ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বাসায় ফিরে তোরাব আলী স্ত্রীকে বললেন, শোভনের মা, বেশ ক’দিন ধরে লক্ষ করছি শোভন মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে ঠিক সময়ে বাসায় ফেরে না। ও কোথায় যায় বলতে পারো?
শোভনের মা মিনু বেগম বলল, ‘কোথায় আর যাবে, হয়তো সকালে একটু হাঁটতে বের হয়।’
মিনু বেগমের কথায় তোরাব আলী সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শুধু বিড় বিড় করে একবার বললেন, বিষয়টা একবার খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার। শোভন রোজ সকালে যায় কোথায়?
মিনু বেগম তোরাব আলীর জন্য চা নাস্তা খাওয়ার টেবিলে রাখলেন। তোরাব আলী নাস্তা সেরে অফিসে বের হবেন। শোভনকে এখনো বাসায় আসতে না দেখে তিনি রীতিমতো বিচলিত হয়ে উঠলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে শোভন বাসায় ফিরলো মুখে তার ক্লান্তির ছাপ। তড়িঘড়ি করে জামা-প্যান্ট পরে শোভন মাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি খেতে দাও আম্মু, আমার কোচিং এর সময় হয়ে যাচ্ছে।’

এক রকম রাগ করেই তোরাব আলী বললেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, আরো সকাল করেই বাসায় ফিরতে পারতে। রোজ রোজ ফজরের নামাজ পড়ে কোথায় যাও তুমি?
শোভনের বুঝতে বাকি থাকলো না যে, আব্বা রেগে আছেন, তাই এক প্রকার কোমল কণ্ঠেই শোভন বলল, ‘আব্বা আমার কোচিং এর সময় হয়ে যাচ্ছে’ এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো’। শোভন কোন রকমে নাস্তা সেরে কোচিং এর দিকে পা বাড়ালো। তোরাব আলী আর কথা না বাড়িয়ে অফিসের পথ ধরলেন।
কোচিং শেষ করে শোভনের সহপাঠীরা মিলে স্কুলের একটি রুমে আবুলের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বৈঠকে মিলিত হলো আবুল শোভনদের বন্ধু। ওরা একই ক্লাসে পড়ে, আবুলের হঠাৎ কিডনিতে পাথর ধরা পড়েছে। যন্ত্রণায় আবুল ছটফট করে। টাকার অভাবে আবুলের যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না। আবুলের আব্বা ভ্যান চালায়, সাতজনের সংসার সেই অর্থে তাদের সংসার ঠিক মত চলে না তার উপর একটি বোন বিবাহযোগ্যা হয়েছে। মাঝে মাঝে সংসারের হাল ধরতে ইচ্ছে করে আবুলের। কিন্তু পারে না সে। লেখাপড়ার ফাঁকে যতটুকু পারে তার আব্বাকে সহযোগিতা করে আবুল।

শোভন বলল, আবুলকে আমি প্রত্যেক দিন সকালে দেখতে যাই, সে সারাক্ষণ যন্ত্রণায় ছটফট করে। এক্ষুনি তার অপারেশনের ব্যবস্থা না হলে আবুল বাঁচবে কি না সন্দেহ। রোকন শোভনের কথা কেড়ে নিয়ে আবেগভরা কণ্ঠে বলল, আবুলের বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু হবে এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যাবে না।
আরিফ বলল, তাহলে কী করবি? সমস্বরে সবাই বলল, আমরা সবাই মিলে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো।
জিসান বলল, আমাদের কাছে তো তেমন টাকা পয়সা থাকে না, তাহলে আমরা ওকে সাহায্য করবো কী করে? শোভন সবাইকে আশ্বস্ত করে বলল, তোমরা দুশ্চিন্তা করো না, তোমরা তোমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলো তারা নিশ্চয়ই আবুলের চিকিৎসার ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন। ইমিডিয়েটলি তার অপারেশন দরকার। আমি তোমাদের আশ্বস্ত করে একটা গুড নিউজ দিতে পারি। আর সেটা হচ্ছে আমার এক বছরের পুরো স্টাইপেন্ডের টাকাটা আমি আবুলের চিকিৎসার জন্য দিয়ে দেবো।

শোভনের কথা শুনে সবাই থ বনে গেল, সভা শেষ করার আগে শোভন সকলকে অনুরোধ করে বলল, বন্ধুরা আমরা সবাই মিলে পরম করুণাময় মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করবো। তিনি যেন আবুলের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দ্রুত সুস্থ করে দেন। সবাই বলল আমিন।
সন্ধ্যার দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তোরাব আলী আজ অফিস থেকে আগেই ফিরে এসেছেন। তিনি জামা কাপড় ছেড়ে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেছেন। মিনু বেগম চা-বিস্কুট নিয়ে হাজির হলো তোরাব আলীর সামনে।
মিনু বেগম বললো- আগে চা-নাস্তা করে ফ্রেশ হয়ে নাও, তারপর কথা হবে।

তোরাব আলী চায়ে মুখ দিয়ে বললেন, শোভন কোথায়? আগে ওকে ডাকো, তারপর অন্য কথা।
শোভন অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে আব্বার ঘরে ঢুকে বলল, তার প্রয়োজন নেই আব্বা, আমি এসে গেছি। তোরাব আলী বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আজ আমার অনেক জরুরি কথা আছে।’
শোভনও নির্দ্ধিধায় বলল, আমারও তোমার সঙ্গে অনেক জরুরি কথা আছে আব্বা। তোরাব আলী দ্রুত চা শেষ করে বললেন, হ্যাঁ এবার বলো, রোজ সকালে তুমি কোথায় যাও?
শোভন বলল, হ্যাঁ বলছি, আম্মু তুমিও শুনে রাখো, আমি ফজরের নামাজ মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করে আমার বন্ধু আবুলদের বাসায় যাই। আবুল আমার সহপাঠী, সে অসুস্থ। তার কিডনিতে পাথর হয়েছে। আবুল যন্ত্রণায় ছটফট করে। তার চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। ইমিডিয়েটলি তার অপারেশন দরকার। টাকার অভাবে সেটিও করা যাচ্ছে না।

তোরাব আলী ঝাঁজালো কণ্ঠে বললেন, তা তোমরা কী করবে ভেবেছো?
শোভন বলল, আমরা সহপাঠীরা মিলে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো।
তোরাব আলী বললেন, তোমরা টাকা পাবে কোথায়?
শোভন বলল, আমরা সবাই মিলে দেবো। সবাই তাদের গার্জিয়ানদের জানাবে। এই সুযোগে আমিও তোমায় বলে রাখি আব্বা, তোমার কাছে রাখা, আমার স্টাইপেন্ডের টাকাগুলি দেবে।
তোরাব আলী বললেন, স্টাইপেন্ডের টাকা নিয়ে তুমি কী করবে? শোভন দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘আমার স্টাইপেন্ডের টাকা আমি আবুলের চিকিৎসার জন্য দান করবো।’
তোরাব আলী বললেন, শোভন তোমার কি মাথা ঠিক আছে? তুমি যা করতে যাচ্ছ তা কি ভেবে চিন্তে করতে যাচ্ছ?
শোভন বলল, হ্যাঁ আব্বা, আমি ভেবে চিন্তেই করছি। আর শুধু আমি না আমার বন্ধুরাও আবুলের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসছে। তুমি অন্তত ওর জন্য দোয়া করো আব্বা। তোরাব আলী রেগে গেলেন, নিজেকে সামলিয়ে তিনি মিনু বেগমকে বললেন, শোভনের মা, ব্যাপারটা কিন্তু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি ছেলেকে বোঝাও, নইলে কিন্তু….।

মিনু বেগম বলল, তোমরা সবাই ঠা-া হও, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাদের জন্য বুয়া গরম লুচি ভেজেছে খাবে এসো।
সে রাতে তোরাব আলীর ঘুম হলো না। তিনি ভাবতে লাগলেন, শোভন যেটা করছে, সেটাতো মহত্ত্বেরই লক্ষণ। এই বয়সে এত বড় মহৎ কাজের চিন্তা ওর মাথায় এলো কী করে?
রাত ভোর হলো, আবারও পূর্বের মতো ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে রওয়ানা হলো ওরা। নামাজ শেষ করে শোভন যথারীতি আবুলের বাসার দিকে পা বাড়ালো। আবুল তখনো যন্ত্রণায় ছটফট করছে। শোভন আবুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আবুল, তোর চিকিৎসার টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে তোর চিকিৎসা হবে ইমিডিয়েটলি তোর অপারেশন হবে। তুই কোন চিন্তা করিসনে বন্ধু। আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে। তিনি সব ফয়সালা করে দেবেন।
আবুল কান্নাজড়িতকণ্ঠে বলল, এ তুই কি বলছিস শোভন, সত্যি আমার চিকিৎসা হবে?

শোভন বলল, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ, আবুল ভেঙে পড়িসনে। দেখিস একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে।
তোরাব আলী কখন শোভনের পিছু নিয়েছেন, তা শোভন জানতে পারেনি। পেছন থেকে তোরাব আলীর কণ্ঠ শোনা গেল। না আবুল টাকার জন্য তোমার ভাবতে হবে না। সত্যি তোমার চিকিৎসা হবে। তোমার অপারেশন হবে। আবুল তোমার চিকিৎসার জন্য শোভন ওর স্টাইপেন্ডের টাকা চেয়েছিল। এই নিয়ে আমি ওকে অনেক ভর্ৎসনা করেছি, কিন্তু আজ দেখলাম, ও যেটা করছে, ও যেটা বলছে, সেটাই ঠিক। তাই ওর স্টাইপেন্ডের তিন হাজার টাকার সাথে আমি আরও দুই হাজার টাকা মিলিয়ে মোট পাঁচ হাজার টাকা তোমার চিকিৎসা খরচের জন্য দিলাম। টাকাটা তুমি রাখো আবুল।
শোভন হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলল, আব্বা তোমার ভেতরটা এক রকম আর বাইরের রূপটা আর এক রকম। এ আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। তুমি যে এত বড় মহৎ তা আমরা কেউ আগে জানতে পারিনি আব্বা।
তোরাব আলী শোভনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মহৎ আমি না, ‘মহৎ তো তুমি’। তোমার মহত্ত্বের কাছে আমি তো কিছুই না। সবার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, মনে হলো, এক্ষুনি শ্রাবণের ধারা নামবে।

Share.

মন্তব্য করুন