পেতে চাই এবং কত সুন্দর করে আমরা এই পৃথিবীকে দেখতে চাই- সেই প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হলো তার যেমন হিসেব কষতে হয়, তেমনি না পূরণ হওয়ার কারণও তালাশ করতে হয়। এতে দুয়ারে দাঁড়ানো নতুন বছটির জন্য ভালো একটি পরিকল্পনা নেয়া যায়। পরিকল্পনা ছাড়া আগামীকে সুন্দর করে পেতে চাওয়া বাতুলতা বৈ কিছু নয়।

সময় কোনো স্থির বস্তু নয়। সময় চলমান। সে হিসেবে বর্তমান বলে আসলে কিছুই নেই। যা আছে তা কেবল অতীত আর ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতের অজানা সমুদ্দুর থেকে উঠে এসে সময়ের ঘোড়া লাফিয়ে পড়ছে অতীতের কৃষ্ণগহ্বরে। আমরা যাকে বর্তমান বলছি, সেখানে কিছুই দাঁড়িয়ে থাকছে না। ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীরকে যেমন আবার ধনুকে ফিরিয়ে আনা যায় না, সময়ও তেমনি। চলে যাওয়া সময়কেও ফিরিয়ে আনা যায় না। এজন্য সময়ের অপচয় করা মারাত্মক ব্যাপার। ইবনুল কায়্যিম বলেছেন, ‘সময়ের অপচয় করা মৃত্যু অপেক্ষাও ভয়ঙ্কর!’ আর দার্শনিক আল ফারাবী বলেছেন, আমি সময়কে শিখেছি একজন বরফ বিক্রেতার কাছ থেকে। বিক্রেতা আর্তস্বরে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছিলেন এভাবে, ‘ভাই, একজন মানুষের প্রতি দয়া করুন, যার পূঁজি গলে যাচ্ছে!’ সময়ের সাথে সাথে বরফ গলতে থাকে। পূঁজি বিনিয়োগ করে বা টাকায় কেনা হয় এই বরফ। বরফটা এখনই বিক্রি হওয়া দরকার, নইলে তা গলে যাবে। সেই সাথে গলে যাবে বিনিয়োগকৃত পূঁজিও। সময়টাও এমনি, বরফের মতো। গলে যায়। অতীতের গর্ভে হারিয়ে যায়।

মানুষের আয়ু সীমিত, মানে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সময় নির্ধারিত। তাও ঠিক কতদিন বা কত বছর, সেটা কারোরই জানা নেই। অথচ কত কত কাজ করে ফেলা দরকার আজই, এখনই। একজন মানুষের ব্রেনের যে সক্ষমতা, তার যে শারীরিক ক্ষমতা এবং পৃথিবীর আলো-বাতাসে তার যা দেবার, তা যদি সে দিতে না পারলো, সেই অনুযায়ী যদি সে নিজেকে গড়তে না পারলো এবং এইভাবে নিশ্চেষ্ট থেকে সে যদি তার সীমিত আয়ু বা বেঁচে থাকার মোট বরাদ্দকৃত সময় অপচয়ই করতে থাকলো- তবে তার বেঁচে থাকার কী অর্থ দাঁড়ালো!

ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের প্রকৃতিও প্রতিশোধপরায়ন। একটা সময় পর্যন্ত সে মানুষের সব অত্যাচার সহ্য করলেও একসময় সে তা দ্বিগুণ করে ফেরত নেয়। বছরের পর বছর ধরে মানুষ নদী দূষণ করে, নদীতে নির্বিচারে বর্জ্য ফেলে। এতে নদীর পানি যেমন বিষাক্ত হয়, দুর্গন্ধ ছড়ায়, তেমনি নদীর তলায় পলি জমতে জমতে একসময় নদী ভরাট হয়ে ওঠে। নাব্যতা হারায় নদী। ফলে জলোচ্ছ্বাস হয়, ভালো পানির সঙ্কট দেখা দেয়, নদীর মাছেরা অস্তিত্বসঙ্কটে পড়ে যায়; এমনকি নদী ভরাট হলে চাষের জমিতেও পানির সঙ্কট হয়। এতোসব সত্ত্বেও একশ্রেণির লোভি মানুষেরা আবার নদীও দখল করে!

ওদিকে বন উজাড় হতে থাকে। জুম চাষের নামে হাজার হাজার একর পাহাড়ি বনভূমি উজাড় হচ্ছে। এটা ঠিক তখন হচ্ছে, যখন বিশ^ব্যাপী গাছ লাগানোর ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। বন উজাড় হলে শুধু যে অক্সিজেনের সঙ্কট দেখা দেবে তাই নয়, আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপরও এর প্রভাব পড়বে। নানান রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও তৈরি হয়। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর প্রভাব পড়ে প্রাণী জগতে। প্রাণীদের জীবনধারণ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বন্যপ্রাণীরা, পাখি ও পশু-প্রজাতিরা হারাতে থাকে প্রকৃতি থেকে। এতে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে, বিপর্যয় নেমে আসতে থাকে প্রকৃতিতে।

আগেই বলেছি, প্রকৃতিও প্রতিশোধপরায়ন। অথবা বলা চলে, প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে অল্প অল্প করে দূষিত করছি, ক্ষতিগ্রস্থ করছি, প্রকৃতি সবকিছু জমা করে একসময় তা আমাদের দিকেই ফিরিয়ে দেয়। বিপদে পড়ে আমরা তখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। সমাধান খুঁজতে থাকি। অথচ বিপদ এসে যাওয়ার আগেই যদি আমরা সচেতন হই, যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা না ফেলি, তাহলেই তো অনেক বিপদ আমাদের থেকে দূরে থাকে। নতুন বছরে এসব কিছুও আমাদের ভাবতে হবে।

শঙ্কা ও সম্ভাবনার বিপুল উত্তেজনার মধ্য দিয়ে বিদায় নিলো একটি বছর। দু’হাজার বিশ সাল। বৈশি^ক অতিমারী কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। পুরো বছরটাই ছিলো একটা শোকের বছর। এখনও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন কোভিডে। বিশ^ব্যাপী আতঙ্কগ্রস্থ মানুষের মুখচ্ছবি টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই চোখে পড়ে। এমন দৃশ্য ছিলো প্রায় বছর জুড়েই। মানুষের সচেনতারও কোনো কমতি ছিলো না। মুখে মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া, পরিচ্ছন্ন থাকা, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন রাখা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলা ইত্যাদি সচেতনতামূলক কাজ ছিলো সবারই নিত্যদিনকার অভ্যাসের বিষয়। এই অভ্যাস ধরে রাখা দরকার। এসবই প্রকৃতির শিক্ষা। আমরা যেন এই শিক্ষামতো চলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠি, অভ্যাস যেন ধরে রাখি সবসময়। এতে পরিবেশ সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরাও সুস্থ থাকতে পারবো। ময়লা-আবর্জনা থেকে কোনো জীবাণু ছড়াবে না। গাছপালা সজীব হয়ে উঠবে। প্রাণীরা তাদের বাসস্থানে নিরাপদ বোধ করবে।
আমার তো মনে হয়, আগামীর দিনগুলো কেবলই সম্ভাবনার। আলো ঝলমলে। বিপদমুক্ত। এটা হবে আমাদের আজকের সচেতনতার ফল। এই একটি বছর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো। বন্ধ ছিলো অসংখ্য মানুষের কর্মক্ষেত্রও। এতে শিক্ষার্থীদের যেমন ক্ষতি হলো, তেমনি সাধারণ মানুষেরও বিরাট ক্ষতি হয়েছে। একটি অপরটির সঙ্গে জড়িত।

করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ চলছে এখন। সচেতনতায় কোনোরকম ছাড় দেয়া চলবে না। সুস্থ থাকার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকতে হবে আমাদের সবার। আমরা সবাই সবার জায়গা থেকে সচেতন থাকলে, একে অপরকে সচেতন করলে এই অতিমারী থেকে বেঁচে থাকতে পারবো আমরা। নতুন বছরে খুব দ্রুততম সময়ে খুলবে আমাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এই প্রত্যাশা আমাদের সবারই। আবার কোলাহলমুখর হয়ে উঠবে স্কুল-মাদরাসা-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়।

করোনা পরিস্থিতি আমাদের শিখিয়েছে মানবিক হতে। মনে রাখা দরকার, সবকিছুর আগে আমরা মানুষ। সবকিছুর আগে আমাদের মানুষসুলভ আচরণ। মানুষ যখন একান্ত একা হয়ে পড়ে, বিপদে পড়ে- তখন তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে একজন মানুষকেই। এমনকি আমাদের বাড়ির পোষা বিড়ালটি, কুকুরটি এমনকি নিজেদের বাড়ির এবং প্রতিবেশীর কিংবা যে কোনো প্রাণীর প্রতিও আমাদের সদয় হতে হবে। তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে হবে।

শুরুতে যে কথা বলছিলাম- সময়ের মূল্য দিতে হবে। তোমরা সারা বছর ধরেই পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অনেক গল্প-উপন্যাস ও কবিতার বই পড়েছো নিশ্চয়। এই খেলাধুলা ও পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি এই পড়াটাকে অব্যাহত রাখতে হবে। নতুন বছরের জন্য সুন্দর একটি পরিকল্পনা করতে হবে। আর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে, তিনি যেন আমাদের সবাইকে তথা পৃথিবীর সব মানুষকে ভালো রাখেন। নতুন বছর যেন হয় কল্যাণের বছর। ভালো কিছুর, সুন্দর কিছুর সমাবেশ ঘটুক আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে। স্বর্ণালী আলোর বন্যায় ভেসে উঠুক আমাদের আঙিনা। আনন্দময় হোক আমাদের সবার জীবন। এ মুহূর্তে এই লেখাটি যারা পড়ছো, সবাইকে ইংরেজি নতুন বছরের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ দু’হাজার একুশ।

Share.

মন্তব্য করুন