যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলসের মেরদের টিডফিল শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে মেরদের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি শান্ত গ্রাম অ্যাবাভান। পাহাড়ে ঘেরা এই গ্রামটির অধিবাসীদের জীবিকা নির্বাহের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল কয়লা উত্তোলন। গ্রামের অধিকাংশ ব্যক্তি ছিলেন কয়লাখনির শ্রমিক।
কাছেই অবস্থিত মেরদের ভেইল কয়লাখনিতে কাজ করতো অধিকাংশ শ্রমিক। তখন কয়লা উত্তোলনের সময়ে প্রাপ্ত বর্জ্য ও অবশেষ খনির কাছে পাহাড়ের ওপর ঢিপি করে রাখা হতো।
এগুলোকে বলা হতো টিপ। প্রতিটি টিপের একটা করে নম্বর ছিলো। মেরদের ভেইল কয়লাখনির ৭ নম্বর টিপটা ছিলো অ্যাবাভান গ্রামের ঠিক ওপরে। ৭ নম্বর টিপের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভূগর্ভস্থ নদী।
১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে সে সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ২১ তারিখ সকাল সাতটার সময় যখন কয়লাখনির শ্রমিকরা এসে উপস্থিত হন, তখন তারা দেখতে পান যে ৭ নম্বর টিপটি এক রাতের মধ্যেই প্রায় ১০ মিটার নিচে দেবে গেছে। পাহাড়ের উপর কোনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় নিচের গ্রামের অধিবাসীদের সতর্ক করতে পাহাড় থেকে নেমে আসতে আসতে টিপটি আরো দেবে যায়। এরপর কেউ কিছু করার সুযোগ পাবার আগেই সম্পূর্ণ টিপটি ধসে পড়ে।
প্রায় ১৫০,০০০ টন কয়লা, তরল বর্জ্য, কাদাপানি এবং ধ্বংসাবশেষের স্রোত ধেয়ে আসে ঠিক নিচের অ্যাবাভানের দিকে। আর এর রাস্তার প্রথমেই পড়ে প্যান্টগ্লাস জুনিয়র স্কুল এবং এর ২৪০ জন শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা। কেউ বুঝে ওঠার আগেই কয়লাখনির বর্জ্যরে স্রোতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় প্যান্টগ্লাস স্কুল এবং তার আশপাশের এলাকা। মুহূর্তের মধ্যে দালান ভেঙেচুরে কুচকুচে কালো তরলের স্রোতে হারিয়ে যায় স্কুল, বসতবাড়ি ও মানুষ।
কয়লাখনির শ্রমিক, অগ্নিনির্বাপণকর্মী, সাধারণ গ্রামবাসী সবাই উদ্ধার কাজে সাহায্য করেন। বেঁচে যাওয়া মানুষদের উদ্ধার করায় বাধা দিচ্ছিল তরল বর্জ্যরে উপস্থিতি। তাই সবাই মিলে বালতিতে করে বর্জ্য তুলে পরিষ্কার করছিলো মানব-শিকলের মাধ্যমে। পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হয় বাকেট চেইন।
স্কুলের ভাঙা দরজা, স্কুলের বেঞ্চ সরিয়ে বহু কষ্টে তারা বের করে এনেছিল একেক জনকে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বের হয়ে আসছিল লাশ হয়ে। লাশ বের হচ্ছিল ছোট ছোট শিশুদের। প্ল্যান্টহাউজ স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বয়স ছিল ১০ বছরের নিচে। লাশ হয়ে বের হচ্ছিলেন শিক্ষকেরাও। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তেও আগলে রাখতে চেয়েছিলেন তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের। এমন একজন শিক্ষক ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী ডেভিড বেনন। তাকে যখন বের করে আনা হয়, তখনও তার হাত দু’টো পরম মমতায় আগলে রেখেছিল পাঁচজন শিক্ষার্থীকে। হয়তো ধেয়ে আসা কালো স্রোত থেকে বাঁচাতেই এমনটি করেছিলেন তিনি।
অ্যাবাভান ট্র্যাজেডি কেড়ে নিয়েছিলো ১৪৪ জনের প্রাণ। এর মধ্যে ১১৬ জনই শিশু। অ্যাবাভানে যা ঘটেছিল, তা যে একেবারেই আকস্মিক ছিল, তা বললে ভুল বলা হবে। ৭ নম্বর টিপটির অবস্থা অনেক আগে থেকেই বেশ নাজুক ছিল। ১৯৬৩ সালে জোন্স নামের একজন পানিবিষয়ক প্রকৌশলী ন্যাশনাল কোল বোর্ডের কাছে বৃষ্টিতে ঝুঁকিপূর্ণ ৭ নম্বর টিপ ধসে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠান।
ঘন বর্ষায় টিপের কিছু হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্যান্টগ্লাস স্কুল এটাও জানান তিনি। এর পরের বছর গুয়েনেথ উইলিয়ামস নামের একজন কাউন্সিলর এই বর্জ্যরে পাহাড় নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ১৯৬৫ সালে দু’জন মায়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে টিপ নম্বর ৭ অন্যত্র সরানোর আবেদন করেন প্যান্টগ্লাস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অ্যান জেনিংস। তার আবেদনের প্রতি কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। এর ঠিক এক বছর পরই টিপ ধসে প্রাণ হারান জেনিংস।
দুর্ঘটনার পর ২৫ অক্টোবর ১৯৬৬ সালে গঠিত হয় অ্যাবাভান ট্রাইব্যুনাল। প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলা বিচার প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৩৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দী নেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল শেষে এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় ন্যাশনাল কোল বোর্ডকে, যাদের চূড়ান্ত গাফিলতির কারণে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে অ্যাবাভানের আর্থিক সহায়তার জন্য ১.৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের তহবিল গঠন করা হয়। যার মাধ্যমে সাত নম্বর টিপটি অপসারণ করা হয়। পরবর্তীতে অ্যাবাভানে কয়লা উত্তোলন ও পাহাড়ের ওপর কয়লা রাখার ব্যাপারে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

Share.

মন্তব্য করুন