নাসিরকে দেখে সাইকেলের ব্রেক কষলো অনিক। তার সাইকেলের হ্যান্ডেলের সাথে একটি কাপড়ের ব্যাগ ঝোলানো। মোবাইল শো-রুমের ব্যাগ। অনিক নিশ্চয় আবারও নতুন মোবাইল কিনেছে। সে এ রকমই। নতুন মডেলের মোবাইল বাজারে এলেই সে যেন পাগল হয়ে যায়। মরিয়া হয়ে ওঠে ঐ মোবাইলটি কেনার জন্য। কিছুদিন আগে সে সরু চাকাওয়ালা একটি সাইকেল কিনেছিল। ওটা অচল হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। আশপাশে ওটার টায়ার পাওয়া যায়নি। যেখান থেকে ঐ সাইকেলটা কেনা হয়েছিল, তারা টায়ার এনে দেয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্তু তারা আর ঐ টায়ার এনেছিল কি না তা জানা যায়নি। মূলত ঐ অজুহাতেই ওটা অচল হয়ে পড়ে আছে। এখন আবার কিনেছে মোটা চাকাওয়ালা একটি সাইকেল। আশপাশে এই সাইকেলটার পার্টস পাওয়া যায়। তার চাকাওয়ালা জুতাও আছে। প্রথমে কেনা জুতা জোড়ার চাকা ভেঙে গেছে। তাই সে আবার এগুলো কিনেছে। তাদের গ্রামে চাকাওয়ালা জুতাতে চড়ে বেড়ানোর ব্যাপারটি একেবারে নতুন। এ গ্রামের আর কারো এরকম জুতা নেই। তাড়াশের আরো তিন-চারজন ছেলের আছে। ওরা আর অনিক একসাথে বেড়ায়। তাদের গ্রামের কাঁচামাটির রাস্তাগুলো এখন সব পাকা হয়ে গেছে। আর এই পাকা সড়কগুলো অনিকদের পায়ে দিয়েছে বেসামাল গতি।

সকাল নয়টাও অনিকের কাছে গভীর রাত। আর গভীর রাতগুলো তার কাছে সন্ধ্যা। রাতভর মোবাইলে গেম খেলে। তার বাবার ধমকে কোন কোন রাতে সে তাড়াতাড়ি ঘুমায়। আবার তাড়াতাড়ি ওঠে। তবে এরকম ঘটনা খুব একটা ঘটে না। ফ্রি ফায়ার, পাবজি, নাইনটি সেভেন, সিওসি, আরো কী কী সব ওদের গেমের নাম। নাসিরও মাঝে মাঝে তার সাথে গেম খেলে। তবে অনিকের মতো সে আসক্ত নয়। একদিন সে অনিকের জুতা জোড়া তার পায়ে লাগিয়েছিল। ঐ জুতাগুলোর টাল সামাল করা ভীষণ কঠিন। এসব কারণে অনিক গ্রামের তার বয়সী ছেলে-মেয়েদের কাছে খুব জনপ্রিয়। স্কুলেও তার ভীষণ দাপট। তবে পড়াশোনার কারণে নয়। পড়াশোনার বিষয়টি তার অসহ্য লাগে। তাই সে ভোকেশনাল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। যেন সহজে পাস করা যায়। অনিক বেলপুকুর ভোকেশনালের ক্লাস নাইনের ছাত্র।
সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে মোবাইলের ব্যাগটি ছুটিয়ে নিয়েছে নাসির নিজেই। মোবাইলটিকে সে নেড়েচেড়ে দেখছে। মোবাইলটি বেশ বড়োসড়ো। আগেরটার চেয়ে এবারেরটা লম্বায় দুই আঙুল বড়। নাসির আঙুল ফেলে মেপে দেখল। সে অনিককে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, দাম কত? অনিকও প্রথমে তার দু’হাতের দশ আঙুল দেখিয়ে, পরে আবার চারটি আঙুল উঁচিয়ে দেখাল। অর্থাৎ ডান হাতের পাঁচ আর বাম হাতের পাঁচ এবং পরের চার- সবমিলিয়ে চৌদ্দ হাজার টাকা। নতুন মোবাইলের হেডফোনটি অনিকের গলাতেই ঝুলছিল। নাসির সেটিকে হাতে তুলে নিলো। এবং সে তার দুই কানে হেডফোনটি লাগিয়ে, অনিককে একটি গান চালু দেয়ার অনুরোধ করলো। ফুলস্ক্রিনে গানটি দেখা যাচ্ছে। অনেক মানুষ গানটির সাথে নাচানাচি করছে। নিশ্চয় তার সাথে বাজনাও বাজছে। কিন্তু ফুল সাউন্ড দিয়েও তা নাসিরের কানে আসছে না। সে হেডফোন দু’টিকে তার কানের সাথে আরো একটু চেপে দিল। তাতেও কোন কাজ হলো না। কান থেকে খুলে নাসির হেডফোনটি অনিকের হাতে দিলো। নাসিরের দুচোখে বেদনার বান ডেকেছে এখন। দু’চোখের উপকূল ছাপিয়ে লোনাজল গড়িয়ে পড়ছে তার দু’গালে। আর গাল বেয়ে তার গায়ের নীল রঙের শার্টে। নাসির আর সেখানে দাঁড়াল না, হাঁটতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে সে পেরিয়ে গেল সার গোডাউনের বাঁক।
কিন্তু অনিক দাঁড়িয়ে থাকল সেখানেই। শুধু অনিক নয়, যে কারো কাছে নতুন মোবাইল দেখলেই নাসির সে মোবাইলের হেডফোনটি কানে লাগিয়ে চেক করে দ্যাখে। সে হয়তো মনে মনে ভাবে দুনিয়াতে এতো কিছু হচ্ছে, কোনদিন হয়তো এমন মোবাইলও কেউ বানিয়ে ফেলবে, যার হেডফোনের আওয়াজ পৌঁছাবে তার কানে।
তার এলাকাতে অনুষ্ঠিত কোন ওয়াজ-মাহফিল বাদ দেয় না নাসির। সবগুলোতে যায়। নিয়মিত জুমার ঘরে যায়। একেবারে প্রথম কাতারে গিয়ে বসে, খতিবের কাছাকাছি। হয়তো এই আশাতে যে, পবিত্র সেই কালামে পাক একদিন জাগিয়ে তুলবে তার কানকে। খোদা ফিরিয়ে দেবেন তার জবান। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। একই উদ্দেশ্যে, সে চারঘাটের সিনেমা হলটিতেও গিয়েছিল। হলটির ভেতরে কতো বড় পর্দা! পর্দার মধ্যে ভেসে বেড়ানো মানুষগুলোকে কতো বড় বড়। হলরুম ভর্তি মানুষ নাসির দেখেছে, সেই মানুষগুলো হাসছে, আবার দুঃখও পাচ্ছে মাঝে মাঝে, আবার ক্ষেপেও যাচ্ছিল কেউ কেউ। কিন্তু নাসির এসবের কোনটিই করেনি। বড় পর্দার বড় বড় ঐ মানুষগুলোও তাকে হাসাতে পারেনি, তাকে কাঁদাতে পারেনি।
নাসির অনিকের বড় ভাই। বুঝতে শেখার পর থেকে সে দেখছে, নাসিরের জন্য বাবা-মা কত কষ্ট পাচ্ছেন। নাসির বাড়ির বড় ছেলে। তার মুখে একটি কথা শোনার আশাতে যে যেখানে বলেছে, তাকে নিয়ে সেখানেই ছুটেছেন তার বাবা-মা। মেডিক্যাল থেকে কবিরাজ, পানিপড়া আর ঝাড়ফুঁক মাঝখানের কখনো কিছুই বাদ রাখেননি। কিন্তু না, কিছুতেই তার মুখে কথা ফুটলো না। অনিকের বাবা সুগার মিলে চাকরি করেন, জমিজমাও আছে। ধান-পেঁয়াজ আর পাটের মতো ফসলগুলো তাদের ভালোই হয়। চাকরি এবং ফল-ফসলাদি সব কিছু মিলজুল করে তাদের চলে যায়। বড় কোন ঝামেলা তাদের পোহাতে হয় না। শুধু তাদের দুঃখ ঐ একটাই, নাসিরের মুখের কথা। নাসির অনিকের বছর চারেকের বড়। তার কথা শোনার আশা সবাই ছেড়েই দিয়েছে। তবে অনিক খেয়াল করেছে, নাসির কিন্তু সে আশা ছাড়েনি। নাসির হয়তো কখনো সে আশা ছাড়বেও না।
অনিক মোবাইলটি এবার পকেটে ঢুকিয়ে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল। স্ট্যান্ডের কাঁধে সাইকেলের দায়িত্ব দিয়ে সে উঠে বসলো সাঁকোটির রেলিংয়ের ওপর। বানের পানির আগ্রাসন কমতে শুরু করেছে। মানে কেবল জেগে উঠেছে খালের দুই পাড়। দু’দিন আগেও থইথই পানির মধ্যে খালের পাড়টিকে চেনার উপায় ছিল না। তবে এখনও খালের বুকে ঘোলাজলের স্রােত বেশ তীব্র। ঐ স্রােত যেন আত্মসমর্পণ করতে চাচ্ছে না। ওদের শাঁ শাঁ শব্দগুলো পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে অনিকের কান জোড়া। এই স্রোতটি যেন খালের বুকের ওপর দিয়ে না, যেন তার বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। খালটি জ্যাঠা টুডুর হাতের ধনুকের মতোন বাঁকা। যে ধনুকের দু’প্রান্তের জলই অনিকের দু’চোখের সীমানার বাইরে। তবে এ কথাও তো সত্যি, ধনুক পরিমাণ এই জলের মধ্যেই তো অনিকদের সব কাজ চলে। বিলের মাছ ধরা, গরু গোসল করানো অথবা পাট জাগ দেয়ার মতো সব কাজ। এখানকার জলে গোসল করানোর পর- তাদের কালো রঙের গরুটিও যেন হয়ে ওঠে সতেজ-সবল ঐ পাটের ডগার মতো। এখানকার জলে তারা খরা জাল পাতে, মাছ ধরে, এখানকার জলে জাগানো পাটের সোনা রঙই তো বানেশ্বর বাজারে তাদের পরিচয়। বাজারের কেউ তো তাদের মুখের কথা শুনতে চায় না। মুখ দেখে কোন কিছুর দামও দেয় না। বাজারের লোকেরা তাদের গরুর দাম দেয়, তাদের মাছের দাম দেয়, তাদের পাট কিনতে বেপারিরা বাড়িতে পর্যন্ত উঠে আসে। তাহলে নাসিরের হাতের কাজ বাঁশ-বেতের কাজগুলোও তো তার জবান হতে পারে! ফুলই তো ফুলগাছের জবান। গ্রামের মধ্যে সবাই তার এ কাজের খুব কদর করে। এখন যদি তার এ কাজগুলোকে নিয়ে একটা ফেসবুক পেজ খোলা যায়!

Share.

মন্তব্য করুন