আমাদের এই প্রিয় পৃথিবী বড়ই রহস্যময়। এখানে রয়েছে বিচিত্র সব প্রাণীর বসবাস। এসব প্রাণীদের কিছু কিছু আমাদের দৃষ্টিসীমানার মধ্যে পড়ে, আবার বেশির ভাগ প্রাণীই থাকে আমাদের চোখের আড়ালে। এসব প্রাণীদের আচরণ আমাদের কাছে অচেনা। আবার এসব প্রাণীদের অনেকেই, যারা প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকে বিচিত্র সব কৌশল অবলম্বন করে। একেক প্রাণীর রয়েছে একেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। রয়েছে তাদের নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্র। মানুষের যেমন বিনোদন রয়েছে। প্রাণীদেরও বিনোদন রয়েছে ভিন্নমাত্রায়। উল্লেখ্য, প্রাণীদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হলো খেলাধুলা। বিভিন্ন প্রাণী কিভাবে খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের বিনোদনের কাজটি সেরে নেয় তাই তুলে ধরা হলো নিবন্ধটিতে।
তিমি
তিমি। এরা মাছ হলেও আসলে ওরা মাছ নয়। স্তন্যপায়ী জীব। এরাও আমাদের মতো মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়। এক একটা তিমি সত্তর থেকে আশি ফুট লম্বা হয়। জলে বাস করলেও তিমি নাকি একসময় ডাঙাতেও বাস করতো। তাই ডাঙার অনেক স্বভাব এখনো ছাড়তে পারেনি তিমি। ওরা ফুসফুস দিয়ে শ্বাসকার্য চালায়। সমুদ্রের বুকে দাপটের সঙ্গে খেলে বেড়ায়। খেলতে খেলতে তারা একটানা আধঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টাও জলের নিচে থাকতে পারে। কিন্তু তারপরেই তাকে ওপরে উঠে আসতে হয় বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয়ার জন্য। তার ফুসফুসে যে জলীয় বাষ্প জমা থাকে তা প্রবল চাপে তরল হয়ে যায়, আর নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় সেটাই ফিনকি দিয়ে ফোয়ারার জলের মতো দশ বারো ফুট উঁচু হয়ে ছিটকে পড়ে। কী মজার ব্যাপার তাই না?
পেঙ্গুইন
দক্ষিণ মেরুর প্রধান অধিবাসী পেঙ্গুইন। পেঙ্গুইন কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। রাজ পেঙ্গুইন বিরাট আকারের হয়ে থাকে। এদের উচ্চতা চার ফুট বা তার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। আর ওজন প্রায় আশি পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। পেঙ্গুইন গম্ভীর চালে হাঁটে। চলতে চলতে এরা অন্যের দিকে ঝুঁকে থাকে যেন কত কী গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে। এরা কিছুক্ষণ পর পর উচ্চস্বরে শিস দিতে দিতে খেলতে থাকে। পেঙ্গুইন বরফের ঢিবিতে নাক ডুবিয়ে খেলা করতে পছন্দ করে। দক্ষিণ মেরুর আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে এরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। রাণী পেঙ্গুইন খোলা জায়গায় বরফের ওপর একটি মাত্র ডিম পেড়ে সেখানে তা দেয়। বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর সদ্যফোটা বাচ্চাকে মা পেঙ্গুইন তার পুরু পালকের ভাঁজে গুঁজে রাখে। মা-বাবা দু’জনে মিলে পালাক্রমে বাচ্চা দেখাশোনা করে। কোনক্রমে কচি বয়স পেরুলেই শিশু রাজ পেঙ্গুইন বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং খেলাধুলায় পারদর্শী হয়ে থাকে।
জেলি ফিশ
প্রাণীদের উদ্ভবের সেই প্রাচীন কাল থেকেই আছে জেলি ফিশ। জেলি ফিশকে এমন এক মারাত্মক সামুদ্রিক বিভীষিকা বলবে না কেউ। তবে কি জেলি ফিশ নিরীহ শান্ত, সুন্দর প্রাণীর নাম? হ্যাঁ সেটাও বলা যাবে না কোনো মতে। হাঙরের মতো এরা ছুটে এসে সাঁতারু বা ডুবুরিকে আক্রমণ করে না, এ কথা ঠিক। অক্টোপাসের মতো ভয়াবহ চোষকে সজ্জিত শুঁড় দিয়ে জড়িয়েও ধরে না কাউকে। অথবা দৈত্যাকার স্কুইডের মতো শুঁড়ের সাহায্যে নৌকা বা জাহাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে উল্টে দেয় না। বরং এদের একটি ভয়ঙ্কর দিক হলো প্রাণীদের দিকে বিষাক্ত রস ছড়িয়ে দেয়া। সব জাতের জেলি ফিশেই বিষ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে কুখ্যাত বক্স জেলি ফিশ। জলের নিচে খেলার ছলেই এরা সামুদ্রিক প্রাণী কিংবা মানুষদেরও বিষ ছুঁড়ে দিয়ে আক্রমণ করে। জেলি ফিশের এই বিষ ছড়ানোর খেলাটা সত্যিই রহস্যময়।
ডলফিন
পৃথিবীর সব সাগরেই ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়। ডলফিন অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। বুদ্ধির মাধ্যমে এরা অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করে। খেলাধুলায় পটু এরা। জলের নিচে ছোটখাটো জিনিস খুঁজে বের করতে এদের জুড়ি নেই। এক দমে এরা হাজার ফুটের বেশি ডুব দিতে পারে। ছাব্বিশ মাইল গতিতে সাঁতারও কাটতে পারে। এরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে। উন্নত দেশগুলো ডলফিনদের পোষ মানিয়ে খেলাধুলায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিল
এরা মূলত স্তন্যপায়ী জীব। বাস করে পানিতে। পাঁচ রকমের সিল কুমেরু অঞ্চলে বাস করে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ওয়েডেল সিলকে। এরা লম্বায় নয় ফুট এবং ওজনে নয়শো পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। অ্যান্টার্কটিকার উপকূল ভাগজুড়ে বা কাছাকাছি সব জায়গাতেই এই সিল পাওয়া যায়। সিল মাছ খেলাধুলায় ভীষণ পটু। শীতকালে এরা বরফের নিচে দল বেঁধে বাস করে। এদের দেহ হালকা ও চটপটে হওয়ায়, খেলাধুলায় এরা অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে এগিয়ে। পানি ছেড়ে সামান্য দূরে সিলরা পাখির কিচিরমিচির শব্দ জুড়ে খেলতে থাকে। খেলাধুলার সময় ছাড়াও এরা উঁচু নিচু বরফের ওপর দিয়ে মানুষের চেয়েও দ্রুত ছুটতে পারে। খেলাধুলার ফাঁকে ফাঁকে এরা কাঁকড়া ও পেঙ্গুইন পাখি ধরে খায়।
ক্যাঙ্গারু
ক্যাঙ্গারু স্তন্যপায়ী চতুষ্পদী প্রাণী। এরা বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। ক্যাঙ্গারুকে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে অভিহিত করা যায়। খেলাধুলোয় পারদর্শী তারা। এরা অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় আস্তে চলার চেয়ে দ্রুত চলতেই পছন্দ করে। শত্রুরা আক্রমণ করলে এরা খেলার ছলে হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে পারে। এরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খেলাধুলা করে। দিনের বেলায় এরা পূর্ণ বিশ্রাম ঘুম, কিংবা আড্ডায় কাটিয়ে দেয় কোন ঘন শ্যামল ছায়াঢাকা জঙ্গলে কিংবা গাছ বা মাটির গর্তে।

সি-হর্স
সি-হর্স। যাকে বাংলায় সামুদ্রিক ঘোড়া হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এরা লম্বা লেজের সাহায্যে সাগরজলে চলাফেরা করে। সি-হর্সের খেলাধুলার ধরনে রয়েছে বৈচিত্র্য। এদের খেলার অন্যতম উপায় হলো তার লম্বা লেজটিকে সংকুচিত করে পেটের নিচে নিয়ে ঠেকিয়ে ঊর্ধ্ব বা নিম্নমুখী হয়ে সাঁতার কাটা। যেন ক্রিকেটের একটি স্পিন বল পানিতে পাক খেতে খেতে ছুটে চলেছে। এরা সাঁতার কাটে খাড়া বা কৌণিক পথে। পোনা সি-হর্স খেলাধুলোর আগে বাবার পিঠের থলেতে বাস করে।
গ্রিন ইগুয়ানা
গ্রিন ইগুয়ানার নাম তোমরা অনেকেই শুনে থাকবে। আমেরিকার এক ধরনের গুইসাপ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পড়ে থাকতে দেখা যায় ওদের। তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, রোদের মাঝে গা ভাসিয়ে দিয়ে ওরা কী করে? রোদ পোহায়? মোটেও না। আসলে রোদে গা পেতে হজম করে নেয় খাবার। শুনলে তোমরা অবাক হবে, সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি সংগ্রহ করে ইগুয়ানা। ফলে এদের হাড়গুলো বেশ মজবুত হয়ে ওঠে। গ্রিন ইগুয়ানার খেলাধুলায় রয়েছে বিভিন্ন কৌশল। অন্য বড় প্রাণীদের কাছ থেকে রক্ষা পেতে অভিনব খেলাধুলোর আশ্রয় গ্রহণ করে তারা।
ওয়ালরাস
বিচিত্র প্রাণী ওয়ালরাসের নাম তো তোমরা শুনেছো। একটু সহজ করে বলি। টিভির ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এই প্রাণীটিকে প্রায়শই দেখা যায়। এরা দেখতে অদ্ভুত হলেও খেলাধুলায় বেশ পটু। সাগরে এরা ডুব দিয়ে আবার মাথার উপরে তুলে বেশ মজার ভঙ্গিতে খেলাধুলা করে থাকে। এদের দেখতে ভয় লাগলেও এরা কিন্তু পারতপক্ষে কাউকে ক্ষতি করে না। একা কিংবা দল বেঁধে এরা সাগরের পানিতে খেলাধুলা করে থাকে। অতীতে এদের পোষ মানানো না হলেও বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এদের পোষ মানিয়ে খেলাধুলার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এবার তাহলে বুঝতেই পারছো, খেলাধুলায় পটু বলে বিভিন্ন দেশে এদের কতটা কদর বেড়েছে!

বানর
প্রাণিজগতে বানর মূলত এক খেলাধুলাপ্রবণ ও কৌতুকপ্রিয় প্রাণী। বুদ্ধিতে একমাত্র মানুষের সাথে এদের তুলনা চলে। এরা গাছে গাছে লাফালাফি করে খেলা করে। গাছের মগডালে ঝুলে থাকা বানর দেখতে ভারী মজা। অনেক বানর সারা বনভূমিকে নিমিষেই যেন চঞ্চলতা দান করে। এরা কখনও এগাছে কখনও ওগাছে, কখনও বা হরিণের পিছে আবার কখনও ব্যঙ্গভরে অঙ্গভঙ্গিতে করে বানর। বনের অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে হরিণের সঙ্গে এদের সখ্য খুব বেশি। স্বভাবে এরা অত্যন্ত কৌতুকপ্রিয় ও খেলাধুলা করতে ভালোবাসে। এদেরকে মাঝে মাঝে হরিণের পিঠে চড়ে বসে খেলাধুলা করতে দেখা যায়। অবাক হলেও সত্য, বানর খেলার ছলে বাঘের সঙ্গে নানা প্রকার কৌতুক করে থাকে। বাঘকে আসতে দেখলে এরা ধপাস করে গাছ থেকে মাটিতে পড়ে নানারূপ অঙ্গভঙ্গি করে আবার গাছে উঠে যায়।

Share.

মন্তব্য করুন