সর্দার ফের প্রশ্ন করেন যে, খোদার নবী কে ছিলেন? আমি বললাম ‘মোহাম্মদ’। যখন সে মোহাম্মদের নাম শুনল তখন সে মাথা নুইয়ে আমাকে অভিবাদন জানাল এবং তার পাশে বসাল। নিগ্রোদের একজন কাঠের বাটিতে করে আমার জন্য একটু দুধ নিয়ে এলো। সাথে দিল এক টুকরো ঝলসানো ভেড়ার মাংস। খেয়ে-দেয়ে ভোরের দিকে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
প্রহরীরা জানতে চায় ‘তুমি কে’? উত্তরে আমি বললাম যে, আমি একজন দরবেশ। আমি মক্কা নগরে যাচ্ছি, যেখানে সবুজ পর্দার ওপর রূপালি হরফে ফেরেশতাদের হাতেলেখা কোরআনের বাণী অলঙ্কৃত হয়েছে।
প্রতিদিন বিকেল শেষে তরুণ জেলে সমুদ্রে যায়।
তারপর মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে জাল ফেলে অপেক্ষায় থাকে সে। কিন্তু যেদিন উথালপাথাল বাতাস সমুদ্রকে অশান্ত করে তোলে সেদিন তার জালে কোন মাছই ধরা পড়ে না। যদিওবা ধরা পড়ে, তা একেবারেই হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র। আর বাতাস যেদিন শান্ত থাকে সেদিন মাছেরা গভীর সমুদ্র্র থেকে এসে যেন তার জালের ভেতরে ঢুকে সাঁতার কাটে। তরুণ জেলে তখন মাছে ভরা জালটা টেনে তোলে। তারপর মাছগুলোকে ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে।
এভাবে প্রতিদিন সে সমুদ্রে যায় মাছ ধরার জন্য। একদিন এক সন্ধ্যায় সমুদ্রে জাল ফেলল সে। কিন্তু জালটা তোলার সময় এমন ভারী লাগছিল যে, তা টেনে তুলতে তরুণ জেলের খুব কষ্ট হচ্ছিল। তরুণ জেলেটি তখন আপন মনে হেসে উঠল এবং বলল, নিশ্চয় আমার জালে সাঁতারকাটা সব মাছই ধরা পড়েছে। কিংবা অদ্ভুত কোন সামুদ্রিক জীব, হতে পারে তা মানুষের চাইতেও বিচিত্র, কিংবা হতে পারে ভৌতিক কোন কিছু। তরুণ জেলে এ কথাও ভাবে, যদি তার জালে এমন সুন্দর জিনিস ধরা পড়ে, যা দেখে রাজ্যে মহারানি খুশি হবেন আর এতে তার ভাগ্য খুলে যাবে।
তরুণ মৎস্যশিকারি সর্বশক্তি দিয়ে জাল টানতে থাকে। জালের দড়ি টেনে টেনে সে বাহুতে পেঁচাতে থাকে। তার বাহুর শিরাগুলো ফুলে ওঠে। দড়ি টেনে সে জালের বেড় ছোট করে আনে। জালের চক্র ছোট হয়ে ক্রমেই কাছে আসতে থাকে। একসময় জালটাকে সে টেনে তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু জালটাকে তুলে দেখা গেল তাতে আদৌ কোন মাছ নেই, আর না আছে তাতে কোন সাগরদানো বা ভৌতিক কোন কিছু। তবে, জাল টেনে দেখা গেল, তাতে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট এক জলকন্যা। রুপালি মাছের মত তার লেজ; সোনালি চুল আর মায়াবী মুখের এক অপরূপা মেয়ে।
জাল টানার শব্দে জলকন্যার ঘুম ভেঙে যায়। মানবসন্তান জেলেকে দেখামাত্র সে ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকে। তারপর এক জটকা মেরে পালিয়ে যেতে চায়। জেলে তাকে ঝাপটে ধরে রাখে। মৎস্যকন্যা যখন দেখল যে তার আর পালাবার উপায় নেই তখন সে মানুষের মত কথা বলে ওঠে। সে বলল, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, আমাকে ছেড়ে দাও। কেননা আমার বাবা খুব বৃদ্ধ এবং নিঃসঙ্গ। তরুণ জেলে বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো, আমাকে কথা দাও, যখন আমি তোমাকে ডাকব তখন তুমি আমার জন্য উঠে আসবে এবং আমাকে সমুদ্রের গান গেয়ে শোনাবে। তোমার কণ্ঠে সমুদ্রের গান শুনে মাছে মাছে আমার জাল ভরে যাবে। আমার ভাগ্য বদলে যাবে।
জেলের ইচ্ছে মত মৎস্যকন্যাটি রাজি হয়। তারপর জেলে মৎস্যকন্যাকে বাহু থেকে মুক্ত করে পানিতে ছেড়ে দেয়। মৎস্যকন্যাটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পানিতে ডুব দেয়।
তারপর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে সমুদ্রে যায় এবং মৎস্যকন্যাকে ডাকে। মৎস্যকন্যাটি তখন সমুদ্র থেকে উঠে এসে তরুণ জেলেকে গান শোনায়। তখন তার চতুর্দিকে ডলফিনের দল সাঁতার কাটতে থাকে এবং বুনো শঙ্খচিলের দল মাথায় উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। মৎস্যকন্যা যখন গান গায় তখন টুনিমাছগুলো গান শোনার জন্য জলের গভীর থেকে উঠে আসে। তরুণ জেলে তখন মাছগুলোর ওপর জাল ছুঁড়ে ফেলে। মাছে মাছে যখন তার নৌকা ভরপুর হয়ে যায় তখন মৎস্যকন্যাটি ডুব দিয়ে সাগরতলে তার বাড়িতে চলে যায়। ডুব দেবার সময় সে তরুণ জেলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। জেলের তখন কী যে ভালো লাগে!
তরুণ জেলে প্রায়ই তাকে কাছে আসার অনুরোধ করত কিন্তু মৎস্যকন্যা আসতো না। যদি কখনো সে তাকে ধরার জন্য জোরাজুরি করত সে পানিতে টুবুক করে ডুব দিত। তারপর ওই দিন আর সে দেখা দিত না। তরুণ জেলের কাছে মৎস্যকন্যাটির কণ্ঠস্বর দিনদিন এমন সুমধুর শোনায় যে সে হতবুদ্ধি হয়ে সাগরে জাল ফেলার কথা ভুলে যায়। তখন তার নৌকার কথাও মনে থাকে না। টকটকে লাল ডানা ও সম্মোহিত সোনালি চোখের টুনিমাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে তার কাছ দিয়ে চলে যায় কিন্তু তরুণ জেলের সে দিকে খেয়াল থাকে না। সে অলসভাবে তার নৌকায় বসে বসে মৎস্যকন্যার গান শোনে এবং সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা কুয়াশা-ঝড় তার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়া পর্যন্ত সে শুনতেই থাকে। রাত নেমে এলে জোছনায় দৌড়ানো যাযাবর চাঁদ তার শরীরে যখন রুপালি আলো ফেলে তখন সে সম্বিত ফিরে পায় আর অতৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরে যায়।
একদিন তরুণ জেলে মৎস্যকন্যাকে তার মনের কথা বলেই ফেলে : শোনো, ছোট মৎস্যকন্যা, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ তুমি আমাকে তোমার বর করে নাও।’ কিন্তু মাছমেয়েটা মাথা নেড়ে বলল- ‘তুমি তো মানুষ! তোমার দেহে একটা মানব আত্মা রয়েছে। যদি তুমি ওটা ত্যাগ করতে পারো তবে আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি।’ তখন তরুণ জেলে বলে- ‘আমার আত্মা আমার কী এমন কাজে লাগে? আমি তো তাকে দেখতে পাই না, ছুঁতেও পারি না। আমি তাকে জানি না, চিনি না।’ তারপর তরুণ জেলে আনন্দে চিৎকার করে নৌকার ওপর তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে আর দু’বাহু বাড়িয়ে ছোট্ট মৎস্যকন্যাকে বলে- ‘আমি আমার আত্মাকে ত্যাগ করব। তুমি হবে আমার কনে আমি হবো তোমার বর। আমরা দু’জনে অথই সাগরে ঘর বাঁধবো। তুমি যেমন তোমার গান আমাকে শুনিয়েছ তেমনি তোমার যা কিছু প্রিয়তম ও পছন্দের আমি তা সব কবর, না হলে আমাদের জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’
ছোট্ট মৎস্যকন্যা তরুণ জেলের কথা শুনে খুশিতে হেসে ওঠে, আর লজ্জায় সে তার দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে।

২.
পরদিন সকালে তরুণ জেলে এক যাজকগুরুর কাছে গিয়ে বলল, ‘গুরু, আমি এক সাগরকন্যার ভালবাসায় পড়েছি। কিন্তু আমার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার আত্মা আমাকে তার থেকে বিরত থাকতে বলে। বলুন গুরু, কি করে আমি আমার আত্মাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি?’ সাধকগুরু বলল, ‘হায় হায়, তুমিতো দেখছি বদ্ধ-পাগল! মানুষের কাছে আত্মার চেয়ে মূল্যবান তেমন কিছু আর নেই। ওটার মূল্য পৃথিবীর সব স্বর্ণের চাইতেও দামি। মহান রাজার বহুমূল্যের রত্ন-পাথরের চাইতেও মূল্যবান। অতএব বাছা, এ নিয়ে ভাবাটা হচ্ছে ক্ষমার অযোগ্য পাপ। এ কারণেই সমুদ্রজীবেরা যেমন হতভাগ্য তেমনি করে তাদের সাথে যারা বিচরণ করে তারাও হতভাগ্য।’ সাধকগুরুর কড়া কড়া কথা শুনে তরুণ জেলের চোখ জলে ভরে উঠলো। বলল, ‘সেই রাজকন্যা ধ্রুবতারার চাইতেও রূপসী, চাঁদের চেয়েও শুভ্রসমুজ্জ্বল। তাকে পাওয়ার জন্য আমি আমার আত্মাকে বিসর্জন দিব।’
যাজকগুরু তরুণ জেলেকে কোন আশীর্বাদ না করে বরং তাকে তার আস্তানা থেকে বের করে দিলেন। তিনি বললেন, ‘যাও যাও, তোমার ওই ভালবাসার জন্য তুমি পথ হারিয়ে ফেলেছো। তুমিও তার সঙ্গে হারিয়ে যাবে।’
তরুণ জেলে তখন মন খারাপ করে এক বাজারে গিয়ে সওদাগরদের বলল, ‘আমি তোমাদের অনুরোধ করছি আমার আত্মাকে কেনার জন্য। ওটার জন্য আমি হয়রান হয়ে যাচ্ছি।’ সওদাগরগণ উপহাস করে বলল, ‘ওটার দাম একটা ফুটো পয়সার চেয়েও কম। বরং তুমি তোমার দেহটাকে বিক্রি কর। আমরা তোমাকে সাগরনীল পোশাকে সাজিয়ে, আংটি পরিয়ে মহারানির মোসাহেব বানাব।’ তরুণ জেলে আপন মনে বলল, কী অদ্ভুত জিনিস এটা! সাধকগুরু আমাকে যে বলল, আত্মা নাকি পৃথিবীর সবচাইতে মূল্যবান জিনিস! অথচ বণিকদল বলছে যে, ওটা তাদের কাছে অর্থহীন। অতঃপর তরুণ জেলে বাজার থেকে সমুদ্রসৈকতে গেল। সেখানে গিয়ে তরুণ জেলের মনে পড়ল এক বন্ধুর কথা। সে তাকে এক মায়াবিনী ডাকিনীর কথা বলেছিল। সেই ডাকিনীর জাদুবিদ্যা তাকে তার আত্মা থেকে মুক্তি দেয়ার উপায় বলে দিতে পারে। সে বাস করত সমুদ্রের শেষ প্রান্তের এক খাড়িতে। জেলে আঁটসাঁট বেঁধে তার বাড়ির দিকে যাত্রা করল।
জাদুবলে ডাকিনী আগেই জেনেছিল, এক সুদর্শন জেলে তার কাছে আসছে। সে তাকে নিজের করে পাবার ফন্দি আঁটতে লাগল। ডাকিনী বলল, ‘তোমার আবার অভাব কিসের? তুমি কি খারাপ আবহাওয়াতেও জালে মাছ চাও?’ তারপর সে তাকে অনেক লোভ দেখাল। কিন্তু জেলের এক কথা : আমি আমার আত্মাকে নিজ থেকে মুক্ত করতে চাই। যাজকগুরু এবং বণিকেরা আমাকে ঠাট্টা করেছে। তাই আমি তোমার কাছে এসেছি, যদিও লোকজন তোমাকে অশুভ বলেই মনে করে। বলো, আমার ইচ্ছা পূরণের জন্য তোমাকে কী মূল্য দিতে হবে। আমাকে শুধু বলো, কি করে আমি আত্মা থেকে মুক্তি পেতে পারি। সে জন্য আমি তোমাকে সব দেবো, একান্ত যা যা আমার অধিকারে আছে।’ ডাকিনী বলল, ‘শোন হে নন্দিত বালক, সেটা এক কঠিন কাজ। এর জন্য তোমাকে আমার সঙ্গে আজ রাতে পাহাড়ের চূড়ায় নাচতে হবে, হে সুদর্শন বালক।’
তরুণ জেলে মৎস্যকন্যাকে পাবার উপায় পেয়ে বিপুল আনন্দে তার ডেরায় ফিরে যায়। ডাকিনী মনে মনে বলল, আমি সেই মৎস্যকন্যার ফু সুন্দর; তুমি শুধু আমার।
সন্ধ্যায় তরুণ জলে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়াল। মধ্যরাতে একদল ডাকিনী এলো। সবার শেষে সেই তরুণ ডাকিনী তার লালচুল বাতাসে দুলিয়ে হাজির হলো। তরুণ ডাকিনী জেলেকে টেনে নিয়ে চাঁদের আলোয় ভয়ঙ্করভাবে নাচতে লাগল। জেলে ভয় পেল এবং তার মাথা ব্যথা করতে লাগল। তার কেবলই মনে হতে লাগল একটা অশুভ জিনিস তার পিছু নিয়েছে। অবশেষে খুব নিরিখ করে সে দেখল যে পর্বতের ছায়ায় কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখম-ল ছিল অদ্ভুত রকমের ফ্যাকাসে। লোকটা তার দিকে নজর রাখছিল। ডাকিনীর হাসি শোনা গেল। হঠাৎ একটা কুকুর ডেকে উঠল। নাচ থেমে গেল। ডাকিনী লোকটার হাতে চুমু খেল। লোকটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে গৌরবের হাসি দেখা গেল। কিন্তু তাতে তাচ্ছিল্যও ছিল। লোকটি তখন জলের দিকে তাকিয়ে রইল। ডাকিনী লোকটাকে বলল, এসো আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা করি। তখন সে বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকলো এবং তার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকল। লোকটা যখনি এমন করল তখনই ডাকিনীরা পালিয়ে যেতে চাইল কিন্তু জেলে লালচুলা ডাকিনীকে ধরে ফেলল।
জেলে ডাকিনীকে বলল, ‘দেহ থেকে আত্মাকে মুক্ত করার গুপ্ত রহস্যের কথা আমাকে না বলা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছাড়ছি না। ডাকিনী বলল, ‘ওটা ছাড়া আমাকে যে কোন কিছু জিজ্ঞেস করো। ওই নীল জলরাশিতে যারা আছে তাদের ফু আমি লাবণ্যময়ী।’ জেলে রেগে বলল, ‘তুমি মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করেছ, তোমাকে শেষ করে ফেলব।’ ডাকিনী তখন ভয়ে ভয়ে বলল যে, ‘ওই ছায়া-লোকটা তোমার আত্মা। ওটাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।’
অতঃপর জেলে ডাকিনীর কোমরে থাকা সবুজনাগের চামড়া মোড়ানো হাতলযুক্ত বিশেষ চাকুটি হাতে নিলো এবং ডাকিনীকে ছেড়ে দিল। জেলে এগিয়ে গেল ছায়ার দিকে। তখন তার মন বলে উঠল, ‘আজ কত বছর যাবৎ আমি তোমার চাকর হয়ে আছি। আজ তুমি আমাকে ত্যাগ করো না, মালিক। বলো, আমি তোমার সাথে কী এমন খারাপ আচরণ করেছি?’
তরুণ জেলে হেসে বলল, ‘যদিও তুমি আমার সাথে খারাপ কিছু করোনি, তবু তোমাকে আমার দরকার নেই। দুনিয়াটা অনেক বড়, বিস্তৃত। যাও, যেখানে খুশি চলে যাও। আমার কোন ক্ষতি করো না। আমার ভালবাসার মৎস্যকন্যা আমাকেই টানছে।’
জেলেটির আত্মা করুণভাবে মিনতি জানাতে লাগল তাকে যেন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা না হয়। কিন্তু জেলে তাতে কর্ণপাত করল না। জেলের আত্মা বলল, ‘যদি, সত্যিই তুমি আমাকে তোমার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারো, তাহলে আমাকে তোমার হৃদয় ছাড়া ঠেলে পাঠিয়োও না। কারণ দুনিয়াটা হৃদয়হীন। তুমি তোমার হৃদয়টাকে আমাকে দাও, আমি নিয়ে যাই। জেলে হেসে বলল, ‘যদি আমি আমার হৃদয়টাকে তোমাকে দিয়ে দেই, তাহলে বলো, আমার ভালবাসার জিনিসকে কী দিয়ে ভালবাসবো?’ এ কথা বলে ডাকিনীর কথা মত জেলে তার ছুরিটি হাতে নিলো এবং তার দু’পায়ের চারপাশের ছায়াকে গোল করে কেটে ফেলল। তখন ছায়াটা জেলের সামনে দাঁড়াল। ছায়াটা দেখতে ঠিক জেলের ফু। জেলে আঁতকে ওঠে বলতে থাকে, ‘তুমি শেষ। তোমার মুখ যেন আমি আর না দেখি।’ জেলের আত্মা তখন বলল, ‘না, আবার আমাদের দেখা হবে। বছরে ঘুরে এই দিনে আমি এখানে এসে তোমাকে ডাকব। আমার প্রয়োজনেই আমি এখানে আসব। জেলে বলল, ‘তোমাকে আবার আমার কী প্রয়োজন হতে পারে? তোমার যা হয় হোক গে। জেলে একথা বলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে তার মৎস্যকন্যার কাছে গেল। ছোট মৎস্যকন্যা জেলের হাত ধরে চুমু খেলো আর তার কাঁধে হাত রেখে সাগরে ডুব দিল।
আত্মাটি নির্জন সৈকতে দাঁড়িয়ে সব দেখল। তার খুব কষ্ট হলো; তারপর ওটা কাঁদতে কাঁদতে জলাভূমির উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল পৃথিবী পরিভ্রমণে।

৩.
বছর পার হয়ে গেল আত্মাটি সাগরতীরে এসে জেলেকে ডাকে। জেলে বলে, ‘আমাকে কেন ডেকেছ?’ আত্মা তাকে বলল, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পর আমি পূবের দিকে যাত্রা করি। জ্ঞানভা-ারের সব কিছুই পূর্ব থেকেই আসে। আমার সেই ব্রাজক জীবনের গল্প শোনো : ছয় দিনের ভ্রমণ শেষে সপ্তম দিন সকালে আমি তাঁতারদের দেশের এক পাহাড়ের পাদদেশে এলাম। দেখলাম একদল বণিক আগুনকে ঘিরে গালিচায় বসে আছে। বণিক সর্দার উঠে দাঁড়িয়ে তার তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে আমার আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইল। আমি তাকে বললাম যে, আমি আমার দেশের একজন রাজকুমার ছিলাম। আমি তাঁতারদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি। ওরা আমাকে ওদের দাস হতে বাধ্য করেছিল। বণিক সর্দার হেসে উঠে আমাকে বাঁশের নলায় গাঁথা পাঁচ-পাঁচটি নরমু-ু দেখালেন। সর্দার ফের প্রশ্ন করে যে, খোদার নবী কে ছিলেন? আমি বললাম ‘মোহাম্মদ’। যখন সে মোহাম্মদের নাম শুনল তখন সে মাথা নুইয়ে আমাকে অভিবাদন জানাল এবং তার পাশে বসাল। নিগ্রোদের একজন কাঠের বাটিতে করে আমার জন্য একটু দুধ নিয়ে এলো। সাথে দিল এক টুকরো ঝলসানো ভেড়ার মাংস। খেয়েদেয়ে ভোরের দিকে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
আমরা তাতারদের দেশ ছেড়ে আরেক দেশে পৌঁছালাম, সে দেশের লোকজন চাঁদকে গালমন্দ করে। সেখানে ঈগলমুখো গ্রিফনরা শ্বেত পাথরের উপরে বসে সোনাদানা পাহারা দেয়। ছোট ছোট ড্রাগনগুলো গুহায় ঘুমোচ্ছিল। যখন আমরা উপত্যকা পার হচ্ছিলাম তখন পিগমীরা গাছের কোটর থেকে আমাদের দিকে তীর ছুড়ছিল। রাতের বেলায় আমাদের কানে এলো জংলীদের ঢাকঢোল পেটানোর শব্দ। আমরা এক বন-মানুষদের গুহায় এলাম। সেখানকার নিয়ম মেনে আমরা বনমানুষদের ফলমূল খেতে দিলাম, যার জন্য ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করল না। তারপর সর্পকুলের দুর্গে গিয়ে আমরা ওদের পিতলের বাটিতে দুধ খেতে দিলাম। সাপগুলো আমাদের পথ ছেড়ে দিল। তারপর প্রকা- এক চড়ে আমরা ওক্সাস নদী পার হলাম। আমরা মাগাদিদের সঙ্গে লড়াই করেছিলাম। মাগাদিরা জন্মগত বৃদ্ধ, জন্মের পর প্রতি বছর তারা ছোট থেকে ছোট হতে থাকে। শেষে তারা ছোট্ট শিশু হয়েই মৃত্যুবরণ করে। আমাদের লড়তে হয়েছিল লাকটোরিদের বিরুদ্ধে যারা নিজেদের বাঘের সন্তান বলে দাবি করে। লড়াই হয়েছিল ওরান্টি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যারা মৃত্যুর পর তাদের দেহ গাছের উপরে রেখে দেয়। সূর্যের আলোর ভয়ে তারা সুড়ঙ্গের মধ্যে বসবাস করে। ওদের মধ্যে যে তাদের দেবতা হয় সেই তাদের হত্যা করে। আমরা লড়াই করেছিলাম কুমীরপূজারি ক্রিমনিয়াদের সঙ্গে। ওরা কুমীরদের সবুজ-স্বচ্ছ কানবালা পরায় আর খেতে দেয় মাখন ও জীবন্ত পাখি। অতঃপর কুকুরমুখো আগাজনবাইদের সঙ্গে লড়াই হয়। যুদ্ধ করি সিবনস্ জাতির সঙ্গে ওদের পা ঘোড়ার মত এবং ঘোড়ার চাইতেও দ্রুত দৌড়াতে পারে। আমাদের দলের এক-তৃতীয়াংশ যোদ্ধা নিহত হয় এবং আর তিনজনের প্রাণ যায় যায়। বাকি যোদ্ধারা আমার ওপর বিরক্তি প্রকাশ করে বলল যে, আমি তাদেরকে এই দুর্ভাগ্যের মধ্যে টেনে এনেছি। আমি পাথরের তলা থেকে শিংওয়ালা একটা আডাকে সঙ্গে নিলাম। কিন্তু ওটা আমাকে দংশন করতে লাগল। যখন দেখল যে আমি তাতে কাবু হচ্ছি না তখন যোদ্ধারা ভয় পেয়ে গেল।

জেলের আত্মাটি তার ভ্রমণ-জীবনের নানান গল্প বলেই চলে আর জেলে তা বিস্মিত হয়ে শোনে। আত্মাটি বলে, ‘চার মাস পর একরাতে বণিকদের সাথে আমি ইলেলদের শহরে এলাম। প্রথম দিন যাজকগণ, দ্বিতীয় দিন অভিজাতবর্গের লোকজন এবং চতুর্থ দিনে ক্রীতদাস ও কারুশিল্পীরা পণ্য বিনিময় করলেন। রাতে আমরা চাঁদের দেবতার বাগানে এলাম। সেখানে হলুদ গাউন পরা যাজকগণ নিঃশব্দে চরে বেড়াচ্ছে। পথের পাশে কৃষ্ণকালো পাথরে নির্মিত ঈশ্বরের গোলাপি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনে অনিক্স পাথরে বাঁধানো রঙিন স্বচ্ছপানির একটা পুকুর ছিল। পুকুরপাড়ে শুয়ে আমি গাছের পাতাগুলো ছুঁয়ে দেখছিলাম। একজন যাজক এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ জুড়ল। তিনি জানতে চাইলেন যে, ‘আমার মনের ইচ্ছাটা কী।’ আমি তাকে বললাম যে, আমি মহান সৃষ্টিকর্তাকে দেখতে চাই। যাজক বিস্মিত হয়ে আমাকে নিয়ে সেই দেবতাদের ঘরে ঢুকলেন। দেবালয়ের প্রথম কক্ষে আমি এক সাধারণ মানুষের দেবমূর্তিকে দেখে যাজককে প্রশ্ন করলাম, ‘এই বুঝি ঈশ্বর?’ যাজক উত্তর দিল, ‘ইনিই ঈশ্বর।’ আমি বললাম, ‘তিনি যে ঈশ্বর তা প্রমাণ করুন, না হলে আমি আপনাকে শেষ করে ফেলব।’ এই বলে আমি যাজকের হাত ধরলে তার হাত বিকৃত-বিবর্ণ হয়ে যায়।
যাজক ভয় পেয়ে গেলে আমি ফুঁ দিয়ে আবার তার বিকৃত হাত ভালো করে দিলাম। তখন সে আমাকে দেবালয়ের দ্বিতীয় কক্ষে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম এক দেবমূর্তিকে। মূর্তিটির উচ্চতা একটা সাধারণ মানুষের চাইতেও দ্বিগুণ ছিল। যাজক বললেন, ইনিই ঈশ্বর। কিন্তু প্রমাণ দেখাতে না পারাতে আমি রেগে যাজকের দু’চোখ স্পর্শ করলাম এবং সাথে সাথে তার চোখ দুটো অন্ধ হয়ে গেল। তারপর আবার তার দৃষ্টিও ফিরিয়ে দিলাম। তখন সে আমাকে নিয়ে গেল তৃতীয় কক্ষে। আমি যাজককে বললাম, ‘কোথায় সৃষ্টিকর্তা’? অতঃপর সে আমাকে বলল, এখানে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তবে একটা জ্ঞানের আয়না আছে। যারা এটা নিজের আয়ত্তে রাখে তারাই সব কিছু জানে। তাই ওটাই সৃষ্টিকর্তা এবং আমরা ওটাকেই আরাধনা করি।’
অতঃপর আমি আয়নাটা চুরি করে যাত্রাপথের এক উপত্যকায় ওটাকে লুকিয়ে ফেললাম। কাজটি কত সহজে করলাম; কিন্তু হায়! আমি আর তোমার দেহের মধ্যে কিছুতেই ঢুকতে পারছি না। অথচ তুমি হবে সকল জ্ঞানীদের চাইতে অধিক জ্ঞানী। আমাকে তোমার ভেতরে ঢুকতে ধৈর্য ধারণ করতে দাও। যেহেতু তোমার মত জ্ঞানী আর কেউ নেই।
এ কথা শুনে জেলে হাসল এবং বলল, ‘জ্ঞানের চেয়ে ভালবাসা অনেক ভালো। ছোট্ট জলকন্যা আমাকে ভালোবাসে।’ আত্মাটি বলল, ‘না, জ্ঞানের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই।’
‘ভালবাসাই উত্তম।’ এ কথা বলে জেলে জলের গভীরে ডুব দিল এবং আত্মাটি কাঁদতে কাঁদতে জলাভূমির ওপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল তার দ্বিতীয় সফরে।
৪.
দ্বিতীয় সফর শেষে আত্মাটি সাগরতীরে এসে জেলেকে বলল- তোমাকে ছেড়ে আমি দক্ষিণে যাত্রা করলাম। দক্ষিণের সব কিছুই মূল্যবান। ছয় দিনের মহাসড়ক যাত্রার মধ্য দিয়ে আমি অ্যাসথারদের শহরে এলাম। শহরে ঢোকার মুখে নয়টি দরজা রয়েছে। প্রহরীরা জানতে চায় ‘তুমি কে’? উত্তরে আমি বললাম যে, আমি একজন দরবেশ, আমি মক্কা নগরে যাচ্ছি, যেখানে সবুজ পর্দার ওপর রূপালি হরফে ফেরেশতাদের হাতে লেখা কোরআনের বাণী অলংকৃত হয়েছে। আমার কথা শুনে প্রহরীরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল এবং আমাকে নগরে প্রবেশ করতে দিল। শহরের ভেতরটা বাস্তবিকই যেন এক বাজার। তুমি অবশ্য আমার সঙ্গে যেতে পারো। আমি একজন সিরিয়ানকে দেখলাম। অন্যান্যরা বিক্রি করছিল নীলকান্তমণি, মুক্তোগাঁথা ঝালরযুক্ত পিতলের নূপুর, সোনায় বাঁধানো বাঘের থাবা আর গিল্টি করা বিড়ালের নখর, চিতাবাঘ, সোনার গহনা সেট, টোলপড়া চুনি পাথরের কানের দুল এবং জেড পাথরের আংটি। চা-খানা থেকে ভেসে আসছিল গিটারের টুংটাং শব্দ। সত্যতা প্রমাণের জন্য আমার তোমার সাথে থাকা উচিত। আত্মাটি জেলেকে নানান গল্প শুনিয়ে প্রলুব্ধ করতে চায় কিন্তু জেলে অটল থাকে। আত্মাটি হাল না ছেড়ে আবার তার ভ্রমণবৃত্তান্ত বলতে থাকে।
আত্মাটি বলে, একদিন আমি দেখলাম কালো আদমিরা গাঁয়ের মধ্য দিয়ে একটা পালকি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি পালকির পিছু নিলাম। নিগ্রো বেহারারা আমাকে চোখ রাঙায়। আমি তাতে দমে যাইনি। আমার কৌতূহল চেপে বসে। অবশেষে তারা জানালাহীন একটা সাদা বাড়ির কাছে এলো। সবুজ কাফতান পরা একলোক দরজা খুলল। লোকটি মেঝেতে একটা কার্পেট বিছিয়ে দিলো। পালকি থেকে নেমে কার্পেটে পা ফেলে হেঁটে এলো এক নারী। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আগে কখনো কাউকে এমন করে হাসতে দেখিনি। আমি ফিরে গেলাম। যখন চাঁদ উঠল আমি আবার বাড়িটিকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পেলাম না। মনে পড়ল ওই নারীর কথা। ওই নারীটি কে ছিল? কেনইবা সে আমাকে দেখে হাসছিল? শোন জেলে, তুমি অবশ্যই আমার সাথে থাকবে, চলো, দেখবে : নতুন চাঁদের আনন্দ উৎসবের দিন আমি দেখেছি এক তরুণ সুলতানকে। তরুণ সুলতান মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। গোলাপের পাপড়ি-রাঙা ছিল তার চুল-দাড়ি। তার মুখটা ছিল সোনার মিহি চূর্ণে লেপ্টানো। তার হাত-পায়ের তালু ছিল জাফরানি-হলুদ বর্ণের।
আমাকে দেখে সুলতান তার চারুশোভিত ভ্রু কুঁচকে তাকালেন এবং থামলেন। সুলতানকে অভিবাদন জানালাম না। লোকজন আমার ধৃষ্টতা দেখে বিস্মিত হল। তারা আমাকে শহর থেকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিল। আমি তাদের কথায় কান দিলাম না। ওই রাতে আমি যখন ডালিম বাগানের রাস্তায় শুয়েছিলাম তখন সুলতানের লোকজন আমাকে সুলতানের দরবারে নিয়ে গেল। সুলতান আমাকে দেখে চোখ পাকিয়ে বললেন- তোমার নাম কী হে? তুমি কি জানো না, আমি এ রাজত্বের সুলতান? আমি সুলতানের প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। অতঃপর সুলতান লাফিয়ে উঠে একটা বল্লম নিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। আমি শূন্যের ওপরই ওটা ধরে ফেললাম এবং ভেঙে দু’টুকরো করে ফেললাম। অতঃপর তিনি আমার দিকে তীর ছুঁড়ে মারলেন। আমি দু’হাত ওপরে তুলে ধরে শূন্যেই ওটাকে থামিয়ে দেই। ক্লান্ত- শ্রান্ত, পরাস্ত ও বিস্মিত হয়ে সুলতান বললেন, তুমি একজন নবী, অথবা তুমি কোন নবীর পুত্র, সেজন্য কি আমি তোমাকে কোন আঘাত করতে পারছি না? আমি তোমাকে অনুরোধ করছি; তুমি আমার শহর ছেড়ে চলে যাও। আমি বললাম, আমাকে তোমার সম্পদের অর্ধেক দাও, আমি চলে যাবো।
সুলতান আমাকে টেনে নিয়ে বিস্ময়কর এক বাগানে এলেন। সুলতান আমাকে বললেন, এ হচ্ছে আমার গুপ্তধনের ভা-ার। আমি তোমাকে অর্ধেকটা দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি। আমি উটের চালকসহ উটগুলিও তোমাকে দিয়ে দেব। উটের চালকেরা তোমার নির্দেশ পালনে প্রস্তুত থাকবে। ওরা তোমাকে নিয়ে তোমার খুশি মত পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে নিয়ে যাবে। আজ রাতেই চলে যাও। তখন আমি মত পাল্টে তাকে বললাম, আমার প্রয়োজন নেই। তবে ওই ছোট্ট আংটি যেটা আপনি আঙ্গুলে পরে আছেন, সেটা আমাকে দিন। শুনে সুলতান কঠোরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এতো সামান্য একটি সীসার আংটি মাত্র। এর কোন অর্থমূল্য নেই। অতত্রব তুমি ধনসম্পদের অর্ধেকটা নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাও। আমি বললাম- না, আমি ওই সীসার আংটি ছাড়া কিছুই নেব না। সুলতান ভয়ে কেঁপে উঠলেন এবং আমাকে অনুনয় বিনয় করে বললেন, বরং ধনরতেœর সবটাই তুমি নিয়ে যাও। তারপর, সুলতান যখন আংটি দিতে না চাইলে আমি তখন এক অদ্ভুত কা- করে আংটিটি ছিনিয়ে নিলাম এবং পথে এক গুহায় আংটিটি লুকিয়ে রাখি। যার কাছে এ আংটিটি থাকবে সেই হবে পৃথিবীর সকল রাজার চাইতে ধনশালী। তাই সেখানে যাও এবং পৃথিবীর সব ধন-সম্পদ তোমার হবে। তরুণ জেলে বলল, ধন-দৌলতের চাইতে ভালবাসাই বড়। আমাকে তো ছোট্ট এক মৎস্যকন্যা ভালবাসে। আত্মাটি বলল- না, ধনদৌলতের চাইতে ভালো আর কিছু নাই। জেলে বলল, ভালবাসাই উত্তম। অতঃপর জেলে গভীর সমুদ্র্রে ডুব দিয়ে হারিয়ে গেল। আর আত্মাটি স্যাঁতস্যাঁতে জলের উপর দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

৫.
তৃতীয় বছর পার হয়ে গেল। আত্মাটি ফিরে এসে আবার গল্প শোনায়। সে জেলেকে বলল, আমি দেখেছি কোন এক শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে একটা সরাইখানা। আমি নদী-তীরে নাবিকদের সঙ্গে বসে ছিলাম। আমাকে ওরা যবের রুটি, ভিনেগার দিয়ে বে-লিফে পরিবেশিত ছোট নোনা মাছ খেতে দিয়েছিল। সেখানে এক বৃদ্ধলোক হাজির হলো এবং মিষ্টি করে লুইট বাজাতে লাগলেন। তখন নেকাব পরা একটি মেয়ে এসে খালি পায়ে নাচতে শুরু করল। নৃত্য করার সময় তাকে ছোট্ট সাদা পায়রার মত লাগছিল। মেয়েটির পা দু’টি ছিল দৃষ্টি-নন্দন। অমন সুন্দর পা আগে কখনো আমি দেখিনি। মেয়েটি যে শহরে নাচছিল সেটা এখান থেকে একদিনের পথ, চলো ঘুরে আসি। আত্মার কথাশুনে তরুণ জেলের মনে পড়ল যে, ছোট্ট মৎস্যকন্যাটির তো পা নেই, সে নাচতেও পারে না। তখন তরুণ জেলের মনে একটা ইচ্ছে চেপে বসল। সে ভাবল, ঘটনাস্থল তো এখন মাত্র একদিনের যাত্রাপথ, অতএব গিয়ে আমি ফিরে আসতে পারব। অতঃপর সে হেসে উঠে দাঁড়াল। তারপর ভাসাভাসা পানির উপর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ডাঙ্গার দিকে এগোতে লাগল। তরুণ জেলে তার সামনে বালুর উপরে নিজের শরীরের ছায়া দেখতে পেল। তরুণ জেলে তার বাহু দুটি আত্মার দিকে বাড়িয়ে দিলো। তখন আত্মা ভীষণভাবে আনন্দে কেঁদে উঠে তার দিকে ছুটে এসে তার সাথী হলো।
তারপর জেলে ও তার আত্মা সারারাত চাঁদের আলোয় আলোয় এবং পরের সারাদিন রোদে পুড়ে শেষে এক ভুল শহরে এসে পৌঁছাল। তবু তারা ভেতরে ঢুকল। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় একটা দোকানে তরুণ জেলে সুন্দর একটা রুপার পেয়ালা দেখল। আত্মার বুদ্ধিতে জেলে রুপোর পেয়ালাটি চুরি করল। তারপর তারা শহর থেকে চটজলদি বেরিয়ে পড়ল। পথে জেলে পেয়ালাটি ছুুঁড়ে ফেলে দিয়ে আত্মাকে বলল, খারাপ কাজ জেনেও কেন তুমি আমাকে পেয়ালাটি লুকিয়ে ফেলতে বলেছিলে? আত্মাটি তাকে বলল, শান্ত হও।
পরের দিন সন্ধ্যায় তারা এক নতুন শহরে এলো। কিন্তু এটাও এক ভুল শহর। তারা শহরে প্রবেশ করে একটা শিশু দেখতে পেল। আত্মাটির প্ররোচনায় তরুণ জেলে শিশুটিকে মেরে বেহুঁশ করে ফেলে। অতঃপর তরুণ জেলে বাজারে বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। এক বণিক জেলেকে বলল, তুমি বাজারে বসে আছো কেন? জেলে উত্তর দিল : শহরে আমি কোন সরাইখানা দেখছি না, এমনকি আমার কোন আত্মীয়ও নেই। বণিকেরা বলল, আমরা কী তোমার স্বজন নই? এসো আমার সাথে। তরুণ জেলে উঠে দাঁড়াল এবং বণিকের পিছু পিছু তার বাড়িতে গেল। তারপর বণিক তাকে পেট ভরে খাইয়েদাইয়ে মেহমানখানায় ঘুমাতে বলল। জেলে বণিককে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে জেলের আত্মা তাকে ডেকে বলে, বণিককে হত্যা কর এবং তার সব সোনাদানা আত্মসাৎ করো। তরুণ জেলে জেগে উঠে বণিককে এমন আঘাত করল যে বণিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল এবং বণিকের কাছ থেকে স্বর্ণ ভর্তি নয়টি থলি ছিনিয়ে নিলো। তারপর তারা সটকে পড়ল। পথে যেতে যেতে জেলে খুব আত্মপীড়ন অনুভব করে। সে আত্মাকে বলল, তোমার এ কাজ জঘন্য। আত্মাটি বলল- শান্তিতে থাক। জেলে চিৎকার করে বলল -না, আমি তোমার কাজ আর তোমাকে ঘৃণা করি। কেন তুমি আমাকে এপথে টেনে আনলে? আত্মাটি উত্তর দিল- যখন তুমি আমাকে পৃথিবী চরাতে পাঠালে তখন তো তুমি আমাকে তোমার মনটাকে দাওনি। তাই আমি এসব যা-তা করতে শিখেছি।
তরুণ জেলে সোনার থলি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়াতে থাকে। তারপর সে চিৎকার করে বলল- না, তাহলে তোমার সাথে আমি আর নেই। তোমার সঙ্গে আমি যেখানে সেখানে বেড়াতে পারব না। আগেরবার যেমন তোমাকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তেমনি করে এখন আমি তোমাকে দূরে পাঠিয়ে দেব। কারণ তোমার সাথে লেগে থাকা আমার জন্য অমঙ্গল। তরুণ জেলে তার সবুজ গেছো সাপের চামড়ায় মোড়ানো চাকুটি দিয়ে পায়ের তলা থেকে শরীরের ছায়াটা কেটে ফেলার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাল। ওই ছায়াটা ছিল তার আত্মারই ছায়া। কিন্তু আত্মাটি তার কাছ থেকে নড়ল না এবং তার নির্দেশে কর্ণপাতও করল না বরং বলল, ডাকিনী মেয়েটি তোমাকে যে জাদুমন্ত্র দিয়েছিল তা আর এখন তোমার জন্য কার্যকর নেই। এ জন্য আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারছি না, তুমিও আমাকে তাড়াতে বাধ্য করতে পারছো না। একজন মানুষ তার জীবনে একবার মাত্র আত্মাকে ত্যাগ করতে পারে, যদি সে তা ফেরত নেয় তবে সে আত্মা তার সাথে চিরকালের জন্য থেকে যাবে।
আত্মার কথা শুনে তরুণ জেলের চোখেমুখে ফ্যাকাসে ভাব দেখা দিল। রেগে সে দু’হাতের মুঠি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। তারপর চিৎকার করে বলল, সে ছিল এক মিথ্যাবাদী ডাকিনী। অতঃপর তরুণ জেলে বুঝতে পারলো যে, সে তার আত্মাকে তার থেকে আর মুক্ত করতে পারছে না। কেননা ওটা এখন এক অশুভ আত্মা। এখন থেকে ওটার সঙ্গেই চলতে হবে। তরুণ জেলে কান্নায় ভেঙে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। তারপর ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালবেলা জেলে আত্মাকে বলল, আমি আমার হাত দুটোকে বেঁধে ফেলব যাতে তোমার কথা মত আমাকে কিছু না করতে হয়। ঠোঁট দুটোকেও বন্ধ রাখব যাতে তোমার সঙ্গে কথা বলতে না হয়। আর আমি ফিরে যাচ্ছি সেই ভুবনে, যেখানে আমার ভালবাসা বসত করে। হ্যাঁ, আমি সমুদ্রসৈকতেই ফিরে যাবো, যেখানে আমার ভালবাসা আমাকে গান গেয়ে শোনায়। আমি তাকে ডাকব, আমি তাকে সব বলব, কী অনাচারই না আমি করেছি এবং কী দুষ্কর্মের ফাঁদে তুমি আমাকে ফেলেছিলে।
আত্মা উত্তেজিত হয়ে বলল, কে তোমার ভালবাসা? কার কাছে তুমি ফিরে যাবে? দুনিয়া জুড়ে তার চেয়ে কত না অপরূপা মেয়ে পড়ে আছে। সামারীয় নাচের মেয়েরা পশুপাখিদের নাচের ভঙ্গিমায় কত না বিচিত্রভাবে নাচে। তাদের পা দু’টি মেহেদি রাঙানো, তাদের দু’হাতে থাকে রূপার ছোট্ট ঘণ্টা। তারা হেসে হেসে নাচে এবং তাদের সে হাসি জলের ফু সরল, অনাবিল। চলো আমার সাথে, আমি তোমাকে ওদের দেখাব। পাপ নিয়ে তোমার কী এমন মাথা ব্যথা! এটা কি এমন গরল যা পান করতে মিষ্টিমিষ্টি লাগে। চলো আমার সাথে অন্য কোন শহরে। কাছাকাছি ছোট্ট এক শহর আছে। শহরের ভেতরে আছে এক টিউলিপের বাগান। সুন্দর সেই বাগানে বাস করে সাদা সাদা ময়ূর। এক নারী ময়ূরগুলিকে খাবার দেয় আর আনন্দ দেবার জন্য নাচে। কখনো সে তার হাতের মুদ্রা দিয়ে নাচ দেখায় আবার অন্য সময়ে সে পায়ে পায়ে নাচে। নাচতে নাচতে সে হাসে আর তার গোড়ালিতে পরা রূপার বালা দুটো রুপালি ঘণ্টার মত টুংটাং করে বাজে। আমার সাথে ওই শহরে চলো।

৬.
তরুণ জেলে আত্মার সঙ্গে অজানা শহরে যেতে রাজি হলো না। সে কোনো কথা না বলে দড়ি দিয়ে নিজের হাত নিজেই পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর সে সাগর উপকূলে এলো যেখানে তার প্রিয় ছোট্ট মৎস্যকন্যাটি গান গাইতো। পথে আত্মা তাকে বারবার উত্তেজিত করছিল, কিন্তু জেলে টু শব্দটি করল না এবং এমন কোন খারাপ কাজও সে করেনি যা আত্মাটি তাকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল। ভালবাসার মহৎশক্তি এমনিভাবে তার ভেতরে অবস্থান নিয়েছিল।
সমুদ্রের তীরে এসে সে তার হাতের বাঁধন খুলে দিল এবং নীরবতা ভেঙে ছোট্ট মৎস্যকন্যাকে ডাকল; কিন্তু সেই মৎস্যকন্যা তার ডাকে সাড়া দিল না। তারপর সে সারা দিনমান ধরে তাকে ডাকল। কত না অনুরোধ করল। তবুও সাড়া দিল না। জেলের আত্মা জেলেকে উপহাস করল এবং বলল, ‘তোমার ছোট্ট মৎস্যকন্যা তোমার ভালবাসা থেকে দূরে আছে। তুমি যা ত্যাগ করেছ তা কখনোই তোমার কাছে ফিরে আসার মত নয়। এর চেয়ে ভালো তুমি আমার সাথে চলে এসো। আনন্দের উপত্যকা কোথায় আছে আমি তার সন্ধান জানি এবং আর কী কী সম্ভার সে উপত্যকা জুড়ে আছে সেও আমি জানি।
তরুণ জেলে আত্মার কথায় কোন সাড়া দিল না। সে পাহাড়ের ফাটলে কঞ্চি দিয়ে একটা ঘর বানিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করল। প্রতিদিন সকালে সে জলকন্যাটাকে ডাকে। তারপর দুপুরেও এমনকি রাতের বেলাতেও সে তাকে ডাকে। কিন্তু সে জলকন্যাকে আর কখনোই সাগরের বুকে কোথাও দেখা গেল না। মন খারাপ করে জেলে জলকন্যার বাড়িতে এবং সবুজ জালের গভীরে, এমনকি ভরা জোয়ারের জলে কিংবা গভীর সমুদ্রের গর্তেও তাকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও তাকে দেখা গেল না। এদিকে আত্মাটি তখনো তাকে অশুভ উপায়ে প্রলুব্ধ করছিল। আত্মা তার কানের কাছে ভয়ঙ্কর সব গুজব ছড়ায়। তবু আত্মাটি জেলের ওপর কোন রকম প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। সত্যি, ছোট্ট সেই মৎস্যকন্যার প্রতি তার ভালবাসার জোর কতই না অসাধারণ ছিল!

৭.
একটি বছর পার হয়ে গেল। সমুদ্রঘেঁষা নির্জন গিরিগুহায় জেলের আশায় আশায় দিনরাত কাটে। তবু সেই মৎস্যকন্যার দেখা মেলে না। এদিকে আত্মা তার পিছু ছাড়ে না। জেলের শরীরে সে ঢুকে পড়তে চায় কিন্তু জেলে প্রলুব্ধ হয় না। আত্মাটি ভাবল, আমি আমার মালিককে কত না খারাপ কাজে প্রলুব্ধ করেছি কিন্তু তার ভালবাসা আমার ভালবাসার চাইতে দৃঢ়। তবে আমি এখন তাকে সুন্দর ভাবে প্রলুব্ধ করব এবং এতে হয়তো সে আমার কাছে ভিড়বে।
একদিন আত্মাটি তরুণ জেলেকে বলল, আমি তোমাকে এতদিন পৃথিবীর আনন্দের কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমার সেসব কথা শুনে তুমি যেন বধির হয়ে গেছ। এখন তুমি আমাকে পৃথিবী বেদনার কথা বলার সুযোগ দাও। তবে এটা হতে পারে তুমিই তাতে মনোযোগের সাথে কর্ণপাত করবে। কারণ সত্যিকারের বেদনা হলো পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তার। তার বিস্তৃত জাল থেকে কেউ নেই যে সে পালাতে পারে। অনেকেই আছে যাদের জামা কাপড় নেই, আবার অনেকের খাদ্যের অভাব। অনেক বিধবা আছে রাজ মর্যাদায়, আবার অনেক বিধবা তালিমারা কাপড় পরে আছে। জলাভূমি দিয়ে কুষ্ঠ রোগীরা এদিক ওদিক ছোটে। তারা একে অপরের প্রতি ক্রুদ্ধ। মহাসড়কে ভিক্ষুকরা একবার এদিক যাচ্ছে একবার ওদিক যাচ্ছে। যেহেতু তাদের ঝোলা একেবারে শূন্য। শহরের দুর্ভিক্ষ নেমেছে। ঘরে ঘরে প্লেগ রোগ হানা দিচ্ছে। চলো, আমরা সেখানে গিয়ে তাদের ভালোর জন্য কাজ করি, তাদের সেবা করি। আমরা তাদেরকে বোঝাবো : এ দুঃখের দিন আর থাকবে না। কেন তুমি অযথা এখানে অপেক্ষা করে তোমার মৎস্যকন্যাকে ডাকছো? তুমি তো দেখছোই তোমার ডাকে সে সাড়া দিচ্ছে না। তুমি কি তার জন্যই তোমার বিপুল ভালবাসার সঞ্চয় গড়ে তুলবে?
তরুণ জেলে চুপ করে রইল। সত্যি, তার ভালবাসার জোর এমনি ছিল। তারপর থেকে আবার সে প্রতিটি সকাল, দুপুর এমনকি রাতেও সে তার ভালবাসার ছোট্ট মৎস্যকন্যাকে ডাকাডাকি করে। কিন্তু হায়! কোথায় সেই মৎস্যকন্যা সে আর সাগর থেকে উঠে এসে তার সাথে কখনোই দেখা দিল না। সমুদ্রের কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না; যদিও তাকে খোঁজা হয়েছে সাগরমুখী নদীগুলোতে, তরঙ্গের গভীরে অবস্থিত উপত্যকায়। যে রাত সমুদ্রকে রাজার মর্যাদায় অভিষিক্ত করে সেই সমুদ্রেও তাকে খোঁজা হয়। কিন্তু সবই বৃথা।

৮.
দ্বিতীয় বছর পার হয়ে গেল। এক রাতে তরুণ জেলে যখন তার আস্তানায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছিল তখন আত্মাটি বিরক্ত হয়ে তাকে বলল দেখ, আমি ভালোমন্দ দু’ভাবেই তোমাকে প্রলুব্ধ করেছি, কিন্তু দেখেছি, আমার ভালবাসার চেয়ে তোমার ভালবাসাই মহৎ। এ জন্য আমি আর তোমাকে উত্তেজিত করব না। এখন তোমাকে অনুরোধ করছি আমাকে তোমার ভেতরে প্রবেশ করতে দাও, যেন আমি আগের মত তোমারই একজন হতে পারি।
জেলের মনটা এবার একটু নরম হলো। সে আত্মাকে বলল, অবশ্যই তুমি ঢুকতে পারো, কেননা যখন তুমি হৃদয় ছাড়াই সারা পৃথিবী চরে বেড়িয়েছিলে তখন তোমার কতই না দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল।
জেলের আহ্বানে আত্মাটা জেলের দেহে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। আত্মা তখন আক্ষেপ করে উঠল, হায়! তোমার ভালবাসা তোমার হৃদয়টাকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে, আমি ঢুকবার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
জেলে বলল, এখনোও আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে সাহায্য করেতে পারি। তরুণ জেলের মুখের কথা শেষ না হতেই দূর সমুদ্রে থেকে একটা করুণ কান্নার রোল ভেসে আসে। সে কি করুণ আর্তনাদ, যেন কারো হৃদয় ভেঙে গেল আর কি! মূলত সাগরবাসীদের কেউ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন মানুষেরা ওই করুণ কান্না শুনে থাকে। কান্না শুনে জেলে উঠে দাঁড়ায়। তার মনে পড়ে তার ভালবাসার ছোট্ট মৎস্যকন্যার কথা। তারপর সে তার আস্তানা থেকে বেরিয়ে সৈকতের দিকে নেমে গেল। তখন নিষ্ঠুর ঢেউগুলো ক্ষিপ্রতার সাথে সৈকতের দিকে ধেয়ে আসছিল। তীব্র সে-ঢেউ যেন রূপার চেয়েও সাদা বোঝা হয়ে ভেসে আসছিল। সে ঢেউয়ের বোঝা এমনি যে, তা যেন তীরে জমে থাকা শুভ্র সমুজ্জ্বল ফেনার মত লাগছিল এবং সেই ফেনারাশি ঢেউয়ের ওপর যেন ফুলের মত দুলছিল। বেলাভূমির ফেনারাশি তা গ্রহণ করে তরঙ্গমালা থেকে আর তরঙ্গমালা তা গ্রহণ করে বেলাভূমির ফেনা থেকে। শেষে সেই ফেনা এসে পড়ে তীরভূমিতে; একেবারে জেলের পায়ের কাছে। পায়ের কাছে সেই ফেনারাশির মধ্যেই তরুণ জেলে দেখল যে, তার ভালবাসার ছোট মৎস্যকন্যা নিষ্প্রাণ পড়ে আছে।
মৎস্যকন্যাকে নিথর পড়ে থাকতে দেখে তরুণ জেলে নিদারুণ বেদনায় ভেঙে পড়ে। কেঁদে কেঁদে সে বালুর ওপর গড়িয়ে পড়ল। তারপর সে মৎস্যকন্যার হিম হয়ে যাওয়া গোলাপি মুখে চুমু খেলো এবং তার চুলে জড়িয়ে থাকা ভেজা বালুকণাগুলো ঝেড়ে দিল। তারপর আনন্দে শিহরিত হয়ে সে আবার কাঁদতে লাগল। তরুণ জেলে মৎস্যকন্যাকে দু’বাহুতে আঁকড়ে ধরে। যদিও তার ভালবাসা বালিতে মাখামাখি ছিল তবু সে তাকে চোখ ভরে দেখে নিলো। অতঃপর তার দু’চোখের পাতায় জমে থাকা বুনো শেওলা আর চোখের জলের নুন মুছে দিল। সে তার মুদ্রিত চোখের পাতায় শেষবারের মতো চুমু খেল।
তরুণ জেলে আপন মনে তার হারানো ভালবাসার কাছে নিজের সব বৃত্তান্ত বলতে থাকে। তারপর সে হাসতে থাকে। কত কষ্টের এবং কত না নির্মম হাসি তার! তার বেদনার হাসি ছিল অদ্ভুত উল্লাসে ভরা। সে খেয়াল করেনি, নিষ্ঠুর সমুদ্র ক্রমেই তীরের আরও নিকটতর হলো। ঢেউগুলো কুষ্ঠরোগীর মতো গোঙ্গাতে লাগল। তরঙ্গমালার ফেনিল থাবা বেলাভূমিকে গ্রাস করতে লাগল। দূরের সাগর রাজার প্রাসাদ থেকে আবার কান্নার বিলাপ ভেসে আসল। দূর সমুদ্রে ভাসমান বিশাল বিশাল ট্রাইটনেরা তাদের শিঙ্গাগুলোয় গগনবিদারী সুর বাজাতে লাগল।
আত্মাটা তার পাশেই ছিল। তরুণ জেলের জন্য তার খুব মায়া হলো। ওটা তাকে বলল- পালাও, তরঙ্গমালা ধেয়ে আসছে। ঊর্মি ফণা তোমাকে শেষ করে ফেলবে। পালাও তুমি, আমার খুব ভয় হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে যে, তোমার হৃদয় আমার খুব ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, যদিও তোমার ভালবাসার গভীরতা খুব বেশি। আমি বলছি, তুমি পালাও নিরাপদ একটা স্থানে। আমি জানি, তুমি চাও না যে হৃদয়হীন ভাবে আমি আবার অন্যকোন জগতে ঘুরে বেড়াই।
তরুণ জেলে আত্মার কথা শুনল না। বরং সে ছোট্ট মৎস্যকন্যার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, জ্ঞানের চেয়ে আমার ভালবাসা বড় এবং ধন সম্পদের চাইতেও তা অনেক অনেক মূল্যবান। আমার ভালবাসার চরণযুগল মানবকন্যার চরণের চাইতেও সুন্দর। আমার ভালবাসাকে আগুন বিনাশ করতে পারে না এবং না পারে পানি তাকে ডুবিয়ে মারতে। আমি তোমাকে সকালবেলা ডেকেছি, তুমি আমার ডাকে আসোনি। ওই রাতও শুনেছে তোমাকে ডাকতে। তবু তুমি আমার ডাকে সাড়া দাওনি। আমি তোমাকে অন্যায়ভাবে ছেড়ে গিয়েছিলাম এবং নিজের ক্ষতি করে আমি পৃথিবী চরে বেড়িয়েছিলাম। তবু আজও তোমার ভালবাসা আমার সাথেই আছে। আমার ভালবাসার ওপর কোন কিছুই প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কিন্তু হায়! আজ তুমি নিথর নিস্তব্ধ। তুমি জেনে রাখ, আমিও তোমার সঙ্গে চলে যাবো।
আত্মাটা জেলের কথা শুনে অস্থির হয়ে ওঠে। সে তার হৃদয়ে ঢোকার সুযোগ দেবার জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগল। এদিকে বিশাল জলরাশি আরও এগিয়ে এলো। অতঃপর সেই জলরাশির উত্তাল ঊর্মিমালা তাকে গ্রাস করার জন্য হামলে পড়ে আর কি। যখন জেলে বুঝলো যে তার মৃত্যু একেবারেই সন্নিকটে তখন সে পাগলপারা হয়ে ছোট্ট মৎস্যকন্যার বিষন্ন ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। আর ঠিক তক্ষুনি, ঠিক তক্ষুনি তার ‘হৃদয়’টা, যা তার দেহের ভেতরেই অবস্থান করছিল, তা ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। সেই সুযোগে আত্মাটা জেলের দেহে ঢোকার এক পথ পেয়ে যায় এবং সে ঢুকে পড়ে। যার পরিণাম হলো, সমুদ্রের বিপুল জলরাশির উত্তাল ঊর্মিমালা তরুণ জেলের প্রাণ কেড়ে নেয়। কিন্তু এ গল্পের এখানেই শেষ নয়।

৯.
সমুদ্রকে উত্তাল অস্থির দেখে পরদিন সকালে সেই যাজক সমুদ্র বন্দনার জন্য আসেন। যাজক সমুদ্র্র তীরে পৌঁছে দেখেন যে, তরুণ জেলে ঢেউয়ের শুভ্র সমুজ্জ্বল ফেনায় ডুবে আছে এবং সে দু’বাহু দিয়ে ছোট্ট সেই মৎস্যকন্যাকে জাপটে ধরে আছে। যাজক বললেন, তোমরা জেলে ও তার একান্ত সহচরী ছোট্ট মৎস্যকন্যার দেহটাকে নিয়ে চল। তারপর ওদের দাফন করো প্রাচীন ফুলার প্রান্তরের একপাশে যেখানে সুন্দর সুগন্ধি-তৃণলতা বেড়ে ওঠে না।

তিন বছর পরের ঘটনা: এক সকালে যাজক দেখলেন যে, উপাসনালয়ের বেদিটা অদ্ভুত সুন্দর সব ফুলে ফুলে সাজানো আছে। এত শুভ্র-সুন্দর ফুল আগে কখনো দেখা যায়নি। ফুলগুলির সৌন্দর্য আর মিষ্টি গন্ধ তাকে এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। যাজক জানতে চান, বেদির ওপর ওগুলো কী ফুল আর ওগুলো ওখানে কখন, কোথা থেকেইবা এলো? পুরোহিতগণ বলল, ওগুলো কী ফুল ছিল তা আমরা বলতে পারব না, তবে ফুলগুলো প্রাচীন ফুলার-মাঠের প্রান্ত থেকে এসেছে। একথা শুনে যাজক চমকে ওঠেন। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।
পরদিন সকালে যাজক ফের সমুদ্রযাত্রা করলেন। এ ঘটনার পর থেকে কখনোই কোনদিন কেউ ফুলার মাঠের প্রান্তে কোন ধরনের ফুল ফুটতে দেখেনি। তবে সুপ্রাচীন সে-মাঠ অতীতের মত আজও পড়ে আছে এক অনুর্বর জমি হয়ে। না, এরপর থেকে মৎস্যকন্যারাও আগের মত এ উপকূলে আর আসেনি। কারণ তারা চলে যায় গভীর সমুদ্র পার হয়ে আরেক সাগরের উপকূলে।

Share.

মন্তব্য করুন