কোনমতে পরীক্ষাটা শেষ করেই বাসায় ফিরলো রিফাত। মনটা খুব ফুরফুরে। ঘরে ঢুকেই ফাইল ছুঁড়ে ফেললো খাটে। শার্টেও বোতাম খুলে দরজার কোণায় টাঙিয়ে মায়ের কাছে এলো।
‘আম্মু ভাত দাও, ক্ষুধা পেয়েছে।’
‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোর?’
‘হয়েছে ভালো। এখন ভাত দাও।’
‘ভাত তো দেবো। তার আগে হাত মুখ ধুয়ে নে।’
‘ওসব লাগবে না, খেয়ে তারপর।’
‘কোত্থেকে এমন ছেলে হইলো আল্লায় ভালো জানে!’
চুপচাপ ভাত খেয়ে উঠলো রিফাত। যেন স্বর্গীয় বাতাস বইছে তার মনে। পরীক্ষা শেষ। কোন প্রকার চিন্তা নেই মাথায়। আপাতত রেজাল্টের দিন ছাড়া বাকি দিনগুলো ভালোই কাটবে।
স্কুলের প্যান্টের সাথে জার্সি পরে বের হয়ে গেলো সে। পুরো মাঠ খালি। কেউ আসেনি এখনো। কেন আসবে? আজকে তো সে ফ্রি। কেউ আসবে না আজ। যখন পরীক্ষার চাপ থাকে তখন সবাই আসে। তখন দুপুর হওয়ার আগেই খেলা শুরু করে।
দু’চাকায় হ্যান্ডেল ঘুরাতে ঘুরাতে আসলো জাহেদ।
‘কিরে ব্যাট কই?’ জিজ্ঞেস করলো রিফাত।
‘রাজু আনবে। ব্যাট ওর কাছে। দুইটা থেকে কল দিচ্ছি, এখনো পর্যন্ত ফোন তুলছে না।’

রাজু আসলো প্রায় আধঘন্টা পর। এর মাঝেই মাঠ দখল করে নিলো সিনিয়র ভাইরা। খেলাটা আজ আর হবে না। বিরক্তির চাপ রিফাতের মুখে।
‘সব দোষ রাজুর।’
‘আমার কী দোষ? আম্মু জোর করে ঘুমাতো পাঠাইছে। ঘুমের ভান ধরতে গিয়ে কখন ঘুম চলে আসছে টের পাইনি।’
‘কী আর করার, মাঠতো আর নেই। চল, মাস্টার বাড়ির বাগানে যাই। দিঘীর পাড়ের সাথে খালি জায়গা আছে। শর্ট চার খেলা যাবে।’
জাহেদের কথায় একমত হলো সবাই।
ব্যাট-বল হাতে নিয়ে মাস্টারের বাগানে ছুটলো ওরা। গাছ দিয়ে স্ট্যাম্প আবার গাছের সীমানা। খেলছে সবাই। সবচেয়ে ভালো খেলে রিফাত। আজ তার ব্যাটে আগুন ধরছে না। আগুন ধরাচ্ছে বাকিরা। খেলা শেষে গাল ব্যাঙচিয়ে জাহেদ বললো, ‘আগুনি রিফাত আজ নিবে গেলো।’
হাসলো বাকিরা।
রিফাত তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। দেখছে ডাব গাছের মাথা। এই দেড় মাসে খেলার অবনতি হলেও উন্নতি হয়েছে ডাবের। বেশ বড় হয়েছে। কতদিন যে খাওয়া হয়নি।
রিফাতের এমন দৃষ্টি দেখে বাকিরাও তাকালো উপরে। ডাব ঝুলছে। তাকালো একে অপরের দিকে।
‘চলবে নাকি আজ?’ বললো রিফাত।
‘নাহ, চলবে না।’
সবাই তাকালো জাহেদের দিকে।
‘কেন চলবে না?’ জিজ্ঞেস করলো রাজু।

‘এমনিতেও মাস্টারের বাগানে খেলছি। তার মাঝে ধরা খেলে সব শেষ। বাসায় জানাবে সরাসরি।’
‘ধরা খাবো কেন? রিফাত যেখানে আছে সেখানে এত ভয় কেন?’
‘ধরা খেলে সবার আগে পালাবি তুই।’ বললো জাহেদ।
‘রিফাত থাকতে এসব নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না।’
এই বলে লাফ মেরে উঠলো গাছে। গাছের মাথা থেকে মাস্টারের ঘর দেখা যায়। নিশ্চিন্তে ডাব ফেলানো যাবে। আওয়াজ শুনলেও সমস্যা নেই। মাস্টার সাহেব আসতে আসতে লাফ দিয়ে পালানো যাবে।
একের পর এক ডাব ফেলছে রিফাত। ক্যাচ ধরে মাটিতে নামাচ্ছে রাজু। দিঘীর পাড়ে নিয়ে রাখছে জাহেদ। হাত ফসকে একসাথে দু’টো ডাব ছিঁড়ে গেলো। দু’টো একসাথে দেখে সরে গেলো রাজু। পড়লো শিকড়ে। আওয়াজ হতেই বের হলেন মাস্টার সাহেব।
‘কে রে? সন্ধ্যা হতে না হতেই চুরি। কে ওখানে?’ ডাব রেখেই পালালো বাকিরা। বিপাকে পড়লো রিফাত। যতটা সহজে নামবে ভাবছে ততটা সহজ আর হলো না। মাস্টার এসে হাজির। রিফাত রয়ে গেলো গাছের মাথায়। সন্ধ্যার আবছা আলোতে খুঁজছেন চোরকে। রিফাত স্থির হয়ে আছে। নড়ছে না সে। একবার দেখতে পারলেই খবর করে ছাড়বে।

‘রিফাত তো ধরা খেয়ে যাবে। মাস্টার যেভাবে চেঁচাচ্ছে তাতে তো লোকও জড়ো হয়ে যাবে।’
জিহাদের কথায় মাথা নাড়ালো রাজু।
মাস্টার লোক আনার চেষ্টা করছে। হয়তো ভয় পাচ্ছে এই সন্ধ্যায়। এমনিতেও অনেক বয়স হয়েছে। তার মাঝে চোখে ঠিক মত দেখে না। তুই দাড়া আমি আসছি রিফাতকে নিয়ে।
রাজু বাগানের দিকে এগুলো। খুব সাবধানে পা ফেলছে। হাতে নিলো একটা ঢিল। মারলো মাস্টারের পিছনে। মেরেই দৌড়। মাস্টার ভয় পেয়ে গেলো।
আবার চেঁচিয়ে উঠলো, ‘কে ওখানে? দাঁড়া বলছি।’
মাস্টার অন্যদিকে ফিরাতেই লাফ মারলো রিফাত। ধপাস শব্দে মাটিতে পড়লো। বসে আছে চুপ মেরে। দেখলো কিনা মাস্টার? ভাবছে রিফাত। মাস্টার চমকে গেলো খুব। এবার সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছে। কোন কথা না বলেই পিছন হাঁটছে। এই সুযোগ আর হাতছাড়া করলো না রিফাত। দিলো দৌড়।
‘তুই পায়ে ব্যথা পেয়েছিস?’ জিজ্ঞেস করলো রাজু।
‘আরে না। ব্যথা কেন পাবো!’
‘তাহলে লাফ মেরে মাটিতে বসে ছিলি যে?’
‘লুকিয়ে ছিলাম। তখন আসলে মাস্টার দেখতো। দেখছিলাম মাস্টার কোন দিকে তাকায়। ভয় পেয়েছে হয়তো। ধপাস আওয়াজ শুনে পিছন ছুটছে।
হেসে উঠলো বাকিরা।
‘ভাই তুই পারিস বটে।’ বললো জাহেদ।
‘হুম রিফাতই পারে। তোরা তো আছিস আমার কাঁধে লাঙল গুঁজিয়ে হাল চাষ করতে। নে নে ডাব কাট। তৃষ্ণা পেয়েছে।’

ডাব খেয়ে বাসায় ফিরলো রিফাত। ঘরের ভেতর যেন অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজ করছে। পড়তে বসার কোন চাপ নেই। বই ধরে রাত ১২টা পর্যন্ত বসে থাকতেও হবে না। এইতো গতকাল। আহ! বই নিয়ে বসে থাকতে হইছিলো ১২টা পর্যন্ত। আজ নেই ওসব। নেই মায়ের বকুনিও। এমন সুযোগ যদি সব সময় থাকতো। ঘুম থেকে উঠলো বেলা ১২টায়। গোসল করে নামাজ পড়ে খেতে বসলো রিফাত। রিমোট দিয়ে টিভি অন করে খেলা চালিয়ে দিলো। বাংলাদেশের সাথে ভারতের খেলা। অনেক আগের খেলা। ৩ বলে ২ রান লাগবে। তাতেও ধরা খেলো ভারতের কাছে। ভাত হাতে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে রিফাত। তারও স্বপ্ন দেশের হয়ে একদিন জাতীয় দলে খেলা। এমন হারের মুখ থেকে বিজয় এনে দেশের সম্মান ফিরিয়ে আনা। ভাত হাতে সে হারিয়ে গেলো। নিজেকে ভাবতে লাগলো খেলার মাঠে। খেলছে মুশফিক। মুশফিক আউট। কিন্তু সে আউট হয়নি। হাতে আছে এক বল। এই বলে ছয় মারা যাবে না। ভুল হলে বল ধরা দিবে হাতে। মারতে হবে গ্রাউন্ড শট। তাহলে আউট হওয়ার ঝুঁকি নেই। মারলো গ্রাউন্ড শট। বল পৌঁছে গেলো সীমানার কাছে। আম্পায়ার একহাত সোজা করে আরেক হাত নাড়িয়ে চার ইঙ্গিত করলো। চারদিকে হইচই। বিশ্বকাপ চলে আসলো নিজের দেশে।
‘এই রিফাত। কখন থেকে ভাত হাতে টিভির দিকে তাকিয়ে আছিস? ভাত সব শুকনো হয়ে গেলো। খাইতে বসে কিসের টিভি দেখা?’
আঁতকে উঠলো রিফাত। স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে গিয়েছিলো। কত সুন্দর এক মুহূর্তে ছিলো সে। মায়ের চিল্লানিতে সব গেলো। কাপ হাতে ছবি তুলতে পারলো না। ভাত হাতে এখনো বসে আছে। শুকনো হয়ে গেছে যেন। ঢুকবে না ভাত আর পেটে। ভাত রেখে বের হলো মাঠে। রাজু আর জাহেদ চলে আসছে আগেই।
‘এতক্ষণ কি করলি রিফাত? কখন থেকে বসে আছি।’ বললো রাজ্।ু
‘কই এতক্ষন? ভাত খেয়ে চলে এলাম।’
‘আজকে খেলা আছে। প্রেক্টিসতো আগে করে নিতে হবে। চল আর দেরি করিস না।’
‘আজকে খেলা মানে? কার সাথে? আমাকে তো আগে জানাস নাই।’
‘কিরে জাহেদ, রিফাতকে বলিস নাই আগে?’
‘সরি দোস্ত, মনে ছিলো না।’
‘তোর আবার মনে থাকে কি?’
‘আচ্ছা বাদ দে ওসব। সময় নেই। চল প্রক্টিস করি। বললো রিফাত।’
‘হুম চল। আজকে খেলা চরচান্দিয়ার সাথে। চেয়ারম্যান আসবে। জেলার ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও আসবে।’
‘সত্যি?’
‘হুম। তোকে আজ ভালো খেলতে হবে। সব আশা তোকে নিয়ে। আদি ভাইও তোর উপর ভরসা করে আছেন।’
চিন্তায় পড়ে গেলো রিফাত। খেলা তার আগের মত আর নেই। পরীক্ষার জন্য পুরো দেড় মাস খেলা থেকে দূরে থাকতে হলো। গতকাল শুধু ব্যাট হাতে নিয়েছিলো। তাও ভালো খেলতে পারেনি। আজকে হঠাৎ ম্যাচ। আসবেন চেয়ারম্যান। যেভাবেই হোক ভালো খেলতে হবে। নয়তো স্বপ্নটাও পুরোন হবে না।

মাঠের পিছনে প্র্যাক্টিস করছে সবাই। আদি ভাই (ক্লাবের পরিচালক) আসবে গাড়ি নিয়ে। সবাই হাইস্কুলে থাকবে। খেলা হবে হাইস্কুল মাঠে। বিশাল আয়োজন হবে। সকাল থেকে প্যান্ডেল সাজানো হলো। তোলারাম এবং চরচান্দিয়ার খেলা প্রতিবারই হয়। দুই এলাকার খেলা অনেক বড় আকারে হয়।
রিফাতদের আক্ষেপ অন্যদিকে। চরচান্দিয়া স্কুল টিমের সাথে পরীক্ষার আগে খেলা হয়েছিলো। ম্যাচ জিতে যাবে এমন মুহূর্তে শুরু করলো ভেজাল। রিফাত রাজুদেরও এর কিছুটা স্বাদ গিলতে হয়েছিলো। জ্বর উঠে গেছিলো সেদিন রাতে। সেদিনের প্রতিশোধ নিতে হবে আজ সেই গ্রামকে হারিয়ে। জেলা ক্রীড়া সম্পাদকও আসবে। যে ভালো খেলবে তাকে বড় টুর্নামেন্টেও সুযোগ দেওয়া হবে। এর আগে স্বপন ভাই সিলেক্ট হয়েছিলেন। এখন তিনি জাতীয় দলের লীগ পর্যায়ে খেলেছেন। রিফাতকেও ভালো খেলতে হবে। এই সুযোগে ব্যর্থ হলে সব শেষ।
গাড়ি আসলো। আদি ভাই সবাইকে তাড়াতাড়ি উঠে যেতে বললেন। খেলার সব কিছু নতুন কিনা হয়েছে। রিফাত গাড়িতে উঠেই নতুন ব্যাট হাতে নিলো। আজ এটাকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে।
‘হুম, আজ ভালো করতে হবে। গতবারের কথা মনে আছে?’ বললো জাহিদ।
‘হুম আছে। আজ তার শোধ মেটাতে হবে।’ বল ঘুরাতে ঘুরাতে বললো রাজু।
পৌঁছে গেলো হাই স্কুল মাঠে। চারদিকে দর্শকে ভরে গেছে। চরচান্দিয়া টিম আরো আগেই চলে আসছে। প্র্যাক্টিস করছে খুব।
‘এই দেখ। এদের দেখে তো মনে হচ্ছে ভালো অনুশীলন হয়েছে। আল্লায় জানে কপালে আজ কী আছে।’ বললো জাহেদ।
‘আমারো ভয় হচ্ছে। সুর মেলালো রিফাতও।’
‘কিসের ভয়? ভয় নেই রিফাত। তুই অনেক ভালো খেলিস। আজকেও খেলবি। সাহস রাখ বুকে। আমার বিশ্বাস একদিন তোকে টিভিতে দেখাবে।’
রাজুর মুখে এমন কথা শুনে রিফাতের ভয় যেন পালালো। আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেলো। মুচকি হেসে আনন্দটা ঢেকে নিলো ক্ষণিকেই।

প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো। একটু পর শুরু হবে খেলা। প্রথম ব্যাট রিফাতদের। পুরো গ্যালারিতে হইচই। রিফাতের নাম তোলারামের সবার মুখে। খেলায় মুগ্ধ হয়ে চরচান্দিয়ার অনেকেই রিফাতের নামে স্লোগান দিচ্ছে। ৩৮ রানে হারালে চরচান্দিয়াকে। ফাটিয়ে দিলো রিফাত। গ্যালারিতে বসে দেখেছিলেন রিফাতের কাকা মিহির খন্দকার। মুগ্ধ হয়ে ভাতিজার খেলা দেখেন। এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো রিফাতের নাম। ক্রীড়া সম্পাদক রিফাতকে ডেকে পরিচয় হয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন বড় হ’। আনন্দে মনের ভিতর শুরু হলে ঝড়-তুফান। রাজু ছুটলো রিফাতকে কাঁধে নিয়ে। ছেলের নাম শুনছেন বাবাও। ভালো খেলেছে সে। ভাবছেন পড়ালেখাটাও যদি এমন ভালোভাবে করতো। তবুও ছেলের সুনাম শুনে মনের ভিতর অদ্ভুত আনন্দ লাগছে।
দু’দিন পর রেজাল্ট। সে চিন্তা খুব বেশি চাপ দিচ্ছে না রিফাতের মনে। নিয়মিত খেলায় পড়ে আছে। খেলাকে ঘিরে স্বপ্ন যেন তার আরো গাঢ় হয়ে উঠলো। টিভিতে তাকে দেখাবে। কাপ আর অন্য দেশ নিতে পারবে না। তার হাতেই এদেশে কাপ ফিরবে। খেলেই যাবে সে। সামান্য ভয়েও আছে। এবার জেএসসিতে খারাপ হলে বাবা রাগ করবেন। তাকে নিয়ে স্বপ্ন। ভালো রেজাল্ট করবে সে। বাবার তুলনা তার কলিগের ছেলের সাথে। এ প্লাস চাই বাবার। যে করেই হোক।
আজ রেজাল্ট দিবে। কাকা বাসায় আসছে। সম্ভবত রেজাল্টের জন্যই। মনটা খারাপ রিফাতের। এ প্লাস না আসলে সব শেষ। খেলতে দিবে না বাবা। মার খেতে হবে। কারাবন্দী হয়ে যাবে সে। শুনতে হবে সবার কথা। ভেঙে পড়লো রিফাত। জায়নামাজ নিয়ে বসলো। মুনাজাত করে চোখের পানি ফেলা শুরু করলো। যে করেই হোক প্লাসটা যেন পাই।
কাকা আসলেন ল্যাপটপ নিয়ে রিফাতের রুমে। ‘কিরে কি অবস্থা বাপ?’
‘এইতো ভালো। রেজাল্ট হবে ১২:৪৫ এ, তুমি এত তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ নিয়ে চলে আসল যে?’
‘ভাতিজার রেজাল্ট। তাই আর দেরি করতে ইচ্ছে করছিলো না।’
‘হাহা। আগে আসলে বুঝি রেজাল্ট আগে পাবে?’
‘সবার আগে আমি পাবো। ১২:০০ টায় পাবো। তোর রোল দে।’
‘না থাক কাকা। আমি পরে জনাবো। আগে দেখতে হবে না।’
‘ভয় পাচ্ছিস? ভয়ের কিছু নেই। আমার ভাতিজা এ প্লাস পাবে। এটা আমার বিশ্বাস।’
কাকার আত্মবিশ্বাস দেখে রিফাতের ভয় আরও বেড়ে গেলো। রোল নিয়ে কাকা চলে গেলেন। ১২:০০ টায় জানিয়ে দিবে।
বাবা কল দিলো। তার কলিগের ছেলে এ প্লাস পেয়েছে। রিফাতের রেজাল্ট কি?
রিফাত এখনো রেজাল্ট জানতে পারেনি। কাকা সবার আগে জানাবে বলেছে। এখনো জানায়নি। রিফাতের পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করলো। দাঁড়ানোর শক্তি যেন হারিয়ে ফেললো। কাকার কল, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল রিফাতের। ‘কাকা, রেজাল্ট পেয়েছো?’
‘হুম।’
‘কী পেয়েছি?’
‘প্লাস পাওনি।’
রিফাতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ফোন কেটে রুমে চলে গেল। মাথায় বালিশ গুঁজে শুয়ে আছে।
সামনে পৃথিবীতে আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মা আসছে না রুমে। মা হয়তো আরো বেশি আঘাত পেয়েছে। গাড়ির আওয়াজ। বাবা আসছে হয়তো। হুম, বাবাই।
‘কই রিফাত, সামনে আয় আমার। বের হ’ ঘর থেকে। কী করছিস রেজাল্ট? আজ পিটিয়ে তোর হাঁড় ভাঙবো।
ছুটে আসলো কাকা। থামালেন বাবাকে। বাবা বকতেই লাগলেন। কী করছিস পুরো বছর? খেলা খেলা খেলা, হাড্ডি ভেঙে ঘরে রেখে দিবো, খেলা বন্ধ হয়ে যাবে তখন। মান-সম্মান সব শেষ করলি। কী করিনি তোর জন্য? জামাল ভাইয়ের ছেলে প্লাস পায়। আর আমার ছেলে! লজ্জা করছে ছেলে বলতে।’
রিফাত কিছু বলতে পারছে না। বাবাকে সরিয়ে নিলো কাকা। সব স্বপ্নগুলোর মৃত্যু হলো আজ। ৪.২৫ পেয়েছে সে। এই রেজাল্টে বাঁচার স্বাদ যেন হারিয়ে ফেলেছে। বাঁচার কোনো পথ দেখতে পাচ্ছে না। সবাই জানতে চাইবে তার রেজাল্ট। কিভাবে মুখ দেখাবে সে?
মিহির খোন্দকার বুঝতে পারলেন রিফাতের অবস্থা ভালো না। একদিকে নিজের চিন্তা, অন্যদিকে সবার বকুনি। তাকে শান্তনা দিতে হবে। এতোক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে সে। তবুও দেখে আসি।
মিহির খন্দকার গেলেন রিফাতের রুমে। রিফাত নেই। কয়েকবার ডাক দিলেন। রিফাত কোথাও নেই। মা ছুটে আসলেন। কোথায় গেল রিফাত? মা সব রুমে খুঁজতে লাগলেন। কাকা ছুটছেন ছাদে। ভয় পাচ্ছেন খুব। এই সময়টা খুবই খারাপ। কী করে বসে কে জানে। কোথায় যাবে সে। মা কল দিলেন বাবাকে। রিফাতকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গেলেন বাবাও। বাবা ছুটে আসলেন। কল দিচ্ছেন, ফোন বাসায় বাজছে। কোথায় যাবে সে। কোনো আত্মীয়ের বাসায় যায়নি।
বাবার চোখে পানি। উল্টাপাল্টা কিছু করে বসেনি তো? চিন্তার পাহাড় চেপে বসলো মাথায়। আমি রাগ করে কয়েকটা বকাই দিলাম, তাতে ঘর ছেড়ে চলে যাবি?
কান্না করছেন মা। কাকা বের হয়ে গেলেন। সব জায়গায় খুঁজছেন। রাজুদের বাড়িতে গেলেন।সেখানেও নেই। ভাবছেন কোথায় যেতে পারে ছেলেটা। রাজুর কাছে জেনে নিলেন রিফাতের আড্ডা দেয়ার জায়গাগুলো। এক এক করে সব জায়গায় খুঁজছেন। পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। ভয় যেন আরো বেড়ে গেলো। এদিকে রিফাতের বাবা কল দিয়ে যাচ্ছেন। রিফাতকে পাওয়া গেলো কিনা। পাচ্ছে না কোথাও। ভেঙে পড়লেন। বসে পড়লেন রাস্তায়। ভাবছেন কী করতে পারে রিফাত? ফিরে আসবে? নাকি এতক্ষণে অন্য কোন জগতে হারিয়ে গেলো।

চিন্তিত রাজু। কোথায় যাবে রিফাত। অন্তত তাকে তো বলে যেতে পারতো। এসব আর ভাবার সময় নেই। খুঁজতে হবে রিফাতকে। কাকা খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। তাহলে আছে কোথায়?
রিফাতকে পাবে সে। সে জানে রিফাত কোথায় থাকতে পারে। দিঘীর পাড়। ওখানেই থাকবে সে। মন খারাপ হলে সে ওখানেই বসে থাকতো। রাজু ছুটলো মাস্টারের বাগানের পিছনে দিঘীর পাড়ে। রাস্তায় বসে আছেন মিহির খন্দকার। কাকা এখানে বসে আছেন যে? রিফাত কে পেয়েছেন?
‘না, ভয় হচ্ছে খুব। তুমি কোথায় যাচ্ছো?’
‘আমি যাচ্ছি রিফাতকে খুঁজতে। দিঘীর পাড়ে থাকতে পারে। সে ওখানে প্রায়ই যেত মন খারাপ হলে।’
‘দিঘীর পাড়? আমিও যাবো।’
কাকা ছুটছেন রাজুর আগেই। মাস্টারের বাগান পার হয়ে দৌড়ালেন দিঘীর পাড়ে। হঠাৎ শব্দ শুনতে পেলো রাজু। বাগানের মাঝখানে কি যেন নড়ছে। উঁকি মারলো। এই তো রিফাত। চিৎকার দিলো রাজু। আওয়াজ শুনে ছুটে আসলেন মিহির খন্দকার। রিফাত! রিফাত শূন্যে দুলছে। ঝুলছে একটা দড়ির সাথে। ছটফট করছে।
চিৎকার করে যাচ্ছেন মিহির খন্দকার। আগলে ধরলেন রিফাতের পা। রশিতে যেন টান না পড়ে। চিৎকারে ছুটে আসলো আশেপাশের মানুষ। রাজু লাফ দিয়ে উঠলো গাছে। খুলে নিলো দড়ি।
রিফাত অজ্ঞান। কাঁধে তুলে নিলেন মিহির খন্দকার। রিকশা করে নিয়ে গেলেন সদরে। ভর্তি করালেন ইমার্জেন্সিতে। হাসপাতালে জড়ো হলো এলাকার মানুষ। ছুটে আসলো অনেকে।
রিফাতের জ্ঞান ফিরছে। ঘাড় নাড়াতে পারছে না। প্রচ-রকম ব্যথা। কথা বলতে পারছে না। শক্তি নেই। মৃত্যু তার চোখে ভাসছে। এতটা ভয়ানক মৃত্যু সে কখনো ভাবতে পারেনি। এই পথে একবার গেলে কেউ আর ফিরে আসতে পারে না। সে ফিটে এসেছে। এতটা ভয়ানক জানলে কখনো ওই পথে পা বাড়াতো না। মায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কান্না করছেন। শান্তনা দিচ্ছেন বাবা। মোটা গলায় বাবার আওয়াজ শুনছে সে। এই আওয়াজে কোন শাসন নেই, রাগ নেই। কেমন মায়াবী আওয়াজ।

ব্যথাটা কমছে কিছুটা। মা আসছে তার কাছে। এমন পাগলামী করলি কেন? কাঁদতে কাঁদতে বলছেন মা। আমাদের ছেড়ে চলে যাবি? ভালো লাগে না আমাদের? রিফাতের কিছু বলার শক্তি নেই। চুপ করে শুনছে সব। বাবার চোখে পানি। শব্দ নেই বাবার কান্নায়। এই প্রথম বাবার কান্না দেখছে সে।
বাসায় নিয়ে আসলো রিফাতকে। আত্মীয়-স্বজন সবাই আসছে। রেজাল্ট জানতে নয়। মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে আসা রিফাতকে দেখতে।
আসলেন মিহির খন্দকার। মাথার পাশে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছেন তাই কথা বেরুচ্ছে না।
‘শরীরের ব্যথা কমছে?’
‘রিফাত কিছু বলছে না। ইচ্ছে নেই তার।’

আজ তোর এ-প্লাস আসেনি বলে তুই এমন করছিস। একবার ভাবতো, যে ছেলেটা ফেইল করেছে কিংবা তোর চেয়ে কম পয়েন্ট পেয়েছে সে কি করছে? তোর মত এমন পাগালামী করছে? না। সে ভাবছে কিভাবে এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। সে ভাবছে এই রেজাল্টকে আরো ভালো করার টেকনিক। মানলাম তোর বাবা তোকে একটু বকা দিছে। তাই বলে এমন পাগলামী? যে বাবা তোকে এত কিছু দেয়। তোর সব কিছু বহন করে। সে বাবার কি এতটুকু শাষণ করার অধিকার নেই? উনারও তো খারাপ লাগে। বাবা এমনি এমনি বকছে? উনারও তো খারাপ লাগছে। সবাই জিজ্ঞাস করবে তোর রেজাল্টের কথা। সবার কাছে উনি ছোট হবেন। জামাল ভাইয়ের ছেলে শিহাব এ প্লাস পেয়েছে। তোর বাবার অফিসে সবাইকে জামাল ভাই মিষ্টি খাওয়াবে। তোর বাবার খারাপ লাগে না তখন? আর তুই? এই রেজাল্টে কি হবে। এই রেজাল্ট তোর জীবনে কি করতে পারতো? জীবনকে সাজাতে এই রেজাল্টের কোন বিশেষ প্রয়োজনীয়তা নেই। পৃথিবীতে যত গুণী এবং খ্যাতিমান মানুষ আছে তাদের বেশি সংখ্যকই ভালো ছাত্র ছিলো না। আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম শুনেছিস? ক্লাসে অমনোযোগিতার কারণে তাকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছিলো। কিন্তু আইনস্টাইন হার মানেনি। নিজের স্বপ্নকে কাজে লাগানোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলো। সব শেষে তিনি জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছেন। মার্ক জাকারবার্গের এর নাম শুনেছিস? নিজের স্বপ্নের ফেসবুক তৈরির পিছনে সময় দিতে ছেড়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের জীবনেও বাঁধা এবং কঠিন ব্যর্থতা এসেছিলো। তারা হতাশ হয়নি। তারা তাদের স্বপ্নকে ভালোবাসতো। স্বপ্ন পুরোনে তারা লেগে ছিলো। এবং তারা পৃথিবীকে জয় করে নিয়েছে। আর তোরতো জীবন এখনো শুরু হয়নি। শুরুর আগেই হার মেনে নিচ্ছিস।
তুই বলেছিলি খেলোয়াড় হবি। টিভিতে তোকে দেখাবে। দেশের হয়ে কাপ নিয়ে আসবি। তাহলে এই রেজাল্টে ভেঙে পড়লি কেন?
রিফাত নড়ে উঠলো। জড়িয়ে ধরলো কাকাকে।
আমি ভুল করেছি কাকা। আর করবো না এমন। ক্ষমা করে দাও আমায়। আমি খেলেয়াড় হবো। আমি কাপ আনবো।
নতুন ক্লাবে ভর্তি হলো রিফাত। স্কুল থেকে এসে নিয়মিত প্র্যাক্টিসে যায়। বাঁধা দেয় না বাবা। এখনকার রিফাত তাদের খোদার উপহার। একবার বাধা দিয়ে ভুল করেছেন। এ ভুল আর করবেন না। ছেলের চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখছেন বাবা।
দেশের হয়ে ট্রফি জেতা এবং দেশের হয়ে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন লালন করে মাঠে দৌড়াচ্ছে রিফাত। লেগে আছে ব্যাটে বলে। মনোবলে বাধা হতে পারছে না সূর্যের তীক্ষ্ম তাপ। স্বপ্ন তার খেলোয়ার হবে।

পুরো এলাকা জুড়ে হইচই। ব্যস্ত রাজু। ক্লাবের সামনে বিশাল টিভির পর্দা। ৫০০ মানুষের আয়োজন। চেয়ারে সবাই বসছে। বসছেন রিফাতের বাবাও। চোখে পানি জমে আছে তার। জাতীয় দলে খেলছে তার ছেলে। তৃপ্তিদায়ক এক আনন্দ বয়ে যাচ্ছে মনের ভিতর। একটা নাম তার চারপাশে বাজছে। রিফাত-রিফাত। বসলেন না আর চেয়ারে। চোখে তার আনন্দের অশ্রু। চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলেন তিনি। অপেক্ষা করছেন, কাপ হাতে ছেলের ফিরে আসার জন্য।

Share.

মন্তব্য করুন