মানিকে মানিক চেনে। সাপুড়ে লোকটাও ঠিকই চিনল আমাকে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নির্জন বটের ছায়ায় কাছে ডেকে বসাল। সাপ খেলা হয়ে গেছে। বাকশোপেটরা বেঁধে কেবল গুছিয়ে বসেছে একটু। নতুন লোক পেয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দিল মনের সুখে। আহ্লাদে গলে গেলাম। চোখের সামনে এত বড় সর্পরাজ! সে আবার ডেকে বসিয়েছে কাছে! নিজেরও একটা সাপুড়ে দল আছে আমার। দু’ চারটে মাইটা আর মেছো সাপ নিয়ে বেশ দাঁড়িয়েছে দলটা। ইচ্ছে আছে কামরূপ-কামাখ্যা গিয়ে বিদ্যাটা রপ্ত করে আসবো পোক্তভাবে। তা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ওস্তাদ গোঁফের ফাঁকে হেসে বলল, ‘কিরে খোকা, রাজকপাল লয়ে কই যাও?’ অর্থ না বুঝে তাকিয়ে থাকলাম বোকাটে মুখে। সে গামছা পেতে বসতে দিয়ে বলল, ‘তোর কপালে সোনা আছেরে। আগুনের নাহান চকচক করতাছে। রাজা অইয়া যাবি।’ সোনা বলতে দেখেছি মায়ের দুগাছা চুড়ি, আরেকটা চিকন চেইন। কী করে সোনা আসবে আমার কপালে! লোকটা বিড়িতে শেষ টান দিয়ে টুসকি মেরে ফেলে দিল যত দূরে যায়। এরপর সামান্য কেশে মুখখানা সুচালো করে নিয়ে এলো কানের কাছে- ‘শোন, খবরদার, কারোরে কবি না। তোরে মনে ধরসে। তায় দেলাম।

এই লাল সুতা হাতে বাইন্ধা অমাবস্যার রাইতে কবরস্থানে যাবি। আলো নেওনের কাম নাই। হাতাইলে পাইয়া যাবি সোনার কলস। মোরে আদ্দেক দিস। আচ্ছা থাউক, এক সিকি দেলে অইব। একন কি বকরা দিবি মায়েরে?’ সোনার স্বপ্নের ঘোর লেগে আছে চোখে। সোনা মানে বড় কিছু ব্যাপার-স্যাপার এটা বেশ বুঝতে পারছি। তার উপর এক কলস! আগেতো পেয়ে নি। সিকি ভাগের চিন্তা পরে হবে। আচ্ছা, এত সোনা দিয়ে কি হবে! মাকে একটা মোটা দেখে হার বানিয়ে দেব বড় ফুফুর মতো। আর ওই কাজের বোকাহাদা ফুলিটার জন্য একটা কানবালা। ওর নুলো মেয়েটার পাদুটো ঠিক করতে কত সোনা লাগবে! তা যা লাগে লাগুক। সিনেমার মতো একটা ঘোড়া কিনলে কেমন হয়! যখন যেদিকে ইচ্ছে পিঠে চড়ে যাওয়া যাবে উড়তে উড়তে। পল্টুটাকে নেয়া যাবে না কিছুতেই। যা একটা ভিতুর ডিম! আর কি কি করা যায়, এই নিয়ে যখন কঠিন হিসাবে ব্যস্ত, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি চোখ বন্ধ করে নিজের মনে কি যেন বিড়বিড় করছে লোকটা। এবার চোখ খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাতখানা বাড়িয়ে বলল, ‘সোনার বহনিবখরা কিছু দে। এনাম না পাইলে বহুত অসোম্মান অইবে মা মনসার।’ এনামবখরা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। তবে লোকটা যে কিছু চাচ্ছে এটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কাছে তো সিকি আধুলি কিছু নাই। ফাঁকা পকেট। ব্যাগে আছে খানকয়েক বই, খাতা। বিব্রত অবস্থা দেখে একটু যেন মায়া হল তার। চোখ নাচিয়ে আমার গায়ের নতুন ক্যারোলিন জামাটা দু’ আঙুলে পরখ করে বলল, ‘আচ্চা, কিচু যহন নাই, তাইলে এইডাই দে। উনি খুশি হবে নে।’ বলতে বাকি, খুলতে দেরি নাই। সঙ্গে সঙ্গে হাড়ঝিরে শরীরখানা উদোম করে তুলে দিলাম নতুন বানানো বহু স্বপ্নের দামি ক্যারোলিন জামাটা। ভাগ্যিস হাফপ্যান্টের কথা বলেনি। মা মনসার ওটা কোন কাজে আসবে না দেখে স্বস্তি পেলাম। লোকটা চটপট জামাটা থলেতে গুঁজে একরকম দৌড়ে গিয়ে নৌকায় উঠল। তা উঠুক। আমি তখন ঝুলে আছি সোনার কলস নিয়ে। কাকে কি দেব, কি বানাব, কামরূপ কবে রওয়ানা দেব, এই চিন্তায় বিভোর হয়ে আছি। রাস্তায় যা দেখি ভালো লাগছে। প্রতিটি গাছ, লতাপাতা, জঙ্গল, সোনাল ফুল, দোয়েল, হরিয়াল, ফুলটুকি- সব চোখ চেয়ে তাকাই মনোযোগ দিয়ে। যেন কিছুই দেখেও দেখিনি এতদিন! কেমন যেন সব নতুন নতুন লাগছে। অকারণ পা দু’খানা নেচে উঠছে কেবল। মনে হয় নর্তকী ফড়িং। আহা, কি আনন্দ আকাশে, বাতাসে! আনন্দটা অবশ্য বেশিক্ষণ থাকে না। বাড়ির সামনে এসে দেখি কাচারিতে বসে বাবা বন্দুকের নল সাফ করছেন তেলতুলো দিয়ে। আমার খালি গা দেখে একটু অবাক হলেন। সবে টাইফয়েড থেকে উঠে খালি গা! বিস্ময়ে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন জামার কথা। কাঁইকুঁই করছি দেখে কান টেনে নিয়ে এলেন বন্দুকের নলের সামনে- ‘বল, জামা কই? বল, বল, শিগগির বল।’ বাবা রাগি মানুষ। সাদাকালো খোপকাটা জামাটা নতুন বানিয়ে দিয়েছেন বাগেরহাটের কামাল টেইলার্স থেকে। ক্যারোলিন বলে কথা। কটা লোক কিনতে পারে এই রকম দামি জামা! সব শুনে মাথায় আগুন ধরে গেল মানুষটার। ‘তবে রে হারামজাদা!’ বলে তিড়িং করে লাফিয়ে দৌড় মারলেন বন্দুক হাতে। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। বর্ষায় ফুলে ওঠা নদীর জোয়ারের টানে বহু দূরে চলে গেছে বেদের নৌকা।

Share.

মন্তব্য করুন