চারিদিকে করোনার ফণা। এই অদৃশ্য ফণার থাবা থেকে মানুষ কবে যে মুক্তি পাবে, কেউ জানে না। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তাদের, যারা এই সমাজের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। সবচে দুশ্চিন্তা তাদের। কাজ ছাড়া ঘরে বসে থেকে কয়দিন চলা যায়। তাদের তো জমানো কোনো অর্থ নেই। দুটো হাতই কেবল সম্বল এসব মানুষের। চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে থাকে তারা। হতাশার কালো মেঘে ছেয়ে যায় তাদের পৃথিবী। ছোট হতে হতে একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে বলয়টা।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি সাহায্যের অন্ত নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে তবেই না অসহায় এসব মানুষের সিকে ছিঁড়বে?
ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বার আর লোভী দলীয় নেতা-কর্মীদের হাত গলে নিম্নশ্রেণির ওই সকল দুঃখী মানুষের ঘর অবধি পৌঁছে না কিছুই। কেবলই শোনা যায়, সরকার এ দিচ্ছে, তা দিচ্ছে। কাউকে না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না। এগুলো সত্যিকার অর্থে কথার কথা, ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়।
এক্ষেত্রে বাস্তবতা ভিন্ন। দু-একজন ভাগ্যক্রমে কথিত ত্রাণের কিছু অংশ পেলেও তা নিতান্তই দলীয় বিবেচনায়। চেয়ারম্যান, মেম্বারের ভোটার কিনা- ত্রাণ পাওয়ার যোগ্যতা নাকি এটাই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
এসব দেখে দেখে নিজেকে আর গুটিয়ে রাখতে পারে না পারভেজ।
এই সকল মানুষের কষ্টে ওর বুক ভেঙে যায়। নিজে নিজে পরিকল্পনা আঁটতে থাকে, কিভাবে এই অসহায় মানুষের পাশে থাকা যায়। কিভাবেই বা তাদের মুখে এই দুর্দিনে হাসি ফোটানো যায়। একা এত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তো সম্ভব নয়। সম্মিলিত কোনো প্রচেষ্টাই পারে এর সুফল আনতে।
ভাবনার অতলে হারিয়ে যায় ও।
ভাবতে ভাবতে চট করে একটা প্ল্যান এসে যায় মাথায়। আর দেরি করে না। ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করে সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে। পারভেজের ভাবনার সঙ্গে দ্বিমত করে না কেউ। ওরাও সানন্দে রাজি হয়ে যায়। এটা সাকসেস করতেই হবে।
প্ল্যানমাফিক ‘সুন্দর গ্রাম গড়বো আমরা’ শিরোনামে একটা ফেসবুক পেজ খোলে। সেখানে ওই গ্রামের উঠতি বয়সের তরুণদের যুক্ত করে নেয় সে। যাদের সকলের চোখেমুখে নতুন স্বপ্ন লেপ্টে রয়েছে। শুধু দিকনির্দেশনার অভাব।
এতটুকু করতে পেরে পারভেজের মনে শক্তি সঞ্চার হয়। ও বুঝতে পারে, সে পারবে। এবং তাকে পারতেই হবে। সবার সহযোগিতা নিয়ে তার এই মনোকষ্ট ঘোচাতেই হবে। পণ করে পারভেজ।
ওর পরিকল্পনার কথা সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। মানবিক আবেদনের আহ্বান জানায়। মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। গ্রামের অসহায় মানুষকে বাঁচাতে হবে। যে যেভাবে, যতটুকু পারো সহযোগিতা করো।
ব্যস, এর মাধ্যমেই সবার ভেতরে একটা মানবিক দোলা দিতে পারল সে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের কথা যারাই শুনল, সবারই প্রাণ হাহাকার করে উঠল।
প্রায় সকলেই ওইসব মানুষের পাশে দাঁড়াবার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
আসতে থাকে প্রতিশ্রুতি একের পর এক। যার যার সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করার অঙ্গীকার করে। আনন্দে পারভেজের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ভিজে ওঠে চোখের কোণ।
দেখতে দেখতে এই কর্মকা-ে যুক্ত হয়ে যায় গ্রামের মুস্তাক, রিপন, জনী, ইয়াদুল, রকি, জাহিদুল, এমদাদ, সবুজ, আব্দুল্লাহ, জহির, ইমরান, হাবিব, তারিক, শাওন, সাহারুল, চঞ্চল, আকাশসহ বেশ ক’জন স্বপ্নবাজ তরুণ।
এর মধ্যে বেশ ক’জন দেশের বাইরে থাকে। তারা যেন বেশি উৎসাহী এই ব্যাপারে। দেশছাড়া হলে বুঝি এমনই হয়, বুঝল পারভেজ। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা পাঠায় প্রবাস থেকে। যে যখন টাকা পাঠায়, অ্যাডমিন হিসেবে পারভেজ তা ফেসবুক পেজে আপলোড করে। এ থেকে সবাই জানতে পারে তাৎক্ষণিক চালচিত্র। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি জমা হয় টাকা। আবেগে ওরা টগবগ করে ফুটতে থাকে।
তরুণদের এই অগ্রযাত্রা দেখে বড়দেরও কেউ কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সাহায্য করে।
বড়দের অংশগ্রহণ যৎকিঞ্চিৎ হলেও তাতে ওদের উৎসাহ বেড়ে দ্বিগুণ হয়। বড়দের কাউকে কাউকে ওদের পরামর্শক হিসেবে গ্রহণ করে ওরা।
দেখতে দেখতে ক’দিন কেটে যায়। ত্রাণফান্ড যখন ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল, তখন বাস্তবে ফিরতে সাহস হয় ওদের। গ্রামের কার কী হালহকিকত তা জানার কাজ শুরু করে। একটা সূক্ষ্ম চকআউট করতে হবে। প্রকৃত অর্থেই যারা অসহায়, তারাই যেন এই সাহায্য পায়, সে ব্যাপারে সতর্ক হয়ে তালিকা তৈরি করে তারা।
জমা হওয়া টাকায় তালিকাভুক্ত প্রত্যেক পরিবারকে কী পরিমাণ সাহায্য করা যাবে সেই খতিয়ানও প্রস্তুত হয়ে যায়।
এরপর একদিন বাজারে গিয়ে চাহিদামাফিক চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, সাবান, আটা, চিনি কিনে আনে।
সব অপেক্ষার ইতি ঘটে ত্রাণসামগ্রী হাতে পেয়ে। এবার প্যাকেট করার পালা। ওই দিনই প্যাকেট করে তালিকা মতো। প্রত্যেক প্যাকেটে ১০ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, এক কেজি ডাল, এক কেজি পেঁয়াজ, একটা সাবান, দুই কেজি আটা, দুই লিটার তেল আর এক কেজি চিনি। এরপর নিজেদের দায়িত্বে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিল ওরা। তারপর সকলেই শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
এই পরিমাণ সাহায্য দেয়ার পরও আরো কিছু টাকা অবশিষ্ট রইল। অন্য দিকে কেউ কেউ অর্থ সাহায্য পাঠাচ্ছে তখনো।
তাতে করে আরো কয়বার এভাবে সাহায্য করা যাবে বলে ফেসবুক পেজে জানানো হলো। একইভাবে আবারো কিছুদিন পর ত্রাণসামগ্রী সময়মতো দেয়াও হলো অসহায় মানুষকে।
আবার এরই মধ্যে রোজা এসে গেল। তখন আবার নতুন ভাবনা। সিদ্ধান্ত হলো, এবারও অসহায় ওই সকল মানুষের মাঝে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করা হবে।
যথারীতি ইফতারসামগ্রী দেয়ার পর রইল আরো কিছু টাকা।
এখন কী করা যাবে? পরিকল্পনা হলো, সামনেই ঈদ। এই ঈদে বাছাই করে কিছু মানুষকে নগদ টাকা ঈদ উপহার হিসেবে দেয়া হবে। তাতে খুশির পাল্লাটা আকাশ ছোঁবে। কথামতো ঈদের এক সপ্তাহ আগে কিছু মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেয়া হলো।
দুর্দিনে ত্রাণ হাতে পাওয়া, ইফতারসামগ্রী হাতে পাওয়া, ঈদ-উপহার হিসেবে নগদ টাকা হাতে পাওয়া মানুষের যে আশ্চর্য সুন্দর হাসি ওরা দেখেছিল, তা কোটি টাকায় কেনা সম্ভব নয়।
খুব অল্প সময়ে এতগুলো মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে ওদের সকলের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। ঝলমল করে উঠল মুখ।
এখানে একটা বড় ব্যাপার হলো, সমাজে বিভিন্ন সময়ে খুঁটিনাটি বিষয়ে যারা লম্বা লম্বা কথা বলে, তাদের কারো এই কাজে খুঁজে পাওয়া গেল না। তারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখল। পারভেজরা তা অবাক হয়ে লক্ষ করল বরাবরের মতোই। এরা কখনোই নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া গ্রামের কোনো ভালো কাজেই থাকে না। কিন্তু কথার বেলায় দারুণ বাকপটুতা তাদের।
ওদের আশা ছিল, ওরা এই কাজ শুরু করলে সমাজের ওই সকল অভিভাবকেরা (?) এসে যোগ দেবে এবং এটার হাল ধরবে। তাদের পরামর্শে ওরা মনের আনন্দে কাজ করবে।
কিন্তু তা তো কেউ করলই না, উপরন্তু এই কাজকে নানাভাবে নেতিবাচক কথা বলে থামিয়ে দিতে চাইল।
কিন্তু ওরা তা পরোয়া করেনি কিছুতেই। বুক চিতিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে এই কাজ সম্পন্ন করেছে। এ জন্য কেউ কেউ যে ওদের সাধুবাদ জানাননি, এমন নয়। দু-চারজন যে উৎসাহমূলক কথা বলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, তাতেই ওরা খুশি।
এখন ওরা স্বপ্ন দেখছে, এই জনপদের বড়রা যা পারেনি, তা বাস্তবায়ন করার।
বড়দের কেউ কেউ এখানে বেশ কবার একটা সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়তে চেয়েছেন। নানারকম উদ্যোগও নিয়েছেন। তখন বই রাখার ঘর হয়েছিল। বই সংগ্রহ হয়েছিল। চাঁদা তুলে নির্বাচিত অনেক বই কেনাও হয়েছিল। কিন্তু কেন যেন আস্তে আস্তে আর আলো ছড়াতে পারেনি তা। মানে হলো না, জ্বলতেই নিভে গেল। স্তিমিত হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল পাঠাগারের সব কার্যক্রম।
সেই পাঠাগারকে এই তরুণ প্রজন্ম আবার আলোয় আনতে চাইছে। পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে। ‘জ্ঞানের আধার বই, পড়ব অবশ্যই’– এই স্লোগানকে ধারণ করে ওরা নতুন এই কর্মসূচি হাতে নিতে চাইছে।
ওদের এই জন-আকাক্সক্ষার কথা জানতে পেরে বড়দের কেউ কেউ প্রাণভরে ওদের জন্য দোয়া করছে। বলছে, জয় হোক তারুণ্যের। যুগে যুগে এই তরুণরাই তো সকল সফল স্বপ্নের সিঁড়ি রূপায়ণ করেছে। ওরাই পারবে সামনের সকল বাধা অতিক্রম করে একটা শুভ পরিণতি ডেকে আনতে।
বড়দের কেউ কেউ যারা এক সময় এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করছিল, তারা এটুকু ভেবে শান্তি পাচ্ছে যে, যাক তারা আর কিছু না পারুক, নবযৌবনা এই তুর্কি-তরুণদের চোখের তারায় একটা উজ্জ্বল স্বপ্ন তো বুনে দিতে পেরেছে!!

Share.

মন্তব্য করুন