অবিভক্ত বাংলা ও আসামের প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। অথচ মজার বিষয় কি জানো, বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর শিক্ষকতা করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। তিনি স্বপ্ন দেখতেন পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করবেন। ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য তাদের দুয়ারে দুয়ারে যাবেন। দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করবেন। রাজনীতি করতে হলে স্বাধীন আইন পেশা সবচেয়ে ভালো। তাই বড় হয়ে তিনি আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু শিক্ষকতার প্রতি তার মনে একটি সুপ্ত বাসনা যে ছিল। কারণ ছাত্রজীবনে সুযোগ পেলেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।
তিনি যখন কলকাতার সেন্ট পলস কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স শেষ করেছেন, তখন একটি ঘটনা ঘটলো তার নিজ জেলা (তৎকালীন মহকুমা) টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। তখন আটিয়ার পরগণার জমিদার করটিয়ার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি করটিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কী সেই ঘটনা? নিশ্চয়ই তোমাদের জানতে ইচ্ছে করছে! তাহলে বলছি শোন, জমিদারের প্রতিষ্ঠিত করটিয়া হাইস্কুলের নামাজ ঘরের কাছে হিন্দু ছাত্ররা সরস্বতী পূজার ম-প তৈরি করে, এতে মুসলমান ছাত্রদের নামাজে ব্যাঘাত ঘটে। তারা প্রথমে বিষয়টি প্রধান শিক্ষককে জানায়। কিন্তু তিনি তাদের তাড়িয়ে দেন। বাধ্য হয়ে ছাত্ররা জমিদারকে বিষয়টি জানায়। জমিদার প্রধান শিক্ষককে অনুরোধ করেন, নামাজ ঘর থেকে একটু দূরে ম-প তৈরি করে পূজার কাজ সম্পন্ন করতে। কিন্তু প্রধান শিক্ষকসহ অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন হিন্দু। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তাদের দারুণ দাপট। প্রধান শিক্ষক জমিদারের অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন। জমিদার তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ঘোষণা দিলে তিনি তার সমর্থক সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
এক সাথে এত শিক্ষক পদত্যাগ করায় জমিদার বিপদে পড়ে গেলেন। কিন্তু দমে গেলেন না। তিনি কলকাতায় লোক পাঠান তার এলাকার মুসলমান ছাত্র কে কে আছেন তার খবর নিতে। ইবরাহীম খাঁর সন্ধান পাওয়ার পর জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী তাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। তিনি জমিদারকে জানান, এত ছোট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত নন। তিনি যদি শিক্ষকই হন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন, হাইস্কুলের নয়। জমিদার সাহেব যদি আলীগড়ের মতো কোন বড় প্রতিষ্ঠান গড়ার দায়িত্ব তাঁকে দেন তাহলে তিনি করটিয়া যাবেন। জমিদার তাঁকে কথা দেন, স্কুলটাকে বাঁচাতে পারলে তিনি বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে আরো বড় কিছু করবেন। ইবরাহীম খাঁ রাজি হলেন। তিনি এমএ ভর্তি না হয়েই ১৯১৯ সালের ২৮ নভেম্বর করটিয়াতে চলে আসেন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯১৭ সালে আইনে প্রিলিমিনারি ও ১৯১৮ সালে ল-ইন্টার, ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এমএ এবং ১৯২৩ সালে আইন পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষণ না দেখে ইবরাহীম খাঁ ১৯২৩ সালে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ময়মনসিংহে গিয়ে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক বছর পর তিনি আবার ফিরে আসেন। কেন তিনি ফিরে এলেন তা নিয়ে আছে নানান মত। অনেকে মনে করেন, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে ইবরাহীম খাঁকে ডেকে পাঠান। আবার অনেক গবেষক তাঁর এই ফিরে আসা নিয়ে বলেছেন, আইনব্যবসা করে হালাল রুজি অর্জন কঠিন এই চিন্তা করে তিনি নিজেই করটিয়ায় ফিরে আসেন। ১৯২৬ সালের ২রা জানুয়ারি এসে আবার প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) তাঁর পিতামহের নামে সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ইবরাহীম খাঁকে এই কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পেলেও তিনি স্বপ্ন দেখেন এই বঙ্গে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার। তিনি কবিতার ভাষায় প্রার্থনা করেন,
‘দেহ (দাও) বিভু এই বর
করটিয়ার বুকে জাগিয়া উঠুক
বঙ্গের আলীগড়।’
দীর্ঘ একুশ বছর তিনি সা’দত কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষকতার জন্য ডাকা হলেও তিনি করটিয়া ছাড়েননি। রাজনীতি সচেতন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ছাত্রজীবনেই নিখিল ভারত কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। সাহিত্য সাধনা, শিক্ষা আন্দোলন, সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সমান সক্রিয়।
তিনি একাধারে প্রবন্ধ, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতিকথা ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের তালিকা নিম্নরূপ : নাটক : কামাল পাশা (১৩৩৪), আনোয়ার পাশা (১৩৩৭), ঋণ পরিশোধ (১৯৫৫), ভিস্তি বাদশা (১৯৫৭), কাফেলা। উপন্যাস : বৌ বেগম (১৯৫৮)। গল্পগ্রন্থ : আলু বোখরা (১৯৬০), উস্তাদ (১৯৬৭), দাদুর আসর (১৯৭১), মানুষ, হিরকহার। স্মৃতিকথা : বাতায়ন (১৩৭৪)। ভ্রমণ কাহিনী : ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র (১৯৫৪), নয়া চীনে এক চক্কর, পাকিস্তানের পথে-ঘাটে। শিশু সাহিত্য : ব্যাঘ্র মামা (১৯৫১), শিয়াল প-িত (১৯৫২), নিজাম ডাকাত (১৯৫০), বেদুঈনদের দেশে (১৯৫৬), ইতিহাসের আগের মানুষ (১৯৬১), গল্পে ফজলুল হক (১৯৭৭), ছোটদের মহানবী, ছেলেদের শাহনামা, ছোটদের নজরুল, গুলবাগিচা, নবী জীবনের ঝা-া বহিল যারা, তুর্কী উপকথা, নীল হরিণ, সোহরাব রোস্তম ইত্যাদি। ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ : মহানবী মুহাম্মদ, ইসলামের মর্মকথা, ইসলাম সোপান, ছোটদের মিলাদুন্নবী। শিক্ষাবিষয়ক গ্রন্থ : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতির মর্মকথা, নীতিকাহিনী। ইব্রাহীম খাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ১১৮টি। এর মধ্যে ১৮টি অনুবাদ গ্রন্থ, ইংরেজিতে লেখা গ্রন্থের সংখ্যা ১২ এবং বাংলা ভাষায় রচিত মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা মোট ৮৮টি। ইংরেজিতে লেখা তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এনেকডোটস ফ্রম ইসলাম’ একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
ইব্রাহীম খাঁ তার অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নানা খেতাব ও পুরস্কার পেয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রথমে ‘খান সাহেব’ ও পরে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। খান সাহেব উপাধি তিনি সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করেন এবং খান বাহাদুর খেতাব তিনি পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের মুসলিমবিরোধী মনোভাবের প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তঘমা-এ-কায়দে আযম’ খেতাব প্রদান করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ভূঞাপুর ‘সাহিত্য সংসদ’ গঠন করে একুশে পদকের সব অর্থ ও কিছু জমি উক্ত সাহিত্য সংসদে দান করেন। এত কথা বললাম, কিন্তু তোমাদেরকে আসল কথাই বলা হয়নি। এই মহান ব্যক্তির একটি সুন্দর ডাকনাম আছে। সেই ডাকনাম হলো খাজা মিয়া। এই নামটিও কিন্তু তাঁর বড় পছন্দের ছিল। আর এই জন্যই তিনি এ নামেও লেখালেখি করেছেন। তাঁর জন্মসন তারিখ নিয়েও আছে আছে মজার ব্যাপার। পারিবারিক নথিপত্রে তার জন্ম বিবরণে লেখা আছে, তিনি ১৮৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে কোন এক বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু পিংনা হাইস্কুলের ভর্তি রেজিস্টারে লেখা আছে তিনি ১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫-সনে টাঙ্গাইল জেলার ভুয়াপুর থানার অন্তর্গত বিরামদী (বর্তমান শাহবাজনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন।
থাক জন্মসন নিয়ে এই বিতর্ক কথায় আছে, ‘জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হোক ভালো।’ তিনি দেশ, জাতির জন্য অনেক অনেক ভালো ভালো কাজ করেছেন। অবশেষে ১৯৭৮ সালের ২৯ মার্চ ইন্তেকাল করেছেন। ভালো কাজের তালিকায় ভরা তাঁর কর্মজীবনটা অনেক দীর্ঘ। বড় হয়ে এই মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আরো অনেক কিছু তোমরা জানতে পারবে।

Share.

মন্তব্য করুন