বন মানেই সবুজের সমারোহ। বনকে বলা হয় সবুজ অরণ্য। কিন্তু জার্মানির একটি বনের নাম কালো বন। জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই বনভূমি। জার্মানির এই বনটি পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় জায়গা। ব্ল্যাক ফরেস্ট বনটি মোট ১৫০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বেষ্টিত। লম্বা লম্বা গাছ আর উঁচু উঁচু পাহাড়ের কারণে এই বনটি ব্ল্যাক ফরেস্ট নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
অপরূপ সৌন্দর্যের এই বনভূমিতে পাহাড় ও বন একসাথে মিশে তৈরি করেছে এক অনাবিল পরিবেশ। এখানে আছে উঁচু উঁচু গাছ আর পর্বতচূড়া। গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে পাইন ও দেবদারু জাতীয় গাছ। এখানকার সর্বোচ্চ পর্বতচূড়ার নাম ফেল্ড বাগরাউর। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,৮৯৮ ফুট। পর্যটকদের কাছে দারুণ এক আকর্ষণের নাম এই ব্ল্যাক ফরেস্ট। আর তাই পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এই বনে করা হয়েছে নানান আয়োজন।
ব্ল্যাক ফরেস্টের রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। শেষ বরফ যুগের সময় বর্তমান ব্ল্যাক ফরেস্ট তুষার আচ্ছাদিত ছিল। পরে এই বরফ হিমবাহ আকারে নেমে এসে তৈরি করেছে কয়েকটি নদী। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম দানিয়ুব, দিইনজ, দি কিনজিগ, দি মুরগ, দি নেগোল্ড, রেন্চ। এই বনের মূল বৃক্ষগুলোর মধ্যে রয়েছে পাইন ও দেবদারু জাতীয় গাছ।
বনের গাছগুলোর ডালপালা কম এবং পাতা সরু সুচালো। ব্ল্যাক ফরেস্ট আফ্রিকার বনের মতো ঘন ও নিবিড় নয়। গাছগুলো একটু সাজানো গুছানো ও পরিপাটি।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই বনে কোনও হিংস প্রাণী নেই। বন্যজীবের মধ্যে রয়েছে গরু, উট, ছাগল, ভেড়া, ঈগল, পেঁচা, অস্ট্রিচ পাখি ইত্যাদি। এখানে খুব বড় আকারের কেঁচো ও শিয়াল দেখতে পাওয়া যায়। শিয়ালগুলো এতই বড় আকৃতির যে সেগুলো ঘোড়ার সমান বড়। অতীতে এই এলাকার লোকেরা এই শিয়াল দিয়ে বোঝা বহন করাতো।

বনটি বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। এক সময় মানুষের নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বনটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আকাশ থেকে এসিড বৃষ্টি বর্ষিত হবার কারণে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে এ এলাকায় সংঘটিত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। এই ঝড়ে অন্তত ১০০ একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
ব্ল্যাক ফরেস্ট এলাকায় রয়েছে একটি বিশেষ ছুটির দিন। এদিন সবাই দলবেঁধে রাস্তায় নেমে আসে এবং আদিবাসীদের মুখোশ পরে আনন্দ উল্লাস করে। আকর্ষণের বিষয় হচ্ছে, এই বনে প্রায় ২৩ হাজার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে পর্যটন নেটওয়ার্ক; যা পর্যটকদের বনের মধ্যে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। এই পর্যটন নেটওয়ার্ক পরিচালনার জন্য সেখানে রয়েছে প্রচুর লোকবল ও পর্যটন ব্ল্যাক ফরেস্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠন।

এখনে আছে অনেক সুন্দর সুন্দর লেক ও মনোরম ঝরনা। লেকগুলোতে দেখা যায় সবুজের মাঝে স্নিগ্ধ পানির উপর পাথর ছড়িয়ে থাকার অপরূপ সৌন্দর্য। পাহাড়ের চূড়া থেকে গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার দৃশ্য দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবেন। বনের মধ্যে সবুজ বেষ্টনীর মাঝে তৈরি করা হয়েছে নয়নাভিরাম বিভিন্ন কটেজ। যেখানে পর্যটকরা অবস্থান করতে পারেন।

এই বনে আছে সুন্দর কয়েকটি জলপ্রপাত। যার মধ্যে একটি অন্যতম জলপ্রপাতের নাম ট্রিবার্গ। জলপ্রপাতটি খুব উঁচু না হলেও এটি জার্মানির একটি বিখ্যাত জলপ্রপাত। জলপ্রপাতটি পর্যটকদের দারুণভাবে মুগ্ধ করে। বনের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ইউরোপিয়ান হাইওয়ে। তৈরি করা হয়েছে দীর্ঘ ফুটপাথও। ফলে পর্যটকরা অনায়াসেই বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এখানে পাহাড়ে সাইক্লিং করার সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছা করলেই পাহাড়ের খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারবেন ওপরে। এ ছাড়া দিনের বেলায় হাঁটার জন্য বনের মধ্যে আছে ছোট রাস্তা।
ব্ল্যাক ফরেস্টের মধ্যে আছে একটি জাদুঘর, যেখানে দেখানো হয়েছে ১৬ ও ১৭ শতকের জার্মান কৃষকদের জীবন। এ ছাড়াও দেখে আসবেন ঘড়ির জাদুঘর। নানা ধরনের ঘড়ির ইতিহাস নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই জাদুঘরটি। পাহাড় ও বন এক সাথে মিশে এখানে তৈরি করেছে এক অনাবিল পরিবেশ।

Share.

মন্তব্য করুন