বহুকাল আগের কথা। রাশিয়ায় বাস করতেন অত্যন্ত ধনী এক ব্যক্তি। ভাগ্যগুণে অল্প বয়সেই তিনি বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। কিন্তু সে জন্য তার মনে কোনো অহংকার ছিল না। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। বিয়ের কয়েক বছর পর তার প্রথম সন্তান জন্ম নিল। সন্তান মায়ের কোলে যেদিন এল, তার আগের রাতে ভালো মানুষটি একটি স্বপ্ন দেখলেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে তার ছেলে সন্তান হবে। কিন্তু স্বপ্নেই এক মারাত্মক হঁশিয়ারি পেলেন। বারো বছর বয়সের মধ্যে ছেলের পা যদি মেঝে বা মাটি স্পর্শ করে তাহলে মৃত্যু হবে তার। তবে এ বয়স পেরিয়ে গেলে আর বিপদ হবে না তার। স্ত্রীসহ সবাইকে সে কথা জানিয়ে দিলেন তিনি।
ছেলে জন্ম নেয়ার পর সে যাতে সব সময় উঁচুতে থাকে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হল। অর্থাৎ সে যেখানেই থাক, সে স্থানটি হবে মাটি থেকে উঁচুতে। সবার সদা সতর্ক নজরদারির মধ্যে শিশুটি বড় হতে থাকল। বাড়ির সকল কাজের লোক, প্রহরী সবাই খেয়াল রাখে যেন কোনো সময়ই সে তার পা মেঝেতে না রাখে। সে বসবে , দাঁড়াবে সবই খাটের ওপর। কোথাও তাকে নিতে হলে কাঁধে করে বা কোনো চেয়ারে বসিয়ে নেয়া হয়। তাই কোনো ভাবেই তার পা মাটিতে পড়ার উপায় নেই।
অবশেষে ছেলেটির ১২ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন এগিয়ে এল। ধনী ব্যক্তির বাড়িটি রাজপ্রাসাদের মত বড়। সারাবাড়িতে সাজ সাজ রব। দিনটির নাম দেয়া হয়েছে উৎসবের দিন। সব প্রস্তুতিই প্রায় শেষ। আগামী কালই সে দিন। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। ছেলেটি অন্যান্য দিনের মতই জানালায় বসে যতটা দেখা যায়, সব তাকিয়ে দেখছিল। বাইরে থেকে তখনো নানা রকম ফলসহ খাবার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে লোক আসছিল। আরো আসছিল উৎসবে যোগ দিতে অতিথিরা।
হঠাৎ ভীষণ এক আওয়াজ হল। এত প্রচন্ড আওয়াজ আগে কেউ কখনো শোনেনি। ছেলেটিকে দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল একজন পরিচারিকা। সে আওয়াজে এমন ভীত হয়ে পড়ল সে যে ছেলেটিকে ফেলে রেখে অন্যদিকে দৌড় দিল। এদিকে হতচকিত ছেলেটিও পরিচারিকা মেয়েটি নেই দেখে লাফিয়ে নামে মেঝেতে। ওদিকে পরিচারিকা ঘর থেকে বেরনোর পরই তার হুঁশ ফিরে আসে- করেছে কি সে! ছেলেটিকে একলা ফেলে এসেছে। সাথে সাথে সে দৌড়ে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু তাকে দেখতে পেল না। ছেলেটি ঘরে নেই।
ভয়ে চিৎকার শুরু করে পরিচারিকা। মুহূর্তের মধ্যে চাকর-বাকররা সব ছুটে আসে। দৌড়ে আসেন বাবাও। পরিচারিকা তখনো চিৎকার করে চলেছে। তাকে ধমক দেন তিনি-
ঃ এই থাম, কি হয়েছে? আমার ছেলে কোথায়?
পরিচারিকা কাঁপা গলায় সব জানায়। সে সত্য কথাই বলে যে হঠাৎ ভীষণ আওয়াজে সে ভয় পেয়ে ঘর থেকে ছুটে পালায়। কিন্তু বাইরে গিয়ে ছেলেটির কথা মনে হতেই সে দৌড়ে ফিরে আসে। কিন্ত তাকে আর পায়নি। সে ধনীব্যক্তির পা জড়িয়ে ধরে বলে-
ঃ ভুল হয়ে গেছে মনিব, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর এ রকম হবে না।
বাবার বুকটা তখন সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। অচিরেই পাগল হওয়ার দশা হল তার। চিৎকার করে বাড়ির সব লোককে ছেলেকে খুঁজতে পাঠালেন চারদিকে। তাতেই থেমে থাকলেন না। বাড়ির বাইরে পথে এসে দাঁড়ালেন তিনি। যাকে দেখলেন , তারই হাত ধরে মিনতি করলেন তার ছেলেকে খুঁজে এনে দিতে। বললেন, যে ছেলেকে এনে দিতে পারবে সে যা চাইবে তা দিয়ে দেবেন। তার কান্না ও কাকুতি-মিনতি দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না কেউ।
চাকর-বাকরসহ কত যে মানুষ ছেলেটিকে খুঁজল। কেউ মনিবের দুঃখে ব্যথিত হয়ে, কেউ তার মন জয় করতে, কেউ তার কাছ থেকে বড় রকম কিছু পাওয়ার আশায়। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মিলল না। কেউই বলতে পারল না সে কোথায়। ছেলেটি নেই, যেন সে ছিলই না কোনো দিন।
কতদিন সকালে নতুন সূর্য উঠল, কত রাতে চাঁদের আলোয় আকাশ ভাসল। ছেলেটি আর ফিরল না।
কয়েক বছর কেটে গেছে। ছেলে ফিরে আসবে সে আশায় এখনো পথ চেয়ে বসে থাকেন মানুষটি। তার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার অবস্থা। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করে না তার।
এর মধ্যে একটা নতুন বিষয় দেখা দিল। ছেলে যে ঘরটিতে থাকত সেটি ছিল ধনী ব্যক্তির প্রাসাদোপম বাড়িটির সবচাইতে সুন্দর ঘর। কিছুদিন থেকেই মধ্য রাত হওয়ার সাথে সাথে প্রাসাদে একটি পায়ের শব্দ শোনা যায়। যেন কেউ এগিয়ে আসছে ঘরটির দিকে। কিন্তু তারপর কি হয়, কেউ জানে না।
ধনী ব্যক্তিটির খুবই জানতে ইচ্ছে করে এ কি তার ছেলে? সে কি তার ঘরে আসে? এসে কি করে? তিনি তা জানার জন্য রাতে ছেলের ঘরে থাকতে চান। কিন্তু তার শরীরের যে অবস্থা, তার ছেলে যদি সত্যিই ঘরে না আসে সে আঘাত বা কোনো উত্তেজনাই তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয় বলে তিনি থাকতে পারেন না।
তিনি চারদিকে খবর ছড়িয়ে দিলেন। কেউ যদি এসে তার ছেলের ঘরে সারা রাত কাটাতে পারে তবে তাকে তিনশ’ স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেয়া হবে। এতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে এল, কিন্তু মধ্যরাতের পর কেউ আর সে ঘরে রাত কাটাতে পারল না। যেই ঘড়িতে মধ্যরাতের ঘন্টা বাজে তার পরই পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। সে আওয়াজ ঘরের কাছে আসার পর আর কেউ ভয়ে সেখানে থাকে না, পড়িমরি করে ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে প্রাসাদ ছেড়ে পালায়। বহুবারই এ ঘটনা ঘটল।
ধনী ব্যক্তির বাড়ির কাছেই এ বিধবা মহিলার বাড়ি। তিনি ছিলেন খুব দরিদ্র। তার তিন মেয়ে। সত্যি বলতে কি, ভালো খাবার জুটত না তাদের। পুরস্কার এবং কারোরই সে ঘরে না টিকতে পারার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তা শুনে একদিন সবারবড় বোন সদ্য তরুণী ও অপূর্ব সুন্দরী দনিয়া কি যেন ভাবল। মেয়ে হলেও বেশ সাহসিনী সে। ছোট দু বোনকে ডেকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল। তারপর ডাকল তাদের মাকে। দনিয়া বলল-
ঃ মা শুনেছ তো ঐ ধনী ব্যক্তির বাড়ির ঘটনা। আমরা তো গরিব। আমাদের হারানোর কিছু নেই। তাহলে একটা চেষ্টা করে দেখি না কেন? শোনো মা, তুমি যদি অনুমতি দাও আমি ঐ ঘরে এক রাত থাকতে চাই। যদি তিনশ’ স্বর্ণমুদ্রা পেয়েই যাই, বেশ কিছুদিন ভালোভাবেই চলে যাবে আমাদের।
কোনো মা কি এ রকম কাজে অনুমতি সন্তানকে যেতে দেন? তারপর আবার মেয়ে। বিধবা মহিলাও দিলেন না। কিন্তু দনিয়া অনেক বোঝানোর পর রাজি হলেন তিনি। বললেন-
ঃ তোমাদের বাবা নেই। এদিকে সংসারে খাবারও জোটে না ঠিকমত। ঠিক আছে, দেখ তুমি চেষ্টা করে। তবে যদি ভয় পাও, তাহলে এক মুহূর্ত দেরী করবে না, বেরিয়ে আসবে ওই ঘর থেকে। এর যেন কোনো অন্যথা না হয়।
মেয়ে কথা দিল মাকে যে এ রকম কিছু হলে চলে আসবে সে। তারপর সন্ধ্যায় গিয়ে সে হাজির হল ধনী ব্যক্তির বাড়িতে।
ভালো মানুষটি তার কথা শুনে বিস্মিত হলেন। বুঝলেন যে অনেক দুঃখে পড়েই সে এ কাজ করতে এসেছে। বললেন-
ঃ দেখ মা! অনেক ছেলে এ কাজ করতে এসে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। তুমি মেয়ে, তুমি কি পারবে? তোমার কি ভূতের ভয় নেই?
দনিয়া বলল-
ঃ দেখুন, আমি জোর করে কিছু বলতে পারব না। তবে চেষ্টা করব। এখন আপনি আমার রাতের খাবার রান্না করার জন্য কিছু জিনিসপত্র দিন।
ভালো মানুষটি তার খাবার রান্নার জন্য প্রচুর পরিমাণে সব জিনিসপত্র দিলেন। দনিয়া সে সব নিয়ে তার ছেলের ঘরে ঢুকল। আগে ঘরটাকে নিজের থাকার মত করে গোছালো সে। একটা টেবিল আনিয়ে রাখল ঘরের মাঝখানে। তারপর রান্না করতে বসল। তার ক্ষিদেও পেয়েছিল খুব। তাই রান্না শেষ হতেই সব খাবার রাখল টেবিলের ওপর। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। তাই ঘর গরম রাখতে আগুন জ¦ালে ফায়ার প্লেসে।এদিকে সময় দ্রুত এগিয়ে রাত বারোটা হয়ে গেছে তা সে বুঝতেই পারেনি। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার ঘন্টাধ্বনি হল। তখনি শোনা গেল সেই পায়ের শব্দ। মুখে যাই বলুক, এতক্ষণে ভয় এসে ঘিরে ধরে দনিয়াকে। ভয়ে ভয়ে সারা ঘর তাকিয়ে দেখে সে। না, কেউ নেই। কিন্তু আশ্চর্য যে পায়ের শব্দ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। একি ব্যাপার! ভয়ে গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার।
হঠাৎ ভারি সুন্দর চেহারার অত্যন্ত সবল ও স্বাস্থ্যবানএক তরুণকে ঘরে দেখতে পায় সে। তরুণটি তার কাছে এগিয়ে আসে। টেবিলে রাখা খবার তাকিয়ে দেখে সে। জিজ্ঞেস করে-
ঃ কার জন্য এ খাবার রান্না করেছ?
দনিয়া বুঝতে এই সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলে। ভয়ে মুখ থেকে কথা সরতে চায় না তার। সে অবস্থায়ই তোতলাতে তোতলাতে কোনো রকমে বলে-
ঃ আমার জন্য।
তরুণটির সুন্দর মুখটিতে দুঃখের ছাপ ফোটে। তারপর বলে-
ঃ এ টেবিল পেতেছ কার জন্য?
এক মুহূর্ত পর দনিয়া বলে-
ঃ আমার জন্য।
তরুণের সুন্দর চোখ দুটি পানিতে ভরে ওঠে। কিন্তু তারপরও সে জিজ্ঞেস করে-
ঃ আর এই যে আগুন, কার জন্য জে¦লেছ?
দনিয়া আবারও বলে-
ঃ আমার জন্য, শুধু আমার জন্য।
ছেলেটির দু চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। দনিয়ার দিকে হাত নাড়ে সে, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। পাথরের মূর্তির মত বসে থাকে দনিয়া।
পরদিন সকালে ভালো মানুষটিকে রাতের ঘটনা খুলে বলে দনিয়া। কিন্তু তরুণটির মুখে যে দুঃখের ছায়া দেখেছে এবং তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ার কথা সে বলতে পারল না। ছেলের দেখা পাওয়া গেছে এটা জেনেই খুশি হয়ে যান তিনি। ছেলেকে কাছে না পেলেও দনিয়ার হাতে তিন শ’ স্বর্ণ মুদ্রা তুলে দেন তিনি। বাড়ি চলে আসে দনিয়া।
বড় বোনের কাছে রাতের ঘটনা শোনে সবাই। দ্বিতীয় বোন তানিয়া সব শুনে সিদ্ধান্ত নেয় যে আজ রাতে সে ছেলেটির ঘরে থাকবে। যদি আরো তিন শ’ স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া যায় তাহলে তাদের খুব উপকার হবে। আরো কিছুদিন ভালো ভাবে চলে যাবে তাদের। ভালো মানুষটির কাছে হাজির হয় সে। বলে-
ঃ আমার বড় বোন আপনার ছেলের ঘরে রাতে ছিল। তার কাছে সব শুনেছি। আপনি অনুমতি দিলে আমি আজ রাতে ওই ঘরে থাকতে চাই।
ভালো মানুষটি কি মনে করে রাজি হয়ে যান। তার রাত কাটানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই দেয়া হল তাক্
েতানিয়া ঘরটিতে গিয়ে নিজের মত করে সব গুছিয়ে নেয়। একটু রাত হওয়ার পর চুলা ধরিয়ে রান্না করতে বসে সে। মাঝরাত হয়ে গেল। ফায়ার প্লেসে আগুন জ¦ালে সে। রাত বারোটার ঘন্টা বাজে ঘড়িতে। পায়ের আওয়াজ শোনা যায় বাইরে। একটু পরই তরুণটিকে ঘরের মধ্যে দেখতে পায় তানিয়া। দনিয়ার মতই তানিয়াকেও পরপর তিনটি প্রশ্ন করে ছেলেটি। কার জন্য খাবার রান্না করেছ? টেবিল পেতেছ কার জন্য? কার জন্য আগুন জে¦লেছ?
দনিয়া যে উত্তর দিয়েছিল, তানিয়াও সেই একই উত্তর দিল-
ঃ আমার জন্য, শুধু আমার জন্য।
আগের মতই ছেলেটির মুখে ব্যথার ছাপ দেখা গেল, চোখ পানিতে ভরে উঠল, তারপর অশ্রু গড়িয়ে নামল। তানিয়ার উদ্দেশে হাত নাড়ল, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
সকালে ভালো মানুষটির কাছে গিয়ে সব জানাল তানিয়া। কিন্তু বড় বোনের মত সেও ছেলেটির মুখে দুঃখের ছাপ পড়া ও চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার কথা বলল না। ভালো মানুষটি তাকে তিন শ’ স্বর্ণমুদ্রা দিলেন। বাড়ি ফিরে আসে সে।
তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট জিনিয়া। কিশোরী মেয়েটি বড় দু বোনের কাছে সব শুনে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতে সে ওই ছেলেটির ঘরে থাকবে। সন্ধ্যার আগেই ভালো মানুষের সাথে দেখা করে। বলে-
ঃ আমার বড় দু বোনের কাছে সব শুনেছি। আপনি অনুমতি দিলে আমি আজ রাতে আপনার ছেলের ঘরে থাকতে চাই।
ছেলেটির আরো কোনো খবর পাওয়া যাবে ভেবে ভালো মানুষটি তাকে রাতে ছেলের ঘরে থাকার অনুমতি দিলেন।
জিনিয়া প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে সে ঘরে ঢোকে। নিজের মত করে গুছিয়ে নেয়ঘরটি। ফায়ার প্লেসের পাশে একটি আরামদায়ক চেয়ার আছে। তবুও একটি রকিং চেয়ার আনিয়ে নেয় সে। তারপর চুলা ধরিয়ে রান্না করতে বসে। মনের ভেতর ভাবনা চলছে কখন রাত বারোটা বাজবে, তখন ছেলেটি আসবে। রান্না করা খাবার টেবিলে রেখে রকিং চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে।
রাত বারোটা বাজে, ঘ্টাধ্বনি হয় ঘড়িতে। পায়ের শব্দ শোনা যায় বাইরে। তারপর হঠাৎ করেই ঘরের ভেতর দেখা যায় তরুণকে। টেবিলের দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করে সে-
ঃ কার জন্য খাবার তৈরি করেছ?
বোনেরা তাকে বলে দিয়েছিল কি বলতে হবে, মানে তারা যা বলেছিল সেও যেন তাই বলে। কিন্তু জিনিয়া যখন ছেলেটির ব্যথাভরা মুখটার দিকে চাইল, তার মুখ দিয়ে কথা সরল না। চুপ করে রইল সে।
ছেলেটি আবার তাকে একই প্রশ্ন করে। এবার জিনিয়া তোতলাতে তোতলাতে বলে-
ঃ আমার জন্য রান্না করেছি, তবে আপনি আমার সাথে খেতে বসলে খুশি হব। আসুন, খেতে বসুন।
ছেলেটির মুখ থেকে ব্যথার ছাপটি মিলিয়ে যায়। কোমল হয়ে ওঠে তার চেহারা।
ঃ আর এই টেবিল? এটা কার জন্য পেতেছ?
ঃ আমার জন্য। তারপর খুব আন্তরিক ভাবে বলে, যদি আপনি আমার সাথে টেবিলে খেতে বসেন তাহলে নিজেকে সম্মানিত মনে করব।
মিষ্টি হাসিতে ছেলেটির মুখ ভরে ওঠে। বলে-
ঃ আর এই আগুন? কার জন্য জে¦লেছ?
ঃ আমার জন্য, কিন্তু আপনি যদি আমার সাথে এসে বসেন ও আগুনের উষ্ণতা নেন, তাহলে আমার ভালো লাগবে।
তরুণটি খুশিতে হাত তালি দেয়-
ঃ কি যে ভালো আপনি! আমি খুিশ হয়ে আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। কিন্তু দয়া করে আমার জন্য একটু অপেক্ষা করুন। আমাকে বাইরে যেতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে যে সব দয়ালু বন্ধু আমার দেখাশোনা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে আসি।
সে মুহূর্তে ঘরের দেয়ালে একটি ছোট্ট দরজার সৃষ্টি হয়। ছেলেঠি সোজা সে দরজা দিয়ে বাইরে চলে যায়, যেন পাশের কোনো ঘরে যাচ্ছে সে। ভীষণ কৌতূহলজাগে জিনিয়ার মনে। কোথায় যাচ্ছে ছেলেটি? সে তাকে যাতে দেখতে না পায়, তাই খুব সন্তর্পণে দরজা দিয়ে তাকে অনুসরণ করে।
দরজার ভেতর দিয়ে এগোতেই তার চোখের সামনে উন্মোচিত হয় এক নতুন জগত। সে দেখতে পায়, তার ডানদিক দিয়ে বয়ে চলেছে তরল সোনার নদী। বাম দিকে খাঁটি সোনার এক সুউচ্চ পাহাড়। মাঝখানে লক্ষ লক্ষ ফোটা ফুল শোভিত এক বিশাল তৃণভূমি। ছেলেটি এগিয়ে চলে, সে তখনো টের পায়নি তার পিছনে কেউ আছে। তাকে অনুসরণ করতে থাকে জিনিয়া। ছেলেটি যেতে যেতে ফুলগুলোকে স্যালুট করে, যেন তারা তার বন্ধু।
তারা পৌঁছে এক বনে, সেখানকার গাছগুলো সব সোনার। তরুণটির চারপাশে অসংখ্য পাখি উড়তে থাকে, কয়েকটি এসে তার মাথায় ও কাঁধে বসে। সে সব পাখিকে যখন ধন্যবাদ জানাচ্ছিল তখন জিনিয়া নিঃশব্দে একটি সোনালি গাছ থেকে একটি ছোট ডাল ভেঙ্গে নেয়। এ আশ্চর্য জগতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেটাকে লুকিয়ে রাখে তার পোশাকের নিচে।
সোনালি গাছের বন পিছনে রেখে এবার তারা পৌঁছে আরেক বনে যেখানে সব গাছই রুপার। নানা ধরনের জন্তু ছেলেটিকে ঘিরে ধরে। তাদের সবার সাথে কথা বলে সে, তার প্রতি মমতা প্রদর্শনের সবাইকে ধন্যবাদ জানায়। জিনিয়া এক ফাঁকে ছোট একটি রুপার ডাল ভেঙে তার কাছে লুকিয়ে রাখে।
সব বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তরুণ, যে পথ দিয়ে এসেিেছল সে পথ ধরে ফিরতে শুরু করে। তাকে যেন ছেলেটি দেখতে না পায়, তাই সাবধানে আবার তার পিছু নেয় জিনিয়া। প্রাসাদে এসে সেই দরজাটি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে সে,তার পিছনে জিনিয়াও। ছেলেটি ঘুরে দরজা বন্ধ করতে যায়, সেই সুযোগে চট করে ফায়ার প্লেসের পাশে নিজের জায়গায় বসে পড়ে সে।
জিনিয়ার কাছে এসে বসে তরুণ। বলে-
ঃ আমার সব বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি। এখন আমরা দুজনে রাতের খাবার খেতে পারি।
জিনিয়া টেবিল থেকে দু জনের জন্য তার রান্না করা খাবার নিয়ে আসে। আগুনের পাশে বসে খেতে খেতে কথা বলতে থাকে তারা।
কাওয়া শেষ হয়। ছেলেটি বলে, এখন আমি ঘুমাব। বলেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে সে। ঘুমিয়ে পড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই। জিনিয়া সেই আশ্চর্য জগত থেকে আনা সোনা ও রুপার গাছের ডাল দুটি তার বিছানার এক পাশে রেখে দেয়। তারপর আগুনের পাশে নিজের রকিং চেয়ারে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখেও ঘুম নেমে আসে।

পরদিন সকাল। বেলা অনেক হয়ে গেছে, কিন্তু দু বোনের মত মেয়েটি তার ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেনি। চিন্তিত হয়ে পড়েন ভালো মানুষটি। মেয়েটির কিছু হল নাকি? অপেক্ষায় থেকে পায়চারি করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু মেয়েটি বের হচ্ছে না। আর দেরী না করে নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখতে ছেলের ঘরে গিয়ে হাজির হন ভালো মানুষটি।
ঘরের মধ্যে ঢুকে যা দেখলেন তাতে নিজের চোখকে বিশ^াস করতে পারছিলেন না তিনি। দেখতে পেলেন, বিছানায় ঘুমাচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে। আর নিভে যাওয়া ফায়ার প্লেসের পাশে রকিং চেয়ারে বসে আছে সুন্দরী কিশোরী মেয়েটি। এ সময় জেগে ওঠে ছেলেটি। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন ধনী ব্যক্তি। এতদিন পর তিনি ফিরে পেয়েছেন হারিয়ে যাওয়া একমাত্র পুত্রকে।
ছেলেটি বিছানায় রাখা সোনা ও রুপার ছোট ডাল দুটি দেখে জিনিয়াকে জিজ্ঞেস করে-
ঃ তুমি আমাকে অনুসরণ করেছিলে?
সত্যি কথাই বলে জিনিয়া-
ঃ হ্যাঁ, তুমি কোথায় যাচ্ছ তা জানতে ভীষণ ইচ্ছা করছিল আমার।
ঃ খুব ভালো করেছ। এখন এ ডালগুলোর বিশেষ জাদু দেখতে পাবে।
জানালা দিয়ে বাইরে দু দিকে নিক্ষেপ করে সে ডাল দুটি।
চোখের পলকে অপূর্ব সুন্দর একটি সোনার ও একটি রুপার প্রাসাদ সৃষ্টি হয় দু জায়গায়।
এ ব্যাপার দেখে ভালো মানুষটির আনন্দের সীমা ছিল না। দেরী করলেন না তিনি। যার জন্য ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন সেইজিনিয়ার সাথে মহা ধুমধামে তার ছেলের বিয়ে দিলেন তিনি।
সোনা ও রুপার প্রাসাদে শুরু হয় তাদের নতুন জীবন।

*রাশিয়ার এ বিখ্যাত রূপকথাটি ‘দি লস্ট চাইল্ড’ নামে ক্যাথারিন টি. ব্রাইস রচিত ‘ফোকলোর ফ্রম ফরেন ল্যান্ডস’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। পরে এলাইন লিন্ডি ‘দি বয় হু ভ্যানিশড’ নামে রপকথার এ গল্পটি পুনর্লিখন করেন এবং তা ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘ফেয়ারি টেলস ফ্রম বোহেমিয়া’ গ্রন্থে এ রূপকথাটি ‘দি চাইল্ড দ্যাট ভ্যানিশড’ নামে প্রকাশিত হয়েছে বলে দেখা যায়। আবার ইন্টারনেটের ‘ফেয়ারি টেল স্টোরিজ ফ্রম কিডস’ নামক ওয়েবসাইটে এ গল্পের নাম দেখা যায় ‘দি মেইডেন অ্যান্ড দি বয় হু ভ্যানিশড’। বাংলায় ‘হারানো ছেলে’ নামে গল্পটি অনুবাদ করা হয়েছে।

Share.

মন্তব্য করুন