মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ব্রেন বা মস্তিষ্ক। মানব অস্তিত্বের সবকিছু ব্রেন দ্বারা পরিচালিত হয়। মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে নিয়ন্ত্রক শক্তি হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল চিন্তা ও সচেতনতার কেন্দ্র ব্রেন। মানুষের সকল উদ্ভাবনী দক্ষতার উৎস ব্রেন।
ব্রেনের এই দক্ষতার কারণে মানব জাতির পূর্বপুরুষের দৈহিকভাবে তার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে শুধু টিকেই থাকেনি বরং প্রাণীকূলের মাঝে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মানুষ ব্রেন সম্পর্কে পুরোদমে গবেষণা শুরু করেছে ৬০-এর দশক থেকে। ব্রেনের কার্যক্রম বোঝার ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এই আগ্রহের কারণ হচ্ছে, ব্রেনের ভেতরে যা ঘটছে তা থেকে ব্রেনের বাইরে যা ঘটছে তাকে আলাদা করা যায় না। তাই প্রতি বছরই বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী ব্রেনের কার্যকম নিয়ে গবেষণা করেছেন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. ফ্রান্সিস অটো স্মীথ তাই বলেছেন, মানুষকে বুঝতে হলে প্রথম ব্রেনকে বুঝতে হবে।

কম্পিউটারের সঙ্গে এর তুলনা করা হলেও একটি আধুনিক কম্পিউটার ১০০ বিলিয়ন ‘বিট’ তথ্য জমা ও মনে করতে পারে, সেখানে ব্রেনের সামর্থ্য অসীম। কম্পিউটার অবশ্য ব্রেনের চেয়ে দ্রুত বেতন তালিকা, হিসেব তালিকা, মহাশূন্য যানের গতিপথ নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু কম্পিউটার শুধুমাত্র সে কাজগুলোই করতে পারে যা তার নির্মাতা মানুষ তাকে করার জন্য প্রোগ্রাম করেছে। অপরদিকে ব্রেন অনেক অনেক সূক্ষ্ম কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করে।
মানুষের মস্তিষ্কের ওজন আনুমানিক ১.৫ কিলোগ্রাম, যেখানে একটা হাতির মস্তিষ্ক ৫ কিলোগ্রাম আর তিমির ৯ কিলোগ্রাম। কিন্তু এই ১.৫ কিলোগ্রাম মস্তিষ্কে ৮৬ বিলিয়ন নিউরনের উপস্থিতি মস্তিষ্কের ঘনত্ব অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেটাই আমাদের করেছে আরো বেশি চৌকশ।
মানুষের হার্ট নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, গরম কিছুতে লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নেয় ব্রেন। আর এ নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের সচেতনতার অজ্ঞাতে।
ব্রেন সেলগুলো যে বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে যে কত সংখ্যক নিউরোন সেলের পারস্পরিক যোগাযোগ প্রয়োজন হয় তা কল্পনা করতে গেলেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়।

জার্মানীর বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. ম্যানফ্রেড ইগান নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ব্রেনের কোন কোন কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন সংগঠিত হতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের ১০লাখ ভাগের এক ভাগ সময়। তিনি বলেছেন, একটি দ্রুতগামী গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচার জন্যে এক পা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা কার্যকরী করার জন্যে ১লাখ নিউরোনের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে।
মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় সারাজীবনই নতুন কোষ তৈরি হয়। কমপক্ষে ৯৭ বছর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলে বলেই ধারনা করা হচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি মাদ্রিদের একদল গবেষক এমনও দেখিয়েছেন যে, বয়সের সাথে সাথে নতুন কোষ তৈরির সংখ্যাও বন্ধ হয়ে যায়। আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমতে থাকে-তাইডিমনেশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগের জন্যে এমন গবেষণা নতুন ধারনার সৃষ্টি করে।

আমাদেও মস্তিষ্কের বেশির ভাগ কোষ যা নিউরন নামে পরিচিত নিজেদের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়, আর এই প্রক্রিয়া আমাদের জন্মের সময় থেকেই শুরু হয়। অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনের পরবর্তী সময়েও তাদের মস্তিষ্কে নতুন কোষের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে নতুন নিউরনের উদ্ভব বা যে প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘নিউরোজেনেসিস’ অব্যাহত থাকে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। একটি সুস্থ মস্তিষ্কে বয়সের সাথে সাথে নিউরোজেনেসিস বা নিউরনের বৃদ্ধির পরিমাণ ‘সামান্য কম’ দেখা যায়।
গবেষক ড. মারিয়া লরেন্স মার্টিন বিবিসিকে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, মানুষ যতক্ষণ নতুন কিছু শিখছে ততক্ষণ নতুনভাবে নিউরনের বৃদ্ধি ঘটছে। এবং এটি আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তেই ঘটে চলেছে।’
কিন্তু আলঝেইমার রোগীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। আলঝেইমারের প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন নিউরন বৃদ্ধির সংখ্যা প্রতি মিলিমিটারে ৩০,০০০ থেকে কমে দাঁড়ায় ২০,০০০ এ।

ব্রেনকে সতেজ রাখার জন্য রয়েছে নানা রকম ব্যায়াম। স্নায়ু মনোরোগ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, ব্রেনকে সুস্থ রাখার মতো যথাযথ লাইফ স্টাইল এবং খুব পরিকল্পনা মাফিক নিয়মিত ব্রেনের ব্যায়াম করলে আমাদের ব্রেন অধিত জ্ঞান, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও বোধের যে সঞ্চয়, যা আমাদের নিজস্ব সত্বার পরিচয় বহন করে, সেগুলির ক্ষয়কে অনেকখানি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

মনে রাখতে হবে, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় –দর্শন, ঘ্রাণ, স্পর্শ, স্বাদ ও শ্রবণের সঙ্গে ব্রেনের বিভিন্ন অংশের যোগাযোগ রয়েছে। ফলে এদের কার্যকলাপের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সৃষ্টির ফলে স্বাভাবিক ব্রেন নিউট্রিয়েন্ট উৎপন্ন হবে, যা স্মৃতিশক্তিকে মজবুত করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি ব্রেনের বিভিন্ন কোষকেও শক্তিশালী করবে। যেমন – সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজার সময় ‘অনভ্যস্ত’ হাতটি ব্যবহার করে ব্রাশ করা। ব্রেন কোষগুলি এতে সজাগ হবে। চোখে না দেখেও কিছু কাজ স্পর্শের সাহায্যে করার অভ্যেস করলে ব্রেনে কটিকাল এলাকায় তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
মানসিক-চর্চা বা সাধারণভাবে যাকে আমরা মস্তিষ্কচর্চা বলছি তার সাফল্য দাঁড়িয়ে আছে ব্রেনের কিছু বিশেষ বৈশিষ্টের ওপর, যেমন নিউরোপ্লাস্টিসিটি। মস্তিষ্কের কিছু অংশের অভ্যন্তরীণ স্নায়ুকোষ (নিউরোন) এর আমৃত্যু বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা থাকে। শুধু তাই নয়, স্নায়ুকোষগুলির মধ্যে সংযোগও অপরিবর্তনীয় নয়।

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলে এই স্নায়ুকোষগুলি দিয়ে তৈরি জোট বন্ধনের ভিত্তিতে। মস্তিষ্কের যাবতীয় কাজকর্ম আর তার ফলে আমাদের ব্যবহার, আচার-আচরণ, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য সবই মূলত নির্ভর করে থাকে এই বিভিন্ন জোট বন্ধনের উপর। এক একটি স্নায়ুকোষ অন্তত ১০হাজার অন্য স্নায়ুকোষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার ক্ষমতা ধরে।
নির্দিষ্ট কাজের জন্য মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ উদ্দীপ্ত হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে মস্তিষ্কের এক থেকে ষোল শতাংশ কার্যকর পাওয়া যাবে। এমনকি ঘুমানোর সময়ও যে মস্তিষ্ক সচল থাকে তাও পরীক্ষা করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তাই অলস সময় না কাটিয়ে আমাদের উচিত মস্তিষ্ককে সিঠিকভাবে কাজে লাগানো।

Share.

মন্তব্য করুন