শিরোনাম দেখে এই ভেবো না যে, তোমাদের মূল্যবান সময়গুলো কেবল বইয়ের সাথেই কাটাতে বলছি। আসল কথা হলো, তোমাদের সাথে একটা পরিকল্পনা শেয়ার করতে চাই। এখন তো তোমাদের ইশকুল-কলেজ সব বন্ধ। যে বৈশি^ক দুর্যোগ চলছে তাতে অবশ্য শুধু ইশকুল-কলেজ নয়, প্রায় সব মানুষেরই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যেতে সমস্যা হচ্ছে। অনেক মানুষ তো একদম কর্মহীনই হয়ে পড়েছে। চাকুরি হারিয়েছেন অনেকে। কোম্পানীগুলোরও এখন কর্মী ছাঁটাই না করে উপায় থাকছে না। তোমরা জানো বোধহয়, অনেক ইশকুল-কলেজও এই দুর্যোগের সময় গুটিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের আসবাবপত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। কী করবে? ভবনের ভাড়া পরিশোধ করতে পারছে না তো। শিক্ষকদের বেতন দেবার ব্যাপারও আছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও এই অবস্থা। তো, তোমরা যারা এইসব ইশকুলে পড়তে, তোমাদের খুব খারাপ লাগছে নিশ্চয়। ইশকুলের বন্ধুদের সাথে আড্ডা-কোলাহলের দিনগুলোকে তোমরা সবাইই খুব করে মিস করছো। এছাড়া একাডেমিক সেশনেও তো একটা গ্যাপ এসে গেলো! মন খারাপেরই ব্যাপার যদিও, তবু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, যেন তিনি এই দুর্যোগ দূর করে দেন এবং পৃথিবীর সব মানুষকে ভালো রাখেন।

সীমিত পরিসরে হলেও তোমরা অনেকেই এখন খেলাধুলা করছো, কেউ কেউ সংগীত চর্চা করছো আবার অনেকেই বাড়িতে বসে শর্টফিল্ম বানাচ্ছো। এতোদিনে অনেকেই তোমরা নিজেদের মতো করে সময় ভাগ করে নিয়েছো। একাডেমিক পড়াশোনাটাও চালু রেখেছো নিশ্চয়। এরই ফাঁকে তোমাদের বলছি বই পড়ার কথা। হ্যাঁ, পাঠ্য বইয়ের বাইরের বইয়ের কথা বলছি। ধরো, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ -ভ্রমণ-ফিকশন এইসব। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল একটা জগৎ রয়েছে সেই জগতের কথাই বলছি। অনেক বই তোমাদের পড়ার পরিকল্পনা ছিলো, কিন্তু সুযোগ হয়নি। অনেক বইয়ের নাম শুনেছো, দেখোনি। এরকম বইগুলো সংগ্রহ করে পড়ে নিতে পারো এই অখ- অবসরে। যাদের কেনার ইচ্ছে নেই তারা এক কাজ করবে। গুগলে গিয়ে পছন্দের বইয়ের নাম লিখে কিংবা লেখকের নাম লিখে পিডিএফ সার্চ করতে পারো। সবগুলো না হলেও অনেক বইই তোমরা পেয়ে যাবে। পরিকল্পনা করে প্রতিদিন যদি কিছু কিছু পড়ো তাহলে দেখবে একসময় তোমার অনেকগুলো বই পড়া হয়ে গেছে। যদি পরিকল্পনা নিয়ে পড়ো, তাহলে ক্যাটাগরিও নির্ধারণ করে নিতে পারো। যেমন ধরো, কিছু বই পড়লে বিজ্ঞানের, কিছু বই পড়লে ধর্ম বিষয়ক আবার কিছু বই পড়লে গল্প-কবিতা-উপন্যাস কিংবা ইতিহাসের। এ হিসেবে আমরা অল্প কিছু বই নিয়ে আলাপ করি, চলো।

মানবদেহের অলৌকিক রহস্য: বইটির লেখক হারুন ইয়াহিয়া। তাঁর আসল নাম আদনান ওকতার। আদনান ওকতার জন্মগ্রহণ করেন তুরস্কের আঙ্কারায়। আঙ্কারাতেই তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ইস্তাম্বুলের মিমার সিনান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। লেখালেখি শুরু করেন ১৯৮০ সালে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রায়ান্ধ এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে অতি আবেগ লক্ষ্য করা যায়। ব্যাপারটা লেখক হারুন ইয়াহিয়াকেও আন্দোলিত করে। এরইমধ্যে তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের বিশ^াস, বিজ্ঞান ও সমসাময়িক রাজনীতির বিশ্লেষণ করে বই লিখে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠলেও বিশ^ব্যাপী তাঁর পরিচিতি আসে ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ভুল প্রমাণ করে ফ্যাসিজম ও কমিউনিজমের সাথে ডারউইনের তত্ত্বের সম্পর্ক প্রমাণ করার মাধ্যমে। ‘মানবদেহের অলৌকিক রহস্য’ লেখকের তুমুল জনপ্রিয় একটি বই। বইটিতে তিনি এমনসব বিষয়ে খুব সহজবোধ্য ভাষায় আলোচনা করেছেন, যেগুলো পড়তে পড়তে মানব মন তার নিজের অজান্তেই একজন মহান শক্তিধর ও দয়ালু ¯্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ওঠে। একান্ত নাস্তিকও বলে উঠবে, একজন ¯্রষ্টা না থাকলে শুধুমাত্র ছোট্ট একটা মানবদেহে এত ব্যাপক ও বিস্ময়কর মেকানিজম একা একা পরিচালিত হওয়া অসম্ভব। এ পর্যায়ে এসে তার হয়তো মনে হবে সেই দার্শনিক উক্তি, ‘ইশ^র যদি নাও থাকেন, তবে নিজের প্রয়োজনেই একজনকে ইশ^র বানিয়ে নাও।’

মরু মূষিকের উপত্যকা: আল মাহমুদের কিশোর উপন্যাসের কথা আসলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার আর নাটকীয় ঘটনার উত্তেজনাপূর্ণ একটি উপন্যাসের ছবি। মরু মূষিকের উপত্যকা। এই উপন্যাসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এতে মানুষের কথা, মানবতার কথা এবং ধর্ম ও বিশ্বাসের কথা যেমন এসেছে তেমনি এখানে উঠে এসেছে একটি জাতিগোষ্ঠীর অনুপুঙ্খ ও শিল্পিত উপাখ্যান। পৃথিবীব্যাপী মানবতার দুশমনদের গতিবিধি, তাদের ধ্বংসলীলা এবং অবৈধ বসতি স্থাপন করে সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করার কদর্য দিকটিও উঠে এসেছে খুব স্বাভাবিকভাবে। উপন্যাসটি ছোটো-বড়ো সবাই-ই পড়ে মজা পাবে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন ড. লায়লা ইলাহী। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুরাতাত্ত্বিক। যিনি এক সুপ্রাচীন পিরামিডের অস্তিত্বের আভাস একটি দুর্বোধ্য পা-ুলিপি থেকে উদ্ধার করেছেন। সেটা হলো মেমফিসের প্রিন্সেস জুলফিয়ার পিরামিডের গঠনশৈলী আর তার অবস্থান নকশার বিবরণ সংবলিত একটি প্যাপিরাস পা-ুলিপি। যে পা-ুলিপির লিপিকৌশল এতোকাল দুষ্পাঠ্য বলে পরিত্যক্ত হয়ে ইজিপশিয়ান গ্যালারির বাতিল মালের তাকে বস্তার সাথে নিলামের জন্য পড়ে ছিলো। যা ড. লায়লা ইলাহী কৌতূহলবশতই বাসায় এনে রেখেছিলেন এন্টিকের আলমারি সাজাবার জন্য। সে জিনিস থেকেই লায়লার চোখে ধরা পড়েছে এক সুপ্রাচীন পিরামিডের অস্তিত্বের খবর এবং এক দুর্লভ ধনভা-ারের ইঙ্গিত।

লায়লার স্বামী ড. আকরাম ইলাহী, যিনি নিজেও একজন গবেষক। তিনি নিজেও এই পাঠোদ্ধারের কথা জানার পর লায়লাকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘ডার্লিং, এ কথা এখনই কাউকে জানানো উচিত হবে না। চলো কাল আমরা আল আহরাম পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের কাছে যাই এবং তোমার আবিষ্কারের ওপর একটি প্রেস কনফারেন্সে তাকে উপস্থিত থাকতে বলে আসি। তোমার এ আবিষ্কার মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব বলে জাহির করতে পারে। সোনাদানার প্রতি আমাদের দু’জনেরই লোভ নেই। তবে আবিষ্কারের কৃতিত্ব যে তোমার এটা পুরাতত্ত্বের ইতিহাসে স্বীকৃত হওয়া উচিত।’
কিন্তু স্বামী আকরাম ইলাহীর এই প্রস্তাব তার সরলমতি বিদূষী স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেনি। সে বিষয়টা মিউজিয়াম প্রধানকে জানাতে চায়। তার মতে, হাজার হোক আমরা সরকারের নিমক খাচ্ছি। তাদের জানালে তারা খুশি হয়ে আমার কৃতিত্বের কথা জগৎকে জানাবে এবং প্যাপিরাসে উল্লিখিত পিরামিডটির অবস্থান নির্ণয়ে সরকারি উদ্যোগ নেবে। এতে লুকোছাপার কোনো ব্যাপার নেই। লায়লা তার স্বামীকে বোঝাতে থাকে, ‘আমরা গরিব লোক; এতবড়ো একটা আবিষ্কার হজম করার শক্তি আমাদের নেই। তা ছাড়া আমরা মরুভূমিতে কিংবা উপত্যকায় গিয়ে বিপুল ব্যয়সঙ্কুল খননকাজ বা এস্কেভেশন চালাতে পারবো না। মিসর সরকার তা ব্যক্তিবিশেষকে করতেই বা দেবে কেন?’

স্ত্রীর কথার যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে তার সাথে একমত হয়ে সেদিন বিকেলেই মিউজিয়াম প্রধানের বাসায় গিয়ে বিষয়টি তাকে অবহিত করেন। মিউজিয়াম কতৃপক্ষ পাঠোদ্ধারকৃত প্যাপিরাসের ট্রান্সলেশনটার খোঁজ নেন। আর লায়লাও সরল মনে সব তথ্য দিতে থাকেন তাকে। একপর্যায়ে তারা দু’জনই বাসায় চলে আসেন। আসার পথে একটি রেস্তোরাঁ থেকে রাতের খাবার সেরে আসায় বাসায় এসেই তারা ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ড. আকরাম ইলাহী দেখেন বাসায় লায়লা নেই এবং তার খাটের ওপরের জানালায় একটি পাট বা শিকও নেই। যেন কোনো দৈত্য এসে নিঃশব্দে তা উপড়ে নিয়েছে। সারা ঘরে কোথাও লায়লা নেই। তার ড্রয়ার খোলা; সেখানে কোনো প্যাপিরাস বা লিপি অনুবাদপত্রটত্র কিছু নেই। তবে টেবিলের ওপর একটা পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া একখ- কাগজে আরবি হরফে লেখা, ‘ইন তুরিদ আন তাকুনা হাইয়্যান আল ইয়াওম এহয়েব মিনাল মিসর।’ অর্থাৎ আজই মিসর ছেড়ে গেলে প্রাণে বাঁচবে। পালাও!

বুক ধুকপুক করা শঙ্কা-আশঙ্কা আর তীব্র উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কাহিনী এগোতে থাকে। আমাদের উপন্যাস সাহিত্যের চেনা গ-ির বাইরে একদম ভিন্ন অবস্থান ও আয়তনে কাহিনীকে স্থাপন করে আল মাহমুদ তাঁর নিজস্বতার বার্তা দেন এভাবেই। মজার ব্যাপার হলো, তিনি তাঁর উপন্যাসে কোনো চরিত্রকে ডেকে এনে খাতির করে বসান না বরং তারাই বর্ণে-গন্ধে আপনি এসে পড়ে। আংকল কারামে, জাহরা, হিজ এক্সেলেন্সি রাষ্ট্রদূত, ড্রাইভার মিজান এমনকি সেই হাফেজ সাহেব এবং তার কিশোর শিক্ষার্থী, সবাই। অবশ্য আল মাহমুদের এই ভিনদেশি ফ্লেভারের ভাষা ও কাহিনীতে তাঁর যে প্রত্যক্ষ জানাশোনা ও অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে তা নিঃসন্দেহ। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি বিচরণশীল মানুষ।’ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন। সেসব দেশের মানুষের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, সেখানকার ঐতিহ্য- এসবই তিনি খুব ভালো করে অবলোকন করেছেন। আর এই অবলোকনেরই ছাপ থাকে তাঁর উপন্যাসে। ফলে তাঁর উপন্যাস হয়ে ওঠে একেবারেই নিজস্ব ও জীবন্ত।

বড়োদের গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখে যারা খ্যাতি অর্জন করেন তারাই যে আবার ছোটোদের জন্যও ভালো লিখবেন, এমন কোনো কথা নেই। অবশ্য আগেই বলে এসেছি আল মাহমুদের ছোটোদের রচনাও বড়োরা পড়ে মজা পাবেন এবং ছোটোদের মতোই সমান উত্তেজনা অনুভব করবেন। সম্ভবত অনেক কিশোর ঔপন্যাসিক বা সাহিত্যিকের সাথে আল মাহমুদের পার্থক্য এখানেই। তিনি একান্ত নিজের মতো করেই তার পাত্র-মিত্রের অবস্থা ও আকৃতি নির্ধারণ করে নেন। ‘মরু মুষিকের উপত্যকা’ ছাড়াও তাঁর অন্যান্য কিশোরতোষ গল্প-উপন্যাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও এ বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। আবার তিনি যখন ছোটোদের মতো করেই ভাবেন- দেখেন, তখনও তা দারুণরকম প্রাণবন্ত এবং সব বয়সের পাঠকের জন্যই উপযোগী হয়ে ওঠে। যেমন উপযোগী তাঁর ‘মরু মুষিকের উপত্যকা’, ‘ময়নামতির ছেলে’, তার রূপকথার গল্প ‘ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড়’ এবং কিশোরতোষ গল্প ‘একটি ছবি’, ‘একটি পাহাড়ি গল্প’ এবং ‘বেপরোয়া’।

কবিখ্যাতি যখন অভ্রভেদী তুঙ্গে তখনই আল মাহমুদ হাত দিয়েছিলেন কথাশিল্পে। তার পরের গল্প পাঠকমাত্রেরই জানা। তোমরা নিশ্চয় তাঁর ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র কথা জানো এবং এটি পড়েছো। এটিকে বলা চলে বাংলা গদ্যসাহিত্যের সেরা আত্মজৈবনিক রচনা। যেখানে তিনি কৈশোরের অনেক স্মৃতি রোমন্থন করার পাশাপাশি ঐ বয়সের সূক্ষ্মতম অনুভূতিকেও স্পর্শ করে গেছেন দারুণভাবে। পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করবেন তাঁর ঐতিহ্যচেতনা, দেশাত্মবোধ ও ভাষার সুনিপুণ শিল্প-সুষমা। যদিও ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ দিয়েই তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতির জানান দিয়েছেন।

যুৎসই চরিত্র, কাহিনীর গতিময়তা, পরিমিতিবোধ ও সার্বিক সঙ্গতির দিকে দারুণ মনোযোগী একজন গদ্যশিল্পী আল মাহমুদ। পাঠককে তিনি তাঁর উপন্যাসের শিল্প-সুষমায় বিবশ করে রসাস্বাদনে বাধ্য করেন। উপন্যাস পড়তে পড়তে বোদ্ধা পাঠক বুঝতে পারেন- এরকম ব্যতিক্রম দৃশ্যের যোজনা ও মুগ্ধকর শিল্পভাষ্য কেবল আল মাহমুদেরই হতে পারে। দেখা গেল, তিনি খুবই সাধারণ একটি বিষয় নিয়ে এবং খুবই সাধারণভাবে গল্পের অবতারণা করেছেন, কিন্তু তাঁর ব্যতিক্রমী বর্ণনাকৌশল এবং ধীরে ধীরে রস ও রহস্যঘন করার মাধ্যমে গল্পটিকে অসাধারণ করে তোলেন। অবচেতনভাবেই পাঠক গল্পের মূল প্লটে ঢুকে বুঝতে পারেন, গল্পকার এমন একটি জায়গায় তীর্যক আলোকপাত করেছেন যেটা আমাদেরই চেনা পরিবেশের অচেনা দৃশ্য! আমরা পুলকিত হই; গল্পের দার্শনিক, মানবিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য অনুভব করি আর ভাবনার গভীরে সঞ্চরণ করতে থাকি।

সূর্যের দিন: আমাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি কিশোর উপন্যাস এটি। বইটি পড়তে গিয়ে তোমরা যারা একটু বড়ো হয়ে গিয়েছো, মানে যারা কলেজে উঠেছো তাদেরও ভালো লাগবে। আমি বলি, যে কোনো বয়সের পাঠকেরই ভালো লাগবে এই বই। নস্টালজিক হবার মতো ব্যাপার আছে পুরো বইতে। সেই সাথে আছে পরিবারে একজন কিশোর যেরকম শাসন-বারণের মধ্য দিয়ে সাধারণত বড়ো হয় তারও একটা চিত্র। শেষটা তো অসাধারণ! কিন্তু সেটা আমার বলে দিলে আর চলে না। ইতোমধ্যে আল মাহমুদের বইটি নিয়ে অনেককিছুই বলে দিয়েছি। বইগুলো তোমরা পড়বে অবশ্যই। জানো তো, কথায় আছে, ‘পড়িলে বই, আলোকিত হই।’

চাঁদের পাহাড়: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ মূলত একটি অ্যাডভেঞ্চারাস স্টোরি। বাংলাদেশের এবং কোলকাতার অনেক প্রকাশনী থেকেই বইটি বেরিয়েছে। বহু বছর আগের লেখা হলেও পড়লে মনে হবে এটি একটি আধুনিক কাহিনীই। জানো বোধহয়, কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এটি নিয়ে একই শিরোনামে চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন। সুযোগ হলে এটিও দেখে ফেলতে পারো। তোমাদের উপযোগী আরো আরো চলচ্চিত্রের খোঁজ পেতে কিশোর পাতার চলচ্চিত্র সংখ্যাটি আবার পড়তে পারো। এই ফাঁকে বলে রাখি, কিশোর পাতার সবগুলো সংখ্যাই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। পড়বে, সংগ্রহে রাখবে এবং বন্ধুদেরকে পড়তে বলবে। হ্যাঁ, বলছিলাম ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসের কথা। ঠিক এই নামেই আরো একটি উপন্যাস আছে, যদিও সেটি রুশ সাহিত্যের অনুবাদ। বইটি লিখেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক ও বিজ্ঞানী ইভান ইয়েফ্রেমভ। খুব বেশি বড়ো নয়, মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ পৃষ্ঠার এই বিদেশী গল্পটিও তোমরা পড়তে পারো।

মোরা বড় হতে চাই: এবার আরেকটি দারুণ বইয়ের কথা তোমাদের বলছি; বইটির নাম, ‘মোরা বড় হতে চাই’। বড় তো সবাই-ই হতে চাও, কিন্তু কিভাবে? হ্যাঁ, সে কথাই আলোচনা করেছেন প্রখ্যাত লেখক ও ক্যারিয়ার বিষয়ক গবেষক আহসান হাবীব ইমরোজ। বইটি পড়তে পড়তে অনেক মনীষার সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ ঘটে যাবে। জানতে পারবে কিভাবে তাঁরা বড়ো হয়েছেন, কেমন করে পড়াশোনা করেছেন এবং কী ছিলো তাঁদের লাইফস্টাইল। বড় হবার পাশাপাশি তোমরা সবাই কিন্তু স্মার্টও হতে চাও। তো, যারা স্মার্ট হতে চাও তাদের জানতে হবে আসলে স্মার্ট বলতে কাদের বুঝায়। আমাদের দেশে আমরা স্মার্ট বলতে কেবল ভালো পোশাকাদি পরা লোকদেরই বুঝি, অনেকটা এরকমই তো! কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে স্মার্ট বলতে জ্ঞানী এবং সফল ব্যক্তিদের বোঝায়। যেমন ধরো, আইনস্টাইন ইজ এন স্মার্ট ম্যান! এরকম স্মার্টম্যানদের কথাই বলা হয়েছে বইটিতে। সেই সাথে দারুণ সব পরামর্শ ও রুটিন বাতলে দেয়া হয়েছে তোমাদের জন্য।

আচ্ছা, এবার একটু থামো। কিশোর পাতার রূপকথা এবং সায়েন্স ফিকশন সংখ্যার কথা কি তোমাদের মনে আছে? ওই দুইটি সংখ্যায়ও কিন্তু অনেকগুলো বইয়ের কথা বলা হয়েছিলো। সেগুলো কি তোমরা পড়তে পেরেছো? নইলে খামোখা এতো বইয়ের কথা কেন বলছি! যারা পড়তে পেরেছো তারা তো এগিয়ে গেলে। আর যারা পড়তে পারোনি, এখনই প্ল্যান করে ফেলো। আজ থেকেই শুরু হোক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল ও বিস্তৃত জগতের সঞ্চরণ। কয়েকটা মাত্র বইয়ের কথা খুব ছোট করে আলোচনা করলাম। এর বাইরেও তো কত শত শত রাশি রাশি বই! আচ্ছা, আরেকটা বইয়ের কথা বলতে বলতে এই আলোচনা শেষ করি। মার্ক টোয়েনের নাম শুনেছো তোমরা? এই প্রশ্ন শুনে হেসে হয়তো কুটি কুটি হচ্ছো। হা হা, হবারই কথা। কারণ এ যুগে তোমরা কত কিছুরই তো খোঁজ রাখো। ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/ তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া করো মেলা।/ আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি? তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।/ উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা/ আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন, পরী, দেও-দানা।’ সত্যিই তো! দ্যাখো, কবি সুফিয়া কামাল তাঁর ‘আজিকার শিশু’ কবিতায় কী দারুণভাবে তোমাদের কথা বলেছেন। এজন্যই বলি, তোমরা অনেক কিছুর খোঁজ রাখো। তো, এবার বইটার নাম বলা যাক। ‘টম সয়ারের দুঃসাহসিক অভিযান’। কী, হইহই করে উঠলে নাকি? অনেকেই হয়তো বলছো, কী বলেন- এ বই তো আমার পড়াই আছে! মার্ক টোয়েনের বই! হা হা, একদমই ঠিক ধরেছো। যারা পড়োনি তারা এ বইটিও পড়ে নিও। তো, বেশ তো গল্প হলো বই নিয়ে। আজ এপর্যন্তই থাকুক, কেমন? তোমরা সবাই ভালো থেকো। খুব সাবধানে থেকো।

Share.

মন্তব্য করুন