অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ, সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে ইউরোপের এমন একটি দেশে যা তাকে অন্য দেশগুলো থেকে আলাদা করে রেখেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর স্থাপত্যের ঐশ্বর্যে ভরপুর ইউরোপের এক অসাধারণ দেশ ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ খ্যাত স্টিভেনসনের স্কটল্যান্ড।
স্কটল্যান্ড গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিস্তৃত। স্কটল্যান্ডের উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর, পূর্বে উত্তর সাগর, দক্ষিণ-পূর্বে ইংল্যান্ড এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর ও নর্থ চ্যানেল অবস্থিত। প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ দেশটির দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এডিনবরা, গ্লাসগো, লক নেস, ইভারনেস, বেন নেভিস, গ্লেনকো, আবেরডিন ও স্কটিশ হাইল্যান্ডস অন্যতম।
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা। এই শহরের একটা নিজস্ব ভাষা, রং ও রূপ রয়েছে। লন্ডনের পর স্কটল্যান্ডের এই শহর ইউরোপের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পর্যটন শহর। শহরটি এতটাই পরিষ্কার ও সুন্দর যে, পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ইউরোপের অনেক শহরের মতোই এডিনবরা শহরটিও শুধু হেঁটেই দুই-তিন দিনের মধ্যে ঘুরে ফেলা যায়।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের নির্মিত নানা স্থাপত্যশিল্প এখনও সেভাবেই রয়ে গেছে। শহরের ওল্ড টাউন এলাকার বেশির ভাগ বাড়িই অষ্টাদশ শতকে নির্মিত। এডিনবরার রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন পৃথিবীর অন্যতম পুরনো ও সুন্দর রক গার্ডেন। অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ, সুন্দর স্থাপত্যের আর্ক, ভিক্টোরিয়ান গ্লাস হাউজ, রডোডেনড্রন ও আজালিয়া ফুলের সমাহারে শুধু সুন্দর নয়, বর্ণময়ও। অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছ দেখার সুযোগ আছে এখানে।
ওল্ড টাউন হয়ে ভ্রমণার্থীরা ঘুরে আসেন রয়্যাল মাইল ও এডিনবরা ক্যাসেল। এডিনবরা শহরের প্রধান আকর্ষণ এডিনবরা ক্যাসেল। শহরের একবারে কেন্দ্রে অবস্থিত দর্শনীয় এক দুর্গ। পাথুরে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত দুর্গটি ইংল্যান্ড ও সেন্ট্রাল স্কটল্যান্ডের মাঝে থাকা পাহাড়ি পথের ওপর তৈরি করা হয়েছিল। মূলত দ্বিতীয় শতাব্দীতে, রোমান সাম্রাজ্যের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এই দুর্গ নির্মিত হয়। গ্রেট হলের নিচে ক্যাসল ভল্টগুলো নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলোও সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের তৈরি। এই ক্যাসেল পুরনো জিনিস সংরক্ষণের জাদুঘর। এর এক দিকে রয়েছে রয়্যাল প্যালেস এবং অন্য দিকে স্কটিশ ক্রাউন জুয়েলস।
এখানে ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো রত্নগুলোর এক সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়া ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজা-রাজড়াদের গুপ্তকক্ষ, বাসন-কোসন বা পোশাক-আশাক ছাড়াও সে সময়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রও এই দুর্গের সংগ্রহশালাতে রয়েছে। স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর গ্লাসগো। পশ্চিম উপকূলে ক্লাইড নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। একে চার্চের শহর হিসেবেও অভিহিত করা হয়। গথিক স্থাপত্যে নির্মিত গ্লাসগো ক্যাথিড্রাল দেখলে মনে হবে সময় এখানে থমকে আছে। ক্যাথিড্রালটি দেশটির অন্য ক্যাথিড্রালগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন।
লক নেস স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত লেক। প্রায় ২৩ মাইল বিস্তৃত এই লেকটি পশ্চিমে স্কটিশ হাইল্যান্ড ও উত্তরে ইনভারনেস পর্যন্ত বিস্তৃত। লেক নেসে পর্যটকদের জন্য ক্রুজের ব্যবস্থা রয়েছে। ক্রুজে করে অজানা নেসির সন্ধানে বেরিয়ে পড়া যায়। স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো।
লক নেস থেকেই দেখা যায় উর্কহার্ট ক্যাসেল। ১৩ শতাব্দীতে নির্মিত এই কেল্লা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাযুদ্ধে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৭ শতাব্দীতে এটি পরিত্যক্ত হয় এবং তত দিনে অনেকটা ধ্বংস হয়ে যায়। এই কেল্লা পর্যটকদের প্রিয় জায়গা। এখান থেকেই ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া বেন নেভিস দেখা যায়।
গ্লেন অর্থাৎ উপত্যকা। যেহেতু কো নদীর তীরে এই উপত্যকা তাই এই জায়গার নাম গ্লেনকো। গ্লেনকোর প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক গল্প। ক্যাম্পবেল আরম্যাক ডোনাল্ড উপজাতির নৃশংস ইতিহাসের কথা। উইলিয়াম ওয়ালেস এবং স্টার্লিং ব্রিজের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় সেসব আখ্যান।
স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটি এই স্কটিশ হাইল্যান্ড। পুরো হাইল্যান্ডজুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নানা নিদর্শন। নির্মল নীল আকাশ, পাথুরে পাহাড়, নীল লেক, সুনসান সবুজ উপত্যকা, কখনও লাল হরিণ আবার কখনও পরিযায়ী পাখির আনাগোনা- সব মিলিয়ে হাইল্যান্ড অঞ্চলের তুলনা মেলা ভার। ঘনঘন আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে হাইল্যান্ডও নিজের রহস্যময়তা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। উপত্যকায় এক অদ্ভুত ধরনের প্রাণী, হ্যামিশ এখানকার বড় আকর্ষণ।
ইনভারনেস হচ্ছে নেস নদীর উৎসমুখ। স্কটিশ হাইল্যান্ডের এই শহরটি গ্রেট ব্রিটেনের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। হাইল্যান্ড কাউন্সিল এরিয়ার এটি একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। ইভারনেস স্কটল্যান্ডের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। শহরটি স্কটল্যান্ডের কঠিনতম যুদ্ধগুলোর স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে। ইনভারনেস মনে করিয়ে দেবে শেকসপিয়রের ট্র্যাজিক হিরো ম্যাকবেথের কথা। এখানেই রচিত হয়েছিল রাজা ডানকানকে মারার কুটিল ষড়যন্ত্র। এ ছাড়া স্কটল্যান্ডের আরও বেশ কিছু জায়গা আছে যা না দেখলে হয়তো মনে হতে পারে দেশটি দেখা অসম্পূর্ণই রয়ে গেল। যেমন, স্কটল্যান্ডের উচ্চতম পাহাড় বেননেভিস। হাইল্যান্ডসের মনোরম পরিবেশের রহস্যময়তা আরও বাড়িয়ে দেয়ার জন্য সেখানে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন দুর্গ যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে বহু রক্তপাত ও যুদ্ধের ঘটনা।
ইউরোপে অসংখ্য সুন্দর দেশ রয়েছে তার মাঝে স্কটল্যান্ডের এত বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশটিকে অনন্য করে তুলেছে।

Share.

মন্তব্য করুন