আলোর বয়স ৭ বছর। নাম আলো হলেও এখন পর্যন্ত সে পৃথিবীর আলো দেখেনি। কী করে দেখবে? ও যে জন্ম থেকেই চোখে দেখতে পায় না। দু’বছর আগে আলোর মাও মারা গেছে।
বাবা বলে, মা আকাশের তারা হয়ে গেছে। আলো ওর মাকে দেখতে চায়। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টার পর ক’দিন আগে আলোর চোখের অপারেশন হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, আলো চোখে এবার আলো দেখতে পাবে। তাই তার আর তর সইছে না। আলো কী? কোনো মজার খেলনা? বাবা বলে আলো কোনো কিছু দেখার শক্তি। সে সবার আগে আলো দেখতে চায়। অপারেশনের পর ক’দিন একটু ব্যথা হয়েছে, এখন আর ব্যথা করে না। ব্যান্ডেজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল কি একটা এসে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিলো। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে এসেছে। বাবা চোখে এটা কি পড়েছিলো? আলো জিজ্ঞেস করেছিলো। বাবা বলেছিলো, এটাই আলো। এটা বৈদ্যুতিক আলো। ওই যে, ঘরের কোণে জ্বলজ্বল করছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আলো বললো, চলো না বাবা, বাইরে গিয়ে সবকিছু দেখি।
চল মা তাহলে, আজ তোকে সব দেখাব। কিছুক্ষণের মধ্যে আলো আর তার বাবা বাইরে ঘুরতে বের হলো। বাইরে বের হয়েই আলো সূর্যের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, ওটা কি? এমন আলো ছড়াচ্ছে।
ওটা সূর্য। দিনের বেলা সূর্যই আলো দিয়ে সবাইকে পথ দেখায়। গাছগুলো রোদের আলোয় ঝকমক করছে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো ওরা। কাছেই ছিল একটি মন্দির। মন্দিরের বাইরে জ্বালিয়ে রাখা প্রদীপ দেখিয়ে বাবা বললো, ওই যে, ওটা প্রদীপের আলো। মাটির ছোটো পাত্রে তেল রেখে আগুন ধরিয়ে ওতে আলো জ্বালানো হয়। একটু পরেই ওরা রিকশায় উঠলো। বাবা ওকে নিয়ে শহিদ মিনার, জাতীয় জাদুঘর, শিশুপার্ক আরও অনেক জায়গায় ঘুরলেন। আলোর জীবনের সেরা দিন ছিলো সেদিন। তারপর ওরা গেলো রমনা পার্কে। সেখানে বেঞ্চে বসে বাবা আলোকে সবকিছু চিনিয়ে দিতে লাগলেন।
ওই দেখো, ওইটা মেহগনি গাছ। ওই যে, ওটা চড়–ই পাখি। আলোর চারপাশ এত সুন্দর সেটা আলো কল্পনাও করতে পারেনি। বসন্তকালের কোকিল পাখিরা মিষ্টি সুরে গাইছে। দখিনা হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো নড়ছে। আলোর মা থাকলে আজ কতই না ভালো হতো। মায়ের কথা মনে করে মন খারাপ হয়ে গেলো আলোর।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আকাশে শুকতারা উঁকি মারছে। দোকানে দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তার মাঝখানে রোড ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠেছে। গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে রাস্তায় চলছে। আলো যে এতো রকম হয়, সেটা আলো জানতোই না। বাবা বললো এই সব আলো বিদ্যুৎ থেকে আসে। তাই এগুলো বৈদ্যুতিক আলো। বাসায় ফিরে আসলো আলোরা। নিজের বাসাটাকে ভালো করে দেখলো আলো। মায়ের ছবি দেখলো। কত সুন্দর ছিলো তার মা! আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। বাবা চাঁদ দেখাতে আলোকে ছাদে নিয়ে গেলো। কত সুন্দর আলো দিচ্ছে চাঁদটা! রাতের আকাশ পুরোটা তারায় ঢাকা। আকাশে এগুলো হলো তারা। আর ওই যে, সবচেয়ে বড় তারাটা হলো তোর মা। আজ সে খুব খুশি হয়েছে, বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল বাবা। একটু পরে বাবা জিজ্ঞেস করলো, কোন আলো তোর সবচেয়ে ভালো লাগলো?
চাঁদের আলো, উত্তর দিলো আলো। কিন্তু সবচেয়ে দামি আলো কি জানিস? গৌরবের আলো, সাহসিকতার আলো। যে আলো দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী নজরুল ইসলামের মত মানুষরা বাংলাদেশকে আলোকিত করেছেন, সেই আলো। এই আলো দেখা যায় না, একে অর্জন করে নিতে হয়, বললো বাবা। আমি দেশের জন্য অনেক বড় কিছু করব। আমিও একদিন আলো হবো। বললো আলো।
তারপর বাবা-মেয়ে দু’জনই আবার আকাশের দিকে তাকালো। তাকাতেই আকাশের বড় তারাট যেনা ঝলমল করে উঠলো!

মেহজাবিন হক বিভা
অষ্টম শ্রেণী, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা

Share.

মন্তব্য করুন