আমাদের পাড়ায় এসেই শহরটা যেন শেষ হয়ে গেছে। পাড়ার পূর্ব পাশ থেকে শুরু হয়েছে ধানক্ষেত, বাগান, তারপর গ্রাম। এমন দুটো গ্রাম পার হয়ে অরু আপাদের বাসা। যখনই অরু আপাদের বাসায় যাবো ভেবেছি তখনই কিভাবে যেন টুলু মামা টের পেয়ে যান। ঠেসে ধরেন- আমিও যাবো। শেষমেশ অগত্যা টুলু মামাকে সঙ্গে নিয়েই যেতে হয়। যেখানেই যাবো সেখানেই টুলু মামা এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া বাধাতেই থাকে। তাই এবার খুব সতর্কতার সাথে একা একা, কাউকে না বলে, সকাল সকাল রওনা দিলাম। জানলো শুধু মা। বললাম, টুলু মামা যেন জানতে না পারেন।
মাঠের মধ্য দিয়ে ভ্যান চলা রাস্তা। ভ্যানে করে কাঁচাসড়ক পেরিয়ে চলেছি। দুই পাশে ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে বাগান, এসব পেরিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম অরু আপুর বাসায়। ভাগ্নে-ভাগ্নিরা মহাখুশি। কিন্তু দুলাভাই আর আপু খুশি না। কারণ টুলু মামা এবার কেন আসেনি। এ কথা শুনে রাগে গা কাঁপতে লাগলো। এই টুলু মামা সব গ-গোলের গোড়া। আর সেই কিনা সবার কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তি। বললাম আপু থাক, টুলু চৌধুরী এবারকার মতো থাক।
দুলাভাই মকলেস তো রেগে আগুন। টুলু একটা মজার ছেলে, ও না এলে কি গল্প জমে। হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। বুঝলাম এবারের বেড়ানোটাও মাটি হবে। কারণ অরু আপু অলরেডি টুলু মামাকে মোবাইল করে সব ফাঁস করে দিলেন। এবং এ খবরও পাওয়া গেল, কিছুক্ষণের মধ্যে টুলু চৌধুরী জার্নি বাই ভ্যানে রওনা দেবেন।
আপাতত আমি মেহমান হয়ে গেছি। গাছে চড়ে পাকা আম খাওয়া শুরু করলাম। টুলু মামা আসার আগে যত মজা করা যায় করে ফেলি। উনি ভিড়লো মানে তো জার্নি শেষ। কোন না কোন ভ্যাজাল পাকিয়ে বসে থাকবেন।
ভাগ্নে পল্টু আর ভাগ্নি পুতলিকে নিয়ে ভালোই মজা চলছিলো। দু’চারটে পাকা আম পাওয়া গেল, সেগুলো মজা করে খেলাম, তারপর আসন্ন টুলু মামার টেনশনে অরু আপুর বাসায় ঢুকলাম। নাহ্ টুলু মামা এখনও আসেনি। দুপুরের রান্না-বান্নার আয়োজন শেষের দিকে। হঠাৎ টুলু মামার ফোন- হ্যালো মামা, আপনি কত দূরে?
মামা বললেন, তোর খুব কাছাকাছি। আমাকে ফেলে একা একা আসা শেখাচ্ছি। মোবাইল অফ।
ভাবছি, টুলু মামা গ্রামে এলে তো নায়ক সেজে আসেন। হেব্বি জিন্স, চোখে সান গ্লাস, হাই হিল জুতো, উফফ ডিসগাস্টিং! কী বিচ্ছিরি, নিশ্চয় আজও এসব পরেছেন।
চিন্তায় মরে যাচ্ছি। এমন সময় বাইরে কেমন যেন গোলমাল শোনা গেল। সেই সাথে মকলেস ভায়ের পোষা কুকুরের ঘেউ ঘেউ। দৌড়ে বাইরে গেলাম। গিয়ে দেখি হায়! যা ভেবেছিলাম তাই। টুলু মামা ভ্যান থেকে নেমে অরু আপার বাড়ির কাছে যেই এসেছেন আর অমনি পোষা কুকুরটা আজব প্রাণী দেখে সহ্য করতে পারেনি। কুকুরের প্রেসটিজে লেগে গেছে তাই ঘেউ-ঘেউ করে প্রতিবাদ করেছে। টুলু মামা প্রতিবাদ সহ্য করতে না পেরে একটু জোরে হেঁটেছেন বা দৌড়েছেন। সেই সুযোগে ভেলু অতি উৎসাহে ধাওয়া করেছে। টুলু মামা ছুটছেন আম বাগানের দিকে। মাঝে ছুটছে ভেলু, আর আমি ছুটছি ভেলুর পেছনে। আমার পেছনে পল্টু আর পুতলি, কুকুরটাকে ধমক দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু শুনছে না। এদিকে টুলু মামার জুতার হিল খুলে গেছে সান গ্লাস ধরণীতল।
শেষ পর্যন্ত মামা অরু আপাদের আমগাছের ডালে ধরে ঝুলে উঠে গেলেন। গাছ তলায় ভেলু লাফালাফি করছিল। আমি পল্টু আর পুতলি ভেলুকে ধমকে বুঝিয়ে দিলাম যে, এটা আমাদের মেহমান। ভেলু লেজ নাড়িয়ে লজ্জিত ভাব নিয়ে সরে পড়লো। কিন্তু মামার মুখের দিকে তাকানো যায় না। এত বড় অপমান! দেখলাম তার দুই হাঁটুর কাছে জিন্সের প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে। বললাম, মামা নেমে আসুন, নেমে আসুন। মামা নামবেন না। বললেন, মকলেস মামা আসুক নাহলে নামবেন না। পল্টুকে বললাম, তোর বাবাকে ডেকে আন। পল্টু আর পুতলি ডাকতে চলে গেল।
মামা রেগে আগুন। তুইও আমাকে ঠাট্টা করছিস! এত দাম দিয়ে এই ছেঁড়া জিন্সটা কিনেছি তাও বলছিস ছিঁড়লো কি করে! বোঝা গেল কুকুরটা ছেঁড়া জিন্স দেখেই বুঝি বেশি খেপেছে। আমি চুপ মেরে গেলাম। মকলেস ভাই চলে এলেন, টুলু মামা সসম্মানে বৃক্ষ থেকে নামলেন এবং টুলু মামাকে দুলাভাই আর আমি গার্ড অফ অনার দিয়ে বাড়ি নিয়ে এলাম।

Share.

মন্তব্য করুন