আলফা সেন্টোরি
প্রকৃতিতে আমরা অনেক অদ্ভুত প্রাণীর নাম শুনেছি, যাদের কাউকে দেখেছি আবার কাউকে দেখিনি। তেমনি গ্রিক মিথলজিতে অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ঘোড়ার মত দেখতে প্রাণীটার নাম ছিল সেন্টার! দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশের দিকে চোখ মেললে সেন্টোরাস নামে একটা নক্ষত্রপুঞ্জ দেখা যায়। এইতো কিছুকাল আগের ঘটনা, ১৮০০ বছর আগে জ্যোতির্বিদ টলেমি ৪৮টা নক্ষত্রপুঞ্জ তালিকাভুক্ত করেছিলেন, তার মধ্যে এই সেন্টোরাস নক্ষত্রপুঞ্জও ছিলো।

সেন্টোরাস নক্ষত্রপুঞ্জ
এই নক্ষত্রপুঞ্জে ‘সেন্টারের পা’ এই নামে তিন নক্ষত্রবিশিষ্ট একটা সৌরজগৎ আছে। এটাকে আমরা বলি, আলফা সেন্টোরি। এতে অবস্থিত তিনটা নক্ষত্রের নাম বেশ সোজা- আলফা সেন্টোরি এ, আলফা সেন্টোরি বি, আর আলফা সেন্টোরি সি। শেষের নক্ষত্রটাকে আমরা ডাকি প্রক্সিমা সেন্টোরি। Proxima একটা ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে নিকটতম। অর্থাৎ, সূর্যের পরে এই প্রক্সিমা সেন্টোরিই আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। বাকি দুই সঙ্গীর তুলনায় এটা একটু কম উজ্জ্বল। এটাকে বলে রক্তিম বামন নক্ষত্র (Red Dwarf Star); এমন নক্ষত্রের সংখ্যাই কিন্তু মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
বাকি দু’টো (আলফা সেন্টোরি এ আর বি) নক্ষত্রকে খালি চোখে আলাদা করে দেখা যায় না। অর্থাৎ, খালি চোখে মনে হয় যে ওখানে নক্ষত্র একটাই। আলফা সেন্টোরিতে আমাদের সূর্যের তুলনায় দেড়গুণ বেশি উজ্জ্বল। সিরিয়াস আর ক্যানোপাসের পরে আকাশের তৃতীয় উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এই আলফা সেন্টোরি।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মাত্র ৯৩ মিলিয়ন মাইল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছুতে ৮ মিনিটের কিছু বেশি সময় লাগে। প্রক্সিমা সেন্টোরি থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৪.২৫ বছর। দূরত্বটা তাই আর মাইলে হিসাব করা হয় না, বলা হয় ৪.২৫ আলোকবর্ষ। বাকি দুটো সামান্য একটু দূরে, পৃথিবী থেকে ৪.৩৭ আলোকবর্ষ। আর এই সোয়া চার আলোকবর্ষ দূরের সৌরজগতেই মহাকাশযান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন Breakthrough Starshot প্রকল্প।

ব্রেকথ্রু স্টারশট প্রকল্প
রাশিয়ান পদার্থবিদ ও ব্যবসায়ী ইউরি মিলনার আর জুলিয়া মিলনার মিলে মহাকাশ গবেষণা ব্রেকথ্রু ইনিশিয়েটিভ নামক একটি সংস্থা স্থাপন করেছিলেন ২০১৫ সালে। এই মুহূর্তে তার অধীনে তিনটা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে 1) Listen, 2) Message, 3) Starshot. প্রথম প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১০০ মিলিয়ন ডলার, যার কাজ হচ্ছে মহাকাশ থেকে কোনো বার্তা আসছে কি না তা শোনা। দ্বিতীয় প্রকল্পে ওরা একটা প্রতিযোগিতা করছে, যার পুরস্কার ১ মিলিয়ন ডলার। জেতার জন্য একটা বার্তা তৈরি করতে হবে যাতে পৃথিবী, এখানকার মানুষ, আর সংস্কৃতি নিয়ে কথা থাকবে; এটা পাঠানো হবে মহাকাশের উদ্দেশ্যে। আর তৃতীয় প্রকল্প কাজ করবে নিকটতম নক্ষত্রে মহাকাশযান পাঠানোর জন্য।
নিউ ইয়র্কের ওয়ান ওয়ার্ল্ড পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্টিফেন হকিং আর ইউরি মিলনার ২০১৬ সালের এপ্রিলের ১২ তারিখে ব্রেকথ্রু স্টারশটের ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রকল্পে অল্প ওজনের একটা মহাকাশযান তৈরি করা হবে। এর ওজন হতে পারে এক গ্রাম। আর এটার সাথে লাগানো থাকবে lightsail. Lightsail মূূলত আলোর ধাক্কায় চলে। এটার অসাধারণ একটা ইতিহাস রয়েছে। খুব সংক্ষেপে বলি, আলো হচ্ছে শক্তির প্যাকেট দিয়ে তৈরি, যেটাকে বলে ফোটন। ফোটনের কোনো ভর নেই। কিন্তু যখন সেটা প্যাকেটের মধ্যে ভ্রমণ করে, তখন তার শক্তি থাকে, আর থাকে ভরবেগ (আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্য যে ফোটনে ভর নেই তবুও ভরবেগ আছে এটা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা অংশ থেকে প্রমাণ করা যায়)। এই ফোটন যদি কোনো প্রতিফলকের গায়ে এসে পড়ে, তখন এটা সামান্য পরিমাণ ধাক্কা দেয়। ধাক্কাটা খুব সামান্য, কিন্তু একবার ধাক্কা শুরু হলে আর কোনো থামাথামি নাই। এটা ধাক্কা দিতেই থাকে। ব্রেকথ্রু এর ছোট্টো মহাকাশযান বা ন্যানোক্রাফটকে ধাক্কা দেবে পৃথিবীর মাটিতে বসানো একটা আলোকরশ্মির উৎস।

এই ন্যানোক্রাফটের গতি হবে আলোর গতির প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ বা এক-পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে আলফা সেন্টোরিতে যেতে আলোর যেহেতু ৪ বছর লাগে, এই ন্যানোক্রাফটের লাগবে ৫ গুণ বেশি সময় প্রায় ২০ বছর। সফল হলে, উৎক্ষেপণের ২৪ বছর পর আমরা আরেকটা সৌরজগতের চোখধাঁধানো ছবি পাবো। ২৪ বছর কেন? এইমাত্র না বললাম, ২০ বছর লাগবে! ঠিক ধরেছেন, ন্যানোক্রাফট ২০ বছরে পৌঁছে যাবে। এরপর আলোর গতিতে ছবিগুলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে আরো ৪ বছর লেগে যাবে।
কী অসাধারণ উত্তেজনার ব্যাপার! প্রথম উড়োজাহাজ তৈরির পর ১০০ বছরের কিছু বেশি সময় পেরিয়েছে। আর এর মধ্যেই আমরা স্বপ্ন দেখছি অন্য নক্ষত্রে যাওয়ার। এর আগে পাইওনিয়ার, ভয়েজার এবং নিউ হরাইজনস মহাকাশযানগুলো আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু ওরা নিকটতম নক্ষত্রের দিকে যাচ্ছে না, ব্রেকথ্রু এর গন্তব্য আবার সেদিকেই।
কিছুক্ষণ পরে মাথায় এলো যদি এই মহামারীতে কিছুদিনের জন্য অতীতে যেতে পারতাম তাহলে কতোই না ভালো হতো। এই রকম চিন্তা-ভাবনা অনেকেরই মাথায় এসেছে। সময় ভ্রমণ নিয়ে আমাদের কল্পনা কম নয়। মাত্র কয়েকশ কোটি ন্যানো সেকেন্ড আগের চিন্তা-ধারা। এই ধারণাটাই আমাদের গায়ের লোম খাড়া করে দেয়। এই সময় ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করার মত অনেক দিক আছে। তবে এখন আমরা কোনো রকম কিছু আলোচনা করব না। আলোচনা না করে চলুন একটু দেখে আসি টাইম ট্র্যাভেল ব্যাপারটা কী রকম? আনন্দের নাকি দুঃখের?
সম্ভব কিনা, সম্ভব হলে কোন দিকে (অতীতে নাকি ভবিষ্যতে) বা কিভাবে ইত্যাদি। আমরা এখনো সময় ভ্রমণ সম্ভব করতে পারিনি। তবে এটা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত কল্পনা করতে পারছি ঠিকই। আসুন, ঠিক তেমন কিছু দিক নিয়ে আমরা আলোচনা না করে একটু জেনে নিই।

পিতামহ স্ববিরোধ (Grandfather Paradox)
স্টিফেন হকিং একবার বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ থেকে যদি কোনো আগন্তুক এসে থাকে, তবে তারা এখন কোথায়? হ্যাঁ, হকিং সময় ভ্রমণের কথাই বলেছেন, তবে একটু ভিন্নভাবে। ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ থেকে আমাদের সময়ে আসার কথা বলা হচ্ছে, কারণ ভবিষ্যতের মানুষ টাইম মেশিন আবিষ্কার করে ফেলতেও পারে। অতীতে যে সেরকম কিছু হয়নি সেটা আমরা বেশ ভালোই জানি। তাই অতীতের মানুষগুলোর এখন তথা আমাদের এই সময়ে ভ্রমণ করতে আসার সম্ভাবনা পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া যায়। তবে বিজ্ঞানীরা কিন্তু অতীতের তুলনায় ভবিষ্যতে যাওয়ার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেন। তার একটি কারণ হচ্ছে পিতামহ স্ববিরোধ। এই স্ববিরোধে বলা হচ্ছে, কেউ যদি অতীতে গিয়ে তার পিতা জন্মাবার আগেই পিতামহকে হত্যা করে, তবে তো সব হিসাব-নিকাশই ওলটপালট হয়ে যাবে (যেন বীজ ছাড়া উদ্ভিদের জন্ম)। বাবার বংশগতির ধারক সেই কেউ একজন তাহলে পৃথিবীতে এলো কিভাবে?
পিতামহ স্ববিরোধ আসলে কোনো সমস্যাই না, যদি মহাবিশ্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাগুলোকে পূর্বনির্ধারিত ও অপরিবর্তনশীল ধরা হয়। বিষয়টিকে একটু বুঝিয়ে বলা যাক।
দেড় ঘণ্টার একটি সিনেমার কথাই ধরুন (এতো কিছু থাকতে এই সিনেমাকে বেছে নিতে হলো, কি আর করার আছে)। আপনি সিনেমাটি দেখুন আর না-ই দেখুন, সিনেমার দৃশ্যের কোথাও কোনো পরিবর্তন হবে না। ধারণ করার পর যেভাবে চূড়ান্ত সম্পাদনা করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই থাকবে। অর্থাৎ আপনি কোনোভাবেই সিনেমার ওপর আপনার নিজের প্রভাব খাটাতে পারবেন না।
সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি অতীতে গিয়েও অবশ্যম্ভাবী কোনো ঘটনাকে পরিবর্তন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না। যা ঘটার, তা ঘটবেই। আপনি হয়তো অতীতে গিয়ে আপনার পিতামহের সাথে কোনো এক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লেন এবং আপনার পকেটে রাখা রিভলবারটি বের করে ট্রিগারও চাপলেন। কিন্তু হয়তো দেখা যাবে, রিভলবারের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছে অথবা কোনো এক অজানা কারণে রিভলবারটি ঠিকমতো কাজ করছে না। অর্থাৎ আপনার পিতামহকে বাঁচানোর সকল বন্দোবস্ত যেন আগে থেকেই হয়ে রয়েছে!

আলোর চেয়ে বেশি বেগে ছোটার মাধ্যমে সময় ভ্রমণ
তা ছাড়া আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে আলোর বেগ একটি সীমা নির্দেশ করে, যে সীমানাটাকে অতিক্রম করতে পারলে হয়তো সময়ের পেছনের দিকে যাওয়া সম্ভবপর হতে পারে। কিন্তু আজ অবধি সে রকম কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি। আবার বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বেরই আরেকটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে ভ্রমণ করে যদি ভ্রমণকারীর সময়ের গতিকে ধীর করে দেয়া যায়। ফলে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে সোজা মহাকাশের দিকে নভোযানকে চালিত করে যদি পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসা যায়, তবে পৃথিবীতে অতি অগ্রসরমান এক জীবনব্যবস্থা দেখা যেতে পারে। নভোচারীর সম্পূর্ণ ভ্রমণের সময়কাল তার নিজের ঘড়ি অনুযায়ী যদি কয়েক দশক হয়, তবে পৃথিবীতে হয়তো শত বছর পার হয়ে যাবে। নভোচারী তার মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় পৃথিবীতে ফিরে তার রেখে যাওয়া সমাজব্যবস্থাকেই আশা করবে, যদিও সে দেখবে অন্য এক পৃথিবীকে। এটাকে ‘ভবিষ্যতে গমন’ ছাড়া আর কি-ই বা বলা যেতে পারে?

মহাকর্ষের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ
সময়ের সাথে মহাকর্ষের একটা দড়ি টানাটানির মতো সম্পর্ক। মহাকর্ষ যত বেশি, সময় তত ধীরে চলবে। আর মহাকর্ষ কম হলে সময় চলবে অপেক্ষাকৃত দ্রুত। তাই, কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি কোনো জায়গায়, যেখানে মহাকর্ষ অনেক বেশি, সেখানে অবস্থান করলে দেখবেন পৃথিবীর চেয়ে আপনার সময় অনেক ধীরে কেটেছে। ধরুন, আপনার কাছে মনে হচ্ছে একদিন পেরিয়েছে। ওদিকে পৃথিবীতে চলে গেছে শত বছর। অর্থাৎ, কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি গিয়েও সময় ভ্রমণের অনুরূপ অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব। এটা মূলত মহাকর্ষজনিত সময় প্রসারণের ফল।

সমান্তরাল মহাবিশ্বে ভ্রমণের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ
চিরায়ত পদার্থবিদ্যা এমন যে, কিছু সূত্র, স্বীকার্য আর গাণিতিক নিয়মের অধীনে কোনো একটি ঘটনার পরের পদক্ষেপ কী হবে, অথবা ঘটনার পূর্বের অবস্থাটি কী ছিলো, সেটা নিশ্চিতভাবে বলে দেয়া যায়। অর্থাৎ চিরায়ত পদার্থবিদ্যার জগৎ হচ্ছে নিশ্চয়তার জগৎ।
আমাদের শরীর অসংখ্য কণার সমষ্টি। চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুসারে এসকল কণার প্রতিটি চলাচলও পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুসারে পূর্বনির্ধারিত। ফলে আমাদের নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছাকেও অনেক সময় জলাঞ্জলি দিতে হয়। অপরদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্বে, বিশেষ করে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি প্রকাশিত হওয়ার পর প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখানে প্রকৃতি এবং পর্যবেক্ষক উভয়ই একটি সিস্টেমের অংশ এবং এদেরকে আলাদা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। ফলে পূর্বনির্ধারণ বা কঠোরভাবে অপরিবর্তনশীলতার কোনো সুযোগ এখানে নেই।
কোয়ান্টাম তত্ত্বানুসারে বহু মহাবিশ্বের (Multi universe) সম্ভাবনাকে পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া যায় না। বহু মহাবিশ্বের ধারণা থেকেও অতীত ভ্রমণের যৌক্তিকতা তুলে ধরা যায়। এক্ষেত্রে আপনি অতীতে গেলেন এবং আপনার পিতামহকে হত্যাও করলেন কোনো সমস্যা নেই। তবে ঘটনাটি ঘটবে কোনো এক সমান্তরাল মহাবিশ্বে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনাকে শুধু সময় ভ্রমণ করলেই চলবে না, স্থানকেও অতিক্রম করতে হবে। আপনি অন্য একটি মহাবিশ্বে গিয়ে আপনার পিতামহের দর্পণ প্রতিবিম্বকে হত্যা করলে আপনার পিতার মাধ্যমে সেই মহাবিশ্বে আপনার জন্ম হবে না। তবে সেখানেও আপনার অস্তিত্ব থাকবে ভবিষ্যৎ থেকে আগত এক ঘাতক হিসেবে, যিনি অমুক নামের এক লোককে হত্যা করেছেন।

স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়া সিলিন্ডারের সাহায্যে সময় ভ্রমণ
১৯৩৭ সালে স্কটিশ পদার্থবিদ ভ্যান স্টকাস টাইম মেশিন সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে ব্যবহার করেন। তিনি ঘনত্বপূর্ণ ও অসীম দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ঘূর্ণায়মান (এর মূল অক্ষ সাপেক্ষে) সিলিন্ডার কল্পনা করেছিলেন, যেটা ঘূর্ণনের সাথে এর আশপাশের স্থান-কালকেও এর সাথে ঘুরতে বাধ্য করবে। ঐ ঘূর্ণায়মান কালের মধ্যে প্রবেশ করে অতীতে চলে যাওয়া সম্ভব। স্টকাসের মতে, এভাবে যাত্রা শুরুর আগেই যাত্রা শুরুর পূর্বের সময়ে চলে যাওয়া সম্ভব হবে। চিন্তাটি ছিলো কাল্পনিক, যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক।

কীটগহ্বর (Worm Hole) এর মাধ্যমে সময় ভ্রমণ
সময় ভ্রমণের আরো একটি তাত্ত্বিক সম্ভাবনা হচ্ছে ওয়ার্মহোল বা কীটগহ্বর। ওয়ার্মহোল হচ্ছে অতি অল্প সময়ে মহাজাগতিক দূরত্ব অতিক্রম করার এক তাত্ত্বিক সম্ভাবনা, যেটার কথা আইনস্টাইন ও নাথান রোজেন ১৯৩৫ সালে প্রথম বলেন, এবং যেটা পরিচিত ছিলো আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ নামে।

পঞ্চাশের দশকে বিশিষ্ট পদার্থবিদ জন হুইলার ওয়ার্মহোল নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন এবং ‘ওয়ার্মহোল’ শব্দটির উৎপত্তি ঘটান। ওয়ার্মহোলকে যদিও আমরা মহাকাশ ভ্রমণের সংক্ষিপ্ততম পথ বলেই জানি, তবুও কিপ থর্নের গবেষণার মাধ্যমে সময় ভ্রমণের বিষয়টিও উঠে আসে। কার্ল সেগান তার ‘কন্ট্যাক্ট’ বইয়ের কাজ করার সময় লেখার প্রয়োজনেই বন্ধু কিপ থর্নের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ওয়ার্মহোল নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা করার অনুরোধ করেন। তখন আইনস্টাইনের তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ যে কয়জন বিজ্ঞানী ছিলেন, কিপ থর্ন ছিলেন তাদের একজন। সেগানের অনুরোধে থর্ন ওয়ার্মহোল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য বের করে আনতে সক্ষম হন। তবে এই ওয়ার্মহোল ঠিক আমরা যেরকম চিন্তা করি সেরকম অর্থাৎ এর প্রবেশমুখ ও বহির্মুখ পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির হলে চলবে না।

ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ
কেননা এক্ষেত্রে সময় একই হারে চলবে। কিন্তু যদি বহির্মুখ সাপেক্ষে প্রবেশমুখকে গতিশীল করা যায় (এবং এতে একটি সময় পার্থক্য তৈরি হবে) তবে সময় ভ্রমণ সম্ভব হতে পারে। ওয়ার্মহোল একটি তাত্ত্বিক বিষয়। বাস্তবে যদি ওয়ার্মহোল থাকেও, তবুও কোয়ান্টাম অস্থিরতার জন্য সেটা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। কিপ থর্নসহ অনেক বিজ্ঞানী ওয়ার্মহোলের স্থিতি প্রদানের জন্য উত্তেজক পদার্থের কথা বলেন, যেগুলোর ঋণাত্মক শক্তি থাকায় মহাকর্ষ বিরোধী ক্রিয়াও আছে। হিসাব করে দেখা গেছে, ১ মিটার চওড়া একটি ওয়ার্মহোলকে স্থির রাখার জন্য সূর্যের ১০ বিলিয়ন বছরেরও অধিক সময়ে উৎপাদিত শক্তির সমান ঋণাত্মক শক্তির জোগান দিতে হবে!

উপরের চিন্তা ধারাগুলো আপনাদের কাছে বাস্তবতাবর্জিত কল্পকাহিনী মনে হতে পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কেননা, সময় ভ্রমণ করার মতো প্রযুক্তির আশপাশে আমরা এখনও পৌঁছুতে পারিনি। তবে আমরা যখন সময় ভ্রমণ নিয়ে কথা বলি, তখন মূলত সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সামনে রেখেই সেটা বলে থাকি। ফলে সময় ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনা বিজ্ঞানের বাইরের কোনো বিষয় নয়। সময়কে যেহেতু বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা গেছে সেহেতু সময় ভ্রমণ বিষয়টাও আপনা আপনিই বিজ্ঞানের আওতায় চলে আসে।
সময় ভ্রমণ আদৌ সম্ভবপর হবে কিনা অথবা হলেও কবে হবে, সেটা আমাদের পক্ষে এখনই জানা সম্ভব নয়। তবে সময় ভ্রমণ তত্ত্বীয় বিজ্ঞানের অংশ হওয়ায়, এটা নিয়ে গবেষণা অব্যাহত থাকবে। সুদূর ভবিষ্যৎ থেকে হয়তো কোনো আগন্তুক নিভৃতে অতীত ভ্রমণে এসেছিলেনও, তবে সেটা আমাদের সময়ে নয়, আরো বহু বহু পূর্বের কোনো এক সময়ে, যার কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
উৎস: জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞান, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, বিভিন্ন উইকিপিডিয়া ইত্যাদি।

Share.

মন্তব্য করুন