নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণবিধি, যা মানুষের জীবন চলার পথকে করে তোলে সুন্দর, নির্মল ও সুচি। এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের সততা, মানবতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সৌজন্যবোধ।
নৈতিক মূল্যবোধ মানব চরিত্রকে করে তোলে সুষমাম-িত। নাগরিক জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের লালন-পালন, পরিচর্যা ও বিকাশ অত্যন্ত জরুরী। এর অনুপস্থিতিতে মানব জীবন হয়ে পড়ে নোংরা, কুৎসিত ও কদর্য পূর্ণ। মানুষের সামাজিক তথা নাগরিক জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের কোন বিকল্প নেই।
নাগরিক জীবন কি? নগর রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আচার-আচরণই হলো নাগরিক জীবন। ব্যাপক অর্থে একটি দেশে বসবাসকারী নাগরিকগণ ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাদের ওপর প্রদত্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ কীভাবে পালন করে, তার চালচিত্রই নাগরিক জীবন।
একজন নাগরিকের নানাবিধ অধিকার আছে। তন্মধ্যে নৈতিক অধিকার, আইনগত অধিকার, সামাজিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি রাষ্ট্রের সাফল্য, অগ্রগতি ও উন্নতি তার নাগরিকদের কর্তব্যনিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে। এ সাফল্য বয়ে আনে সুনাগরিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস (খড়ৎফ ইৎুপব) এর মতে, সুনাগরিকের ৩টি গুণ থাকা একান্ত প্রয়োজন। আর তা হলো- বুদ্ধিমত্তা, আত্মসংযম ও বিবেক।
বুদ্ধিমত্তা, আত্মসংযম ও বিবেক-বিবেচনা নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনের অপরিহার্য উপাদান। যে ব্যক্তির চরিত্রে এ ৩টি গুণ প্রতিফলিত হবে, সে-ই নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সুনাগরিক। এরূপ নাগরিকগণই সদা-সর্বদা দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। তাদের কাছ থেকেই মানুষ দয়া-মায়া, সাহায্য-সহযোগিতা, শিষ্টাচার ও সৌজন্যতা পেয়ে থাকে, অন্যের কাছে নয়।
নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সৎ ও চরিত্রবান নাগরিক একটি দেশের গর্ব। চরিত্রবান নাগরিক জাতিকে প্রগতির পথে টেনে নেয়, পক্ষান্তরে চরিত্রহীন নাগরিক জাতিকে অবনতির দিকে ঠেলে দেয়। নৈতিক মূল্যবোধহীন মানুষ দেশ ও জাতির শত্রু। তার কাছ থেকে কখনো ভাল কিছু আশা করা যায় না।
মানুষ সামাজিক জীব। সে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত বসবাস করতে পারে না। সমাজে বসবাস করতে হলে নিজের স্বার্থের প্রতি শুধু লক্ষ্য রাখলে চলবে না, অপরের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। অপরের সুখে সুখী ও অপরের দুঃখে-দুঃখী হতে হবে। পারস্পরিক সহানুভূতি ও কর্তব্যবোধ হতে বিচ্যুতি সমাজে অনৈতিকতার জন্ম দেয়। অনৈতিকতা তথা নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নাগরিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। যা সভ্য সমাজে কখনো কাম্য নয়।
আজকাল মানুষ কোন কোন ক্ষেত্রে বিবেকহীন চতুষ্পদ প্রাণীর মত আচরণ করছে। পরিবেশ দূষণ করতে, অপরের সম্পদ গ্রাস করতে, মিথ্যা ও অন্যায়ের আশ্রয় নিতে বিবেক তাকে বাধা দেয় না। তার সামনে ক্ষুধাতুর পঙ্গু অসহায় মানুষ পড়ে থাকলেও ফিরে তাকাবার একটু প্রয়োজন মনে করে না। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নিষ্পাপ মানুষকে কলঙ্কিত করতে, নিজের হাতে আইন তুলে নিতে; এমন কি মানুষ হয়ে মানুষ খুন করতে তার বুক একটুও কাঁপে না। এরূপ পাষ- নাগরিক কোন জাতির কখ না কাম্য হতে পারে না।
ইদানিং নাগরিক জীবনের দিকে তাকালে প্রতিনিয়ত নানা অসঙ্গতি চক্ষুকে তীরবিদ্ধ করে। প্রতি পদে পদে মানবিকতার ভূলুণ্ঠন পরিদৃষ্ট হয়। পৃথিবীর সভ্য ও উন্নত দেশসমূহের নাগরিকগণ নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যেখানে-সেখানে কখনো ময়লা-আবর্জনা; এমন কি থুথুও ফেলে না, অথচ আমাদের দেশ যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। মানুষ চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট ফুটপাতগুলোর অধিকাংশ অবৈধ দখলদারদের দখলে। আবার কোথাও কোথাও পরিণত হয়েছে পুঁতিগন্ধময় ময়লা-আবর্জনার স্তূপে। ফলে নাগরিকগণ বাধ্য হয়ে যান চলাচলের রাস্তায় চলতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বরণ করছে সীমাহীন দুঃখ ও কষ্টের জীবন। যাপন করছে পঙ্গুত্ব। ফলে গোটা পরিবারে নেমে আসছে নিদারুন দারিদ্র্য। অন্যদিকে রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রাক্রসিং নির্দিষ্ট থাকলেও আইল্যান্ড ও আইল্যান্ডের বেড়া টপকাতে আমরা একটুও দ্বিধা করি না। ওভারব্রীজ থাকলেও তাতে উঠে রাস্তা পার হতে চাই না। এটি কোন সুনাগরিকের লক্ষণ নয়।
পানির টেপ খুলে দিতে পারি কিন্তু বন্ধ করতে ভুলে যাই। দিয়াশলাইয়ের একটিমাত্র কাঠি জ¦ালাবো বলে দিনের পর দিন গ্যাসের চুলা জালিয়ে রাখি। অবিবেচকের মত ফুল ভলিয়মে রেডিও, টিভি, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনি অথচ পাশের বাসার পরীক্ষার্থী অথবা মুমূর্ষু রোগীটির কথা একবারও ভাবিনা। মধ্যরাতে প্রতিবেশীর ঘরে ডাকাত পড়লে তার সাহায্যে এগিয়ে যাই না বরং নিজের খিড়কিটা শক্ত করে বেঁধে রাখি। সচক্ষে খুন, রাহাজানি, ছিনতাই হতে দেখলে বাধা তো দেই না; আদালতে সাক্ষ্য দিতেও ভয় পাই। চোখের সামনে কোন অসহায় মেয়েকে বখাটে ছেলে ইভটিজিং করলে বা মারাত্মক আহত করলে আমরা দর্শক সেজে মজা লুটি, স্মার্ট ফোনে ভিডিও করি; কিন্তু বখাটেকে বাধা দেইনা।
রমযান মাস এলেই ইচ্ছাকৃতভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিই, একটুও চিন্তা করিনা যে, ফরয রোযা পালন করতে গিয়ে আমার গরীব-অসহায় মুমিন-মুসলমান ভাইয়েরা কষ্ট পাবে। আর বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির গন্ধ পেলেই নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করি, যাতে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে সর্বসাধারণের কাছ থেকে বিপুল মুনাফা করতে পারি। গত কয়েক বছর বেগুনের আগুন ও পেঁয়াজের ঝাঁজ তো সবার নাকে লেগে আছে। এসব নানাবিধ অসঙ্গতি সাধারণ মানুষ ও তরুণ সমাজের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে সমাজে সন্ত্রাস, ব্যভিচার, ঘুষ, দুর্নীতি মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। এই কী আমার নৈতিকতা, এই কী আমার নাগরিক কর্তব্য? মানুষ মানুষের জন্য, আত্মস্বার্থ চিন্তায় বিভোর হবার জন্য নয়। একজন মুসলমানের চরিত্র এরূপ হওয়া অনুচিত। কুরআন-হাদিসের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। এরূপ ঘৃণিত চরিত্রের মানুষকে যেমন ব্যক্তি ও সমাজ ঘৃণা করে তেমনি পরকালেও এরা রাসূলে পাক (সা.) এর শাফায়াত হতে বঞ্চিত হতে বাধ্য। জাহান্নামের অগ্নি গহ্বরে তারা ছাইভস্ম হবে।
লজ্জা-শরম কি আমাদের দিন দিন লোপ পাচ্ছে? না হয় প্রকাশ্য দিবালোকে যেখানে সেখানে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করতে কেন আমাদের বিবেক একটুও বাধে না? মা-বোন-কন্যা সন্তান আমাদের সবারই আছে অথচ একশ্রেণির অসৎ চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী সিনেমার নগ্ন পোস্টার ছাপিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, স্কুল-কলেজের গেটে নির্দ্বিধায় টাঙিয়ে দিচ্ছে। যা দর্শনে প্রতিনিয়ত পথচারী হচ্ছেন বিব্রত। এদের এ হীন কর্মে আমাদের কোমলমতি সন্তানেরা অশ্লীলতার পঙ্কিল পথে পা বাড়াচ্ছে আর নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে ভূলুণ্ঠিত।
নৈতিক মূল্যবোধহীন এ অশুচি অবস্থার উত্তরণ সময়ের অপরিহার্য দাবী। রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিবেকের জাগরণ এ মুহূর্তে একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে প্রতি পদে পদে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ ও নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। সুনাগরিক হিসেবে আমরা তা কখনো হতে দিতে পারি না। আমাদের বিশ^াস এই প্রতিকূল অবস্থার অবসানে একটি সামাজিক আন্দোলন সূচিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

Share.

মন্তব্য করুন