বিখ্যাত ক্রীড়াবিদদের সন্তানদের অনেকে বাবার পথ অনুসরণ করেই নাম লিখিয়েছেন খেলাধূলায়। কেউ বাবার ‘নাম রেখেছেন’, আর কেউ হয়েছেন ব্যর্থ। আবার কারো মাঝে দেখা যাচ্ছে আগামী দিনে বড় খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা। এবারের লেখায় তেমন কয়েকজন বিখ্যাত ক্রীড়া তারকার সন্তানদের কথা জানাবো।
মোহাম্মাদ আলীর মেয়ে লায়লা
বিখ্যাত মার্কিন বক্সার ও গত শতাব্দীর বিশ্বসেরা ক্রীড়াবিদ মোহাম্মাদ আলীর নয় সন্তানের মাঝে লায়লা আলী সপ্তম। বাবার মতো তিনিও নাম লিখিয়েছেন পেশাদার বক্সিংয়ে এবং একই রকম দাপট দেখিয়েছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। আলীর তৃতীয় স্ত্রীর ভেরোনিকা আলীর ঘরে ১৯৭৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর জন্ম লায়লার।
মাহিলাদের বক্সিংয়ে লায়লা একজন কিংবদন্তী। পেশাদার ক্যারিয়ারে যিনি কখনোই কোন ম্যাচে হারেননি। জিতেছেন বক্সিংয়ের সব শিরোপা। অথচ মেয়ে বক্সিংয়ের মতো বিপজ্জনক খেলায় আসতে চায় শুনে কষ্ট পেয়েছিলেন আলী, তবে বাধা দেননি।

১৯৯৯ সালে পেশাদার বক্সিংয়ে লায়লার অভিষেক। প্রথম ম্যাচেই প্রথম রাউন্ডে নকআউট করে দেন আইরিশ বক্সার গোগার্টিকে। আর নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে স্বদেশী শাডিনা পেনিবাকেরকে হারান মাত্র ৩ সেকেন্ডে। ২০০৭ সালে অবসরে যাওয়ার আগে পেশাদার ক্যারিয়ারে ২৪টি লড়াইয়ের সবকটিতে জিতেছেন। এর মধ্যে ২১ ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে নকআউট করেছেন লড়াই করার সুযোগ না দিয়েই। মাত্র তিন ম্যাচে রেফারিকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছে জয় পরাজয়ের। কোন ম্যাাচের সবগুলো রাউন্ড শেষ হওয়ার আগেই কোন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের ঘুষি খেয়ে লড়াই করার শক্তি হারিয়ে ফেললে বক্সিংয়ে তাকে নকআউট বলা হয়। তাইতো মহিলা বক্সিং জগতের অলিখিত রীতিই হয়ে গিয়েছিল যে, লায়লা রিংয়ে নামবেন আর জিতে ফিরবেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা মনিকা কলেজ থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া লায়লা অবসরের পর কাজ করছেন টিভি উপস্থাপক হিসেবে।

পেলের দুই ছেলে
ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কিংবদন্তী এডসন এরান্তেস দো নাসিমেন্তো। পেলে নামেই যিনি পরিচিত বিশে^। ব্রাজিলের হয়ে তিনবার বিশ^কাপ শিরোপা জেতা (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) এই ফুটবলারের সাত সন্তানের মধ্যে দুই ছেলেই নাম লিখিয়েছিলেন ফুটবলে।
পেলের প্রথম স্ত্রী রোজমেরির ঘরে জন্ম নেয়া এডসন চোলবি নাসিমেন্তোর ডাক নাম এডিনহো। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো থেকে পেলের বিশ^কাপ জিতে দেশে ফেরার দুই মাস পর তার স্ত্রীর কোল জুড়ে আসে এই সন্তান। বাবার মতোই আসেন ফুটবলে। তবে বাবা ফরোয়ার্ড হলেও এডিনহো ছিলেন গোলরক্ষক। খেলা শুরু করেন পেলের দীর্ঘদিন খেলা ব্রাজিলের নামকড়া ক্লাব সান্তোসের যুব দলের হয়ে। ১৯৯০-৯১ মৌসুমে সিনিয়র দলে অভিষেকের পর কয়েক বছরে খেলেছেন ব্রাজিলের কয়েকটি ক্লাবে। জাতীয় দল কিংবা ইউরোপের নামি কোন ক্লাবে খেলা হয়নি তার। কয়েক বছর আগে মাদক পাচারের দায়ে জেলও খেটেছেন। এখন কাজ করছেন সান্তোস অনূর্ধ-২৩ দলের কোচ হিসেবে।
ফুটবলে নাম লিখিয়েছেন পেলের আরেক সন্তান জশুয়া নাসিমেন্তো। সান্তোস অনুর্ধ-২০ দলে খেলেছেনও। তবে ফুটবলে নজরকাড়ার মতো কিছু করতে পারেনি বলেই হয়তো তার সম্পর্কে ইন্টারনেটে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।

ম্যারাডোনার ছেলে ইতালি দলে
আর্জেন্টাইন ফুটবল কিংবদন্তী ডিয়েগো ম্যারাডোনার ছেলের নাম ডিয়েগো সিনাগ্রা। ইতালির নেপলস শহরের নাপোলি ক্লাবে খেলতে গিয়ে স্থানীয় এক নারীর সাথে সম্পর্কে জড়ান ম্যারাডোনা। সেই নারীর কোলে জন্ম ডিয়েগো সিনাগ্রার। যদিও শুরুতে ম্যারাডোনা ডিয়েগোকে সন্তান হিসেবে মানতে চাননি। শেষ পর্যন্ত আদালতের সিদ্ধান্তের পর সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করেন।
এই ছেলে জীবনে প্রথমবার বাবার সাথে সাক্ষাৎ করে ২০০৩ সালে, যখন তার বয়স ১৭ বছর। তাতে কি! রক্তে তো আছে ঠিকই ফুটবল। ততদিনে তারও অভিষেক হয়েছে ফুটবলে। ১৯৯৭ সালে ম্যারাডোনার ক্লাব নাপোলির যুবদলে খেলা শুরু ডিয়েগোর। ২০০১ সালে সুযোগ পান ইতালি অনূর্ধ-১৭ দলে। তখন সবাই তার মাঝেই দেখছিলো পিতার ছায়া; কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেননি। অনূর্ধ-১৭ দলে একটির বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ঘুরে ফিরে কয়েকটি ক্লাবে খেলে যোগ দেন বিচ ফুটবলে। সমুদ্র সৈকতে বালুর ওপর খালি পায়ে খেলা হয় এই ফুটবল। ইতালি বিচ ফুটবল জাতীয় দলের হয়ে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছেন।

ভিভের ছেলে মালি রিচার্ডস
ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুইবার বিশ^কাপ জয়ের নায়ক কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের ছেলে মালি রিচার্ডসও এসেছিলেন ক্রিকেটে। সাড়াও ফেলেছিলেন বামহাতি ব্যাটসম্যান মালি। ডান হাতে মিডিয়াম পেস বোলিংও করতেন। অনূর্ধ-১৯ পর্যায়ের এক ম্যাচে এন্টিগার হয়ে ৩১৯ রানের একটি ইনিংসে খেলে জানান দিয়েছিলেন নিজের প্রতিভার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরোয়া ক্রিকেটের লিওয়ার্ড আইল্যান্ড দলের হয়ে। এরপর কাউন্টিতেও সুযোগ পেয়েছিলেন মিডলসেক্স ক্লাবে; কিন্তু ক্যারিয়ার থেমে গেছে মাত্র ১৫ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেই। জাতীয় দলে আর সুযোগ হয়নি মালি রিচার্ডসের।

শচীনের ছেলে পেসার
ভারতীয় ব্যাটিং জিনিয়াস শচীন টেন্ডুলকারের ছেলেও ক্রিকেটে এসেছেন। তবে বাবার মতো ব্যাট হাতে বোলারদের ওপর চড়াও হওয়ার চেয়ে বল হাতে ব্যাটসম্যানদের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলতেই পছন্দ করে সে। অর্জুন টেন্ডুলকারের বয়স এখন ২১ বছর। মুম্বাই অনূর্ধ-১৯ দলে খেলার সময় আলোচনায় আসে অর্জুন। ভারতীয় অনূর্ধ-১৯ দলে ডাক পেয়েছিলো, অবশ্য সেরা একাদশে জায়গা হয়নি। এরপর সুযোগ হয় ভারতীয় দলের নেট অনুশীলনে বোলিং করার। এছাড়া লর্ডসে তাকে সুযোগ দেয়া হয় ইংল্যান্ডের নেটে বোলিং করার। সেখানে নিখুত ইয়র্কারে বিপাকে ফেলেছিলেন জনি বেয়ারেস্টোকে। এমসিসি ক্লাবের যুব দলের হয়েও বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেছেন অর্জুন। তাকে এখন অনেকেই ভাবছেন ভারতীয় জাতীয় দলের আগামী দিনের বামহাতি পেসার হিসেবে। পাশাপাশি মিডল অর্ডারে দারুণ ব্যাটিংও করে অর্জুন।

আরো কিছু তথ্য
১। ক্রিকেট কিংবদন্তী স্যার ডন ব্রাডম্যানের ছেলে জন ব্রাডম্যান ক্রিকেটে আসেননি। শুধু তাই নয় ব্রাডম্যানের ছেলে বলে পরিচয় দিতে দিতে ‘বিরক্ত’ হয়ে তিনি এক পর্যায়ে নাম থেকে ব্রাডম্যান অংশটিই পাল্টে ফেলে করেন ব্রাডসেন(১৯৭২)। যেখানেই যেতেন সবাই বলতো ‘তুমি ডনের ছেলে’, কিন্তু স্বাধীনচেতা জন চাইতেন নিজের পরিচয়ে বড় হতে। সে কারণেই হয়তো ক্রিকেটেও আসেননি, পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে। কারণ ক্রিকেট খেললে আর পিতার পরিচয় গোপন রাখা যেত না। কর্মজীবনের শেষ দিকে এসে অবশ্য পিতার নামের অংশকে ফিরিয়ে এনেছিলেন নিজের নামের সাথে(২০০৮)।
২। পাকিস্তানের কিংবদন্তী ক্রিকেটার হানিফ মোহাম্মাদের ছেলে শোয়েব মোহাম্মাদও পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেছেন ৪৫ টেস্ট ও ৬৩ ওয়ানডে। শোয়েবের ছেলে শেহজার মোহাম্মাদ এখন খেলছেন পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে। ভালো করলে তাকেও দেখা যেতে পারে পাকিস্তান দলে।
৩। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০ হাজার রান করা সুনীল গাভাস্কারের ছেলে রোহান গাভাস্কার ভারতের হয়ে ১১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন।

৪। ফ্রান্সের ১৯৯৮ বিশ^কাপ জয়ের নায়ক জিনেদিনে জিদানের চার ছেলেই ফুটবল খেলে। এর মধ্যে একজনের অভিষেকও হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ সিনিয়র দলের হয়ে।
৫। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ^কাপ জয়ী অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের ছেলে জেসন ছিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলার। নিজ দেশ গায়ানার হয়ে খেলেছেন ১২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

Share.

মন্তব্য করুন