শো শো বাতাস ঢুকছে বাসের জানালা দিয়ে। মনটা তাই বেশ ফুরফুরে। হাওয়ায় দোল খাওয়া ফসলের মাঠ। দূরে ছোট ছোট ঘর আর খড়ের গাদায় ভেসে উঠেছে গ্রামের মায়াবী ছবি। এই মেঠোপথ মাড়িয়ে প্রিয় ঠিকানায় ছুটে চলছে রায়হান। তার নানার বাড়ির দিকে। টাঙ্গাইলের বাসে উঠেছে সে। এসএসসি পরীক্ষার পর জীবনে একটু দম ফিরে এসেছে বলা যায়। দীর্ঘদিন থেকে একটানা লেখাপড়া করতে গিয়ে মেজাজটাই যেন পানসে হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চগড় থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে তার নানার বাড়ি আসতে হয়। এ জন্য বেশি একটা আসা-যাওয়া হয় না। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার মতো একটা সেনসিটিভ সময়ে এই আবদার ছিল পুরোটাই অবান্তর। চাচাতো ভাই সুরুজ্জামালকে আনতে পারলে ভালো হতো। ছোটবেলা থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা; একই ক্লাসে পড়া; আবার একই ব্যাচে পরীক্ষা দেয়া হয়েছে ওর সাথে। কিন্তু নানা বাড়ি থেকে এক মাসের আগে আসতে দিবে না তাকে।
তাই ওর বাবা-মাকে রাজি করানো যায়নি। ছোট ভাই রাহিমুলেরও সামনে পিএসসি পরীক্ষা। নইলে ওকে অন্তত আনা যেতো। এবারের আবহাওয়াটা মোটামুটি ভালো। ঘুরে বেড়াতে মজা হবে হয়তো। নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি রায়হান। বাস ততক্ষণে যমুনা সেতুর ওপর উঠে গেছে। উৎসুক লোকজনের কলকাকলিতে টের পেয়ে যায় সে। দৃষ্টিনন্দন বিদ্যুতের পিলারগুলো এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রিজটা অনেক দূর দিয়ে ঘুরে ধনুকের মতো দেখাচ্ছে। নিচে নদীতে ছোট ছোট নৌকাগুলো মেশিনের সাহায্যে কত স্পিডে যাচ্ছে দেখলে অবাক লাগে। কিছু নৌকা ভাসমান অবস্থায় থামিয়ে মাছ ধরছে জেলেরা। নদীর মাঝে মাঝে ছোট বড় চর দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় মানুষের বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে দু’একটা। চারদিকে অথৈ পানি আর মাঝখানে বসবাস করা লোকজন সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিভাবে যে থাকতে পারে ভাবাই যায় না। অজান্তে মনের কোণে ভেসে উঠে করতোয়া নদীর কিছু স্মৃতি। গতবার নানুভাই এসেছিল বাসায়। তিনি দেবীগঞ্জ সংলগ্ন ব্রিজের ধারে জামাল ও তাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে নানুভাইয়ের শৈশবের কিছু স্মৃতি তুলে ধরেছিলেন।

সেগুলো মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন- ‘আমরা একসময় ব্রিজের ওপর থেকে ঝাপ দিয়ে দুই ঘণ্টা সাঁতার কেটে চোখ লাল করে ফেলতাম। প্রায় সময়ই ঠ্যালা জাল দিয়ে মাছ ধরতাম। তিনকোণা নীল রঙের সেই জাল। ছোটবেলার কথা তো, তখন সামান্য মায়া অথবা পুঁটি মাছ পেয়েই খুব আনন্দ হতো। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাসায় ফিরে প্রতিদিন হারিকেন মুছে তেল দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম। একসাথে খেজুর পাতার চাটাইয়ে বসে পড়াশুনা করতাম ভাই বোন মিলে। কিছুক্ষণ পড়ার পর যখন আশপাশ কেউ থাকতো না, তখন বইয়ের ভেতরে বাঘের ছবিটা বের করে মাপতাম। এরপর তাকে চকের গুঁড়ো খেতে দিয়ে আবার আগের জায়গায় রেখে দিতাম। ভাবতাম বইয়ের ভেতর বাঘ বড় হবে। যার বইয়ে বেশি ছবি থাকতো তার ভাবটাও যেন ততো বেশি থাকতো। আমাদের জীবনে এভাবে চকের গুঁড়ো আর পেন্সিলে আঁকা ছবি মিশে আছে। গোলাপ ফুল পেলে তার পাপড়ি ছিঁড়ে বইয়ের ভিতর রেখে দিতাম। যার মিষ্টি গন্ধ প্রতিটা বইয়ের পাতায় ছড়িয়ে যেতো। রাত পেরিয়ে সকাল হলে দল বেঁধে মক্তবে যেতাম কোরআন শিক্ষা নিতে। শীত মৌসুমে দিনের বেলায় আমরা পলিথিন আর খড়বিচুলি জোগাড় করতাম আগুন জ্বালাবার জন্য। উলের সোয়েটারে আগুন লাগার ভয় থাকতো; তাই সোয়েটার খুলে আমরা আগুনের কাছে যেতাম। আগুনে নষ্ট কলম পোড়ানো ছিল আমাদের অন্যতম কাজ। সেই পোড়া কলম থেকে টেনে চিকন সুতো বের করতাম আর আনন্দ করতাম। তোমাদের এই জেনারেশন কখনোই বুঝবে না সেই মজা। আমরা দেখেছি কিভাবে কেরোসিন আনার জন্য কাচের বোতলের মাথায় দড়ি বাঁধা হতো। সেই দড়ি আস্তে আস্তে কালো হয়ে যেত আর বোতলের গায়ে ময়লার আবরণ পড়তো।

ডাঙ্গুলি খেলা তো তোমরা চিনবে কিনা সন্দেহ আছে। কত যে রোমাঞ্চকর ছিল পরিবেশটা। বিভিন্ন জায়গায় মারবেল খেলা, সিগারেট প্যাকেটের নকল টাকা দিয়ে অনেক রকম খেলা ছিল। সন্ধ্যাবেলায় প্রতিটা বাড়ি থেকে এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই পড়ার আওয়াজ হতো। এই আওয়াজ ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দকেও হার মানায়। এখনকার ছোটরা তো ধারাপাত বই চিনবেই না। এরা জানে শুধু ইউটিউব, ফেসবুকে সময় নষ্ট করতে। টিউটোরিয়াল-ক্লাসটেস্ট নিয়ে সারাদিন স্কুলে পড়ে থাকো তোমরা। জুতা-মোজার গন্ধ আর বিদেশী রাইটারের বই তোমরা ভালোই চিনো হয়তো। এখন আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে ইয়াবা, কোকেন আর ধ্বংসাত্মক মাদক দিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে ভালোবাসে এই জেনারেশন। ল্যাপটপ আর অ্যান্ড্রয়েড ফোনের গেমসের কাছে সময় ক্ষেপণ করে জীবনটাকে একঘেয়ে করে ফেলেছে এরা। মিথ্যের ঝাপি খুলে ফেসবুকে চ্যাটিং ছাড়া বাস্তব জগতে মানুষের সুখ দুঃখের ভাগাভাগি করা কী জিনিস তা কোনদিন জানার সৌভাগ্যও হয়তো পাবে না।’ কথাগুলো বলতে বলতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। খানিক নীরব থেকে আরো বলেছিলেন, ‘এখন সময় পাল্টেছে, আমি যুগের বা সময়ের দোষ দেই না। শুধু আফসোস হয়; আমাদের সচেতনতার অভাবে এত সুন্দর দিনগুলো হারিয়ে গেছে। সেই দিনগুলো ফেসবুক ইউটিউবে বন্দী ছিল না বলে আমাদের শৈশব কেটেছে মাঠে-ঘাটে, হাওর-বাঁওড়ে, আগুনে-পানিতে, জলা-জঙ্গলে। তোমরা মোবাইল গেম, ইউটিউব আর ফেসবুক দিয়ে আমাদের কলার ভেলা আর কানামাছি ভোঁ-ভোঁ খেলাকে আদৌ টপকাতে পারবা না।’ নানুভাইয়ের এই কথাগুলো অনেক বন্ধুর সাথে শেয়ার করে রায়হান। তাই তার টার্গেট এবারও সে নানার কাছে কিছু স্মৃতি শুনবে এবং আজীবন তা ভুলবে না।

সন্ধ্যার আগেই নানার বাসায় পৌঁছে রায়হান। নানী ও নানার ভালোবাসার মুখ দু’টি কতদিন দেখা হয়নি…? আবেগে চোখে পানি চলে আসে। জড়িয়ে ধরেন নানীও। এ দিকে সমবয়সী মামাতো ভাই ইয়ামিনকে দেখে চোখের পানিগুলো মুছে ফেলে সে। লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে মাথা নিচু করে থাকে সে। কিন্তু পরক্ষণে ইয়ামিন তাকে হাসিয়ে দেয়। খানিক পরে মাগরিবের আযান হলে নামাজ পড়তে চলে যায় তারা। নানার বাসায় রাতের আয়োজন ছিল যমুনা নদীর চাপিলা মাছ ও গরুর গোশত দিয়ে। গরুর গোশত মামী রান্না করলেও চাপিলা মাছগুলো নানী নিজ হাতে রান্না করেছেন। বহুদিন পর এ যেন অমৃতের স্বাদ নিয়ে মনটা ভরে গেল রায়হানের। ‘দীর্ঘপথ জার্নি করে এসেছ, তাই ইশার নামাজ পড়ে ইয়ামিনের রুমে শুয়ে পড়বে তাড়াতাড়ি। আগামীকাল দেখা হলে অনেক কথা হবে ইনশাআল্লাহ।’ বললেন নানী।

ফজরের আযান শুনে ইতোমধ্যে ঘুম ভেঙে গেছে রায়হানের। মিষ্টি কণ্ঠের সুন্দর বাক্যগুলো খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে। তখনই নানা ইয়ামিনের নাম ধরে ডাকলো নামাজে যাওয়ার জন্য। মোজাইক পাথরের মসৃণ মেঝেতে ফজরের শীতল সময়ে সিজদাহ করতে গিয়ে মহান আল্লাহর অসীম দয়ার কথা মনে পড়ে। আনন্দে বিমোহিত হয়ে দুটি হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুধু চাইতেই ইচ্ছে করছিল যেন। নামাজ থেকে ফেরার পথে নানু ভাইয়ের পরিকল্পনা ছিল জেলে মাজেদের কাছে মাছ বিক্রির কথা বলবে। বিলের পাশেই প্রাইমারি স্কুলটার পাশে ওর বাড়ি। যে স্কুলে ছোটবেলা লেখাপড়া করেছে নানুভাই। সকাল সকালে না গেলে মাজেদের নাগাল পাওয়া মুশকিল। তাই ইয়ামিনসহ তিনজনেই এগিয়ে যেতে থাকে বিলের পাশ দিয়ে। রায়হানের যেন বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার মহা একটা সুযোগ তৈরি হলো। মাজেদের সাথে কথা বলে স্কুলটার কাছে পুরাতন বটগাছের শিকড়ে বসে পড়ে তিনজনই। নানা বলতে থাকেন, ‘আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। কামাল, মিন্টু, রাকিব আর হিমেল আমার অনেক ক্লোজ বন্ধু ছিল। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলা করা সব ওদের সাথেই হতো বেশি। আমাদের বাড়িটা তখন এই স্কুল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ছিল। বর্ষাকালে কি যে অবস্থা হতো! রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা। রাস্তার দু’ধারের এই বিল থাকতো পানিতে ভর্তি। আর বড়-বড় কোলা ব্যাঙের সুরে সুরে থাকতো গান। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা ব্যাঙের মাথায় ঢিল ছুঁড়তাম। ওরা পানিতে ডুব দিয়ে আবার আরেক কোণায় গিয়ে ডাকতো। এখন মানুষ বিষ আর কিটনাশক এতো বেশি ব্যবহার করে যে, ব্যাঙের সেই মন ভুলানো সুর হারিয়ে গেছে। আমরা প্রায় সময়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। সেই মাছ দিয়ে বিকাল বেলা বাড়ি থেকে চাল, ডাল, মসলা এনে চড়–ইভাতি খেতাম। চড়–ইভাতি খাওয়ার জন্য আমরা থালা ব্যবহার না করে কলার পাতায় খেতাম। এই চড়–ইভাতির সবচেয়ে বড় মজা হচ্ছে পাখি মেরে রোস্ট করে খাওয়া। যেটা আমরা করতাম শীতের দিনে।

মাঝে মাঝেই আমরা শুনগাতি গ্রামের দিকে যেতাম। ঐখানে আছে বিরাট একটা জঙ্গল। জঙ্গলের কোন গাছে কয়টা পাখির বাসা সব আমাদের হিসাবের মধ্যে ছিল। একবার বড় ধরনের বিপদ থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছিল। মস্ত বড় একটা মৌচাক এসে যে কবে বসেছিল ঐ জঙ্গলের এক নিমগাছে; তা খেয়াল করিনি কেউ। একগাছ থেকে কয়েকটা দেশি পেয়ারা পেড়ে আমরা ঐগাছের পাশেই বসে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা বাজপাখি ছোঁ মেরে ল-ভ- করে দেয় গোটা চাক। সাথে সাথে মৌমাছিরা ভন-ভন করে বেরিয়ে এসে তাড়া করতে থাকে পাখিটাকে। আমরা রীতিমতো আল্লাহর নাম জপতে থাকি আর ভয়ে চুপসে যাই। অবশেষে রাস্তার পাশে একটি নেড়ি কুকুরকে আক্রমণ করে মৌমাছিগুলো। আমরা উল্টা দিক থেকে সটকে পড়ি আস্তে আস্তে।

একবার কামালকে নিয়ে ঝামেলায় পড়ে যাই। মাঝরাতে সে আমাকে ডাকতে গিয়েছিল মাছ ধরতে যাবে বলে। আমিও লোভ সামলাতে পারিনি। তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ি চুপে চুপে। আলনা থেকে গেঞ্জিটা নিতে গেলে টেবিলের উপর থেকে পড়ে যায় স্টিলের গ্লাসটা। মা তড়িঘড়ি করে বলে কে…? আমি চুপ করে থাকলেও মা কুপি বাতিটা জ্বালিয়ে দেয় মুহূর্তেই। ধরা খেয়ে যাই মায়ের কাছে। সাথে কিছু বকুনি তো আছেই। কিন্তু কামালকে আর খুঁজে পায়নি কেউ। পরে কামালকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেও বিষয়টি স্বীকার করাতে পারিনি।’

Share.

মন্তব্য করুন