বিছানায় বসে কল্পনায় ছবি আঁকছে কাজল। নদীর দু’পাড়ে অপরূপ সবুজের দৃশ্য। এই সবুজের মাঝে হালকা বাতাসে দোল খাচ্ছে সাদা সাদা কাশফুল। নদীর পাড়ে শিকারি বক মাছের অপেক্ষায় এক ধ্যানে বসে আছে। নদীর ঠিক বুকে কলাগাছের ভেলায় ভেসে যাচ্ছে কাজল ও তার বাবা আশরাফ। আশরাফ মিয়া নদীতে জাল ছিটিয়ে মাছ তুলছে আর কাজল সেই মাছ খলুইতে ভরছে। এমন স্বপ্নে যখন কাজল বিভোর ঠিক তখনি তার মা পাশের ঘর থেকে ডাকলো- তাড়াতাড়ি ছড়াটা মুখস্থ কর মামণি। তোর আব্বা আসছে। স্কুলে যাওয়ার সময় হচ্ছে।
‘আচ্ছা আম্মু’ বলেই, জোরগলায় পড়তে লাগলো-
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে…’
কিন্তু মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেলো আম্মুর প্রতি। আহা! কী অপরূপ সে দৃশ্য। আম্মুর জন্যই যেনো তার কল্পনায় ছেদ পড়ল। সেই সাথে মনে মনে ভাবতে লাগলো- কল্পনাকে বাস্তবে আঁকবে। তাই বাবাকে বলবে যেনো আজকে রং পেন্সিল আর আর্টের খাতা কিনে দেয়। মাকে ডেকে বলে, ‘আম্মু, স্কুলে সবার রং পেন্সিল, আর্ট খাতা আছে। আব্বুকে বলো, আমাকেও কিনে দেবে না?
‘ওমা এ কী বলছো! দেবে না কেনো? লাগলে অবশ্যই দেবে। তুমিতো কোনো দিন বলোনি।’
‘এই তো বললাম, আজকে কিনে দিতে বলিও।’
‘আচ্ছা, ঐ যে তোর আব্বু আসছে।’ ‘কি গো আজ এতো দেরি যে? মাছ পাওনি নাকি?’
‘পেয়েছি তো। বিক্রি করেই আসছি। কই কাজল, রেডি হয়েছে?’
দৌড়ে চলে এলো কাজল।
‘আব্বু, আমিতো রেডি। আজকে কিন্তু রং পেন্সিল আর আর্ট খাতা কিনে দিতে হবে। না বলতে পারবে না।’
‘আচ্ছা, চলো মামণি। স্কুলে যেতে পথে কিনে দেবো। পড়া সব পড়েছো? স্কুলে কিন্তু দুষ্টুমি করা যাবে না। তাহলে সবাই ভালো বলবে।’
‘আমি তো দুষ্টুমি করি না। ম্যাডাম বলছে, আমি খুব ভালো মেয়ে। ম্যাডাম তো আমাকে পরী বলে ডাকে। আচ্ছা আব্বু, আমি সত্যি কি পরী হতে পারবো?’
‘তুমি তো পরীই মামণি।’
স্কুল থেকে ফিরেই স্বপ্নের ছবিকে বাস্তবে রূপ দিতে পড়ার টেবিলে বসে কাজল। দুপুরের খাবারও খায়নি। বিকেলে খেলতেও যায়নি।
পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে আবারও ছবি আঁকতে বসে। মা-বাবাকে দেখলে উচ্চস্বরে ছড়া-কবিতা পড়ে। তারা আড়াল হলেই শুরু হয় আঁকার কাজ। কোনোভাবেই সে ছবি আঁকতে পারে না।
তিন-চার দিনের প্রচেষ্টায় একটা নদীর ছবি ফুটে ওঠে সাদা খাতায় নানান রঙের বাহারে। খুশিতে সে নাচতে থাকে। তার হাসি খুশি চাঁদমুখ পিতা-মাতাকে খুব প্রশান্তি দেয়। হাসি-খুশির কারণ আড়ালে থাকে।
পরের দিন নদীর মাঝে কলাগাছের ভেলা আঁকে। সেই ভেলায় তার বাবা ও তার মাছ ধরার দৃশ্যও আঁকে। সে বুঝতে পারে ছবিতে তার বাবাকে খুব রোগাটে লাগছে। তাই বাবাকে মোটাসোটা করার চেষ্টায় দিনরাত ব্যস্ত হয়ে যায়।
প্রতিদিনই ধীরে ধীরে সাদা খাতাটি বাহারি রঙের খেলায় হাসতে থাকে প্রভাতি নদীর মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে। একের পর এক দৃশ্য ছবিতে সংযুক্ত করছে। আজকে সে কাশফুল আর বক সফলভাবেই আঁকতে পেরেছে বলে নিজেকে গর্বিত মনে করে।
এদিকে বিকেলে স্কুলের গণিতের স্যার কাজলদের বাসায় এসে তার মাকে বলে, ‘কাজল এখন আগের মতো পড়াশুনায় মনোযোগী নয়। সব বিষয়ে সে ক্রমাগত খারাপ করছে। এমনকি ম্যাডামও নাকি স্যারকে একই কথা বলেছেন।’
মা রেগে-মেগে কাজলকে ধমক দিলে আশরাফ মিয়া বলে, ‘এটা তেমন কিছু না। বাচ্চাদের বকাবকি করা ঠিক না।’
পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙে কাজলের। ছবিটাকে বর্ডার দিয়ে মনের খুশিতে পড়াশুনা শুরু করে। বারবার ছবিটাকে দেখতে থাকে খাতা মেলে। স্কুলে গিয়ে ম্যাডামকে দেখায়, তার নিজ হাতে আঁকা সেই কল্পনার দৃশ্যাবলি। ম্যাডাম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন কাজলের দিকে। তারপর বলেন, ‘আমাকে ছবিটি দাও, কালকে দেবো।’
পরের দিন শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। মা-বাবার সাথে খেতে বসেছে কাজল। সে সময় ‘আশরাফ মিয়া’ বলে ডাকতে থাকে গণিত স্যার। স্যারের ভয়ে এক দৌড় দিয়ে ঘরে লুকায় কাজল। না জানি, আবার কী অভিযোগ নিয়ে এলেন।
কাজলের বাবা, খাবার রেখে হাত ধুয়ে এগিয়ে যায় আশরাফ।
স্যার বলেন- ‘কাজল তো গ্রামের নাম উজ্জ্বল করেছে। দেখো, তার আঁকা ছবি আজকের পত্রিকায়।’
এই কথা শুনে কাজলের মা-বাবা খুশিতে আত্মহারা হয়। কাজল বুঝতে পারে, এটা ম্যাডামের কাজ। কাজলও খুশিতে ও লজ্জায় ঘর থেকে বের হয়ে নদীর দিকে ছুটতে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন