বিশ্বের সবচেয়ে ছোট রাষ্ট্র কোনটি, জানতে চাইলে উত্তর পাওয়া যাবে ভ্যাটিক্যান সিটি। কিন্তু এর চেয়েও ছোট দেশ আছে। যার নাম সিল্যান্ড। বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্লাটফর্ম, যা সিল্যান্ড নামে পরিচিত। সিল্যান্ডে মাত্র ৫০ জন মানুষ বাস করে। দেশটির আয়তন মাত্র শূন্য দশমিক ০.২৫ বর্গকিলোমিটার। প্রিন্সিপ্যালিটি অব সিল্যান্ড নামের এই দেশটির নিজস্ব পতাকা, পাসপোর্ট, মুদ্রা সবই আছে। এর অবস্থান উত্তর মহাসাগরের ব্রিটেনের জলসীমায় সাফোক উপকূলে। সিল্যান্ডের রাজধানীর নাম এইচএম ফোর্ট রাফস। মুদ্রার নাম সিল্যান্ড ডলার।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একটি সমুদ্রবন্দর ছিল এই সিল্যান্ড। জার্মান সেনারা যেকোনও সময় ইংল্যান্ড আক্রমণ করতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই ব্রিটিশ সেনা ইংল্যান্ড উপকূলে দুর্গ বানানোর পরিকল্পনা করে। এরই একটি পরিত্যক্ত বন্দর হচ্ছে সিল্যান্ড। সিল্যান্ডের অবস্থান ব্রিটিশ সমুদ্র উপকূল থেকে ছয় মাইল দূরে। প্রায় ৫০ বছর ধরে এখানে টিকে আছে এই সিল্যান্ড। এটি আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন কর্তৃক স্থাপিত একটি সামুদ্রিক দুর্গ।
প্রথম দিকে একে ডাকা হতো ‘রাফস টাওয়ার’ নামে। এর কাজ ছিল শত্রু বিমানকে প্রতিহত করা, ইংল্যান্ডের জলসীমায় জার্মান মাইন বসানো পর্যবেক্ষণ করা ও তা সম্পর্কে রিপোর্ট করা। যুদ্ধের সময় এটি ছিল প্রায় ১৫০-৩০০ জন সৈন্যের আবাসস্থান। সেই সাথে এখানে ছিল বিভিন্ন রাডারের যন্ত্রপাতি, দু’টি ৬ ইঞ্চি বন্দুক, এবং দুটি ৪০ মি.মি. অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট অটোমেটিক কামান। ১৯৫৬ সালে রয়াল নেভি একে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। সিল্যান্ডের এই অবকাঠামোটি গড়ে উঠেছে একটি বিশাল ডুবন্ত জাহাজের ওপরে। ১৯৪২ সালে প্রথমে একটি ফেরির ন্যায় বিশাল ভাসমান সমতল জাহাজ নেয়া হয়। এরপর এর উপরে পাটাতন যুক্ত দু’টি কংক্রিটের ফাঁপা টাওয়ার যুক্ত করা হয়, যাতে এর উপরে অন্যান্য কাঠামো তৈরি করা যায়।
এই দুই টাওয়ারের প্রতিটি ছিল মোট সাত তলা করে। এগুলো খাবার ও ঘুমানোর ঘর, গুদামঘর ও নানা যুদ্ধোপকরণ রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো। এর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনটি টাগবোটের সাহায্যে একে ‘রাফ স্টান্ড’ বালুতটে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে নিয়ে আসার পর এটির সেই বিশাল সমতল জাহাজটিকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। ফলে সেটি উপরের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
যুদ্ধশেষে যখন সিল্যান্ডের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন রয়েল নেভি তাদের সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে এখান থেকে চলে যায়। ফলে এই অবকাঠামোটি পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকে কয়েক বছর। ১৯৬৭ সালে এখানে একটি অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী দল ঘাঁটি গাড়ে। তারা এই স্থানটি তাদের হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং প্যাড হিসেবে ব্যবহার শুরু করে এবং এখানে আরামে বসবাস শুরু করে। ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে আরেক অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী রয় বেটস এখানের আগের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে এই স্থানটি দখল করে নেয়।
রয় বেটস এর আগে ‘রেডিও এসেক্স’ নামের আরেকটি অবৈধ বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতো। কিন্তু তা ৩ মাইল ব্রিটিশ এলাকার মধ্যে হওয়ার এক সময় বেটস ধরা পড়ে যায় ও তাকে জরিমানা দিতে হয়। ফলে বেটস তার সমস্ত যন্ত্রপাতি ও ১৫ বছর বয়সী ছেলে মাইকেলকে নিয়ে রাফস টাওয়ারে এসে ওঠে ও দীর্ঘ এক লড়াইয়ের পর এটি দখল করে নেয়। তবুও এই টাওয়ারটি পরবর্তীতে আর পরিপূর্ণভাবে বেতারকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ ততদিনে সমুদ্র আইনে কিছু পরিবর্তন এসেছিল। আর সেই পরিবর্তন অনুসারে ব্রিটিশ এলাকার বাইরের বেতার সম্প্রচারগুলো অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
বেটস দখলকৃত এই কৃত্রিম দ্বীপটি ছেড়ে যাননি আর। তিনি এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং একে ‘প্রিন্সিপ্যালিটি অব সিল্যান্ড’ নামের এক সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। এই অবকাঠামোটির অবস্থান আন্তর্জাতিক জলসীমায়। আর পৃথিবীর কোনো দেশেরই এই আন্তর্জাতিক জলসীমার মালিকানা নেই। কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেই এখানে। এ ছাড়া এটি ছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে। ফলে চাইলেও রয়েল নেভি এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।
এরপর কয়েক বছর বেশ শান্তিতেই কেটে যায়। এর মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রুপ ও চোরাকারবারি দল সিল্যান্ড দখল নেয়ার চেষ্টা করলেও রয় বেটস তাদের প্রতিহত করেন এবং তার এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন। ১৯৭৫ সালে সিল্যান্ড থেকে রাজ্যের সংবিধান প্রকাশ করা হয়। ধীরে ধীরে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, ডাক টিকিট, মুদ্রা ও পাসপোর্ট চালু করা হয়। সিল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক ও সিলমোহরের নকশা তৈরি করা হয় সিল্যান্ডের জাতীয় নীতিবাক্য “ঊ গধৎব খরনবৎঃধং” অনুসারে, যার অর্থ, ‘সমুদ্র হতে, স্বাধীনতা।’ ২০১২ সালের অক্টোবরে ৯১ বছর বয়সে বেইটস মারা যান। এর পর থেকে তার ছেলে মাইকেল সিল্যান্ডের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমান কর্তৃপক্ষের দাবি অনুসারে, ২৭ জন মানুষ এখানে বাস করেন। তবে প্রকৃতপক্ষে, এখানে মাত্র ৪ জন স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ইন্টারনেটে সিল্যান্ডের নিজস্ব একটি ওয়েবসাইটও রয়েছে। সেখানে সিল্যান্ডের নানা স্মারক, ডাকটিকিট, মুদ্রা ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। সিল্যান্ডের পাসপোর্ট করে চাইলে ঘুরেও আসতে পারবেন দেশটি থেকে। এই রাষ্ট্রটি বর্তমানে পর্যটন ও বিভিন্ন মিউজিক ভিডিও ধারণের স্থানে পরিণত হয়েছে। পুরো সিল্যান্ডে রয়েছে একটি মাত্র ভবন ও একটি হেলিপ্যাড। পৃথিবীর কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র এখনও সিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে এর বিরোধিতাও করেনি। স্বীকৃতি না দিলেও এটিই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র।

Share.

মন্তব্য করুন