ক্রিকেট রেকর্ডের খেলা। প্রতিনিয়ত অনেক নতুন নতুন রেকর্ড গড়া হয় ক্রিকেটে। আবার একজনের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন অন্যজন। তবে এমন কিছু রেকর্ড আছে যা সত্যি অনন্য। তেমনই একটি রেকর্ড টেস্ট ক্রিকেটে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নেয়া।
টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৩ বছরের ইতিহাসে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখা গেছে মাত্র তিনবার। আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে এই তিন কৃতী ক্রিকেটারের একজন আমাদের সাকিব আল হাসান। অন্য দু’জন কিংবদন্তি দুই অলরাউন্ডার ইমরান খান ও ইয়ান বোথাম।
একটি বিষয় বলে রাখি, ক্রিকেটে অনেক সময় অনেক রেকর্ড ঘটনাচক্রে হয়ে যায়। মানে বড় মাপের ক্রিকেটের না হয়েও কেউ কেউ বড় রেকর্ড করে ফেলেন; কিন্তু এ রেকর্ডে যে তিনজনের নাম জড়িয়ে আছে তারা সবাই ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডার। তিনজনই নিজ নিজ সময়ের সেরা। চলো জেনে আসি সেই দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুণ্যের ঘটনাগুলো সম্পর্কে।

স্যার ইয়ান বোথাম, ফেব্রুয়ারি ১৯৮০
একটি মাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলতে সেবার মাইক ব্রেয়ারলির ইংল্যান্ড দল গিয়েছিল ভারত সফরে। মুম্বাইয়ে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ শুরু হওয়া সেই ম্যাচে প্রথম এই ইতিহাস গড়েছিলেন ইংলিশ অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম। গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ভারতীয় দলকে সেই ম্যাচে ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। আর এ জয়ের নায়ক ছিলেন বোথাম। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ভারত ২৪২ রানে অলআউট হয়। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার বোথাম ৬ উইকেট নিয়েছিলে ৫৮ রান খরচ করে। সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেবসহ বড় বড় ভারতীয় তারকাদের নিজের শিকার বানিয়েছিলেন।
এর জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ডের শুরুটা ভালো হয়নি। ৫৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা। এরপর ইংল্যান্ডের ইনিংস গড়ার দায়িত্ব নেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান বোথাম। ষষ্ঠ উইকেটে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান বব টেইলরের সাথে গড়েন ১৭১ রানের জুটি। নিজে খেলেন ২০৬ বলে ১১৪ রানের সময়োপযোগী দুর্দান্ত এক ইনিংস। ইনিংসে ছিলো ১৭টি চার। বিপর্যয় থেকে দলকে টেনে তুলে কারসান গাভরির বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যখন বিদায় নেন, ততক্ষণে ইংল্যান্ডে ফিরেছে ম্যাচে। শেষ পর্যন্ত ৫৪ রানের লিড নিয়ে ইংল্যান্ড অলআউট হয় ২৯৬ রান করে। যেটি হতে পেরেছে শুধুমাত্র বোথামের ওই দুর্দান্ত সেঞ্চুরির কারণে।
ভারত নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে আবারো পড়ে বোলার বোথামের তোপের মুখে। এবার বল হাতে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন ইয়ান বোথাম। রীতিমতো দুমড়ে মুচড়ে দেন ভারতের টপ অর্ডার। দলীয় রান ৫৮ উঠতেই ভারত হারায় ৬টি উইকেট। শেষ পর্যন্ত তারা ১৪৯ রানে অলআউট হয়। এবার বোথাম ৪৮ রানে নিয়েছেন ৭ উইকেট। ভারত ৯৭ রানের লিড পেলেও তা টপকে যেতে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনারের কোনো কষ্টই হয়নি। তারা ম্যাচ জেতে ১০ উইকেটে। দ্বিতীয় ইনিংসে বোথামকে আর ব্যাট করতে হয়নি। বোথাম দুই ইনিংস মিলিয়ে নেন ১৩ উইকেট, খরচ করেন মোট ১০৮ রান। এর মাধ্যমে টেস্ট ইতিহাসে নতুন এক নজির গড়েন ইয়ান বোথাম। যা আগে কেউ করতে পারেনি। টেস্ট ক্রিকেট দেখলো প্রথমবার এমন দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুণ্য।

ইমরান খান, জানুয়ারি ১৯৮৩
ইয়ান বোথামের দারুণ ওই রেকর্ডে মাত্র ৩ বছর পরই ভাগ বসান পাকিস্তানের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ইমরান খান। সেবার বছরের শুরুতে পাকিস্তানে ৬ টেস্টের লম্বা সিরিজ খেলতে যায় সুনীল গাভাস্কারের ভারত। প্রথম দুই টেস্ট হেরে ফয়সালাবাদে খেলতে নামে তৃতীয় টেস্ট। প্রথম ইনিংসে ভারতকে ৩৭২ রানে অলআউট করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান। ৬ উইকেট নেন ৯৮ রানে।
এরপর নিজেরা ব্যাট করতে নেমে ভারতীয় বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা করে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা। জাভেদ মিয়ঁদাদ ১২৬, জহির আব্বাস ১৬৮, সেলিম মালিক ১০৭ ও ইমরান খান করেন ১১৭ রান। চার সেঞ্চুরিতে পাকিস্তান দাঁড় করায় ৬৫২ রানের পাহাড়। মানিন্দর সিংয়ের বলে মদন লালকে ক্যাচ দেয়ার আগে ইমরান খানের ১২১ বলের ইনিংসে ৯টি চার ও ৫টি ছিল ছক্কা। লিড নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান চেয়েছিল দ্রুত আরো কিছু রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করতে। সে কারণেই মূলত ইমরান খান অমন হার্ডহিটিং ব্যাটিং করেছিলেন। তখনকার যুগে ওয়ানডেতেও ১২১ বলে ১১৭ রান তোলার বিষয়টি সহজ ছিলো না। তাই টেস্টের বিচারে সেটি কতটা আগুনে ব্যাটিং বোঝাই যাচ্ছে। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তান পায় ২৮০ রানের লিড।

নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ভারতীয়দের মধ্যে সুনীল গাভাস্কার দারুণ ব্যাটিং করলেও অন্যরা কেউ তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি। ওপেনার গাভাস্কার অপরাজিত ছিলেন ১২২ রানে। অন্য প্রান্ত দিয়ে একের পর এক উইকেট পড়েছে। ইমরান খান নিয়েছেন ৮২ রানে ৫ উইকেট। ২৮৬ রান করে ওই ইনিংসে ভারত মাত্র ৬ রানের লিড দিতে পেরেছে। যার ফলে পাকিস্তানের জয়ের জন্য দরকার ছিলো ৭ রান। সহজেই তা করে ফেলে তারা। দুই ইনিংস মিলে ইমরান নিয়েছেন ১১ উইকেট, সেই সাথে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। এর চেয়ে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স আর কী হতে পরে? এই ম্যাচ দিয়ে তিনি রেকর্ড বইয়ে বসে যান ইয়ান বোথামের পাশের আসনে।

সাকিব আল হাসান, নভেম্বর ২০১৪ খুলনা
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে এক ক্রীড়া সাংবাদিক সাকিব আল হাসানকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, টেস্ট ক্রিকেটের এই বিরল রেকর্ডের কথা। আরো বলেছিলেন, দুই কিংবদন্তি অলরাউন্ডার বোথাম ও ইমরান এই কীর্তি গড়েছেন। আপনি এমন কিছু করতে পারলে সেটি মন্দ হয় না। সব শুনে সাকিব আল হাসান বলেন, ও আচ্ছা, এমন রেকর্ডের কথা জানতাম না। ঠিক আছে চেষ্টা করতে দোষ কী!
সেই সাংবাদিককে দেয়া কথা ঠিকই রেখেছেন সাকিব। খুলনায় সেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই তিনি ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি আর বল হাতে ১০ উইকেট নিয়ে বসেন বোথাম আর ইমরানে পাশে। টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪৩৩ রান করে বাংলাদেশ। তামিম ইকবাল ১০৯ ও সাকিব আল হাসান ১৩৭ রান করেন। সাকিবের ১৮০ বলের ইনিংসে ছিলো ১৮টি চার ও ২টি ছক্কা।

জবাব দিতে নেমে নিজেদের প্রথম ইনিংসে দুই সেঞ্চুরি পায় জিম্বাবুয়েও; কিন্তু হ্যামিলটন মাসাকাদজা (১৫৮) ও রেগিস চাকাভার (১০১) সেঞ্চুরি সত্ত্বেও ৩৬৮ রানে অলআউট হয় সফরকারীরা। সাকিব আল হাসান নেন ৮০ রানে ৫ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ২৪৮ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। এবার সাকিব করেন মাত্র ৬ রান। সব মিলে জিম্বাবুয়ের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ৩১৪ রানের। তবে সাকিব-তাইজুলের বোলিং তোপে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ১৫১ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের জয় ম্যাচ শেষ হওয়ার অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে যায়। তাই সবার চোখ ছিলো সাকিবের দিকে। সমর্থকদের হতাশ না করে জিম্বাবুয়ের নবম ব্যাটসম্যান নাতশি এমসাঙ্গয়েকে মুশফিকের গ্লাভসবন্দী করে স্পর্শ করেন মাইলফলক। জিম্বাবুয়ে গুটিয়ে যায় মাত্র ১৫১ রানে। বাংলাদেশ পায় ১৬২ রানের বড় জয়। যে জয় ছিলো শুধুই সাকিবময়।

Share.

মন্তব্য করুন