মনে পড়ে কৈশোরের কথা! বাঁধন হারা সময়ে কখনও পাখি হবার ইচ্ছে! কখনো রাঙা প্রজাপতি! কখনো আকাশে চাঁদ হবার তীব্র স্বপ্ন! আহা কত যে ইচ্ছে ছিলো বুকের ভেতর! কত শখ এবং সুখ ছিলো সে সময়! প্রকৃতির উদার আকাশ আর বৃক্ষরাজির সম্ভারে ভরা গ্রামের উৎসব! কী স্বাধীন! কী তুমুল ছুটে চলা! প্রায় উড়ে যাওয়ার মতো! ভাবি যদি আমার এ দেশ স্বাধীন না হতো! যদি বিজয় না আসতো! কী হতো!
কেমন করে পাখি হবার স্বপ্ন দেখতাম! কেমন করে নদী হবার ইচ্ছে জাগতো! কেমন করে প্রজাতির রঙ মাখা ডানা দেখে আমিও হতে চাইতাম আরেক প্রজাতি! একি সম্ভব ছিলো! এর একটিই জবাব- না!
যে মাটি স্বাধীন নয়! যে দেশ বিজয় পায়নি সে দেশের কোনো কিশোর কখনো পাখি হবার স্বপ্ন বুনতে পারে না!
আমরা বুনেছি, আমরা স্বাধীন বলে! বিজয় পেয়েছি বলে! স্বাধীনতা ও বিজয়ের আনন্দ আছে বলে!

তাই এ দেশটি নিয়ে যখনই ভাবি অন্যরকম মনে হয়। মনে হয় আমার হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসা সবুজ আগুন জড়ানো দেশের শরীরে! যেনো দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত স্বপ্নের জমিন জন্মেছে আমার বুক থেকেই। চারিদিকে ছড়ানো প্রাণ! চারিদিকে সুন্দর! চোখ জুড়ানো প্রকৃতির নিশান! মন ভরে ওঠে ভরপুর! ভরে ওঠে বুকের গহিন!
একটি স্বাধীন দেশ! একটি স্বাধীন পতাকা! একটি জাতির ভীষণ গৌরবের! আমরা এ গৌরবের অধিকারী জাতি! আমাদের আছে স্বাধীন দেশ! আছে স্বাধীন পতাকা! স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা সম্মানিত পৃথিবীর বুকে। আমাদের একটি স্বাধীন দেশ আছে এটি ভাবতেই গর্বে ভরে ওঠে বুক। আমরা ভালোবাসি আমাদের দেশ! ভালোবাসি আমাদের স্বাধীন পতাকা! এদেশ স্বাধীন করেছি আমরা। স্বাধীনতা এনেছি! এনেছি বিজয়! আমাদের কণ্ঠে কণ্ঠে বিজয়ের গান! বুকে বুকে বিজয়ের ধ্বনি। আমরা গাই বিজয়েরই গান! গাই স্বাধীনতার গান!
আমাদের কণ্ঠে যেমন গান আছে। আমাদের পাখিদের কণ্ঠেও আছে। আমরা নিজেদের পাখির মতো ভাবি। ভাবি পাখিদের স্বাধীনতার মতো আমাদের স্বাধীনতার কথা! না আমরা পরাধীন থাকিনি কখনো। থাকবো না কোনোদিন। আমাদের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস। আমাদের ইতিহাস বিজয়ের ইতিহাস!
আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের ইতিহাস!

আমরা স্বপ্ন দেখি স্বাধীন ভাবে। স্বাধীন ভাবে চিন্তা করি। কল্পনাও স্বাধীন আমাদের। আমাদের সম্ভাবনাও স্বাধীনতার আনন্দে আন্দোলিত! যারা ভাবে পরাধীন করবে আমাদের তারা বড় ভুল ভাবে। যারা আমাদের পরাস্ত করার ইচ্ছে করে, বড় ভুল তাদের ইচ্ছে। তাদের জানা উচিত আমরা বীরের জাতি। আমাদের পথ রাজপথ! রাজপথ মানে রাজার পথ! আমাদের অভিযান রাজকীয় অভিযান! আমরা তো শেকড়হীন নই! বরং আমাদের শেকড় অনেক গভীরে! এ মাটি আমাদের! এ মানুষও আমাদের! এ মাটি ও মানুষের বুকের কাছে রাখি আমাদের স্বপ্ন! আমাদের আকাক্সক্ষা রাখি মানুষের আকাক্সক্ষার কাছে। আমাদের আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য! আছে ইতিহাস! আমাদের পরিচয় আমরা সংগ্রামী জাতি। আমরা লড়াকু বীর! জীবন দিয়ে রক্ষা করি আমাদের স্বাধীনতা! রক্ত দিয়ে ওড়াই বিজয় নিশান।

আমার বাংলাদেশ। আমাদের বাংলাদেশ। সকলের বাংলাদেশ চির সবুজ, চির আনন্দের বাংলাদেশ! একটি ফোটা গোলাপের দিকে যখন দেখি, ফুটে থাকে কী ডগমগ! কী রাঙা তার পাপড়ি! বাতাসে কেঁপে যায় তার শরীর! গন্ধ নিয়ে পালিয়ে যায় দূরের বাতাস! এমন মায়াবী ফুল ফোটে আমার বাংলাদেশে। আহা ফুল! কত শত জাত! কত শত রঙ! কত রূপের মাধুরী! যেদিকে চোখ ফেরাই কোথাওনা কোথাও ফুলের মুখ! কোননা কোনো দিকে পাপড়ির কম্পন! এসব রঙের ফুল ফোটে যে দেশে সে আমার বাংলাদেশ! একটি অখ- নীল আকাশ উপুড় হয়ে আছে বাংলাদেশের বুকে! এ আকাশ জুড়ে জেগে ওঠে নতুন ভোর! জেগে ওঠে নতুন দিনের সূর্যটি! যেমন করে সকাল হয় পাখির গানে। তেমনি পাখির গানেই নামে সন্ধ্যার অন্ধকার! রাতের আকাশ ছেয়ে থাকে রূপালি নক্ষত্রের মিছিলে! কোটি কোটি তারার রাজ্য উজ্জ্বল করে জ্বলে ওঠে পূর্ণিমা চাঁদ! আহা জোছনা! দুধের মতো সাদা তার রঙ! রাত জাগা পাখিদের ডানায় জড়িয়ে যায় চাঁদের মায়াবী আলো! তার ভেতর জ্যোতি জ্বলে জোনাকির! দূরে কোথাও ডাহুকির ডাক। ঝিঁঝিঁর একটানা সুর! জলপিপির স্বর! হঠাৎ উড়ে যাওয়া বাদুড়ের ডানার শব্দ! বাতাসে হাসনাহেনার সৌরভ! কোথাও ছাতিম ফুলের সুবাস! এই তো বাংলাদেশের রাত! এই তো আমার বাংলাদেশ!

রাত্রির শিশির অথবা কুয়াশার কথা কি আর বলি! শিশির যেনো রাতের চোখ থেকে নেমে আসা শীতল অশ্রু। যখন ঝরে শিউলি ফুলের বোঁটায় মনে হয় অশ্রু দিয়ে ধুয়ে রাখা ফুল! ঘাসের সারা শরীরে মাখা শিশির! জমে থাকে ডুমুর পাতার পিঠে। মেহেদী গাছের সবখানেই শিশিরের শীতল! কুয়াশা তো ঢেকে রাখে সব! একধরনের আলো আঁধারের খেলা যেনো! সাদা কুয়াশায় ভিজে থাকে বাংলাদেশের মেঠোপথ! বিশাল ধানের জগৎ! মাঠ মাঠ শস্যের সুন্দর! ফসলের বুক চিরে কোথাও বয়ে চলা নদী ছুটে যায় আপন বেগে! হাজার নদীর বাংলাদেশ! ঝাঁক ঝাঁক শালিকের বাংলাদেশ! আনন্দে নেচে ওঠা দোয়েলের বাংলাদেশ! পদ্ম ফুলের কথা না বলে পারা যায়! মাঠভরা শাপলার কথা কী করে না বলি! বেশুমার ঘাসফুলের কথা বলতেই হবে! বলতেই হবে গন্ধারাজের রাজকীয় ঘ্রাণের কথা! বাঁশঝাড়ে জেগে থাকা ছায়া মায়া আহা কী নিবিড়! নিমতলায় নীরব সময়! আম বাগানের বুকের ভেতর মৌমাছির ঝাঁক! এমনই তো আমার বাংলাদেশ! এমনই বাংলাদেশের বুক। এ দেশে জন্ম আমার। আমাদের। আমরা আনন্দিত! আপ্লুত! এমন মায়াময় দেশ আমাদের দিয়েছেন আমাদের মহান আল্লাহ! আমরা কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে!

এখন বিজয়ের মাস। বিজয় দিবসের মাস! আগুন ঝরা সেই ঊনিশ শ একাত্তর! সেই যুদ্ধের দিন! সেই রক্তের অক্ষরে লেখা একটি বিজয়! এ বিজয়ে পরিপূর্ণ হলো আমাদের স্বাধীনতা! শুধু মুখে মুখে বিজয়ের কথা নয়! শুধু স্লোগানে স্বাধীনতার কথা নয়! সত্যি সত্যি ভালোবাসতে হবে বিজয়কে। ভালোবাসতে হবে স্বাধীনতাকে। এবং ভালোবাসতে হবে দেশকে। হৃদয়ের গভীর থেকে হবে এ ভালোবাসা হবে হবে মনের গহন থেকে! গহিন থেকে। কথার চেয়ে কাজ বড়! কথার সাথে মিল চাই কাজের! কথা ও কাজ যদি এক হয়ে যায় তো সুন্দর হবে দেশ! দেশ সুন্দর হলে সুন্দর হবে মানুষ! আর মানুষ সুন্দর হলেই তো জীবন সুন্দর! আমরা তো সুন্দর জীবনের জন্যেই লড়ে যাই! সুন্দর জীবনের জন্য স্বপ্ন বুনি! সুন্দর জীবনের জন্য যাবতীয় আয়োজন করি !

যারা দেশকে ভালোবাসেন তারা দেশের সুনাগরিক। যারা দেশের জন্য কাজ করেন তারা সুনাগরিক। এবং যারা দেশের স্বাধীনতার পক্ষে তারা সুনাগরিক! যেকোনো ভাবেই দেশকে বুকে রাখার অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের। আমরা বিজয় পেয়েছি। স্বাধীনতা পেয়েছি লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে! কত রক্ত দিয়ে আমরা কিনেছি স্বাধীন একটি পতাকা! দেশের জন্য প্রাণ দিলো যারা, আমরা তাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি! নিজের জীবন দিয়ে আমাদের জন্য উপহার দিলেন এই দেশ! এখন আমাদের বড় দায়িত্ব আছে এ দেশের প্রতি। এ জাতির প্রতি। আমরা নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলবো। আদর্শ নাগরিক হবো আমরা। আমরা হবো আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ নাগরিক! আমরা হবো স্বাধীনতার প্রহরী! এ দেশ, এ দেশের মাটি ও মানুষের জন্য আমরা হবো অগ্রপথিক। সত্য ও সুন্দরের আমরাই হবো প্রতিনিধি। দেশকে ভালো না বাসলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। দেশের মানুষকেও ভালোবাসা যায় না। সুতরাং দেশ ও দেশের মানুষের এ ভালোবাসা থেকে আমরা খুঁজে পাবো আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য! আমাদের সংস্কৃতি। এবং আমাদের পূর্বপুরুষের স্বাধীনতার চেতনা।

Share.

মন্তব্য করুন