এক সময় অন্যান্য শহরের মতোই বহু লোকের আবাস ছিল সেখানে। সেখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের ব্যস্ততায় জায়গাটি ছিল কোলাহলপূর্ণ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় একসময় তা জনশূন্যে পরিণত হয়। পরে মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যায় তার অবস্থান।
খেমার রাজ্য জনশূন্য হয়ে যাওয়ায় শতকের পর শতক এর অবস্থান সম্পর্কে কারও ধারণা না থাকায় এটি হারানা সাম্রাজ্য হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। বর্তমান ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস আর থাইল্যান্ডের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় সভ্যতাগুলোর একটি। পানিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বেশির ভাগ সভ্যতা, আর এই পানিকে কাজে লাগিয়েই সবচেয়ে দ্রুত নিজেদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে ৮০০ থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত উন্নতির শিখরে থাকা এই খেমার সাম্রাজ্য।
কম্বোডিয়ায় মধ্যযুগীয় খেমার সাম্রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া প্রথম রাজধানীটি খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা। বছরের পর বছর অ্যারিয়াল লেজার স্ক্যান ও ভূমি জরিপের মাধ্যমে গবেষকরা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন মহেন্দ্র পর্বত।
মেকং নদীর কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা রাজধানী অ্যাংকরকে বলা যায় প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিশাল শহর, যা দখল করে রেখেছিল ১,০০০ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জায়গা আর আশ্রয় দিয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে।
৮০২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রাজা জয়বর্মন রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর তিনি মহেন্দ্র পর্বত শহরেই তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। হারিয়ে যাওয়া শহরটি সম্পর্কে গবেষকরা ধারণা করেছিলেন, আধুনিক সিয়েম রিয়প শহরের ৪৮ কিলোমিটার উত্তরে ফনম কুলেনের পাহাড়ি উপত্যকায় এর অবস্থান হতে পারে। কিন্তু দুর্গম পথ, জঙ্গলে ঘেরা ও ১৯৭০ এর দশকে খেমাররুজ শাসনের সময় সম্ভাব্য স্থাপিত মাইনের কারণে স্থানটিতে যাওয়া ছিল দুঃসাধ্য।
ধারণার ভিত্তিতে প্রথমে স্থানটি অ্যারিয়াল লেজার স্ক্যানের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। এর মাধ্যমে দুর্গম পথ ও বনাঞ্চলের মধ্য দিয়েও আকাশ থেকে স্থানটির পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে পরে ভিন্ন ভিন্ন দুটি অভিযানে নামেন গবেষকরা।
অ্যারিয়াল ম্যাপিং এবং ভূমি জরিপের ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা একটি মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে শহরটিতে পৌঁছানোর বিভিন্ন পথ ছাড়াও শহরে অবস্থিত প্রাসাদ, মন্দির এবং অন্য স্থাপনার অবস্থান দেখানো সম্ভব হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে ২০১২ সালে মোট ৩৭ বর্গকিলোমিটারের আয়তনজুড়ে সরাসরি জরিপ চালানো হয়। পরে ২০১৫ সালে সম্পূর্ণ উপত্যকায় জরিপ চালান গবেষকরা। এর আয়তন ৯৭৫ বর্গকিলোমিটার।
প্রতিবেদনে গবেষকরা বলেন, সব প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা আমাদের ধারণা নিশ্চিত করতে পেরেছি। অষ্টম ও নবম শতাব্দীর খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী মহেন্দ্র পর্বত ফনম কুলেনের পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত।
এই শহরের অসাধারণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সাহায্যে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে গিয়েছিলো। পানিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেই শহরের পানির ব্যবস্থা ছিল স্বয়ংক্রিয়, যে কারণে ইতিহাসবিদরা একে উপাধি দিয়েছেন হাইড্রোলিক শহর নামে।
শক্তিশালী অর্থনীতির জোরে খেমার সাম্রাজ্য কম্বোডিয়া ছাড়িয়ে প্রবেশ করলো লাওস, থাইল্যান্ড আর ভিয়েতনামে, সংস্পর্শে এলো পশ্চিমের সুতখোনিয়া সাম্রাজ্য আর পূর্বে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী শ্যামের।
খেমারদের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় জয়বর্মন শ্যামদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন, দখল করে নিলেন বেশ বড় এলাকা। বিশাল বড় সাম্রাজ্যকে ভাগ করা হলো ২০টি প্রদেশে।
পরে চীনের সাথে বাণিজ্য-ব্যবসা তুঙ্গে উঠলো। কাঠ, আইভরি, মশলা, মোম, সোনা, রূপা আর সিল্ক রফতানির অর্থের ভারে অ্যাংকর ডুবে যেতে থাকলো।
তবে এই অবস্থা বেশি দিন চলতে পারেনি, কিছু দিনের মধ্যেই খেমারদের পতন ঘটল। কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় তিনটি বিষয়কে। প্রথমত, ক্রমবর্ধমান বৌদ্ধধর্মের সংস্পর্শে এসে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, অ্যাংকরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও ক্রমশ কমে আসছিল। আর শেষটি হলো, তাদের ক্রমেই বেড়ে চলা বিশাল সাম্রাজ্য সহজেই অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। এভাবেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সাম্রাজ্য। খেমার সাম্রাজ্য।

Share.

মন্তব্য করুন