প্রচ- রোদের তাপে পুরো প্রকৃতি ভয়ানক রকমের উষ্ণ হয়ে রয়েছে। তাপপ্রবাহ প্রকৃতির শ্যামলিমাকে বিনষ্ট করে ফেলেছে। মাঠ-ঘাট-প্রান্তর জনপদ সমূহ যেন প্রখরতার ঝলসাচ্ছে। অবিরাম ধূলিঝড় বয়ে যাচ্ছে। এ রকমের তাপদগ্ধ পরিবেশে এক গির্জের পাদ্রি অরণ্যের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সামনে একটি বড় শালগাছ দেখে তার ঘন ছায়ার নিচে জিরোবার জন্য দাঁড়ালেন। শালপাতা খসে খসে পড়ছে।
পাদ্রি দূরের গির্জের শাদা চূড়োটিকে দেখতে পেলেন। গির্জাটি নীলগিরি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত একটি ছোট গ্রামের শেষ কোণায়। পাশ দিয়ে একটি ছোট খাল এঁকেবেঁকে তিরতিরিয়ে বয়ে গেছে। সেখানকার রুক্ষ পরিবেশে গির্জের পাশে ছোট একটি উদ্যান রয়েছে। সবুজ ঘাসের আস্তরণ। সেখানে গেলে ঘাসের গন্ধ পাওয়া যায়। গির্জের মাঠের মাঝখানে রয়েছে একটি পুরনো জগ্যিডুমুর গাছ। সেই গাছে বাসা বেঁধেছে পায়রারা। সাধারনত পায়রারা বাসা বাঁধে ভবনের অলিন্দে, কার্নিশে!
কিন্তু এখানে পায়রারা বাসা বেঁধেছে ডুমুর গাছে। পাদ্রি গির্জের নিকটে এসে ডুমুর গাছের পায়রার বাসাটির দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। পায়রাদের বাক-বাকুম ডাক তাকে যেন কিছুটা উদাস করে তোলে। পাদ্রির ইচ্ছে হলো পায়রার বাসাটিকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। এটি তার অদ্ভূত ধরনের একটি ইচ্ছে। এ রকমের হঠাৎ করে জেগে ওঠা বিচিত্র ইচ্ছের দরুন তাকে অনেক সময় ঝামেলার পড়তে হয়েছে।
পাদ্রি সেবার গাছে কিছুটা উঠে ঘন পাতা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন। পায়রার খড়কুটোর বাসাতে দেখলেন চারটি ডিম। আর মাত্র ক’দিন পর হয়তো এসব ডিম ফুটে ছানা বেরুবে। কোমল রোমে ঢাকা থাকবে ছানাগুলোর তুলতুলে শরীর। পাদ্রি মনে মনে প্রার্থনা করলেন সেই পায়রা ছানাদের নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্যে। পাদ্রি এর আগে পাশের ঝোপে বনবিড়াল দেখেছিলেন। ডুমুর গাছটি থেকে নেমে এলেন পাদ্রি। এরপর পাদ্রি ঘাসের উপরে বসে তার ছোট ধর্মগ্রন্থ বাইবেলটি পাঠ করতে লাগলেন। এক জায়গায় লেখা আছে, “ঈশ্বর প্রতিটি প্রাণিকে আহার জোগান। তার প্রকৃত প্রেম সর্বদা বিরাজমান থাকে।”
ঘাসজমিতে বসে থাকতে থাকতেই পাদ্রি হঠাৎ করে দেখতে পেলেন যে, তার ঠিক পাশেই থপ করে একটি জিনিশ এসে পড়ল। ঐ নরম জিনিশটা পড়েই কুঁচকিয়ে যায়। পাদ্রির ধারনা হলো ঐ জিনিশটা হয়তো মহাকাশ থেকে ছিটকে আসা কোন যানের অংশবিশেষ। তখন এরকমভাবে আকাশ থেকে কোন মহাকাশযানের টুকরো অংশ ভেঙেচুরে পৃথিবীর বুকে এসে পড়ত। সে সময় মানুষ বিশেষ ব্যবস্থায় মহাকাশভ্রমণে যেত। স্বল্পসংখ্যাক সেইসব মানুষেরা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের বিত্তশালী। যারা পৃথিবীতে বিশাল সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল।
পাদ্রি আবার তার পাশে ছিটকে পড়া জিনিসটির দিকে তাকালেন। তিনি বিভিন্ন বইতে যে ধরনের মহাকাশযানের চিত্র দেখেছেন সেগুলো ছিল শক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি। দেখলেই জিনিশটির কাঠিন্যকে বোঝা যেত। অথচ খানিকক্ষণ আগে ওপর থেকে য এসে পড়ল তা জেলির মতো থকথকে কোনো নমনীয় জিনিশ দিয়ে তৈরি। এটা যেন মোটেই মহাকাশযানের কোন অংশের রূপকে ফুটিয়ে তুলছে না। পাদ্রি জানেন অনেক সময় মিশন স্কুলের ক্লাশের কোন দুষ্টু ছেলেরা বাইবেলের চাইতেও অধিক মনোযোগ দিয়ে দেখে রঙিন কমিকস বই। উৎসাহের সাথে সেগুলো পাঠ করে। অনেক সময় ক্লাশের শিক্ষিকা ভগিনীরা সেসব কমিকস বই বাজেয়াপ্ত করে এনে তার নিকট জমা দিয়েছে। তিনি ছিলেন মিশন স্কুলের পাঠ্যসূচির দায়িত্বে।
পাদ্রি সেসব বইতে দেখেছেন এমন সব মহাকাশ যানের চিত্র যেগুলো মাঠ-ঘাট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে গর্ত তৈরি করে। সেখানে মহাকাশযানগুলোকে দেখায় অনেকটা চকচকে স্টিলের থালা-বাসনের মতো। অথচ পাশে থপাস করে পড়া জিনিশটি মোটেই সে রকমের নয়।
মিশন স্কুলের বিভিন্ন ক্লাশ-কক্ষ থেকে জব্দ করে আনা কমিকস বইগুলো দিনের শেষে শিক্ষার্থীদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার আগে পাদ্রি অবশ্য তা গোপনে পাঠ করেন। এতে তিনি অনেক নতুন কিছু চাঞ্চল্যকর বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। তিনি তাই ভালো করেই জাননে যে, মহাকাশগুলো কতো রকমের শব্দ করে। রশ্মি বিকিরণ করে পৃথিবীতে এসে পড়ে। আর সেই বিকিরণ আভাকে আশ্চর্য সুন্দরভাবে ঢেউ খেলানো অবস্থায় চারপাশে ছড়িয়ে দেয়। অথচ তার পাশে এসে থপ করে পড়া জিনিশটির বেলায় তার কোন কিছুই ঘটল না। এটা যেন এলো মৃদু বাতাসে ভাসতে ভাসতে। আর নেমে এসেই জগ্যিডুমুর গাছটির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ল। পড়ামাত্রই কীরকম থলথলে হয়ে ছড়িয়ে গেল।
পাদ্রি অবশ্য এই বিষয়টিকে তুচ্ছভাবে দেখলেন না। তার ধারণা জন্মাল, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ বিদ্যমান রয়েছে। তার এমনতর বিশ্বাস রয়েছে যে কোন কিছুই অর্থহীন নয়। পাদ্রি তার স্বভাবনুযায়ী ধীর-স্থিরভাবে অপেক্ষা করতে থাকে। আসলে তিনি খুবই শান্ত প্রকৃতির একজন মানুষ। কোনোরূপ ঘটনা ঘটলে তিনি তা ভালোভাবে নিরীক্ষণ করেন। পর্যালোচনা করেন। তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। হটকারি কোন মন্তব্য করেন না। আচমকা কোন সিদ্ধান্ত দেন না। আর এ কারণেই তিনি এতোটা নিখুঁতভাবে কাজ সম্পাদন করতে পারেন।
পাদ্রি এবার তার চিন্তা-ভাবনা দিয়ে পাশে পড়া থকথকে জেলির মতো নমনীয় জিনিশটিকে নিরীক্ষণ করতে থাকেন। পাদ্রি এ কথা ভেবে দারুণভাবে শিহরিত হরেন যে ঈশ্বর স্বয়ং তাকেই নির্বাচিত করেছে। তিনিই হচ্ছেন সেই প্রথম মানুষ। যে ভিনগ্রহ থেকে আসা মহাকাশযানের কোনো একটি টুকরো অংশের এমন অবতরণের প্রক্রিয়াটিকে অবলোকন করবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
ওপর থেকে ছিটকে আসা থলথলে জিনিশটি ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে বিশালাকৃতি ধারণ করে একটি মহাকাশযানের রূপ নিলো। এই চরম বিস্ময়কর ঘটনাটিকে দেখে পাদ্রি নিশ্চিত হলো যে ঈশ্বরই তাকে বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখার জন্য নির্বাচিত করেছে। ঐ স্থানটি ছিলো একেবারেই জনবিরল। গির্জের আশপাশে তখন কোন জনমানুষ ছিলো না। পাদ্রির বিশ্বাস এই অকল্পনীয় ঘটনাটিকে তার সামনে ঘটানো হয়েছে তার উপলব্ধির জগতে নতুন এক বোধ জাগ্রত করতে। যে বোধে অনুপ্রানিত হয়ে তিনি মানুষের মাঝে নব জ্ঞান সঞ্চারিত করতে পারবেন।
এখন এই নিরিবিলি স্থানে, চারপাশে শুকনো মরুভূমির মাঝখানের মরুদ্যানে, সবুজ পাহাড়ের কোলে রয়েছেন কেবলমাত্র তিনি আর এই মহাকালযানটি। এই রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে। পাদ্রি এবার সিদ্ধান্ত নিলেন যে ঐ অদ্ভুত আকৃতির মহাকাশযানটিকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবেন। এমন নিশ্চল অবস্থার রয়েছে যে, এটা কোন কিছু করবে তা মনে হচ্ছে না। যানটিকে বিচিত্র ধরনের বলে মনে হচ্ছে না। যানটিকে বিচিত্র ধরনের বলে মনে হচ্ছে। অদ্ভূত আকৃতির যানটিতে কোনো রকমের প্রবেশপথের চিহ্ন নেই।

দরজা জানালা নেই। চোখ রাখার মতো কোন ফুটোও নেই। যানটি লম্বায় হবে ত্রিশ ফুট। দেখতে লালচে রঙের বেলুনের মতো। জমি ছোঁয়ার জায়গাটি টায়ারের মতো হয়ে আছে। পাদ্রি যেই মাত্র সেই জিনিশটিতে হাত দিলেন অমনি তার শরীররটা সিরসিরিয়ে কেঁপে উঠল। পাদ্রির ¯œায়ূতন্ত্রীতে প্রবলভাবে কাঁপন জাগল। তার শিরা উপশিরার ভেতর দিয়ে যেন স্ফুলিঙ্গ ঝিলিক মেরে বয়ে গেল। এমনতর বিচিত্র অনুভূতি এর আগে আর কখনো হয়নি পাদ্রির। জিনিশটি থেকে চমৎকার সুগন্ধ বেরুচ্ছে। পাদ্রির একবার সাধ হচ্ছিল জিনিশটা চেখে দেখতে। জিভ ছোঁয়াতে। পাদ্রি হঠাৎ করে দেখতে পেলেন যে জিনিসটার এক জায়গাতে একটি ফুটো তৈরি হয়েছে। ধীরে ধীরে সেই ফুটোটা ক্রমশ বড় হতে থাকে। একসময় ফুটোটা গর্তের আকার ধারণ করল। তাই দেখে ধক করে উঠল পাদ্রির বুকটা। তিনি তখন তার বুকে একটা ক্রশচিহ্ন আঁকলেন। এতে অশুভ শক্তির ক্রিয়া থেমে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। ক্রশচিহ্ন আকাতে আর কোন কিছু ঘটলো না। পাদ্রি স্বস্তি পেলেন। ফুটোর দিকে এগিয়ে গেলেন। তার ভীষণ রকমের ইচ্ছে হচ্ছিল ঐ ফুটোর ভেতরে মাথাটি ঢুকিয়ে ভেতরের অংশটা দেখতে।
এক ধরনের ভীতি জাগল পাদ্রির মনে। মহন হলো মাথা ঢোকানোর পর মুহুর্তে যদি মাথা সুদ্ধ ফুটোটা কপ করে বন্ধ হয়ে যায়! তখন তো তার মাথা সেখানে আটকা পড়ে যাবে। তার ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে থাকবে। তিনি তার মাথাটিকে টেনে আর ছাড়িয়ে নিতে পারবেন না। দৃশ্যটা ভাবতেই পাদ্রি আতঙ্কে জমে গেলেন। আবার যেই মাত্র মনে হলো ঈশ্বর তাকে দিয়ে একটা জটিল বিষয়ের পরীক্ষা করিয়ে নিতে চাইছেন তখন যেন তার সম্বিৎ ফিরে এলো। আবার শরীরে শক্তি খুঁজে পেলেন। আবার তার ¯œাযূ টানটান হয়ে উঠল। পাদ্রি অবাক হয়ে দেখলেন যে ঐ ফুটোটি দিয়ে একটি মাথা ঘষটে ঘষটে বেরিয়ে আসছে। এটা নিশ্চয়ই কোন ভিনগ্রহীর মাথা। তার পুরো অবয়বটা এখনো দৃশ্যগোচর হচ্ছে না।
এভাবে ফুটো গলে একটি মাথাকে বেরিয়ে আসার দৃশ্যে পাদ্রি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। তিনিই সম্ভবত সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী পৃথিবীর প্রথম একজন মানুষ যে কিনা একজন ভিনগ্রহীর সাক্ষাৎ পেয়েছে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে পাদ্রি ঐ বিচিত্র প্রাণিটিকে দেখতে লাগলেন। তার চোখের সামনে যেন এক রহস্যে ঢাকা দরোজা খুলে গেছে।

পাদ্রি অনুমান করলেন যে ঐ বিচিত্র প্রাণির মাথাটি হবে তার সমান আকৃতির। চুলগুলো যেন মাথার সাথে আঠা দিয়ে আটকানো। আর চুলগুলো নকশা করে সাঁটা। দু’টো গোল গোল বাাদামি ধূূসর রঙের চোখ। সেই চোখে কোন হিং¯্রতার ছাপ নেই। ক্রূরতার ঝিলিক নেই। প্রাণিটির চোখের পাতাটি বন্ধ হয় কোণা থেকে মাঝের দিকে। অনেকটা যেন স্লাইডিং দরোজার মতো। পাণিটির নাকের ফুটোর স্থানে আছে চুলের গোছার মতো জিনিশ। তাতে নাকের ফুটোটি বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। পাদ্র্রির মনে প্রথমেই তখন প্রশ্ন জাগল এই যে প্রাণিটি তাহলে কীভাবে শ্বাসকার্য চালায়। প্রাণিটির কদাকার মুখ গহ্বর দেখে শিরশির করে উঠল পাদ্রির শরীর। বীভৎস ধরণের মুখাকৃতি। সামনে দু’টো লম্বা বাঁকানো দাঁত। ওপরে ঠোঁট নেই। কিন্তু সেই ভয়ংকর ভাবটি কেটে যায়। এমন অদ্ভুত রূপ দেখে পাদ্রির কেন জানি হাসি পায়। ভয়ের পরিবর্র্তে হাসি। পাদ্রি তখন ফিক করে হেসে ফেলে। সাথে সাথে ঐ প্রাণিটাও হাসে। সে যেন পাদ্রির হাসির প্রত্যুত্তর দিলো। প্রাণিটির শাদা, বড় বাঁকানো দাঁত চকচকিয়ে ওঠে।
পাদ্রির কাছে প্রাণিটির মুখাবয়ব দেখে ধারণা হলো যে এর সাথে অনায়াসেই ভাব বিনিময় করা যেতে পারে। প্রাণিটি তার ভাষা বুঝতে সক্ষম হবে। পাদ্রি স্মিত হেসে বললেন সুপ্রভাত। প্রাণিটিও তখন প্রতিধ্বনি করল, সুপ্রভাত। পাদ্রি দ্বিধাজড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার ভাষা কি আপনি বুঝতে পারছেন?’ তখন একই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। পাদ্রি বললেন, ‘আপনি এবার এটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসুন।’ পাদ্রি তার হাত-পা নেড়েচেড়ে নানা রকমের ইঙ্গিতের সাহায্যে প্রাণিটিকে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টাকে বোঝাতে চাইলেন। এ জন্যে তাকে খানিকটা কসরত করতে হলো। মনে হলো প্রাণিটি পাদ্রির ইঙ্গিতগুলো বুঝতে পেরেছে। তার মধ্যে ভাবান্তর দেখা যায়। প্রাণিটি তার চোখের স্লাইডিং দরোজা বার কয়েক খুলল আর বন্ধ করল। মনে হয় প্রাণিটি বোধহয় এই পদ্ধতিতেই চিন্তা-ভাবনা করে থাকে।
পাদ্রি দেখল এরপর সেই মহাকাশযানের ফুটোটা ক্রমশ বড় হতে শুরু করেছে। এক সময় ফুটোটা বেশ বড় হলো। এখন তার ভেতর থেকে প্রাণিটির শরীর গলিয়ে বের হয়ে আসাটা সম্ভবপর হবে।
পাদ্রি দেখল প্রাণিটি সচল হয়ে উঠছে। সে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে ভেতর থেকে গড়িয়ে নামা শুরু করল। টিউব থেকে যেমন করে টিপলে টুথপেষ্ট বেরোয় সেভাবেই প্রাণিটির লম্বা শরীর বেরিয়ে আসে। আর বেরিয়ে এসে প্রাণিটি তার শরীরটটাকে জোরালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিয়ে পুনরায় নিজের সঠিক মাপে নিয়ে যায়। ঐ মাপটি ছিল পাদ্রির দ্বিগুণ লম্বা। চওড়াও ছিল দ্বিগুণ। বিচিত্র প্রাণিটি দেখতে ছিল মানুষের মতো। প্রাণিটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে সে তার আঙ্গুলগুলো হাতের মধ্যে ইচ্ছেমতো ঢোকাতে পারে ও বন্ধ করতে পারে। তার শরীরে রোম মাথার চুলের মতো। ঘন হয়ে থাকা ছাঁটা ঘাসের মতো। শরীরে রয়েছে কালো আর রুপোলি ডোরাকাটা দাগ। চকচকে রুপোলি নাট-বল্টুর মতো জিনিশ শরীরের নানা জায়গাতে রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাণিটিকে বিচিত্র এবং কিম্ভূতকিমাকার দেখাচ্ছে। পাদ্রি ভাবছেন, এ ধরণের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারলে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জনের এক মস্ত সুযোগ পাবেন।
এই সুযোগটির সর্বোত্তম ব্যবহার করা উচিত। পাদ্রির কাছে মনে হলো তিনি যদি এই প্রাণিটির সাথে যথাযথভাবে কথা বলতে পারতেন তাহলে খুব উপকার হতো। তার জানার পরিধিটা তাহলে বহুুগুণে বেড়ে যেত। এক অবিশ্বাস্য ভুবনের সাথে তিনি পরিচিত হতে পারতেন। কিন্তু এখন সেটা কোনমতেই সম্ভবপর হচ্ছে না। তিনি প্রাণিটিকে উদ্দেশ্য করে যে কথাই বলছেন প্রাণিটি তখন শুধুমাত্র সেটারই প্রতিধ্বনি করছেন। প্রশ্নের কোন উত্তর পাচ্ছেন না। প্রাণিটির বক্তব্য জানতে পারছেন না। হঠাৎ কিছু একটা মনে হওয়াতে পাদ্রি তার হাতে ধরা প্রার্থনাসংগীতের বইটিকে বাড়িয়ে দিলেন প্রাণিটির দিকে। প্রানিটি সেটা গ্রহণ করল। তাপরপর বইটি নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। প্রাণিটি তার চকচকে রুপোলি আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে থাকে বইতে মুদ্রিত অক্ষরগুলোর ওপরে। তারপর ক্রশ চিহ্নটার দিকে হাত তুলল। সেই সাথে পাদ্রির গলায় ঝুলে থাকা ক্রশটার দিকে হাত বাড়াল। সেটাকে স্পর্শ করল। ক্রশ চিহ্নটার ধারগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর হেসে বইটিকে ফেরত দেয়।
এই ঘটনাটি পাদ্রিকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। তার মন আনন্দে ভরে যায়। তিনি যেন ভিনগ্রহী এই বিচিত্র প্রাণিটির সাথে এবার মতবিনিময় করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রাণিটির মনে ভাবান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রানিটি চমৎকারভাবে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। এবার নিজের প্রার্থনাসংগীত বইটির ওপর মুগ্ধ বিস্ময়ে হাত বোলালেন পাদ্রি। তার মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির ছাপ। তার এরকম বোধ জন্মাল যে এটাই হচ্ছে কোন ভিনগ্রহীর হাতের স্পর্শিত পৃথিবীর একমাত্র গ্রন্থ। বিষয়টা তাকে যথেষ্ট রোমাঞ্চিত করল। এরপর ভিনগ্রহীর ফুটোর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে এক গোছা ছোট ধাতব চাকতি বের করে আনল। চাকতিগুলোর ওপরের দিকটা চাবির রিংয়ের মতো একত্রিত করা। তার প্রতিটিতে রয়েছে দৃষ্টিহীনদের উপযোগী ব্রেইল পদ্ধতির লেখার বাঁধের মতো ছবি। সেসব ছবি কিছুটা উঁচু করে তোলা। তারা যেন পাদ্রির আঙুলের নিচে কথা বলতে চাইছে। সেই ছবিগুলো ছিল অদ্ভুত আকৃতির সব চাকর আর যন্ত্রপাতির। পাদ্রি কৌতুহলবশত চাকতিগুলোকে ধরলেন। ছবিগুলোর মধ্যে একটা ছিল সেই মহাকাশযানের। তিনি তখন মহাকাশযানটিকে একবার ছুঁয়ে দেখলেন। তারপর চাকতিটাকে পুনরায় ধরলেন। ঠিক যেভাবে ঐ প্রাণিটি ধরেছিল তার ক্রশচিহ্নটিকে।
এবার ভিনগ্রহীটা পাদ্রির মুখের ওপর আলতো করে তার রুপোলি আঙুলগুলো বুলিয়ে দিলো। পাদ্রির কাছে তখন মনে হচ্ছিল প্রাণিটি তাকে পছন্দ করেছে। হঠাৎ করে প্রাণিটি সরে গিয়ে একটি বড় গাছের বাঁকানো ডালের দিকে এগিয়ে যায়। প্রাণিটি তার চকচকে দাঁত বের করে গাছের ডালটা ধরে তাতে জোরে কামড় দিল। তারপর পাতাসহ ডালের এক টুকরো মুখে পুরে কপ করে গিলে ফেলল। এবার প্রাণিটি মাটিতে ধপাস করে বসে পড়ে। সাথে সাথে পাদ্রিও বসলেন। প্রাণিটি তখন ওয়াক ওয়াক করে তার মুখের ভেতর থেকে জিনিসগুলোকে উগরে দেয়। এরপর প্রাণিটি যায় বিভিন্ন গাছের কাছে। আর প্রতিবারই গাছের ডালের যেসব টুকরো অংশ খেল তা আবার উগরে দিল। পাদ্রির ধারণা হলো যে প্রাণিটি ভীষণ রকমের ক্ষুধার্ত। তাই অমন করে খাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। প্রাণিটি আবার তার মহাকাশযানের কাছে ফিরে যায়। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যায় গর্তের ভেতরে। এবার পাদ্রি খুব সাবধানে এগিয়ে যায় মহাকাশযানটির দিকে। ভেতরে কী হচ্ছে সেটা উঁকি দিয়ে দেখতে চায়। এমন সময় ফুটো দিয়ে প্রাণিটির মুখ বেরিয়ে আসে।
পাদ্রি চট করে পিছিয়ে যায়। তখন প্রাণিটি একটা বড় বাকসোকে সাথে করে বেরিয়ে আসে। সেই বাকসোটাকে সন্তর্পনে রাখে ঘাসের ওপরে। তারপর পাদ্রির দিকে তাকিয়ে হাত তুলে তার কাছে যাওয়ার জন্য ইশারা করে। কি যেন উচ্চারণ করে তার দুর্বোধ্য ভাষায়। তবে প্রাণিটির ইংগিতের ধরন দেখে পাদ্রি অনুমান করতে পারে। প্রানিটি চাইছে পাদ্রি ঐ বাকসোটাকে দেখুক। পাদ্রি আগ্রহ নিয়ে বাকসোটাকে দেখল। ওটার ওপরে একটা ফুটো পাশে বড় একটা ফাঁক। তার ওপরে রয়েছে চকচকে একটা জিনিশের ভাঙা টুকরো। লালচে রঙের তার থেকে কয়েকটি টুকরো ঝুলছে। পাদ্রি ইশারা ইঙ্গিতে প্রাণিটির কাছে জানতে চাইলেন, এটা দিয়ে কী হয়?
পাদ্রির দিকে তাকালো প্রাণিটি। বারকয়েক তার চোখের স্লাইডিং দরোজাটি খুলল আর বন্ধ করল। এরপর গাছের একটি ভাঙা ডাল ঢুকিয়ে দিলো ওপরের ফুটো দিয়ে। ডালের খাঁজকাটা জায়গাটিতে হাত বুলিয়ে সেই হাত মুখে পুরে দিল। এটা দেখে পাদ্রির কাছে মনে হলো যে এটা বোধহয় ওদের খাদ্য তৈরি করার যন্ত্র। ভেঙে যাওয়াতে যন্ত্রটির এখন বেহাল অবস্থা হয়েছে। কাজ করতে বিপত্তি ঘটছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে কাজটি করতে পারছে না। পাদ্রির বন্ধমূল ধারণা হলো যে প্রাণিটি ভীষণ রকমের ক্ষুধার্ত। পৃথিবীতে এভাবে অবতরণ করার কোন রকমের পরিকল্পনাই হয়তো তার ছিলো না। সে মহাকাশযান করে উড়ে যাচ্ছিল। মহাশূন্যে খাদ্য তৈরি করার যন্ত্রটি বিকল হয়ে যাওয়াতে তাকে নিরুপায় হয়েই পৃথিবীতে এভাবে অবতরণ করতে হয়েছে। প্রাণিটি ক্ষুধার জন্যে ভয়ানকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে। এখনই যদি তাকে খাদ্য সরবরাহ করা না হয় তবে বিপত্তি ঘটবে। প্রাণিটি হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে। না জানি কতোদিন ধরে এই প্রাণিটি অভুক্ত অবস্থায় রয়েছে। তিল তিল করে নিঃশেষিত হয়েছে তার প্রাণশক্তি।
পাদ্রি মমতামাখা কন্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার জন্য এখনই খাবারের ব্যবস্থা করছি। তুমি এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।’ পাদ্রি জানতেন যে প্রাণিটি তার কথা ভাষাকে বুঝতে পারবে না। কিন্তু ইশারা ইঙ্গিতের ভঙ্গি দেখে বিষয়টাকে অনুধাবন করতে পারবে। পাদ্রি তখন কোণাকুণিভাবে মাঠটা পেরিয়ে গির্জের দিকে চললেন। তা আলখাল্লাটি ঘষা খাচ্ছিল ঘাসফুলের সাথে।
পাদ্রি মাঠের একপাশের রান্নাঘরে গিয়ে একটা বাকসে তাকে রাখা নানা ধরনের খাবার তুলে ভর্তি করলেন। সেখানে কেউ ছিল না। এখানে যে স্বল্প ক’জন লোক থাকতো তারাও বিশেষ প্রয়োজনে দূর পাহাড়ে চলে গেছে। বলা যায় ঐ অঞ্চলটি তখন জনপরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। সেই অঞ্চলে আকস্মিকভাবে যে একটি মহাকাশযান অবতরণ করেছে তা এই পাদ্রিটি ছাড়া আর কেউ জানে না। অন্য কারোরই গোচরীভূত হয়নি বিষয়টি। আর মহাকাশযানটিও ঢাকা পড়ে আছে গাছের আড়ালে। পাদ্রি রান্নাঘর থেকে খাবারভর্তি বাকসোটি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন মহাকাশযানে। প্রাণিটির সামনে খুলে ধরলেন বাকসো। প্রাণিটিকে ইঙ্গিতে জানালেন বাকসো থেকে খাবার তুলে নিয়ে খেতে। প্রাণিটি খাবার তুলে নিয়ে তার মুখে পুরে দিতে যাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কোন খাবারই যে তার পেটে সইলো না। প্রাণিটি সমস্ত খাবারই উগরে দেয়। আর এভাবে খাবার উগরে দেয়ার জন্য প্রাণিটি কেমন অস্থির হয়ে যায়। খেতে না পারার দুঃখে সে বিরক্ত হয়। ভিনগ্রহীটা তখন পাদ্রিকে ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করতে থাকে।
তার কথার কোন অর্থ পাদ্রি বুঝতে পারছিল না। কী বলতে চাইছে এই অদ্ভূত প্রাণিটি? প্রাণিটির হাঁ করা মুখ পাদ্রির মাথার ওপরে নড়ছিল। আর প্রাণিটি শক্তভাবে পাদ্রির হাত ধরে ছিল। পাদ্রি প্রাণিটির রুপোলি আঙ্গুলগুলো ছুঁ’লেন। তারপর মমতামাখা কন্ঠে বললেন, ‘এবার তুমি ক্ষান্ত হও, পুত্র আমার।’
পাদ্রি তখন ¯েœহকাতর দৃষ্টিতে প্রাণিটির রুপোলি ধূসর চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। একসময় প্রাণিটি পাদ্রিকে ছেড়ে দিয়ে পেছনে সরে যায়। পাদ্রির দিকে তাকায়। মাটি থেকে ধুলো তুলে মাথার ওপরে ছড়িয়ে দেয়। পাদ্রি মাথা নত করে মৃদু হাসলেন। প্রাণিটাও হাসলো।
রাত গভির হয়েছে। পাদ্রি প্রাণিটিকে কিছুই খাওয়াতে না পেরে হতাশ। ভাবছেন, আজ তো এটাকে কোনভাবেই খাওয়ানো গেল না। আগামীকাল নতুনভাবে পরিকল্পনা করে খাওয়াতে হবে। চেষ্টা করতে হবে। এমন ধরনের কিছু খাদ্য সে নিশ্চয়ই জোগাড় করতে পারবে যা কিনা এই প্রাণিটা খেতে পারবে। পাদ্রি ভাবছেন রাতের বেলায় হয়তো কোন কিছু আর ঘটবে না। প্রাণিটা রাতে হয়তো ঘুমোয়। হয়তো বা ঘুমোয় না।
এই ভয়ংকার নির্জন মাঠে থাকা রুপোলি বেলুনের মতো মহাকাশযানটিকে কেউ এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলবে না। আর ভিনগ্রহী প্রানিটার জন্যেও কোন ধরনের বিপদ নেমে আসবে না। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে পাদ্রি ঈশ্বরের নিকট ঐ প্রাণিটির জন্যে প্রার্থনা করলেন।
পরদিন ভোরে গির্জের প্রার্থনাসংগীত শেষ হলে পাদ্রি এক ঝুড়ি খাবার নিয়ে মাঠের দিকে চললেন। জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল শরীর ধোবার সাবান, এক বয়াম চিনি, বনরুটি, এক গোছা দড়ি, দেয়াশলাই, এক বোতল মবিল তেল, এক জোড়া দস্তানা, এক বোতল পানি আর মোমবাতি। গাঁয়ের একটা ছোট গির্জেতে যত রকমের জিনিস থাকতে পারে তার সবই নিলেন। ঝুড়িটা নিয়ে মাঠে নেমে আসতেই পাদ্রির কেমন যেন শিরশিরে অনুভূতি শুরু হলো। তিনি দেখতে পেলেন, দূরে কয়েকটা কুচকুচে কালো রংয়ের পাখি মাঠের ওপরে চক্রাকারে ঘুরছে। পাদ্রির চিন্তা হলো, পাখিগুলো কেন ঘুরছে? কাছে আসতেই পাদ্রির নিকটে ব্যাপারটা পরিস্কার হলো। মাঠের মাঝে গির্জের পাশের গো-শালার একমাত্র কালো গরুটা ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে। বোঝা গেল ভিনগ্রহী প্রাণিটা ঐ গরুটিকে খাবার জন্যে চেষ্টা করেছিল। পাদ্রি চোখের সামনে এ রকম একটি ভয়ানক দৃশ্য দেখবেন তা কল্পনাও করেননি। তিনি কম্পিত হাতে বুকের ওপরে ক্রশ চিহ্ন আঁকলেন। এ ধরনের অশুভ শক্তির প্রকোপ দেখতে পেলে শুভ চিহ্নের প্রতীক আঁকতে হয়। পাদ্রি দেখলেন গরুটিকে ঘাড় মটকে মারা হয়েছে। গরুর শরীর থেকে মাংস খুবলে খুবলে তুলে নেয়া হয়েছে। সেই মাংস ক্ষুধার্ত ভিনগ্রহী প্রাণিটির পেটে যায়নি। চারপাশে মাংসের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শকুনেরা সেগুলো খাচ্ছে। পাদ্রি এরকম বীভৎস দৃশ্য দেখতে চাইছিলেন না। তিনি মহাকাশযানটির দিকে দ্রুতগতিতে ছুটলেন। ছোটার সময় দেখলেন ভিনগ্রহী প্রাণিটাও একটা ছাগলকে ধাওয়া করে ছুটছে। ছাগলটা হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে একটা ঝোপের ভেতরে পড়ল। অমনি ভিনগ্রহী প্রাণিটা ঝাঁপিয়ে পড়ল দুমড়ে যাওয়া ছাগলটির ওপরে। তারপর ছাগলটির শরীরে এলোপাথাড়ি রুপোলি আঙুল দিয়ে থাবা বসাতে লাগল। আঁচড়াতে লাগল। ছাগলটার বুক থেকে মাংশ টেনে টেনে তুলতে থাকে। শিহরিত পাদ্রি সেদিকে ছুটে গিয়ে একপাত্র পানি দিয়ে প্রাণিটিকে কোনমতে শান্ত করতে চাইলেন। প্রাণিটি তখন ঢকঢকিয়ে পানি পান করল। তারপর নিজের মহাকাশযানটির কাছে চলে গেল। মহাকাশযানের কাছে গিয়ে ভিনগ্রহী প্রাণিটি গর্তের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ছোট মতো কী যেন একটা জিনিশ নিয়ে ফিরে আসে। পাদ্রি জিনিশটাকে দেখে প্রচ-রকমের বিস্মিত হয়ে গেলেন। এ তিনি কী দেখছেন। এতো হুবহু ঐ প্রাণিটির একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। অবিকল একই রকমের দেখতে। আকারে প্রাণিটির তুলনায় অনেক ছোট। আর সেটা ছিল এক মেয়ে প্রাণি। মনে হলো, এটি হচ্ছে সেই প্রাণিটির সন্তান। এরপর প্রাণিটি ভেতর থেকে আরো দু’টো প্রাণিটিকে বের করে আনলো।
পাদ্রি ভিনগ্রহী প্রাণিটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন গতকাল তিনি ওর রুপোলি আঙুলের মধ্যে যে ছোট আকৃতির নাটবল্টুর মতো জিনিস দেখেছিলেন সেগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। এর অর্থ সেগুলোই ছিল এই সব শিশু প্রাণির জন্মের গর্ভে। এই ভিনগ্রহী মেয়ে প্রাণিটির তাহলে মোট ক’টি সন্তান রয়েছে। নতুন ভিনগ্রহী শিশুগুলো তখন ঘাসের ওপরে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। ঐ মেয়ে ভিগ্রহীটা তখন পাদ্রির হাতের ঝুড়িটা থেকে একের পর এক জিনিশ বের করে মুখে পুরছে আর ফেলে দিচ্ছে। এই পৃথিবীর কোন কিছুই কি তাহলে তার পেটে সয় না! কোন কিছুতেই রুচি খুঁজে পাচ্ছে না। সবকিছুই স্বাদবিহীন মনে করছে। পাদ্রি বিষয়টাকে ভালো করে বোঝার জন্য একটা ভিনগ্রহী শিশুকে কোলে তুলে নিলেন। তার হাতের তালুতে খুদে প্রাণিটি সহজেই এঁটে যায়। হঠাৎ আর্তচিৎকার করে উঠল পাদ্রি। সেই চিৎকার শুনে মা প্রাণিটি তাকালো তার দিকে। পাদ্রি তখন তার রক্তমাখা আঙুলটাকে তুলে ধরল। অসহ্য যন্ত্রনা অনুভূত হচ্ছে তার। শিশু প্রাণিটি তার আঙুল সাংঘাতিকভাবে কামড়ে দিয়েছে। কাটা আঙুল থেকে টপটপিয়ে রক্ত ঝরছে।
পাদ্রি মা প্রাণির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, ইশ, কী ভয়ানক কা- করেছে তোমার সন্তান। সে কামড়ে আমার থেকে মাংশ তুলে নিয়েছে। আমার তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে। পাদ্রি আতঙ্কিত হয়ে দেখল মা প্রাণির হাতে ধরে রাখা শিশু প্রাণিটি তার আঙুলের টুকরোটাকে আয়েস করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। সেই খাবারটা কিন্তু তার মুখের ভেতর থেকে আর উগরে বের করে দিল না।
মা প্রাণির স্লাইডিং দরোজার মতো পলক ফেলা চোখে একটা অদ্ভুত ধরনের চাহনি খেলা করছে।
নিজের সন্তানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সেই দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারে পাদ্রি। আর বুঝতে পারামাত্র পাদ্রির শরীরে রক্ত হিম হয়ে যায়। পাদ্রির মনে হলো মা প্রাণিটি এখন এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছে যে এবার তারা তাদের উপযোগী খাদ্যের সন্ধান পেয়ে গেছে। আর সেটা হলো গিয়ে মানুষের মাংশ। একমাত্র মানুষের মাংশই তাদের ভক্ষনযোগ্য। উনাদের খাবার। মানুষের মাংশই শুধুমাত্র তাদের উদরে এখন সহ্য হতে পারে। পৃথিবীর অন্য কোন খাবার দিয়েই এদের খিদে মেটানো যাবে না। বিষয়টি চিন্তা করে পাদ্রি আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এ কী ভয়ংকর তাদের ক্ষুধার রূপ। পাদ্রি ভীত হয়ে দেখল ভিনগ্রহী প্রাণিটি ধীরে লোভাতুর চোখে এগিয়ে আসছে তার দিকে। প্রাণিটি একেবারে তার কাছে চলে এসেছে। প্রাণিটির ধারাল দাঁত ঝিলিক দিয়ে উঠল। পাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে স্থাণুর মতো।
অকস্মাৎ এক অভাবনীয় কা- ঘটে যায়। এরকম যে ঘটতে পারে পাদ্রির তা ধারণাতেও ছিল না। পুরো পরিবেশটাকে ভীষণভাবে পালটে দিল প্রাণিটি। পেছন ফিরে সটান দৌড় দিল। হতচকিত হয়ে পড়ে যায় পাদ্রি। তার ধারণা ছিলো এখনই ভিনগ্রহী প্রাণিটি ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপরে। তারপর ধারাল নখের আঁচড়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে। সে তো ঐ প্রাণিটির নিকট ছিল উপাদেয় খাবার। অথচ তাকে কোন রকম আঘাত না করেই চলে গেল ভিনগ্রহী প্রাণিটি। যাওয়ার সময় প্রাণিটি তার শিশু সন্তানদের ঘাসজমির ওপর থেকে কুড়িয়ে নিলো। প্রাণিটি মহাকাশযানের কাছে গিয়ে তার সন্তানগুলোকে এক এক করে ঢুকিয়ে দিল যানের গর্তের ভেতরে। সবশেষে নিজে ঢুকে পড়ল। পাদ্রি শেষবারের মতো দূরাগত প্রাণিটির রুপোলি কালো ডোরাকাটা হাতটিকে বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে দেখতে পেল। চোখের নিমিষে মহাকাশযানের ফুটো বন্ধ হয়ে যায়। চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো যানটি ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে উঠল। তারপরেই সেটা সোজা ওপরের দিকে উঠল। শাঁ করে আকাশে উড়াল দিয়ে মিলিয়ে গেল। পাদ্রি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গির্জের দিকে হেঁটে যেতে লাগলেন। ভিনগ্রহী প্রাণিটির এভাবে চলে যাওয়াটা তার কাছে অদ্ভুত এক রহস্য হয়ে রইল।

(একটি বিদেশী কাহিনির ছায়া অবলম্বনে)

Share.

মন্তব্য করুন