আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের প্রাণের কবি। জাতীয় জাগরণের কবি। প্রতিদিনের স্মরণীয় কবি।
খুব ছোট্ট বেলায় তিনি কেমন ছিলেন? ছিলেন ছেলেটি বড্ড ডানপিটে। কারুর শাসন মানেন না। বারণ মানেন না। কাউকে ভয়ও করেন না। সবাই বলে ‘বাউ-ুলে’।
একরোখা এই ছেলেটির হৃদয়ে সাহসের তুফান ছোটে। বলেন :
“থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে ছুটছে তারা কেমন করে
কিসের নেশার করছে তারা বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।

পাতাল ফুঁড়ে নামবো আমি উঠবো আবার আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্বজগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোর পুরে।”

সবাই ঘুমিয়ে যায়। ছেলেটি জেগে থাকেন। সবাই যখন বিছানায়, ছেলেটি তখন বাইরে। তিনি তখন চুপিচুপি আকাশের সাথে কথা বলেন। তারাদের সাথে কথা বলেন। চাঁদের সাথে কথা বলেন। ‘ফুলপরীদের’ সাথে ভাব জমান। তার তখন ইচ্ছে হয় :
“আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি।
সূর্যমামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে
হয়নি সকাল ঘুমাও এখন- মা বলবেন রেগে।”

মাকে তখন তিনি কী জবাব দেবেন তাও ছেলেটি ঠিক করে ফেলেন :
“হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে নাকো?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।”

ঘুম তাড়ানো, পাখি ডাকা, অসম্ভব সাহসী সেই ছেলেটির নামই তো- ‘কাজী নজরুল ইসলাম।’ আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় কবি। জাতীয় কবি।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে। পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে। কবির ছেলেবেলা কেটেছে অনেক দুঃখ-কষ্টে। পেট ভরে খেতে পাননি। ভালো জামা কাপড় পরতে পারেননি। যে বয়সে ছেলেরা খেলাধুলা আর পড়াশুনা করে সময় কাটায়, সেই বয়সে তাকে আয়-রোজগার করতে হয়েছে। অন্যের দোকানে কাজ করতে হয়েছে।
স্কুলের ধরাবাঁধা লেখাপড়া তিনি বেশি করতে পারেননি। তাই বলে তিনি কম পড়েননি। লেখাপড়ার প্রতি তার ছিল প্রচ- আগ্রহ। নজরুল ইসলাম প্রচুর লিখেছেন। কবিতা তো ছিলই। আরও ছিল গান, গজল গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি। তাই বলে ছোটদের কথাও তিনি ভোলেননি। ভুলবেন কেমন করে? তিনি তো অনেক বড় কবি। অনেক বড় ছিল তাঁর হৃদয়। সে হৃদয়ে ছিল ভালোবাসার অথই সমুদ্র। তিনি ভালোবাসতেন মানুষ, দেশ, প্রকৃতি এবং ধর্মকে। ছোটরা ছিল তাঁর অনেক আপন। আর আপন বলেই তিনি লিখেছেন ছোটদের জন্যে প্রচুর কবিতা।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, কবির ‘লিচু চোর’, ‘খুক ও কাঠবিড়ালী’, ‘সওদাগর’ ‘ঝিঙে ফুল’- এ ধরনের মাত্র কয়েকটি ছড়া-কবিতার সাথে এখনকার ছোটরা পরিচিত। আগে তো পাঠ্যবইয়ে ‘শিশু যাদুকর’, ‘সংকল্প’, প্রভৃতি কবিতাগুলোও ছিল।
কবি নজরুলের ছোটদের জন্য লেখা বইগুলোও এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না। ফলে আমরা অনেকেই তাঁর বইয়ের সাথে পরিচিত নই। তিনি ছোটদের জন্য কম করে হলেও তেরোখানা বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে ছিল : ‘ঝিঙে ফুল’ (১৯২৬), ‘সঞ্চয়ন’ (১৯৫৫), ‘পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে’ (১৯৬৩), ‘ঘুম জাগানো পাখী’ (১৯৬৪), ‘সাতভাই চম্পা’, ‘ঘুম পাড়ানী মাসী-পিসী’ (১৯৬৫), ‘ফুলে ও ফসলে’ (১৯৮২), ‘ভোরের পাখি’, ‘তরুণের অভিযান’, ‘মটকু মাইতি’, ‘জাগো সুন্দর’, ‘চির কিশোর’ প্রভৃতি।
‘পুতুলের বিয়ে’ নামক একখানা নাটিকাও তিনি লিখেছিলেন। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৩ সালে।
কবি নজরুলের ছড়া-কবিতার টানই অন্যরকম। যেন বসন্তের বাতাস হৃদয়ে ঢেউ খেলে যায়। আবার কখনো বা সাহস ও দিগ্বিজয়ের ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটে যায়। আর তাঁর ছন্দ ও শব্দের দোলা তো কখনই ভুলবার নয়। যেন যাদুর বাঁশী। নিচের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতাটির ছন্দের দোলার কথাই ধরা যাক না! এর তুলনা পাওয়া ভার। যেমন :
“ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল।
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে ফুল-
ঝিঙে ফুল।
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢলে স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল
ঝিঙে ফুল ॥”

কবি নজরুল ইসলাম এক বিশাল বড় কবি।
এত বড় কবি, যিনি সবাইকে, সবকিছুকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন। ভালোবেসে লিখেছিলেন, তাঁর মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি কবিতা পড়ে কি তৃপ্তি পাওয়া যায়?
আহ্! কতইনা ভালো হতো, যদি কবির সবগুলো ছোটদের বই আবার বাজারে পাওয়া যেতো!
আমরা যদি তাঁর সব লেখাই পড়তে পারতাম- তাহলে সত্যিই উপকৃত হতাম। জানতে পারতাম।
কবিকে ভালোবেসে, তাঁর এইসব বইগুলোকে পৃথকভাবে এবং একত্রে ‘সঞ্চয়ন’ আকারে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করতো তাহলে আমরা পেয়ে যেতাম এক মহামূল্যবান সম্পদ।
কবি নজরুল ইসলামের অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক সাধ ছিল। তাঁর সে স্বপ্ন ও সাধকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন আমাদের প্রতিটি শিশুর মনে। তিনি মানুষের জন্য, দেশের জন্য যেমন নিজে জেগে থেকেছেন, তেমনি জাগাতে চেয়েছেন আমাদেরকে। ‘সংকল্পে’ দৃঢ় হয়ে ছুটতে বলেছেন। মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন। কবির সে স্বপ্ন এবং সাধ পূর্ণ হবে যদি আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষা ও আদর্শে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। যদি দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতে পারি।
এই দরদি ও প্রেমিক কবি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ইন্তেকাল করেন ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট ঢাকায়।
না, তিনি মরেননি। কবিরা কখনো মরেন না। এইতো তিনি বেঁচে আছেন। জেগে আছেন আমাদের মাঝে। মানুষের হৃদয়ে। আর জেগে থেকে কবি- এখনো প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই “ভোর হলো দোর খোল” বলে আমাদেরকে জাগিয়ে দেন।
কবির এই ডাক যেন আমরা ভুলে না যাই।
ভুলে না যাই তাঁর স্বপ্ন ও সাধের কথা।

Share.

মন্তব্য করুন