(গত সংখ্যার পর)

আকাশ ভরা ছুটির খুশি
সুন্দরবন বেড়িয়ে আসার পর অমিয়ের দায়িত্ব গেল অনেক বেড়ে। রেজাল্ট ভালো করতে হবে। মাসখানেক ধুম পড়াশোনা। প্রাইভেট টিউটর। গল্প শোনায় ভাটা পড়ল।
সহি-সালামতে পরীক্ষা শেষ হতেই আবার নব আনন্দের জোয়ার। বাদাবনের জোয়ার! মা বলেছেন- ‘মোটেও বিরক্ত করবে না। সুযোগমতো ব্যবস্থা হবে। অনেক বড় বড় প্রোব্লেম আছে। সেগুলো সলভ করে নিই।’
অমিও সুবোধ একেবারেই। ‘আচ্ছা মা মনি। আমি মোটেও বিরক্ত করব না।’
আলীচার সঙ্গে গল্প শোনার মহা মৌসুম এল অগত্যা। সাতদিন নো পড়ালেখা। অমিয় বাবাকে খুব সাহস করে খাবার টেবিলে বলে ফেলেছে, ‘আব্বু তোমরা এখন ব্যস্ত। আলীচার সঙ্গে একটু গে-ারিয়া যাব। দীননাথ সেন রোডে বাঁদর দেখতে, আর একবার নৌকাবাইচ দেখতে।’

বাবা গম্ভীর মুখোশটা আবার ঢাকা এসে পরে ফেলেছেন। বললেন, ‘কেন গত পরশুই না তোমাকে আশুলিয়া ফ্যান্টাসি কিংডমে ঘুরিয়ে আনা হলো। দিনকাল ভালো না, কোথায় না কোথায় যাবার বায়না ধরেছ।’
অমিয় এবার বোবা হয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। বেড়ানো আসলে নেশার মতো। খুব শখ চেপেছে রোজ গার্ডেনে যেতে। পুরনো ঢাকায় যেয়ে হাজী বিরিয়ানি আর বাকরখানি খেতে। আলীচা বলেছে নৌকাবাইচের গল্প, আর পারভেজ বলেছে পুরনো ঢাকার ঘুড়ি উৎসবের গল্প।
টিভিতে অমিয় দেখেছে জাপানের ঘুড়ি উৎসব। যেন আকাশময় ছোট বড় প্রজাপতি, রঙিন মাছ, ফড়িং, পাখি। লম্বা লম্বা লেজুড় কারও কারও বা গড়ন তিনকোণা, কেউ চারকোণা, কেউবা বিশাল লেজের একটা অদ্ভুত সাপ। শেফা খানকে কথাগুলো দুপুরভর বলেছে অমিয়। মনে মনে খুশি হন মা। কৌতূহল থাকা ভালো। ওযে এত কিছু মজার মজার জিনিস জানতে চায় এটাও ভাল লক্ষণ। নিজের দেশের ঐতিহ্যকে আজকালকার ছেলেমেয়েরা থোড়াই মূল্য দেয়। পাগল ছেলেটার মধ্যে আগুন আছে, উত্তাপ আছে, দীপ্তি আছে। ও দলছুট, অন্যরকম। মনে মনে ভাবেন মা। কৌতূহল না থাকলে মানুষের মগজ ভোঁতা হয়ে যায়। অমিয়ের মনটা হয়তো এক ফালি আকাশের মতো নীল।
অমিয় আলীচার সামনে ঝুলবারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে। ‘আলীচা আজ নৌকার গল্প করবে। তুমি বলেছিলে।’
‘ওহরে কুট্টি ভাইয়া, এত কেচ্ছা এহনই শুইন্যা ফেলালে মাতার মগজে কুটকুটায়। বড় হইয়্যা তাইলে কী শুনবা।’ আলীমিয়া তানজিম ওরফে অমিয়কে রাগিয়ে দিতে চায়।

‘শোন কুট্টি ভাইয়া, গাঙপানি নৌকা বইঠা এইগুলো আমার ছোটবেলার সঙ্গের সাথি। আমার যমুনা নদী…। সিরাজগঞ্জ জেলা নদী, চর, খাল-বিল ভরা। আমি আনচি কানচি সবখানে ঘুরছি ফিরছি। চলনবিল কও, আর যমুনার অথৈ পানির কথা কও আমার কাছে খুব আপনার, চেনা-শোনা, মুখস্থ। কুট্টি ভাইয়া এই নদীর দেশে কত জাতের নৌকা আছে কইবার পার, জানো না, না?’
অমিয় ঝকমকে দাঁত মেলে হাসে।
‘হাসালে আলীচা। আমি নৌকা দেখেছি ছবিতে শুধু আর দূর থেকে পালতোলা নৌকা।’
আলীচা আর একটা বাবা জর্দার খিলিপান মুখে পুরে আয়েশি ভঙ্গিতে বলে, ‘আরে আল্লাহ এই নৌকাই যে কত জাতের, কত নকশার আছে এদেশে, শুনলে তুমি ভিরমি খাইবা। বলি শোন, ছোট নদী এপারওপার করতে আছে রাজপুরি নৌকা। পেরায় বিশ ফুটের মত লম্বা, এর বেশি না, হালকা মতো। মাঝি থাকে একজন। ময়মনসিংহে মারাঙ্গা নামের এক ধরনের নৌকা আছে, তিরিশ ফুটের মতো লম্বা হয়। পাট আর মালামাল বয়ে বেড়ায় এই নাও। আলাইপুর নামের এক রকমের নৌকা আছে, তিনজনে চালায়। তিরিশ ফুট মতো লম্বা হয়। ঝিল, বিল, জলা এবং লোকালয়ে এই নাও মাছ নিয়া চলাচল করে।’

‘থাম, থাম আলীচা। সব গুবলেট হয়ে যাচ্ছে আমার। একটু থাম। নোট বইটা নিয়ে আসছি।’ অমিয় ছুটে যায় রিডিং রুমে।’ দড়াম দড়াম করে ড্রয়ার খোলে। নোটবই ডটপেন খুঁজে আনে।
‘আস কুটি মিয়া… আমার ভাব আইস্যা গেছে। নদী, ছলাৎ ছলাৎ পানির তিরতির ঢেউ। গাঙ, জলা, জলায় লাল শাপলা সাদা শাপলার নকশি। নাও, মাঝির ভাটিয়ালি সেই জান খারাপ করা অপূর্ব সুর। আহারে! আ-হা। সেই আমার বালক-বয়স। কোতায় হারায়া গেল কুট্টি ভাই। এই যে তোমার বালক বয়স। এই বয়সটারে খুব যতন করবা সাজায়া গুছাইয়া হিসাব কইর‌্যা চলবা। তাইলে আর কোনোই আফসোস থাকবে নানে। এই বালক কাল হইল গিয়া সোনার দিন। সবকিছু, মানে যা কিছু ভালো দেখবা নিজ চক্ষে আনন্দ কইর‌্যা, আর সময়মতো পড়ালেখা করবা। তবে দিনরাত ভাইয়া বই-পত্তরের মধ্যে মুখ গুইজ্যা না। তাইলে এত্তসব মজার মজার বায়োস্কোপ দেখার সময় চইল্যা যাইব। তখন স-ব ফক্কা। দেখবা কখন যে বিরাট ভদ্রলোক হইয়া গেছ। কত দায়-দায়িত্ব কান্দের উপর। রাইতে ওষুধ খাইয়া ঘুম যাইতে হয়। টেনশনের পোকা কুটকুটায়। বিরাট চাকরি। সংসার। হাবিজাবি মিটিং ফিটিং। কিন্তু বায়োস্কোপওলা আর আইব না তোমার কাছে। তুমি কেবল কেদারায় শুইয়া মাঝে মধ্যে টি.ভি দেখবা। শীতল হাওয়া নাই। একটুতে মন খঞ্জনা পাখির মতো নাচতে জানে না। সবকিছু কেবলই হজম কইর‌্যা ফেলতে হয়। সোরি ভাইয়া সোরি-মারফতি শুরু করছি যেমন। বাপে আছিল কবিয়াল, খালি দেহতত্ত্ব গাইত, লালনগীতি গাইত আর মারফতি কইত। মগজে ঐগুলা কিলবিলায়।’
হা-হা-হা করে হাসে আলীচা। মজার মানুষ।
‘তোমার নাওয়ের কেচ্ছা তো শেষ হয় নাই।’ অমিয় তাগাদা দেয়।
‘শোন কুট্টি বাদশা, জয়নগর নামে এক নৌকা আছে- জলায় মাছ ধরার নাও। মানুষজন পারাপারও করে। আর পাট নৌকা আছে এক রকমের প্রায় চল্লিশ ফুট লম্বা হয়। কয়েকজন মাঝি লাগে লগি ঠেলতে। এইসব নৌকায় ভাইয়া মণকে মণ পাট পারাপার হয়। আর জালিয়া ডিঙ্গি না, পনের ফুটের মতো হয়। একজন মাঝি লগি বায়। বিলে জলায় মাছ ধরে। এইবার তোমারে একটা বড়লোকি নৌকার গল্প কই। পানসী নৌকা যার নাম। এই পানসি নৌকায় আগেকার আমলে রাজা মহারাজারা, জমিদার বিত্তবান রসিক মানুষরা আনন্দযাত্রা করতো। এই জাতের নৌকায় নানা জাতের আমোদ-আহ্লাদের ব্যবস্থা থাকত। গান-বাজনা মানে কলের গান বাজাইয়া, খিচুড়ি ইলশা মাছ ভাজা দিয়া আহার কইর‌্যা জোছনারাতে তারা নৌবিহার করতো। আমাদের দেশের খাঁ সাহেবরা পানসি নাওয়ে আনন্দ করতো শুনছি বাপজানের মুখে। আবার মালদি নৌকা হালকা। মাছ ধরার নাও। বহুদূর বিল জলায় তরতর কইরা এই নাও বাইয়া যায়।

‘আলীচা তুমি এত মুখস্থ বলছ জেট প্লেনের গতিতে, আমি টুকতে পারছি না ঠিকমতো। একটু জিরিয়ে জিরিয়ে বল না, প্লিজ। তুমি যে পানসি নৌকার কথা বলছ ঐ নৌকার কথা আমি শুনেছি নানুমনির কাছে। মা, খালা, মামা সবাইকে নিয়ে নাকি রেকর্ড বাজিয়ে বর্ষাকালে নৌবিহার করতেন। লাল চালের সঙ্গে গাওয়া ঘি আর হাঁসের মাংস ভুনা হতো। জান আলীচা আমার বন্ধু রাজীব না বুড়িগঙ্গায় ‘মেরি এন্ডারসন’- এ নৌবিহার করেছে। এই জাহাজটা ১৯৩০ সালে তখনকার বাংলার গভর্নরের হাউজবোট ছিল। এই জাহাজেই নাকি ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ, চীন দেশের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যায় নৌভ্রমণ করেছেন। ব্রিটিশ গভর্নর স্যার এন্ডারসন তার মেয়ের নামে এ জাহাজের নামকরণ করেন। এখানে ভাটিয়ালি গান চা ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে।’
‘আমি বাকি রাখি নাই কুট্টিমিয়া। পাগলার বাসে উইঠ্যা গেছিলাম অনেক আগে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রাস্তার পাড়ে। এই জাহাজের ছাদে উইঠ্যা বুড়িগঙ্গায় সূর্য ডোবা দেখছিলাম। কী শোভা, আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই।’
আলীচা পান সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

‘আচ্ছা আলীচা তুমি আমাকে কুট্টি ভাইয়া ডাক কেন। আমি এখন কত বড় হয়েছি।’
পান চিবাতে চিবাতে লাল ঠোঁট নেড়ে হাসে আলী মিয়া কথা দিবার পারি না। তুমি এখনও খুব কুট্টি মানুষ। গোসলে যাও ভাইয়া। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়া এইরহম গল্প শুনলে ম্যাডাম আইস্যা দিবোনে ধমকি। হীরামন বিবি একটার সময় টেবিল সাজাইয়া ডাক চড়াইবে। আর তার তো জিবলা খালি তরবড়ায় ম্যাডামের কাছে নালিশ দেবার জন্য।’
‘দূর আলীচা গল্প তোমার ফুরায় নাই, বলো। একবার খালার সাথে নাকি পাভেল মামার সাথে জাদুঘরে গিয়েছিলাম। নৌকার ছবি দেখেছি কিন্তু ঠিক মনে রাখতে পারি নাই। আবার যাব। তাহলে মনে থাকবে।’
আলী মিয়া হাই তোলে, ‘ভাইয়া গোসল করব। নামাজের ওয়াক্ত যায় যায়।’
‘আচ্ছা বাপু আর একটু।’
অমির এবার নৌকার নেশায় ধরেছে।
‘শোন কই, বালক-বয়সে পেটে দানাপানি নাই, তেলপানি নাই খালি। ছুটছি মুলুক মুলুক। কি জানি খুঁজতাম নেশার মতো। নিশি পাওয়া মানুষের মতো ছুটছি। তো এইবার শোন সাল্লুক সাম্পানের বয়ান। লম্বায় চওড়ায় দশাসই। পালের নৌকা। মালামাল বয়। গহিন সমুদ্রেও চলাচল করে। আর এক জাতের নাম পাহাড়ি কোষা। বেশুমার লম্বা। প্রায় চল্লিশ ফুট। চওড়ায় আবার কম। একটা লম্বা গাছ খুদাইয়া এই নাও তৈরি হয়। কোনো জোড়া নাই। বোজ তাইলে। বালাম নৌকায় কয়েকজন মাঝি লাগে। আর চাঁটগার মাজারে মাজারে একবার খুব পইড়্যা থাকতাম। কত কি দেখার আছে। চিম্বু^ক পাহাড়েও চড়ছি। বাটালি হিলেও চড়ছি। তো দেখ, লাইন ছাইড়া কেমুন বেলাইন হইয়্যা যাইতাছি। চাঁটগায়ে কর্ণফুলী নদীতে বহুত সাম্পান নৌকা দেখতাম। খুব সুন্দর। বরিশালের জাইলা নৌকা আছে একপদের। দেখলে তুমি হার্টফেল হইয়া যাইবা। একুশ ফুটের বেশি লম্বা! বুঝলা কুট্টিমিয়া। ইলিশ মাছ ধরার জন্যে খুব ভাল। গয়না নৌকাও খুব লম্বা হয় মনে হয় ষাট ফুট হবে। গয়না নৌকায় মানুষজন পারাপার হয়। যেখানে সহজে স্টিমার লঞ্চ যাইতে পারে না। সেখানে গয়না নৌকা ছাড়া গতি নাই। ডোঙ্গা নাও ছোটখাটো হয়। বিল, ঝিল, জলায় এ নাও তরতরায়া চলে। চাঁদপুরে আছে এক জাতের নাও। মজা হলো গিয়া, এই নায়ে খালি পান আনা-নেওয়া হয়। হাটে-বন্দরে। এইবার মন দিয়া শোন কুট্টি বাদশা, কুমারগুদি নাওয়ের কেচ্ছা। ছোটকালে চাইয়া চাইয়া খালি দেখতাম। কত্ত মাটির হাঁড়ি পাতিল সরা সাজাইয়া চলছে দূর মুলুকে। ভাবতাম আমারে যদি নিত ঐ নাওয়ে। এককোণায় চুপ মাইরা বইস্যা থাকতাম। কোনো শয়তানি করতাম না। খালি তামসা দেখতাম। কত্ত সরা পাতিলা গোছ-মিছিল কইরা সাজান। খালি দেখতেই মনে লয় ছবির মতন। কোষা নাওয়ের কথা একবার বলছি না, খুব লম্বা ছিপছিপা?’
আলী চাচা দম নেয়।
‘হ্যা, আলীচা বলেছ। দাঁড়াও এক মিনিট। মিলিয়ে নেই।’ অমিয় নোট বইটা উল্টায় দ্রুত।
‘হ্যাঁ পাহাড়ি কোষা।’
আলামিয়া পানের রস ফেলে আসে।
‘আর এইডা হইল কোষা, শুধু কোষা। ছোটখাটো। দশ ফুটের শরীর। আমাদের দেশের অগুনতি নদী খালে বিলে সবখানে এরে পাইবা। অল্প পানিতেও চলতে পারে। এইবার কবো মজার এক নৌকার কাহিনী। বাইচ নৌকা। এই নাও ভাইরে ভাই প্রায় এক শ’ তিরিশ-পঁয়ত্রিশ ফুট লম্বা হয়। চওড়া বেশি না। এই নাওয়ে একসাথে সত্তর জন লোক বসতে পারে। মিটমিট করে হাসে আলী, নাদের আলী মিয়া।’
‘কী মজার নৌকা আলীচা। স্বপ্নেও যদি দেখতাম।’

‘আমি দুইবার দেখছি নৌকা বাইচ। গোপালগঞ্জের কোটালী পাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নে বাখিরার নৌকা বাইচ দেখছি। ভাইয়ারে ভাইয়া কি যে মজার বাইচ। শত শত হাজার হাজার মানুষ আসে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল জেলার। কালিগঞ্জ বাজারের সাথে লাগোয়া ঘাগর নদীর দুই পাড় জুইড়া নৌকা বাইচের মেলা। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের দোলায় বাহারি উৎসব। যে নৌকা জেতে প্রথম হয়, তারে মেডেল দেওয়া হয়। এ এলাকার মানুষজন বছরের এই দিনের অপেক্ষায় থাকে। জামাই আসে, মেয়ে আসে নাইয়রে। স্বজন কুটুম আসে। শত শত ছান্দি আর ‘বাচারি’ নৌকা আসে বাইচ দিতে। রঙিন কাগজের ঝালরে নকশি কাপড়ের নিশান ওড়ে। হেই-ও-হেই শোর ওঠে। গানে বাদ্যে আকাশ-বাতাস মাতোয়ারা হইয়্যা যায়। আনন্দে গাছ-গাছালি পাখ-পাখালি, আকাশ বাতাসও কাঁপে থরথর করে। হাততালি এমুন কষায়া মারে মানুষজন যে, রক্ত ফাইট্যা বাড়াইতে চায়। ঠিকারি বাজে কাশি বাজে। জারি-সারি গান হয়। কী আনন্দ! কী আনন্দ বলক দিয়া দিয়া ওঠে, তোমারে বুঝাইতে পারব না কুট্টি ভাইয়া।’
মরিয়া ভঙ্গিতে অমিয় বলে ওঠে, ‘আমাকে যদি নৌকা বাইচটা দেখাতে পারো আমি তোমাকে একটা মজার গিফট দেব। মা বাবাকে রাজি করার দায় আমার।’
বুঝদারের মতো কথা বলে অমিয়। বিজ্ঞ মানুষ একজন আর কি!
‘নারে কুট্টি ভাইয়া সাহেব। গিফট গুফট লাগবে নানে। তুমি যে আমার মতো ছন্নছাড়া মানুষকে এমন ভালোবাসো সেটাই আমার সাত জন্মের ভাগ্যি মানি। এর চাইতে বড় পুরস্কার দুনিয়ায় আর কিছু আছে নাকি!’
আলী মিয়ার গলা বুজে আসে এক অবুঝ বেদনার আনন্দে।
‘আলীচা তুমি দরবেশ ধরনের মানুষ। একদম অন্যরকম, তাই কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। উপহার পেলে আনন্দ হয় বৈকি। আমার হয়। তবে হ্যাঁ, খুব দামি কিছুর জন্য মোটেই আহাজারি করি না। তোমাকে একটা ছোট গিফট দেব, আর অনেক বেশি করে ভালবাসব, কেমন?
‘ওকে ভাইয়া, ওকে।’

ওরা দুই অসম বয়সী বন্ধু। হা-হা-হা করে হাসে অনেকক্ষণ ধরে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে মোচ পাকাতে পাকাতে দারোয়ান বাবু ঝিমুনি ঝেড়ে গলা ঝাড়ে, ‘দিন ভর কী যে সব আবোল-তাবোল গপ করো আলী ভাই। ছোট সাহেবের লেখাপড়া মাটি কইরা দিবা। তোমার ঐসব ছিস্টি ছাড়া পোকাগুলা কচি মাথাটায় ডিম পারবো।’
ওরা মহা আলসে কলিম সর্দারের নসিহতনামা কানে তোলে না। অমিয় এখনই বুঝে ফেলতে চেষ্টা করছে, শুধু বই পড়ে আর হোমওয়ার্ক করে জীবনের অনেক আনন্দ, অনেক জানার বিষয় অন্ধকারে থেকে যায়। হ্যাঁ, পড়াশোনায় কখনও খুব একটা ফাঁকি দেয় না অমিয়। নানাভাই এদেশের প-িত মানুষ ছিলেন। খুব ছোটবেলায় যখন অমিয় মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে তখন প্রায়ই বলতেন, ‘নানুভাই জীবনে একচোখা দৈত্যের মতো বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে রেখ না। আল্লাহর দুনিয়াটাকে দেখ। মানুষকে ভালোবাস। বিদ্যা যা অর্জন করছ তার সঙ্গে মিলিয়ে নেবে চারপাশের জীবন। তবেই হবে পারফেক্ট জেন্টলম্যান। পরিপূর্ণ মানুষ। পুঁথিগত বিদ্যাধররা অনেক সময় শুধুই একটা অচল অস্তিত্ব। অবশ্য এসব কথা এখন তোমাকে বলা ঠিক নয়, সেই বুদ্ধি বিবেচনা এখনও তোমার হয়নি। আমার পরমায়ুর পিদিম টিমটিম করছে। নানুভাই, তাই বলি আর কি। বড় হলে বুঝবে।’
সত্যি অমিয় নানা ভাইয়ের কথাগুলো এখন মাঝে মধ্যে বোঝার চেষ্টা করে। বুঝতে পারেও অনেকটা। অমূল্যবাণী।

মায়ের কৈশোর কথা
রোজকার মতো অমিয়ের ডেইলি ডায়েরি উল্টাতে যেয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন শেফা খান।
‘এই যে ফাঁকিবাজ ছেলে, টিচার কি লিখেছে? আজকাল নাকি ক্লাসে তুমি অন্যমনস্ক হয়ে যাও।’ অমিয়ের গলা মুহূর্তে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। আজই শুধু ইংরেজি ম্যাডাম তানিয়া ওয়ার্নিং দিয়েছিলেন।
‘কী ভাবছ তানজিম? জানালার গ্রিলে কি লেখা আছে?’
আসলে কি করে বলবে অমিয় ‘জার্নি বাই বোট’ বিষয়ে ম্যাডাম এসে লিখতে দিয়েছিলেন। তানজিম জুবায়ের ওরফে অমিয় ভাবছিল, ম্যাডাম কী নৌকা বাইচের কথা লিখলে নাম্বার বেশি দেবেন, না ক্রস দিয়ে দেবেন। আর কত রকম নৌকার নাম, ধরণ-ধারণ সে সদ্য শিখেছে, সেগুলো লিখে দেবে! ভাবছিল তাই। মগজের পরতে পরতে যুদ্ধ চলছিল। ছলাৎ ছলাৎ পানির ঢেউ এসে যেন লাগছিল ওর নাকে-চোখে-মুখে। হাজার জোড়া হাতের জোর করতালি কতদূর পর্যন্ত যায়!
মাকে শান্ত করতে একান্ত মনোযোগী ছাত্র হয়ে ম্যাথ করল। জিওগ্রাফি পড়ল। বাংলাদেশের মানচিত্র প্র্যাকটিস করল বার ছয় কিছুতেই সুন্দর হয় না কেন! জেদ চেপে যায় অমিয়র। বাংলা পদ্য মুখস্থ করে না দেখে লিখলো পর্যন্ত। বোঝা যাচ্ছে শেফা খান মোলায়েম হয়েছেন।
‘অমিয় খেতে এসো।’
কিচেন থেকে ডাক পারছেন মা। হীরামন বুয়ার বাতের ব্যথা চাগিয়ে উঠেছে। অমাবস্যা পূর্ণিমায় বাড়ে। শেফা খান ওষুধপত্র এনে দিয়েছেন, কিন্তু হীরামন জাম্বু সাইজের ট্যাবলেট গিলতে মোটেই রাজি নয়। নিজে নিজে হরেক কিসিমের টোটকা বানিয়ে খায়। টেবিলে লুচি, ব্যাঙের মতো মস্ত পেট ফোলা। আলুর দম, গাজরের হালুয়া আর অপরিহার্য দুধের বাটি সাজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। গরম গরম লুচি দম অমির খুব প্রিয়।
খাবার শেষ করে অমি মায়ের বিছানায় গড়াতে লাগল।
‘মামনি আজ একটা গল্প বলো। তোমার ছোটবেলার গল্প। অনেকদিন তুমি আমাকে একটা গল্পও বলোনি।’
মায়ের গলায় সামান্য অনীহা।
‘ও এখন আবার বায়নাক্কা না?’
মুহুর্তে শেফা যেন বর্ণচোরার মতো রং বদলে ফেললেন। সুন্দর মুখটা আরো সুন্দর মোমের মতো মোলায়েম হয়ে উঠল। চশমার তলার গভীর চোখজোড়া সুদূর আর উদাস। আলতো আঙুল ছেলের চুলে বিলি কাটতে কাটতে মিষ্টি গলায় বলতে লাগলেন, ‘ছোটবেলায় একবার আমি খালাখালুর কোয়ার্টারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স এই তোর মতোই হবে হয়তো। চিটাগাংয়ের পটিয়া থেকে একটু দূরে হাটহাজারীতে। ঘন গাছ-গাছালিতে ছায়াছন্ন বাংলো বাড়ি খালার। খালু সাঙ্গু ভ্যালি টিম্বার ইন্ডাষ্ট্রির কর্মকর্তা ছিলেন। শঙ্খ নদীর নামে নাম। কী নির্জন কী উদাস খোলামেলা বাংলো বাড়িটা। ফায়ারপ্লেস, ইয়া বিশাল বাথটাব, গিজার-ফিজার সব মওজুদ। ব্রিটিশ কায়দায় তৈরি। মনে পড়ে ঐ বাথটাবে সাঁতার শেখার কসরত করেছি কত। আমি আর লাবণী। যে ঘরটায় ঘুমাতাম সেখানে কাচের বড় বড় দরজা জানালা। সাদা কাশফুলের মতো ফুরফুরে পর্দা। সারা দুপুরে ঘুম আসত না। কেন জানিস? পাখির মিষ্টি কড়া ঝগড়ায়। বলতে পারিস রোজ দুপুরে সকালে পাখিরা মাছের বাজার বসাত। ঘুঘু, কাকাতুয়া, কোকিল, লেজনাচুনে কুটুম পাখি, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, ফিঙে আরো কত কী। সবার নামও জানি না। সারা দুপুর ঘুঘু ডাকত, ঘুঘু-উ…। শুনলে মনটা কেমন করত যে। ভাল না মন্দ না অদ্ভুত! ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না। রাতে কত রকমের পাখি ডাকত। নিশিপক্ষী। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি আর প্যাঁচার ঝগড়া, পাঁচমিশেলি কাওয়ালি, রাতভর কাওয়ালি। সাত-সকালে আবার অন্যরকম বায়োস্কোপ। আমি আজও চোখ বুঝলে দেখতে পাই স্পষ্ট। সূর্যমুখী ফুলের বাগানে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি উড়ে উড়ে আসত। পাখায় পাখ ঠেকিয়ে কত গান, গাল-গল্প যে ওরা করতো। সূর্যমুখীর বাগান ছিলো বাংলোর একপাশের লনে। সারা সকাল ওরা মহানন্দে খুঁটে খুঁটে কত যে ঠুকরে খেত। এমন ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি আমি আর কষনও দেখিনি। কোনো কোনো দিন দোয়েল ডাকত। হাঁড়ি চাচা আসতো। অমিয় ভরা গলায় বলে, ‘মা-মনি তুমি তো অনেক মজার জিনিস দেখেছ।’
‘হ্যাঁ- ঐ বাংলোয় অনেক উঁচু উঁচু শাল সেগুন লিচু আম গাছ ছিল। রান্নাঘরের পাশেই একটা কাঠবাদামের গাছ ছিল। লিচু গাছে লিচু পাকলে। আর আমগাছে আম পাকলে বাদুড়দের বার্ষিক আনন্দোৎসব শুরু হয়ে যেত। সন্ধ্যা হলেই লিচু ও আম গাছে ওদের ওড়াউড়ি, পালাগান গাওয়া, পাকা ফল কামড়ে আধ-খাওয়া করাই ছিল কাজ। শেষে মালি ভাই ফজুমিয়া টিন পেটানোর প্রকল্প হাতে নিল। কিছুটা সাকসেসফুল হয়েছিল অবশ্য। তবু রোজ মংলু ঝাড়–দার টুকরি বোঝাই করে আধ-খাওয়া আম লিচু ঘরে নিয়ে যেত। আমি লাবণী আর তমাল টর্চ মেরে মেরে বাদুড় দেখতাম। বাটি চামচ, পেটালে ওরা পাগলা নৃত্য শুরু করে দিত। নিঝুম দুপুরে কী হত জানিস? কাঠবিড়ালীগুলো লেজ উঁচিয়ে ইতিউতি চাইতে চাইতে নেমে আসত। ওরা খুব ভীতু কিন্তু। দু’একটা একটু সাহসী। ওরা বেশ লন জুড়ে ছোটাছুটি করতো। আমরা যে মোড়ায় বসে বাদাম চানাচুর খাচ্ছি তার তোয়াক্কাই করতো না। চোখের সামনে ওরা হুটোপুটি করুক এটা আমরা খুব চাইতাম। আচ্ছা আর একটা ছোট গল্প বলব। তারপর শেষ। একদিন কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে একটা শঙ্খচূড় সাপ বেরুল আঙিনায়। সাপটা বেশ আরামে গা মোচড়াতে লাগল। মংলু দেখেই বিশ্বজয়ের বার্তা বাংলোময় রাষ্ট্র করে দিল। কী না সাহেবের বাংলোয় শঙ্খচড়! হৈ হল্লা, চারপাশ থেকে কর্মচারী লোকজন বেরিয়ে এল ধাই ধাই করে। কিন্তু সবার মুখে এক কথা, এ সাপ মারা যাবে না। মনসাদেবী গোস্বা হবে- মংলুর একই আহাজারি। জোড়ার শঙ্খচূড়া এসে গেরস্থের অকল্যাণ করবে। শেষে শিরাজী সাহেব তার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে সাপটার ইহলীলা সাঙ্গ করে দেয়।
এইবার আমার কথাটি ফুরাল,
নটে গাছটি মুড়াল।
‘কেন রে নটে মুড়ালি?’ / ‘গরুতে কেন খায়?’
‘কেন রে গরু খাস?’ / ‘কেন রে কলাগাছ পাতা ফেলিস না?’
‘জল কেন হয় না?’ / ‘কেন রে জল হস না?’
‘ব্যাঙ কেন ডাকে না?’ / ‘কেন রে ব্যাঙ ডাকিস না?’
‘সাপে কেন খায়?’ / ‘কেন রে সাপ খাস?’
‘খাবার ধন খাব নি?’ / ‘গুড় গুড়তে যাব নি?’
… ব্যস, দি এন্ড।
‘মামনি তোমার ছোটবেলার ছড়া-এখনও ঠোঁটস্থ? কিন্তু আর একটা গল্প মা প্লিজ। আধঘন্টা পরই আমি ঘুমুতে যাব।’ ‘নটে গাছ মুড়ালে কোনো গল্প আর হয়!’
অমিয়ের নেশা পেয়েছে। তাছাড়া মায়ের মুড আজ যারপরনাই ভাল। সাহস বেড়ে গেছে সেইহেতু।
‘নাছোড়বান্দা হচ্ছিস খুব? তা শোন একটা ইতিহাসের কেচ্ছা ঠিক। বানানো গল্প নয়। গোপীবাগে আমাদের বাড়ির সামনে ছিল খোলা হাওয়ার ঢেউ খেলানো অপূর্ব সবুজ। এখন অনেক ঘিঞ্জি হয়ে গেছে, চেনাই যায় না। উনিশ শতকের শেষদিকে ঢাকার জমিদার হৃষিকেষ দাস তৈরি করেছিলেন। বিশাল অট্টালিকা, অসাধারণ গোলাপ বাগান। বাইশ বিঘা জমি জুড়ে গড়ে উঠেছিল ইতিহাসখ্যাত রোজ গার্ডেন। বাগানে মর্মর মূর্তিগুলো এখনও কিছু আছে। শেষ প্রান্তে টলটলে ঘাট বাঁধানো পুকুর। ইতিহাস বলে, সেই সময়ের বলধার জমিদারের উয়ারীর বিখ্যাত বাগানবাড়িতে বিত্তবান ও অভিজাত সংস্কৃতি প্রিয় মানুষের আসর বসতো। গান-নাটকের জমজমাট। আসর নিম্ন বর্ণের হওয়ায় হৃষিকেশ বাবুকে অপমান করা হয়েছিল। সেদিন তিনি পণ করেছিলেন বলধার মতো একটি বাগান-বাড়ি তৈরি করবেন। অপমানের শোধ তুলবেন। পরে অবশ্য বেশি বিলাসিতার দিকে মন যাওয়ায় ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং রোজগার্ডেন বিক্রি করেছেন। ওখানে বেঙ্গল স্টুডিও হয়েছে। সেই বাগান আর নেই। পূর্ণিমা রাতে ধবধবে রোজ গার্ডেনের প্রাসাদটাকে দেখে ভাবতাম, এইরকমই বুঝি আগ্রার তাজমহল!
এইবার নটে গাছটি এক্কেবারেই মুড়িয়ে গেছে। যাও ঘুমিয়ে পড়। সকালে সায়েন্সটা এক নজর দেখে দেব, মনে রেখ।’
‘শুভ শুভ শুভরাত্রি মামনি। আল্লাহ হাফেজ।’ (চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন