প্রাচীন একটা ছড়া-
‘কে রাঁধে গো
কয়লা, কড়াই, খুন্তি?
মা, রাঁধে তোমার মনটি।’

হ্যাঁ, ইলিশ নিয়ে রাঁধাবাড়ার কথাই প্রকাশ পেয়েছে। শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই ইলিশের মৌসুম। অলিতে, গলিতে ফেরিওয়ালার ডাক, চাঁদপুরের ইলিশ, পদ্মার ইলিশ, ডিমওয়ালা ইলিশ, বড় ইলিশ ইত্যাদি। কবি বুদ্ধদেবের ভাষায় ইলিশ হচ্ছে জলের উজ্জ্বল শষ্য। কিন্তু ইলিশ নিয়ে চমৎকার মজা করেছেন রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৭ সালে লেখা তাঁর ‘কষ্টিপাথর’ নাটকে। তাতে নবীন নামে একজন ‘উন্নতিশীল বাবু’ এক টাকায় একজোড়া ইলিশ কিনে লোকজনকে ডেকে বলছে, ‘রাজপুত্তুর মশাই, রাজপুত্তুর কি যে গড়ন, যেন ননীর চাক থেকে কেটে তুলেছে। দিব্যি দোহারা, একটু পাশ থেকে গোলাপী আভা মারছে।’ ইলিশ রান্নার যে রকমারি বর্ণনা দিয়েছেন শ্যামল সান্যাল তাতে বাঙালি মৎস্য রসিকের রসনা ঠাকুরমার ঝুলির সেই রাক্ষসীর জিভের মতো লকলক করে। ইলিশের সঙ্গে গরম ভাত। ভাতের চুড়োয় জয়ের নিশান উড়বার আগে গোড়াতেই ইলিশের তেল। ইলিশের ঝাল, কাঁচালঙ্কা চিরে চিরে দেওয়া, সর্ষের পাশ দিয়ে মাছের গা বেয়ে উঁকি মারছে। দই ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পোলাও আরও কতো কি!
এ তো গেল রসনার কথা। এবার আসি যারা সাগর সেঁচে ইলিশ তুলে আনে তাদের কথায়। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ এই ইলিশ ধরা জেলেদের অনবদ্য গাঁথা। এই উপন্যাসে আমরা পাই ইলিশ শিকারের অপূর্ব বর্ণনা। ‘পদ্মায় ইলিশ ধরিবার মরসুম চলিতেছে। দিবারাত্রি কোন সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে নৌকার আলো ওগুলি। সমস্ত রাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদী-বক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সংকেতের মতো সঞ্চালিত হয়। একসময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে, গ্রামে, রেলস্টশনে ও জাহাজঘাটে শ্রান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশের ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করিতে থাকে। মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’
কী হয় ভোরবেলায়? সারা বছরের রাতের গতর খাটা ইলিশ নিয়ে? ঘাটে আসা মাত্রই কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যাবে বেপারি, আড়তদার আর দাদনদারের মধ্যে আসা মাছ নিয়ে। দাদনদার নির্দিষ্ট না থাকলেও সমস্যা। শোষণের কালো হাত সব জায়গায় প্রস্তুত থাকে। কি প্রতিক্রিয়া হয় তখন এসব জেলেদের?
মানিক বাবুর মুখেই শুনি।
‘ঘুমে ও শ্রান্তিতে কুবেরের চোখ দুটি বুজিয়া আসিতে চায়। আর সেই নিমীলন পিপাসু চোখে রাগে, দুঃখে
আসিতে চায় জল। গরীবের মধ্যে সে গরীব, ছোটলোকের মধ্যে সে আরও বেশি ছোটলোক। এমনভাবে তাকে ব্যথিত করিবার অধিকারটা তাই প্রথার মতো সামাজিক ও ধর্ম সম্পর্কীয় দর্শন নিয়মের মতো অসংকোচে গ্রহণ করিয়াছে। প্রতিবাদ করিতে পারিবে না। মনে মনে সকলেই যাহা জানে মুখ ফুটিয়া তাহা বলিবার অধিকার তাহার নাই।’

ইলিশ মৌসুমে বাংলাদেশের এই উপকূলে প্রচুর ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ে। কিন্তু জেলেরা ন্যায্য মূল্য পায় না। লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। আর মৌসুমের আগেই জেলেদের নৌকা ও জাল মেরামতের জন্য টাকা জোগায় সেই মহাজনরা যাদের কাছে তারা হয় নিগৃহীত, শোষিত। দাদন ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে তারা হয় শোষিত। মাছের মৌসুমে বাধ্যবাধকতা থাকে যে মাছের দাম ঠিক করবে মধ্যস্বত্বভোগীরা। নিয়ম ভাঙার কোন জো নাই। কারণ এতে আছে মাস্তানদের হাতে নিগৃহীত হবার ভয়। জেলেরা মূলত টং জাল দিয়েই ইলিশ মাছ ধরে। ইলিশের মৌসুম হলো শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন এই তিন মাস। এই মৌসুমকে সামনে রেখেই জেলেদের স্বপ্ন। এক একটি ৩/৪ মুখের টং জাল দাম পড়ে ১০০০০-১২০০০ টাকা। একটু বড় আকারের ৪ মুখের টং জালের দাম ৬০০০০-৮০০০০ টাকা। জালের মাপ হলো, মুখের দিকে গোল আকারের মাপ ১৮ বাম, দু’দিকে ৮ হাত করে লম্বা। জালের ফাঁস ৪ আঙ্গুল। ছোট আকারের একটি নৌকার সাধারণ মাপ হলো, পাশে ৬পা, লম্বায় সাড়ে পাঁচ বাম। এই নৌকা বানাতে লাগে ১ লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ টাকা। কী থাকে একটি ছোট নৌকায়? সুয়ান ১টি, দাঁড় ৪ খুঁটি, খুঁটি ১টি, পাল ১টি, হাড়ং ২টি নোঙর ১টি। বড় নৌকার সরঞ্জামের তালিকা বেশ বড়। এতে থাকে ১০-১২ জন কর্মী, কমপক্ষে ৬ নম্বর কর্ড সুতার জাল। তা হবে ৫০ হাত প্রস্থের ও ১০০০ বাম দৈর্ঘ্যের। সরঞ্জামের মধ্যে থাকে পানির ড্রাম, লাইফ বয়া, নোঙর, রশি, ছুরি, দা, পাথর, বাঁশি, ফানস, হারিক্যান, শীল-বাটা, থালা, বড় ব্যাগ, কাপ, ডেকচি, বোম্বা, তেল পাইপ, ডিজেল ড্রাম, নানা ধরনের রেঞ্জ, হেমার রেডিও, টর্চ, মবিল ফ্যান, নলকূপ, ফুরুম রশি, বদনা, ব্রাশ, বরফ ভাঙার বাক্স, রাবার পাইয়া, চুঙ্গি, আগর ছাতা, বিস্কুট, টিন ইত্যাদি বহু উপকরণ। বড় নৌকা ৮টি সাধারণ নাইয়া নৌকাকে টেনে নিয়ে যায় সমুদ্রে। ঘণ্টা ৩-৪ যাওয়ার পর সন্দ্বীপের দক্ষিণে কতুবদিয়ার কাছাকাছি অবস্থান নেয় এরা। এক নৌকায় ৩-৪ জন জেলে থাকে। ওরা গভীর সমুদ্রে ৬/৭ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে। এর মধ্যে ভালো মাছ পড়লে নৌকাটি ২/৩ বার মাছ নিয়ে তীরে আসে। মাছ পড়ে চাঁদের দ্বিতীয়া অমাবস্যার পর চাঁদের তৃতীয়ায়। দ্বিতীয়ায় মাছ পড়া শুরু এবং ডালা অর্থাৎ চাঁদের পঞ্চমীর সময় স্রোত যখন কম থাকে তখন মাছ পড়ে সবচেয়ে বেশি। পঞ্জিকা দেখেও ওরা দিনক্ষণ ঠিক করে। এরা কথায় কথায় পঞ্জিকার পাতা উল্টায়। অধিকাংশ জেলেদের কোন কম্পাস থাকে না। এরা তারা দেখে দিক নির্ণয় করে।

আবার ফিরে আসি ঘাটের দৃশ্যে। এ ইলিশ মৌসুমে যে কেউ ঘাটে গেলে ইলিশ নিয়ে দাদনদারের দৌরাত্ম্য দেখতে পাবে। শহরের বাজারে যে ইলিশের দাম ১০০০ টাকা। দাদনদারেরা দেবে তার জন্য ৩০০/৩৫০ টাকা। কিছু বললেই দাদনদার মারতে উদ্যত হবে। নিরাপত্তার সমস্যা ঘাটগুলোতে খুব বেশি। দাদনদাদের বুদ্ধির কাছে এরা অসহায়। হয়তো দেখা যাবে সব দাদনদার এক যুক্তিতে বলছে ঘাটে বরফ নেই। এটা প্রচার করে এরা মাছের দাম কমিয়ে দেয়। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে এদের জুড়ি নেই। মাছ পঁচে যাবে সুতরাং জেলেরা জলের দামে মাছ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় ট্রাক ভর্তি বরফ আসছে। তখন মাছ আর জেলেদের নৌকায় নেই, দাদনদারের গুদামে স্তুপকৃত হয়েছে। দাদনদারের এজেন্টরা মাঝে মাঝে রটিয়ে দেয় চট্টগ্রাম শহরে মাছের দাম ডাউন। সুতরাং ধৃত মাছের দাম কমে যাবে আরও। এই অদ্ভুত শোষনের প্রক্রিয়া সবখানেই। কুমিরা, শীতলপুর, দক্ষিণ ভাটিয়ারি, সলিমপুর, কাট্টলি, পতেংগা, বোয়ালিয়া, ঘোড়ামারা, মীর্জানগর, আনন্দবাজার, বাঁশবাড়িয়া, সোনাইছড়ি, খেজুরতলি, বাড়বকু-, মনোহরখালি, মাঝিপাড়া, কলাবাগিচা, ইত্যাকার প্রত্যেকটি স্থানে এই শোষনের দৃশ্য। যখন মাছের মৌসুম থাকে না তখন জীবিকার প্রয়োজনে জেলেরা দাদনদারের পাতা ফাঁদে পা দেয়। এ অগ্রিম হিসাবে যত কম টাকাই নেয়া হোক না কেন মাছ দাদনদারকেই দিতে হবে। মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত টাকা পয়সার কোন হিসাব হয় না। মৌসুমে মাঝে মাঝে শুধু হাত খরচ ও সংসার খরচের জন্য কিছু টাকা জেলে নিতে পারে। এইভাবে জেলেরা তাদের সুদিনে সব অর্জিত টাকা অন্যের হাতে তুলে দেয়। নিজের হাতে জাল বুনে জাল বুনে জাল বসিয়ে সে ঘরে সুফল তুলতে পারে না। নিজের অজান্তে আরেক জালে আবদ্ধ থেকে যায়।

Share.

মন্তব্য করুন