এক নবীন ছাগল নিজ এলাকায় ভালো খাবার না পেয়ে অন্য কোন জায়গায় যাবার মনস্থ করল। এক হেমন্তের সকালে নিজ গ্রাম ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে গেল এক বাজারে। সেখানে এক ভিক্ষুকের সাথে তার দেখা হয়ে গেল। ভিক্ষুককে শূন্য থালা নিয়ে গাছের নিচে বসে থাকতে দেখে সে বলল :
“এ জায়গার নাম কী?”
“তুষভা-ার।”
“এখানে ঘাস আর লতাপাতার অবস্থা কেমন?”
“মোটেই ভালো না।”
“কেন। এখানকার গরু-ছাগল কি ঘাসলতা খায় না?”
“খায়। সেটা একপ্রকার না খেয়ে থাকা আর কি।”
“সেটা আবার কেমন কথা? আপনি যে এখানে বসে আছেন?”
“অত প্যাঁচাল পাড়ছ কেন? জায়গার নাম শুনে বুঝতে পারছ না। ঘাস থাকলে কি জায়গার নাম তুষভা-ার হয়।”
ছাগল ভাবল কথাটা সঠিক। এখানে সে কি শুকনো তুষ খেয়ে থাকবে। দাঁতের সাথে তুষের গুঁতো লেগে মুখের বারোটা বাজবে তাহলে। তার চেয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যাক। সে জোরছে হাঁটা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে সে এক নতুন জায়গায় এসে পৌঁছল। জায়গাটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। যদিও হেমন্তকাল তবুও এখানকার আবাদি জমি পানিতে তলানো। আকাশে যদিও সূর্যটা নরম রোদ ছড়াচ্ছে তবু মনে হয় চারদিক মলিন হয়ে আছে। সে জায়গার মানুষ খুব রোগাটে ও অসুস্থ। ছাগল একটা লোকের দেখা পেল। তার স্বাস্থ্য তেমন একটা ভালো নয়। সে তাকে বলল :
“ভাই, এ জায়গার নাম কী?”
“ভেতরবন্দ।”
“ভেতরবন্দ মানে কী?”
“মানে বুঝ না? ভেতরে ঢুকিয়ে তালা মেরে রাখে।”
“তাহলে ঘাস পানি পাওয়া যাবে কেমন করে?”
‘ঘাস পানি মারাচ্ছ। ভেতরে বন্ধ থাকলে ঘাস খাবে কি করে? দেখছ না আমার দশা। ভালো খাবার খেতে পারলে এমন দশা হতো?”
ছাগল ওখানে একটুও দাঁড়াল না। সে আবার হাঁটতে লাগল। সোনালি ধানের খেত পেছনে ফেলে সে এক মৃত অনুর্বর স্থানে এসে পৌঁছল। সেখানে সে দেখতে পেল কাকেরা ঠোঁট দিয়ে মাটি খুঁড়ে নাটা পোকা খাচ্ছে। সেখানে সে কোন মানুষ আর ঘরবাড়ি দেখতে পেল না। এরকম জনশূন্য স্থানে এসে ছাগল খুব ভাবনায় পড়ল। হঠাৎ একটা ব্যস্তÍ মানুষ দেখে জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করল ছাগল। লোকটা বলল :
“ভাইরে, এ জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করবে না।”
“কেন ভাই! এ জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করব না কেন?”
“এটা হল চোর ডাকাতের আবাস। এ জায়গার নাম হলো রাঘবপুর।”
“এখানে কি খাবার-দাবার পাওয়া যাবে না?”
“খাবার মারাচ্ছ। জান বাঁচাতে চাও তো তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও।”

লোকটার কথা শুনে প্রাণভয়ে ছুটতে লাগল ছাগল। কার্তিকের সূর্যটা আকাশে হেলান দিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সেদিকে নজর দেবার সময় নেই ছাগলের। ছুটতে ছুটতে সে এক জায়গায় এসে পৌঁছল। সেখানে এক পুরোহিতের সাথে তার দেখা হলো। ছাগল তাকে প্রশ্ন করল :
“পুরোহিত মশায়, এ জায়গার নাম কি ?”
“জায়গার নাম শুনে কী করবে? নতুন এসেছ মনে হয়। দুদিন থাক। নামধাম এমনিতেই বুঝতে পারবে।”
“বলুন না মশাই, নামটা আমার খুব দরকার।”
“আরে নাম, জান বাঁচা দায়। নাম ধুয়ে পানি খাও। এটা হল বামনডাঙ্গা, বুঝলে?”
“বামনডাঙ্গা আবার কেমন নাম? এমন নাম তো কখন শুনিনি।”
“এখানকার লোকজন বামনকে ধরে মারে। জানি না আমার ভাগ্যে ভগবান কী লিখেছে।”
“এখানে কি খুব অভাব। লোকেরা কিসের জন্য বামনকে মারে। ঘাস পানির কি অবস্থা?”
“ওসব কথা রাখ। বাঁচতে চাও তো অন্য কোথাও পালিয়ে যাও। আমিও এখানে বেশি দিন থাকব না।”
পুরোহিতের কথায় ছাগল খুবই হতাশ হলো। একটা মনের মতো জায়গা সে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে চলতে চলতে সে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যে জায়গায় পুরোহিতের নিরাপত্তা নেই সেখানে সে বাস করবে কেমন করে। গাছের তলে পড়ে থাকা বিবর্ণ কাঁঠালপাতা খেয়ে সে একটা ঝোপের ভেতর শুয়ে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিল। তারপর নতুন জায়গার সন্ধানে ছুটতে লাগল।
এবার সে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটা জায়গায় উপনীত হলো। এখানকার মাটি লালচে এবং শক্ত। উঁচু টিলার মধ্যে সারিবদ্ধ গাছপালা দেখে তার মনে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হলো। জায়গাটার মাটি এমন কঠিন এবং নীরস যে সবুজ ঘাসের কোন চিহ্নই সে দেখতে পেল না। শরৎ চলে গিয়ে হেমন্ত এসেছে। তার দেশে এখন সবুজ ঘাসে কুয়াশার গন্ধ ভেসে বেড়ায়। মাঠের মাঝ দিয়ে পায়েচলা সরু পথে প্রচুর ঘাসের উজ্জ্বলতা। অথচ এখানে কোন ঘাস নেই। টলটলে পানিতে ঢেউখেলানো পুকুরও নেই। ছাগল এক পথচারীর দেখা পেল। সে বলল :
“সোনাভাই, এ জায়গার নামটা দয়া করে বলবেন কি?”
“ভাইরে, নাম শুনে কি হবে। তার চেয়ে বল কোথা থেকে এসেছ?”
“আমি তো এসেছি সাপটানা থেকে।”
“ওখানে কি অসুবিধা হয়েছিল?”
“অসুবিধা তেমন ছিল না। সাপটানা নামটা কেমন না।”
“আর এখানের নাম বুঝি খুব ভালো। টাঙ্গাইল কি একটা জায়গার নাম হলো।”
“টাঙ্গাইল! সেটা আবার কেমন নাম?”
“কাম তো আরও খারাপ।”
“কেমন খারাপ ?”
“যাকে পায় মেরে টাঙিয়ে রাখে।”
“ওরেব্বাবা! তাহলে তো এখানে থাকা যাবে না।”

লোকটার কথা শুনে ছাগলের বুক কাঁপতে লাগল। সে একদ- সেখানে দাঁড়াল না। উড়ে চলা শুকনো পাতার মতো সে লাফাতে লাগল। চলতে চলতে সে অনেক দূর এসে গেল। সেখানে সে সবুজ ধানখেত আর শ্যামল প্রান্তর দেখতে পেল। আকাশে সাদাটে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছের ফল খেয়ে পাখিরা মনের আনন্দে গান গাচ্ছে। এমন মনোহর দৃশ্য দেখে ছাগল আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল। পেট পুরে তাজা ঘাস খেয়ে শীতল ছায়ায় লম্বা ঘুম দিল সে। ঘুম থেকে জেগে সে দেখল এক রাখাল তার পাশে বসে আছে। সে রাখালকে এলাকার হালচাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল।
“ভাই। এ জায়গার নাম কী?”
“এ জায়গার নাম জেনে তোমার কাজ কী? খাও দাও ফুর্তি করে ঘুরে বেড়াও।”
“যেখানে থাকব তার নাম জানব না। এটা কেমন কথা?”
“আমারও তো সেই প্রশ্ন। তুমি এখানে বাস করছ অথচ নাম জানতে চাচ্ছ অন্যের কাছে।”
“না ভাই, আমি এখানে নতুন এসেছি।”
“তাহলে শোন। এ জায়গার নাম ছাগলনাইয়া।”
“এ নামের মানে কী?”
“আমিও এখানে নতুন এসেছি। তবে আমার মনে হয় এরা ছাগলের মাথা নেড়ে করে দেয়।”

ছাগল ভাবল এটা কেমন কথা। লোকেরা যদি তার মাথা নেড়ে করে দেয় তাহলে কেমন হবে। কাজ নেই এখানে থেকে। তার চেয়ে অন্য কোথাও যাই। এ কথা ভেবে ছাগল হাঁটতে হাঁটতে একটা জঙ্গলের কাছে পৌঁছল। তখন রাত নেমেছে। আকাশে চাঁদ থাকলেও গাছালির ছায়ায় চারদিকটা ভুতুড়ে লাগছে। সেখানে ছাগল কোন মানুষকে দেখতে পেল না। হঠাৎ জঙ্গল থেকে একটা বুড়ো শেয়াল বের হয়ে তাকে বলল :
“কি বাপু, এত রাতে এখানে কাকে খুঁজছ। নতুন এসেছ বুঝি?”
‘জি। আমি একটা ভালো নামের জায়গা খুঁজছি। যেখানে ঘাস আর মিষ্টি পানি আছে ।”
“তুমি ঠিক জায়গায় এসে গেছ। এখানে ঘাস-পানির কোন অভাব নেই। চল আমার সাথে।”
“কোথায় যাব?”
“এত রাতে আর কোথায় যাবে। রাতটা আমার এখানে কাটাবে।”
“আপনার ওখানে থাকার জায়গা হবে?”
‘কেন হবে না। কি ভাবছ তুমি। একজন কেন, দশ বিশের কথা বললে না?”
“থাক। অন্য কোথাও রাতটা কাটিয়ে দেব।”
“কী অবাক কথা বলছ! এখানে এসে তুমি অন্য কোথাও থাকবে ? এটা হতে পারে না।”

শৃগালের কথায় ছাগল খুব খুশি হলো। সে শৃগালের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ হেঁটে শৃগাল একটা গর্তের কাছে এসে পৌঁছল। সেখানে এসে ছাগল বলল :
“এ জায়গাটার নাম কী?”
“নাম জেনে কী করবে?”
“না এমনিই শুনছি। কেন নাম জানতে কোন দোষ আছে?”
‘না না, দোষ হবে কেন।’
“শিয়ালদহের নাম শুনেছ কোনদিন? এটা সেই জায়গা।”
“শিয়ালদহ মানে কী?”

ততক্ষণে শৃগাল ছাগলের ঘাড়ে তার ধারাল দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। ছাগল আর্তনাদ করার আগে শৃগাল বলল, “শিয়ালদহ মানে শিয়ালের পেটে হজম হওয়া।”

Share.

মন্তব্য করুন