ফুলের বাগান দেখে কার না মন ভরে! কার না ভালো হয় মন। কার না আনন্দ জাগে হৃদয়ের গভীর দেশে! হৃদয় থেকে জেগে ওঠে এক গভীরতম উৎসবের ধারা। উৎসবই সব আনন্দের প্রতিধ্বনি। সব খুশির মিলিত রূপ। এই রূপই বুঝি ফুল হয়ে ফোটে বাগানের প্রাচুর্যময় শরীরে। বাগানই মানুষকে অন্যরবম আনন্দের জোগান দেয়। দেয় অন্যরকম জীবনের খবর। যে জীবন অনুভূতি প্রবণ। যে জীবন রহস্যময় সুন্দরের প্রতিনিধি। যে জীবন প্রকৃতির ঔদার্যের অনুষঙ্গ।
জীবনে যেমন আনন্দের সমাহার থাকে। তেমনি থাকে বেদনার ঘনঘটা। সুখ-দুঃখ মিলেই জীবন জেগে থাকে। জেগে থাকে আশা ও স্বপ্নের রশি ধরে। কারো কারো জীবনে সুখের সমৃদ্ধি ঘটে দারুণ উচ্ছ্বাসের সাথে। কারো কেবল দুঃখের রজনীই অশেষ হয়। দুঃখবাদী মানুষেরা জীবনকে দুর্বিষহ ভাবে। তারা ভাবে জীবনে যত কিছু রয়েছে তার সবকিছু দুঃখের সাথেই রয়েছে। দুঃখ বিনে বোধ হয় জীবনে আর কোনো দরোজা খোলা নেই। সুতরাং দুঃখ নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে পৃথিবীর বাতাসে- এমন একটি ধারণা নিয়েই চলে দুঃখীরা। আর সুখী মানুষেরা দুঃখকে আমলেই নিতে চায় না। চায় না দুঃখীদের সঙ্গী হতে। তবে সুখী দুঃখী সকলেই সঙ্গী হতে চায় বাগানের। দুঃখীরা মনে করে বাগানে ফুলের সাথে বৃক্ষের সাথে তাদের দুঃখ ভাগাভাগি করে নেবে। ফুলেরা দুঃখের যন্ত্রণা মুছে দেবে। বুলিয়ে দেবে খানিক সুখের পাপড়ি। এবং সৌরভে ঢেকে দেবে সমস্ত বেদনার গ্লানি। তবেই যদি সামান্য সুখের দেখা মেলে। মন যদি কিছুটা প্রশান্তির আনন্দে থিতু হয় তবেই সুখের শীতলতা নামবে হৃদয়জুড়ে। বৃক্ষের ছায়ায় দুঃখীরা নিজেদের ডুবিয়ে দেয়। জাগিয়ে রাখে প্রকৃতির স্পর্শের ঐশ্বর্যে। পৃথিবীর জঞ্জাল থেকে কিছুটা সরিয়ে রাখার প্রবণতা তাদের বাগানে হাজির করে। তারা হাজির হয়ে যায়। হয়ে যায় দুঃখ ভোলা মুহূর্তের অতিথি। সামান্য সময় জীবনের দিকে ফেরার একান্ত মুহূর্তকে উদযাপন করে।
সুখী মানুষেরাও বাগান খোঁজে। বেশি খোঁজে। খোঁজে কারণ তারা তাদের সুখ আরো বাড়াতে চায়। তারা দেখাতে চায় তাদের মন সুখে টইটই। তারা বাগানের ফুল ছিঁড়ে হাতে তোলে। দু’চারবার ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে নিষ্পাপ ফুলের শরীর। তারা ভাবে না ফুলেরও জীবন আছে। আছে ফুলের নিজস্ব পৃথিবী। তারা বাগান খোঁজে নিজের সুখ বিলাতে। বাগানের আনন্দ তাদের আনন্দকে চাগিয়ে দেয়। উদ্বুদ্ধ করে নতুন আনন্দের দিকে চালিত হতে। তারা চালিত হয়। ধাবিত হয়। গতিমান হয়। তারা বাগানের সঙ্গী হয়। কিন্তু বাগান তাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে না। অথবা বাগানকে তারা সঙ্গী করার সুযোগ পায় না। এই তো সুখী দুঃখী মানুষের বাগান। আরেক শ্রেণীর মানুষ যারা নিজেরা বাগানের সঙ্গী হয়। আবার বাগানও হয়ে যায় তাদের সঙ্গী। এ শ্রেণীর মানুষেরা পৃথিবীতে ভাবুকশ্রেণী হিসেবে পরিচিত। তারা সৃষ্টিশীল মানুষ। সৃষ্টির আনন্দই তাদের প্রকৃত আনন্দ। সৃষ্টির ঐশ্বর্যে ডুবে থাকে তারা। তাদের বেদনার অনুভূতি মুখের উৎসারণ সবই সৃষ্টিকে ঘিরে। সৃষ্টিশীলতাই তাদের শ্রেষ্ঠ সুখ। তারা বাগানকে সেই নিরিখেই দেখে। বাগানও তাদের কাছে সৃষ্টিশীলতারই অংশ। বাগানের ফুল পাখি বৃক্ষ এসবই তাদের সুখাক্রান্ত বোধের উৎসারণ। সে বাগানের এবং বাগান তার হয়ে ওঠে। সে যেমন বাণী ছন্দ নির্মাণ করে বাগানও তেমনি সুন্দরের ছবি হয়ে ধরা দেয়। হয়ে যায় সুন্দরের উৎস।
যা সুন্দর তাকে গ্রহণ করার আনন্দ সীমাহীন। এমন সীমাহীনতার ভেতর দিয়েই বয়ে যায় জীবনতরীর জল। সাধারণত বলা হয় জীবন মানেই একটি সীমাবদ্ধ কাহিনীর সমাপ্তি। আসলে কি তাই? না, এ কথা ঠিক নয় মোটেই। আক্ষরিক অর্থে জীবন খানিকটা সীমাবদ্ধ। কিন্তু গভীরার্থে জীবন কখনো সীমাবদ্ধ বিষয়ের অন্তর্গত নয়। জীবন এক ধরনের অসীমতার ভেতর দিয়ে সীমাকে বরণ করে। কিন্তু জীবন সীমাবদ্ধ নয়। হতে পারে না। সীমাবদ্ধ হতো যদি তবে তো যে যে ক’দিন খেয়ে পরে গেলো সে ক’দিনই তার ঠিকানা হয়ে যেতো। হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা-ই হয়। কিন্তু মৃত্যুর পর যারা বেঁচে যায়, তারা? তাদের জীবন! তাদের জীবন তো তারা কাল অতিক্রম করে মহাকালে জেগে থাকে। যদি তাই থাকে এবং তা-ই থাকে তাহলে জীবন কি করে ছোট হলো? কি করে হলো সীমাবদ্ধ? সুতরাং সীমাবদ্ধতার জালে জীবনকে জড়িয়ে বৃহৎ স্বপ্ন থেকে বিরত থাকার কোনো মানে নেই। বাগানের একটি ফুল যখন বাতাসের বুকে তার সৌরভ ঢেলে দেয় সেতো কখনো ভাবে না সীমাবদ্ধতার কথা। যতদূর বয়ে যাবে বাতাসের গান ততদূর সে তার গন্ধের সুরভি ছড়িয়ে দিতে চায়। ছড়িয়ে যায়। যারা বোঝে তারা খোঁজে। তারা জানে সীমাবদ্ধতার দোলাচলে কোনো জীবনকে বন্দি করা চলে না। তাই তারা বাগানের সান্নিধ্য কামনা করে। জীবনের অন্য রকম মানে নির্মাণ করে। জীবনকে খুঁজে বেড়ায় অন্য জীবনের ভেতর। জীবন হয়ে ওঠে পাহাড়ের সমুদ্রের। কিংবা পাহাড় সমুদ্র হয়ে ওঠে জীবনের। জীবন সমস্ত জগতের কিংবা মহাজগতের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি হয়ে জেগে থাকে।
সৃষ্টিশীল মানুষের সবচেয়ে গভীর দিক হলো তারা মনের ভেতর রচনা করে আশ্চর্য বাগান। মনের বাগানে তারা ফোটায় বারমাসী ফুল। যেসব বৃক্ষ থাকে মনের বাগানে তার ছায়া অতি প্রশান্তিময়। স্নিগ্ধতায় কোমল। বনের বাগান থেকে মনের বাগান অতি ঘনিষ্ঠ। অতি নিকটতর। পৃথিবীর সব ফুল পাখি বৃক্ষ নিঃশেষ হয়ে গেলেও মনের বাগানের ফুল পাখি বৃক্ষ জেগে থাকে। থাকবে। পৃথিবীর কোনো ঝড় ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি কিছুই ছুঁতে পারে না মনের বাগান। চুরিও যাবে না এ বাগান। মন তো দৃশ্যমানতার আড়ালের। কেবলই অদৃশ্যের। যারা মনের বাগানের অধিকারী তারা বনের বাগান নিয়ে কখনো হতাশায় বিমর্ষ নয়। তারা পারে না স্বপ্নহীন হতে। স্বপ্নের তরীতে তোলে সম্ভাবনার নতুন পৃথিবী। কোনো সম্ভাবনাই দূরের নয়। সবই কাছের। অসম্ভবের কথা তিনি ভাবেন না। পৃথিবীর শীত নিয়ে থাকে না তার কোন অভিচিন্তন। তার বাগানে যখন তখন কোকিল ডাকে। ডাকবে। যখন তখন নামবে শ্রাবণ দিনের বর্ষণ। অথবা উড়ে আসবে শরৎ পাখির নিমগ্ন নীল। মন যার বাগান হয় তার পৃথিবীটাই বাগানময়। তার বৃক্ষের পাতার সবুজ হবে চির যৌবনা। চির আনন্দের সাথে ডালে বসে গাইবে পাখিরা। আর ফুল? সে তো ফুটবেই। কুয়াশাসিক্ত প্রান্তরের ধূসরতায় জেগে উঠবে তার ফুলের সমাহার। নিশিনীর বুক জুড়ে জোছনার আশ্চর্য ভুবন ফুটবে। অবাক আলোয় ভরে থাকবে অমাবস্যার অন্ধকার। মনের বাগানের অন্ধকার অন্ধকার নয়। আলোও থাকে না আলোর শরীরে। আলো আঁধারির এক অদ্ভুত খেলার ভেতর জেগে থাকে সে বাগান। জীবন সেখানে এক রহস্যের নাম। এক বিস্ময়কর খেলার অভিধা। এক অবিস্মরণীয় উৎসবের উপত্যকা।
মনের বাগানের অধিকারী মানুষেরা কারো পক্ষ বিপক্ষের তোয়াক্কা করে না। জয়-পরাজয় নিয়ে ভাববার সময় তাদের নেই। ভাবেও না তারা। তারা জানেন জীবন মানেই নতুন খেয়ার তরণী। জীবন মানেই প্রতিটি মুহূর্তে নতুনের মুখোমুখি। কে বলে ভালো কে বলে মন্দ এর কোনটিই তাদের বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। তারা কেবল জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার পক্ষে জেগে থাকে। জেগে থাকে অহরাত্রি নতুনের অন্বেষায়। জেগে থাকে জীবনকে জীবনের সাথে মিলিয়ে দিতে। স্বপ্নকে জোড়া দেবে স্বপ্নের সাথে। কোনো সমালোচনার দুর্গন্ধ তাকে কাতর করে না। প্রশংসার পাহাড়ও তার কাছে আহামরি সম্পদ নয়। নিজেকে নিজের আনন্দে আবিষ্কার করার ক্ষমতায় সে শক্তিমান। এটি তখনই সম্ভব যখন তার মনের বাগান বনের বাগানের চেয়ে হবে প্রাচুর্যময়। মনের বাগান যার ঐশ্বর্যময়, বনের বাগান তাকে ডাকে নিশিদিন।

Share.

মন্তব্য করুন