কুরুয়া ও মাছরাঙার মধ্যে একদিন দোস্তি হয়ে গেলো। কুরুয়া নামজাদা পাখি। মাটিতে তার পা পড়ে না। তার চলাফেরা ঠাটবাট অন্যরকম। কেউ তার সাথে কথা বলার সাহস পায় না। সেই কুরুয়া মাছরাঙার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলো। মাছরাঙার গাঢ় সবুজ পালক তার ওপর খয়েরি টানা রেখা তাকে আকৃষ্ট করলো। সে নিজ মুখে বলে বেড়াতে লাগলো মাছরাঙার সাথে দোস্তি করতে চায়। দোস্তালির আলাপে মধ্যস্থতা করার জন্য ঘুঘুকে ডেকে পাঠালো সে।
“ঘুঘুভাই একটা কাজ করতে হবে যে তোমাকে।”
“কী কাজ করতে হবে বলুন না কুরুয়াভাই।”
“আরে কি করে যে বলি। মানে মাছরাঙাকে বলতে হবে কথাটা।”
“বলুন। কী কথা বলতে হবে।”
“এসব কথা তো আমার মুখে মানায় না। তারপরও বলছি আরকি।”
“মানা না মানার কি আছে। বললে এখনই ওকে ডেকে আনতে পারি।”
“না ডাকার দরকার নেই। এই ধর ওর সাথে বন্ধুত্ব করার সখ জাগছে মনে।”
“এই কথা। ও আমি ঠিকই গুছিয়ে দেবো এখন।”
পাখিদের একটা বড়সড় জলসায় ওদের মাঝে দোস্তি হয়ে গেলো। দোয়েল আর পাপিয়া গান গাইলো। পাতার মর্মরধ্বনি নহবত বাজিয়ে গেলো গানের তালে। টুনটুনি নেচে নেচে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। অনেক খাওয়া আর আনন্দ হলো সেদিন। বড় আর ছোটর মাঝে দোস্তি সহজ কথা নয়। সমাজে তো বড়য় বড়য় গলাগলি। এমন দোস্তি তো হামেসা নজরে পড়ে না। নতুন আমেজে সবার মন আপ্লুত হয়ে গেলো। সবাই আলোচনা করতে লাগলো সত্যি এবার নতুন দিনের সূচনা হলো। কুরুয়া আর মাছরাঙাকে কুশল জানিয়ে খুশিমনে যে যার কাজে চলে গেলো।
দোস্তি হবার পর মাছরাঙাকে নিজ বাসায় সস্ত্রীক দাওয়াত করলো কুরুয়া। দাওয়াত পেয়ে মাছরাঙা ও তার বউ খুশিতে আটখানা হয়ে গেলো। দোস্তের বাড়ির প্রথম দাওয়াত। নদীতে গোসল করে সুন্দর করে সেজেগুজে বউকে সাথে করে মাছরাঙা গেলো দাওয়াত খেতে। ওদেরকে দেখে কুরুয়া ও তার বউ খুব খুশি হলো। রুই মাছের মাথা, বোয়াল মাছের কলিজা আর শোল মাছের ঝোল দিয়ে ওরা দোস্তকে আপ্যায়ন করলো। তাজিম করে বড় ঘরের কারুকাজ করা খাটে বসিয়ে নানারকম ফল আর পুঁটিতর মাছের স্যুপ খাওয়ালো। কুরুয়াবউ গল্প করলো ওদের সাথে। কতোসব অবাক করা শিকারের গল্প। একবার নাকি তারা দুজনে মিলে নদী থেকে একটা ইয়াবড় গড়িয়াল শিকার করে এনেছিলো। শুনে তো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো। অনেক কথার পর মাছরাঙা কুরুয়াকে দাওয়াত করে অলস ডানায় বাসায় ফিরে এলো।
সারারাত তাদের ঘুম হলো না। এতো ধনসম্পদ দোস্তের অথচ তাদের কিছুই নেই। থাকার মতো একটা ভালো ঘর নেই। নদীর কাছাড়ে খাল দিয়ে ওরা থাকে। কাছাড় ভেঙে গেলে আবার নতুন করে বাসা তৈরি করতে হয়। দোস্ত এলে কোথায় বসতে দেবে তারা। আর খাওয়াবেই বা কী? প্রতিদিন যেসব মাছ ওরা খায় তা কি দোস্তের সামনে দেয়া যাবে? একদিন দুপুরে কুরুয়া তার বউকে নিয়ে মাছরাঙার বাড়িতে চলে এলো। ওদের ছোট্ট বাসায় তো বসতে পারবে না কুরুয়া। বাধ্য হয়ে একটা হেলানো গাছের ডালে ওদের বসতে দেয়া হলো। দোস্তের জন্য কোন খাবার ওরা জোগাড় করতে পারেনি।
“এখন কী হবে? ওরা যে এসে পড়লো। খাবারের কোন ব্যবস্থাই তো করা হয়নি।” মাছরাঙার বউ ব্যস্ত হয়ে বললো।
“কী করব বুঝতেই তো পারছি না। ওরা যে কি খায়। তাই তো জানি না।” বিমর্ষ কণ্ঠে বললো মাছরাঙা।
“কী খায় আবার। দেখলে না কি খায়।”
“তা তো দেখেছি। অতোকিছু কি জোগাড় করতে পারবো?”
“পারবো না বললেই হলো। ঘরে মেহমান বসিয়ে রেখে এভাবে বললে হবে।”
“কী করবো একটু বুঝিয়ে বলো না। আমার মাথা ঠিক নেই।”
“ওসব বাদ দিয়ে একটা বড় মাছ ধরে আনো নদী থেকে। আমি ততোক্ষণ গল্প করি।”
নদীর ধারে নলের ডালে বসে মাছরাঙা চিন্তা করতে লাগলো। কোনদিন সে বড় মাছ ধরেনি। সে সময় ধরেছে ছোট ছোট মাছ। তার তো পেট ছোট। বড় মাছ ধরার তো কোন প্রয়োজন নেই তার। তার বউ তো নিজের খাবার নিজেই সংগ্রহ করে নেয়। এমন কঠিন সমস্যায় সে কোনদিন পড়েনি। দোস্তের বাড়িতে যতোবড় মাছের মাথা সে খেয়েছে অতোবড় মাছ সে জীবনে দেখেনি। চুঁচড়া মাছ মেরে কি দোস্তের সামনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কী বলবে এসব দেখলে দোস্ত আর দোস্তানি। এসব ভেবে তার মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগলো। এমন সময় মাছরাঙা দেখলো একটা বড় মাছ নলের ঝোপের পাশ দিয়ে পিঠ জাগিয়ে যাচ্ছে। কোন দ্বিধা না করে মাছটার পিঠে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো সে। পিঠে কামড়ের আঘাত পেয়ে একটা বাগড়া দিয়ে মাছটা পানির নিচে তলিয়ে গেলো। মাছের সাথে মাছরাঙাও গভীর পানিতে ডুবে গেলো। মাছ আটকানো তো দূরের কথা জান বাঁচানোই মুশকিল হলো তার। অনেক চেষ্টা করে মাছ ছেড়ে দিয়ে উপরে ভেসে ওঠে মাছরাঙা দেখে তার সুন্দর ঠোঁট ভেঙে গেছে। টপ টপ করে রক্ত ঝরতে লাগলে ঠোঁট দিয়ে। ব্যথায় সে অস্থির হয়ে গেলো। কোনক্রমে পাখা ঝাপটিয়ে নলের ঝোপে একটি পরিত্যক্ত পাখির বাসায় শুয়ে কাতরাতে লাগলো মাছরাঙা। বাসায় ফেরার শক্তি তার নেই। আর কোন মুখ নিয়ে ফিরবে সে বাসায়। তার এ করুণ দশা কী করে সে কুটুমের সামনে প্রকাশ করবে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কাঁদতে লাগল মাছরাঙা। বারবার বুক চাপড়িয়ে একটি কথাই সে বলতে লাগলো- ‘ছোট হয়ে কেন সে বড়র সাথে দোস্তি করতে গেলো।’

Share.

মন্তব্য করুন