‘মা! মা!’ হুড়মুড়িয়ে বাসায় ঢুকল আরিফ।
‘কিরে আরিফ, তোকে আজ বেশ খুশি খুশি লাগছে,’ মা জিজ্ঞেস করল। ‘কী ব্যাপার।’
‘মা, আমরা পরশু স্কুলের পক্ষ থেকে রাঙামাটি পিকনিকে যাচ্ছি,’ আরিফ ব্যাগ-জুতা খুলতে খুলতে জবাব দিল। ‘শুধু ক্লাস সেভেন।’
‘তা, পরশু তো শুক্রবার,’ মা মনে করিয়ে দিল। ‘আচ্ছা এসব কথা পরে বলবি। হাত-মুখ ধুয়ে আগে ভাতটুকু খেয়ে নে। রোদ থেকে এসেছিস। আয়।’
আরিফ ভাত খেতে বসল।
‘হ্যাঁ, এবার বল কি বলবি,’ মা বলল।
‘আজ ক্লাসে সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের ক্লাস টিচার আমাদেরকে নিয়ে রাঙামাটি পিকনিকে যাবে, কয়েকদিন ঐখানে থাকব,’ আরিফ বলল। ‘মা, আমি যাব?’
‘ওঁ, রাঙামাটি তো অনেক দূরে, তোর ভয় লাগবে না,’ মা জবাব দিল। ‘তোকে একা একা ছাড়তে আমার ইচ্ছে করছে না রে।’
‘মা, কিচ্ছু হবে,’ আরিফের মুখে অনুরোধের ছাপ। ‘ক্লাসটিচারও তো যাচ্ছে।’
মার মন যদিও সায় দিচ্ছিল না, তবুও ছেলের জোরাজুরিতে মা রাজি হয়ে গেল।
পরদিন বৃহস্পতিবার। আরিফ ক্লাসে বসে আছে। মুজিব স্যার ক্লাসে ঢুকল। তাদের ক্লাস টিচার। চেয়ারে বসল।
‘তোমরা কারা কারা পিকনিকে যাচ্ছ?’ স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
আরিফ, আরিফের বন্ধু টুটুল ও আরও নয়জনে হাত তুলল।
‘শুধু এই এগারো জন?’ স্যারের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। ‘বাকিরা যাবে না? আমরা বাসে করে যাব।’
সবারই একই জবাব। তাদের মা-বাবা যেতে দিচ্ছে না।
‘যারা যাচ্ছ তাদের বলছি,’ স্যার এই এগারো জনের দিকে তাকালেন। ‘আমরা যে মিনি বাসে করে যাব তাতে অনেক জায়গা খালি থাকবে। তোমরা চাইলে তোমাদের একজন করে গার্ডিয়ান আনতে পার।’
‘না স্যার,’ আরিফ বলল। ‘এসব পিকনিকে গার্ডিয়ান গেলে কোনো মজাই হবে না। সব কাজে বাধা দিবে। বন্ধুদের সঙ্গে একটু মজাও করতে দিবে না।’
আরিফের কথায় বাকি দশজনও সায় দিল।
‘ঠিক আছে তোমাদের ইচ্ছা,’ স্যার জবাব দিলেন। ‘আমাদের যাত্রা শুরু হবে কাল সকাল ঠিক সাড়ে দশটায়। তোমরা দশটার দিকে স্কুল মাঠে উপস্থিত থাকবে। আর হ্যাঁ, নিজেদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস ব্যাগে করে আনবে। তাঁবুর ব্যবস্থা আমি করব।’
বৃহস্পতিবার বিধায় স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল।

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেল আরিফ। পুরা চট্টগ্রাম শহর তখন নিশ্চুপ। কোনো সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু সে জানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এত আওয়াজ শুরু হয়ে যাবে যে কোনো বাইরের লোক টিকতে পারবে না।
আরিফ তাড়াতাড়ি গোসল করে নিল। ততক্ষণে মা তার নাস্তা রেডি করে রেখেছে। নাস্তা সেরে কী কী লাগবে ব্যাগে ভরে নিল। এসব করতে করতেই নয়টা বেজে গেল। তারপর ড্রেস পরেই সোজা রওনা হলো স্কুলের পথে। স্কুল মাঠে পৌঁছাতে প্রায় দশটা বেজে গেছে। সবাই উপস্থিত আছে। স্যার আর বাস এখনো আসেনি।
দশটা বাইশে স্কুল মাঠে প্রবেশ করল মিনি বাসটা। বাস থেকে নামলেন মুজিব স্যার। সবাইকে হাতের ইশারায় বাসে ডেকে তুললেন। তারপর বাসের দরজা লক করে দিল। সবাই একেক সিটে বসে পড়ল। পেছনে খালি সিটগুলোতে নিজেদের ব্যাগগুলো গাদাগাদি করে রাখল।
সামনের সিটে আরিফ আর টুটুল বসল। তারপর স্যার সবাইকে কিছু ইমপর্টেন্ট কথা বললেন। কী কী করতে হবে এসব।

ঠিক সাড়ে দশটায় বাস ছাড়ল।
বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে তারা পৌঁছে গেছে খেয়ালই করেনি। রাস্তার ধারে একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল। সবাই ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়ল। বাসটা চলে গেছে। আবার যখন ডাকবে চলে আসবে। এরকমই কন্ট্যাক্ট করা হয়েছে। আমরা দোকানে গিয়ে বসলাম। পেছন থেকে একজন লোক ডাক দিল।
‘হ্যালো স্যার, আমি রাকিব,’ এখানকার লোকাল গাইড, ‘লোকটি বেঞ্চ ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।’
মুজিব স্যার তার দিকে এগিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর লোকটাসহ ফিরে আসল।
‘আমাদের গাইড ঠিক হয়ে গেছে,’ মুজিব স্যার বললেন। তারপর হাতের ইশারায় রাকিবের দিকে তাকাতে বললেন। ‘ইনিই আমাদের গাইড।’
তারপর তারা একটা দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা ধরে উঠে গেল দোকানের পাশের পাহাড়টায়। যেহেতু তারা পাহাড় চড়ায় অভ্যস্ত নয়, তাই তাদের বেশ কষ্ট হচ্ছিল গাইডের সঙ্গে চলতে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে তাদের প্রায়ই দুই ঘণ্টা লেগে গেল। চূড়ায় উঠেই সবাই ধপাস করে খোলা মাঠে বসে পড়ল। কিন্তু গাইড দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।
আশপাশে আর কেউ নেই। টুরিস্টরা সাধারণত এদিকে আসে না। স্যার সবাইকে এখানে এনেছেন কারণ এখানকার আশপাশের সবকিছু প্রাকৃতিক। কোনো আধুনিকতা নেই
‘হ্যাঁ, এবার তাঁবুগুলো টাঙিয়ে ফেলতে হবে,’ মুজিব স্যার সবাইকে নির্দেশ দিলেন।

তিনটে তাঁবু টাঙানো হলো। একটাতে চারজন করে। মুজিব স্যার, গাইড আর দু’জন মিলে এক তাঁবুতে। আরেক তাঁবুতে চারজন। বাকি তাঁবুটাতে আরিফ, টুটুল আর তাদের ক্লাসমেট খোকা।
গাইড তাদের কাজে সাহায্য করল। সব শেষ করতে করতে আড়াইটা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি তারা লাঞ্চটা সেরে ফেলল।
‘আজ অনেক টাইয়ার্ড,’ স্যার সবার উদ্দেশে বললেন। ‘কিছুক্ষণ সবাই ঘুমিয়ে নাও।’
টুটুল আর খোকার ডাকে আরিফের ঘুম ভাঙল। সাড়ে চারটে বাজে তখন। সবাই হালকা নাস্তা করে নিল।
‘আজ বেশি দূরে যাব না, আশপাশ থেকে একটু ঘুরে আসব,’ স্যার বললেন।
তারপর সবাই একটা পাহাড়ি সরু রাস্তা দিয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল। রাস্তা বলা চলে না। প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়েছে। সবার আগে গাইড হাঁটছে। সবার পেছনে স্যার। পেছন থেকে সবার উপর নজর রাখছে।
আরিফ চারদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। হঠাৎ আরিফের চোখ থেমে গেল একটা চিতার বাচ্চা দেখে। একা। সোজা দৌড় দিল ঐদিকে। কী হয়েছে দেখার জন্য সবাই তার পেছন পেছন গেল। সে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। সবাই তার পেছনে এসে দাঁড়াল। আরিফ সবাইকে ছানাটা দেখাল।
‘এত ছোট ছানাকে তো তার মা একা ছাড়বে না,’ স্যার বললেন। তারপর আশপাশে তাকালেন। ‘নিশ্চয় আশপাশে মা থাকবে।’
না। আশপাশে কোথাও মা নেই।
‘স্যার, এটাকে এভাবে ফেলে রাখা যাবে না,’ টুটুল স্যারের দিকে তাকাল। ‘কোনো বন্যপ্রাণীর খাবার হয়ে যেতে পারে।’
‘হ্যাঁ, স্যার,’ একসাথে তার কথার সায় জানাল আরিফ আর খোকা।
‘ঠিক আছে, ওকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব,’ স্যার জবাব দিলেন। ‘রাত নামছে। চলো, তাড়াতাড়ি তাঁবুতে ফিরতে হবে।’

সবাই ডিনার সেরে এখন শুয়ে পড়েছে। টুটুল আর খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। টিটুও ঘুমিয়ে পড়েছে। টিটু হলো সেই চিতা ছানাটা। এই নামটা আরিফ রেখেছে। সবাই এই নামে ডাকে। টিটুকে গলায় একটা দড়ি দিয়ে তাঁবুর ভেতরে রাখা একটা বড় পাথরের সঙ্গে বাঁধা আছে। যাতে এই অন্ধকারের মধ্যে পালাতে না পারে। গলায় একটা ঘণ্টাও লাগানো হয়েছে। হারিয়ে গেলে যেন সহজে পেয়ে যায়। এই বুদ্ধিটা দিয়েছে আরিফ। সেও শুয়ে পড়ল।
‘আঁউ…….’
হঠাৎ তীক্ষè আওয়াজ শুনে আরিফের ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসল। টুটুল আর খোকাও উঠে বসল। টিটু ঘুম।
‘ওঁ, ওঁ, ওঁ’
‘এটা নিশ্চয় কোনো বন্য প্রাণীর কান্নার আওয়াজ,’ আরিফের মুখে কষ্টের ছাপ। প্রাণীটার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। ‘কিন্তু কোন প্রাণী হতে পারে?’
‘ও,’ টুটুল ভাবছে। ‘এটা তো চিতার আওয়াজ। একবার টিভিতে শুনেছিলাম। কান্নার আওয়াজটা থেমে গেছে।’
‘খোকা, তুমি এখানে থাকো,’ আরিফ বলল। ‘আমরা বাইরে গিয়ে দেখে আসি।’
‘ঠিক আছে,’ খোকা জবাব দিল।
আরিফ আর টুটুল দু’জনেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো। শব্দটা দূর থেকে আসছে। এ কথা বুঝার পরও তারা এদিক-ওদিক তাকাল। কিন্তু কোথাও নেই।
‘হয়তো টিটুর মা,’ আরিফ বলল। ‘টিটুকে না পেয়ে হয়তো কাঁদছে।’
‘হতে পারে,’ টুটুল তার কথায় সায় জানাল। ‘তবুও আমার কেন জানি খটকা লাগছে।’
‘হু, আমারও,’ আরিফ বলল। আরিফ সামনের পাহাড়টার দিকে ইশারা করল। ‘শব্দটা আসছে সামনের পাহাড়টা থেকে।’
‘কিন্তু এখন তো ঐখানে যাওয়া যাবে না,’ টুটুল বলল।
‘হু, কাল সকালে একবার গিয়ে দেখতে হবে,’ আরিফ বলল।
সকালে সবাই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। সবাই স্যারের সঙ্গে ব্যায়াম করল। তারপর ভালো করে সকালের নাস্তা সারল। লাঞ্চের আগে পেটে কিছু পড়বে না। তারপর আরিফ আর টুটুল স্যারকে একপাশে নিয়ে গিয়ে গত রাতের সব কিছু খুলে বলল। আর সামনের পাহাড়টাতে যাওয়ার অনুমতি চাইল। স্যার প্রথমে রাজি হননি। পরে আরিফের জোরাজুরিতে রাজি হলেন। রাজি করানোটা আরিফ বেশ ভালোই পারে।
‘দশটার দিকে বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে যাব,’ স্যার বললেন। ‘তার আগেই কিন্তু ফিরে আসতে হবে।’
দু’জনে মাথা নেড়ে সোজা চলে গেল তাঁবুতে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রওনা হলো সামনের পাহাড়টার দিকে। ঐখানে যাওয়ার কোনো পথ নেই। তাই তাদের গাছপালা ভেদ করে যেতে হচ্ছে। পাহাড় থেকে সহজেই নেমে পড়েছে। কিন্তু সামনের পাহাড়ে লতা-পাতা ভেদ করে বেশি দূর এগোতে পারলো না। একটা গাছের নিচে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল।
‘আহ, আর পারছি না,’ টুটুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘না, আমাদের রহস্যটার সমাধান করতে হবে,’ আরিফ বলল। ‘এটা টিটুর ভবিষ্যতের ব্যাপার।’
‘এই, তুই কখন গোয়েন্দা হলি,’ টুটুল জিজ্ঞেস করল।
‘আচ্ছা, এসব কথা বাদ দে,’ আরিফ বলল।
তারপর দুজনে আবার পাহাড়ে ওঠা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা উপরে উঠে এলো। উপরে তেমন কোনো খোলা জায়গা নেই। গাছপালা, ঝোপঝাড়।
‘এই টুটুল, কোথা থেকে একটা পচা গন্ধ আসছে না,’ আরিফ জিজ্ঞেস করল। ‘তুই পাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ, আমিও পাচ্ছি,’ টুটুল জবাব দিল।
‘চারদিকে একটু খোঁজ,’ আরিফ নির্দেশ দিল।
তারপর টুটুল একদিকে চলে গেল, আরিফ আরেক দিকে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পরও কিছু পেল না।
‘ টুটুল! টুটুল, এদিকে এসে দেখ!’
আরিফের ডাকে টুটুল আরিফের পাশে এসে দাঁড়াল। একটা গাছে মোটা একটা দড়ি বাঁধা। পাশে কোনো বন্যপ্রাণীর একটা কাটা পা। পচন ধরেছে। আশপাশে প্রচুর রক্ত।
‘গন্ধটা তাহলে এখান থেকে আসছে,’ টুটুল বলল।
‘হ্যাঁ,’ আরিফ জবাব দিল। ‘গত রাতে কোনো প্রাণীকে এই দড়িটা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তারপর তার পা কেটে দিয়েছিল। তাই আমরা গত রাতে সেই কান্নার আওয়াজটা শুনেছিলাম।’
‘হায়রে! প্রাণীটা এখন কী অবস্থায় আছে কে জানে,’ টুটুল দুঃখ প্রকাশ করল। ‘কিন্তু এই নির্জন জায়গায় এমন কাজ কে করতে পারে?’
‘আশপাশে নিশ্চয় কেউ আছে,’ আরিফ বলল। ‘চল, খুঁজে দেখি।’
তারপর আরিফ ব্যাগ থেকে একটা ছোট ক্যামেরা বের করে পা-টার ছবি তুলে ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল।
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও,’ আরিফ টুটুলকে থামিয়ে দিল। তারপর মাটির দিকে হাতের ইশারায় তাকাতে বলল। ‘দেখছিস রক্তের দাগটা। সোজা ঐ ঝোপের দিকে চলে গেছে।’
‘চল, গিয়ে দেখি,’ টুটুল বলল।
‘হ্যাঁ, চল,’ আরিফ জানাল।
তারপর তারা রক্তের দাগ অনুসরণ করে ঝোপের সামনে চলে এলো। ঝোপ সরাতেই চোখে পড়ল একটা কুঁড়েঘর। সামনে গিয়ে দেখল। বাইরে তালা লাগানো। তাই তারা পেছনে গিয়ে দেখল। একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানা। তাতে রাখা আছে নেকড়ে, নানা রকমের পাখি। আর একটা পুরুষ চিতা বাঘও আছে।
‘কে? কে ওখানে?’ একটা লোক বেরিয়ে এলো ঝোপ থেকে। হাতে ছুরি। পরনে একটা লুঙ্গি আর মাথায় বাঁধা গামছা। লোকটা তাদের দিকে তেড়ে আসছে।
আরিফ আর টুটুল সোজা দৌড় দিল, যেদিক থেকে এসেছে ঐদিকে। লোকটাও তাদের তাড়া করল। তারা পেছনে না তাকিয়ে দৌড়াতে লাগল। পাহাড়ে ওঠা যত কঠিন, নামাটা ততই সহজ। তারা সোজা তাদের ক্যাম্পে চলে এলো। লোকটা কোথায় জানে না। হয়তো চলে গেছে। স্যার দৌড়ে তাদের কাছে চলে এসেছে। এখনও আটটা বাজেনি।
‘কী হয়েছে,’ স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
তারপর তারা সব খুলে বলল।
‘ছবি তোলা পা-টা দেখাও তো,’ স্যার আরিফের উদ্দেশে বললেন।
তারপর আরিফ ক্যামেরাটা বের করে ছবিটা দেখাল।
‘ঙঐ গণ এঙউ!’ স্যারের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। ‘এটা তো কোনো চিতার পা। এত নিষ্ঠুর মানুষ। এক্ষুনি ফরেস্ট অফিসে ফোন দিতে হবে।’ বলতে বলতে স্যার পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম্বার ডায়াল করলেন।
তারপর মোবাইল নিয়ে স্যার একপাশে চলে গেলেন। আরিফ আর টুটুলের মুখে চিন্তার ছাপ। অন্যরা তাদের ঘিরে ধরেছে কী হয়েছে জানার জন্য। আরিফ আর টুটুল এক এক করে সব কিছু খুলে বলল।
‘সবাই থামো,’ স্যার তাদের পাশে এসে দাঁড়াল। ‘ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফরেস্ট অফিসাররা চলে আসবেন।’
প্রায় দুই ঘণ্টা কেটে গেল। সবাই এখন চুপচাপ বসে আছে। কারও মুখে সাড়াশব্দ নেই। দীর্ঘ এই নীরবতা ভাঙল চারজন ফরেস্ট অফিসার ও দুইজন পুলিশ অফিসারের প্রবেশে।
‘কোথায় সেই বাড়িটা,’ একজন পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন। পুলিশ চিফ। অন্যজন কনস্টেবল। ‘আমাদের শিগগিরই নিয়ে চলুন।’
তারপর আরিফ আর টুটুল তাদের নিয়ে চলল বাড়িটার দিকে। যেই পথে তারা গিয়েছিল। স্যার অন্য স্টুডেন্টদের আসতে মানা করেছিলেন। তবুও তারা মানেনি।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেছে। ফরেস্ট অফিসাররা চারদিকে ঘিরে ধরলেন। বাইরে এত গোলমালের আওয়াজ শুনে ‘কারা ওখানে’ বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সেই লোক। পুলিশ দেখেই পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পুলিশ ধরে ফেলল।
ফরেস্ট অফিসাররা পেছনে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একজন অফিসার এসে খবর দিলেন যে চিতার পা কাটা হয়েছিল তার লাশ পাওয়া গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ চিফ আরিফ আর টুটুলকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর লোকটাকে নিয়ে চলে গেলেন।
‘চলো, আমরা আমাদের ক্যাম্পে ফিরে যাই,’ স্যার সবাইকে নির্দেশ দিলেন। ‘আজ আর কোথাও যাওয়া হবে না।’ এই বলে সবাই রওনা হলো ক্যাম্পের উদ্দেশে।

ফরেস্ট অফিসাররা প্রাণীগুলো নিয়ে যাচ্ছেন।
বারোটার দিকে সবাই ক্যাম্পে ফিরে এলো। সবাই তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে নিল।
সবাই গোল করে বসল। হঠাৎ তাদের মাঝে উপস্থিত হলেন পুলিশ চিফ আর একজন ফরেস্ট অফিসার। সবাই উঠে দাঁড়াল।

পুলিশ চিফ বললেন, ‘লোকটাকে জেরা করে জানতে পারলাম- লোকটার নাম তাহের। তিনি বন্যপ্রাণী শিকার করে তাদের পেছনের খাঁচায় বন্দি করে রাখেন। তারপর প্রাণীগুলো গোপনে নানা জায়গায় পাচার করে দেন। কয়দিন আগে একটা বাবা চিতা ও বাচ্চা চিতা ধরে এনেছিল। বাচ্চাটাকে বাইরে একটা গর্তে ফেলে রেখেছিল। খাঁচায় রাখলে অন্য প্রাণীগুলো খেয়ে ফেলত তাই। কিন্তু রাতের আঁধারে মা চিতা এসে বাচ্ছা চিতাটাকে গর্ত থেকে বের করে নিল। ছানাটা বেঁচে গেলেও মা-টা বাঁচতে পারেনি। তাহের রেগে গিয়ে চিতাটার একটা পা কেটে দিল। তারপর ফেলে রেখেছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণে চিতাটা বাঁচতে পারেনি। পুলিশ চিফ সবকিছু গড়গড় করে বলে গেলেন আর বাকিরা শুনল।
‘সত্যিই সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার এটা একটা অনেক বড় দৃষ্টান্ত,’ স্যার বললেন। ‘সব সন্তানেরই উচিত মায়ের প্রতি পরম শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। কারণ মা যাই চায়, তা অবশ্যই সন্তানের মঙ্গলের জন্য।’
‘হ্যাঁ স্যার,’ টুটুল বলল। ‘আমরা একটা বড় শিক্ষা পেলাম।’
‘স্যার, এক্ষুনি এই পিকনিকটা ক্যানসেল করুন,’ আরিফ কড়া গলায় বলল। ‘পরে আমরা আমাদের পরিবার নিয়ে আসব।’
‘হ্যাঁ স্যার, আমরা এক্ষুনি ফিরে যাব,’ সবাই সমস্বরে আরিফের কথায় সায় জানাল।
‘এতদিনে আমার ছাত্ররা প্রকৃত মানুষ হলো,’ স্যারের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। ‘আমরা আজ বিকেলেই রওনা হবো।’

‘আচ্ছা, বাচ্ছা চিতাটা তো আপনাদের কাছে,’ ফরেস্ট অফিসার বললেন। ‘আমরা ওকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
খোকা তাড়াতাড়ি গিয়ে টিটুকে নিয়ে এলো। আরিফকে দেখতেই তার কাঁধে লাফিয়ে পড়ল।
‘বাচ্চাটা মনে হয় তোমাকে পছন্দ করেছে,’ ফরেস্ট অফিসার বললেন। ‘তোমাকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না।’
‘স্যার আমারও টিটুকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না,’ আরিফ অনুরোধ করল। ‘আপনি বলেন তো আমি ওকে নিয়ে যাই।’
‘ওকে সামলে রাখতে পারলে নিয়ে যাও,’ ফরেস্ট অফিসার জবাব দিলেন। ‘এতে আমার কোনো আপত্তি নাই।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার,’ আরিফ ফরেস্ট অফিসারকে ধন্যবাদ জানাল।
‘তোমরা সত্যিই সাহসী,’ পুলিশ চিফ আরিফ আর টুটুলের মাথায় হাত বুলালেন। ‘তোমাদের জন্যই আজ অনেকগুলো বন্যপ্রাণী বেঁচে গেল। আচ্ছা, আজ আমরা আসি। অফিসে কিছু কাজ আছে।’
পুলিশ চিফ আর ফরেস্ট অফিসার চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার পর সবাই হালকা ঘুমিয়ে নিল।

তিনটের দিকে সবাই ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। স্যার বাস আসার জন্য ফোন করেছেন। চারটের দিকে চলে আসবে। সবকিছু গোছাতে তাদের প্রায় চারটা বেজে গেছে। স্যার গাইডকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দিয়েছেন। পারিশ্রমিক পেয়ে খুশি মনে চলে গেছে। লোকটা সত্যিই ভালো ছিল। তা না হলে স্যারকে এত সাহায্য করত না।
ব্যাগ গুছিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ তাদের মাঝে উপস্থিত হল বাস ড্রাইবার। সবাই পাহাড় বেয়ে নেমে গেল। পিছিয়ে পড়লেন স্যার। স্যার বাসের কাছে পৌঁছাতেই সবাই বাসে উঠে পড়ল। টিটু আরিফের সঙ্গে আছে। দু’জনের মধ্যে বেশ ভালো ভাব হয়েছে। সবাই খুশি মনে ফিরে যাচ্ছে। কারণ তারা এটা বুঝতে পেরেছে যে তারা বাইরে থাকলে পরিবার কত দুশ্চিন্তায় থাকে। আর পরিবারকে দুশ্চিন্তায় ফেলে কোথাও পিকনিকে গিয়ে মজা নেই। আসল মজা সেখানেই, যেখানে পরিবার আছে।

বাস স্টার্ট দিল। সবাই গান গাইতে গাইতে ফিরে এলো চট্টগ্রাম শহরে। তাদের সবারই মনে হলো আগের তুলনায় খুব দ্রুত পৌঁছে গেছে। বাস আবারও থেমেছে স্কুল মাঠে। সেখান থেকে যে যার বাসায় চলে গেল।

Share.

মন্তব্য করুন