গোলাপি বাড়িটায় ভাড়া আসার পর নিপু আর অপু খুশিতে সারাক্ষণ তারাবাতির মতো জ্বলছে। বাড়িটার সামনে সবুজ চত্বর। দুটো হলুদ গোলাপের ঝাড়। গেটের দু’পাশে পাঁচিলের উপর দিয়ে আহ্লাদে মাথা এলিয়ে দিয়েছে দুটো রঙ্গন ফুলের গাছ। তাতে তোড়ায়-তোড়ায় রঙ্গন।
সিঁড়ির দু’ধারে অন্তত গোটা চারেক হাসনুহানার ঝড়। ফুল ফুটলে স্বামীবাগ আড়াইলেনের অনেকটা সৌরভে ম-ম করে। ফুল ফোটার রাতে যদি জোছনা ঝরে তবে তো নিপুর পাখনা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে হয়। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা’- গুনগুন করে নিপু সেই রাতে।
বাড়িটা চারতলা, একটু পুরনো ধাঁচের। ঘরগুলো খোলামেলা। চলতে ফিরতে হোঁচট খেতে হয় না। আর আলো-বাতাসের কমতি নেই। তিনতলায় বাড়িঅলা। দোতলায় অপুরা। নিচতলায় গ্যারেজ-একপাশে দুটো বেডরুমের ছোট কর্নার। একজন সদ্যবিবাহিত কলেজের প্রভাষক থাকেন। কোজাগরি পূর্ণিমা রাত। হাসনুহেনা ফুটেছে থরে থরে। নিপুর আজ রাতে ভেসে যেতে ইচ্ছে করছিল। অনেক রাত অবধি অপুর সঙ্গে গল্প করে ঘুমিয়েছে। হঠাৎ শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেছে নিপুর। কী আশ্চর্য গোলাপি বাড়িটায় মসলা পেষার ধুম পড়ে গেছে নাকি। নিশুতি রাতে কোন পাগলে, শিল পাটা পেতে এমন গভীর যত্নে মসলা পিষে চলেছে। ঘস-ঘস-ঘস একটানা অক্লান্ত শব্দ। লাগাতার ছন্দবদ্ধ শিল পাটার ঐক্যতান। মাঝে মধ্যে ঘস-ঘস-ঘটাং-ঘট। হলুদ হেঁচার শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। বিরামহীন শব্দগুলো ভৌতিক আবহে গাঢ় ভারি অবিশ্বাস্য হয়ে উঠছে।
বাইরে রূপপাগলা জোছনা। নিপু ঘুমচোখে কাঁপা-কাঁপা হাতে জানালার পর্দা সরাতেই গলগল করে এক ঝলক হাওয়া ঘরে ঢেউ খেলে গেল। হাওয়া নয় যেন সুতীব্র হাসনুহেনার সৌরভই নেচে-নেচে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। নিপুর সারা শরীর শিরশির করে উঠল। আপুকে ডেকে-ডেকে ওঠায় এবার নিপু।
গভীর রাতে মসলা পেষার এ উৎসব আর সহ্য হচ্ছে না। ভোর চারটার দিকে বিদঘুটে শব্দটা মিলিয়ে গেল।
মাকে নিপু বোঝাতেই পারে না সারা রাতের ঘটনা। মা ঝাঁজালো গলায় বলে ওঠেন, দিনরাত হরর পিকচার দেখ তো। এবার বোঝ। রাতভর দুঃস্বপ্নে কাটে। যতসব আজগুবি কা-। কার শখ হয়েছে গভীর রাতে মসলা পেষার! নিপু দমে যায়। বাবার কানে গেলে তো নিজেদের কান দুটোর রং হবে নেভি ব্লু কালার।
মঙ্গলবার দিন বিকেলবেলা নতুন ভাড়া বাড়ির সিঁড়িতে বসে নিপু অপু মুড়িমাখা খাচ্ছিল। কাঁঠাল তলায় কয়েকটা সাত-ভায়লা লম্বা লেজ বাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ গেটে একটা রিকশা এসে থামল। নড়বড়ে হুডটা ফেলে দিতেই নিপু চেঁচিয়ে উঠল, ‘দিলশাদ, খালাম্মা!’
দিলশাদ নিপুর ক্লাসমেট, বন্ধু। দিলশাদের মা নিপুর মায়ের বন্ধু। একসময় কলাবাগানে থাকত পাশাপাশি ওরা। দিলশাদ দৌড়ে আসে নিপুর কাছে। ‘গত বছর এ বাড়িতে আমরা ভাড়া ছিলাম, তিনতলায়।’ উত্তেজনায় খামাখা হাঁফাতে থাকে ও। খালাম্মা রিকশা থেকে নেমে টেনে-টেনে দম নেন। বাতের ভারি শরীর তার। একটু এগিয়ে চোখ বড়-বড় করে বলেন, ‘এ বাড়িতে তোরা উঠেছিস? হায় আল্লাহ!’ কলেজের প্রভাষক মতলুব সাহেবের কাছে এসেছে ওরা জমি সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজ নিয়ে। মতলুব সাহেব আর দিলশাদের নানাবাড়ি শাহজাদপুরে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে দিলশাদের মা বলেন, আচ্ছা আপা, আপনারা কিছু শুনতে পান না নিশুতি রাতে! নিপুর লোমকূপ শিরশির করে ওঠে। অপুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। নিপুর মা একটু বিরক্ত গলায় বলে ওঠেন, কী শুনব? কিসের শব্দ!
দিলশাদের মা হতাশ গলায় বলেন, সে তো ভাই অনেক কথা। একটু থেমে এক গ্লাস পানি খেয়ে বলেন, এ বাড়ির চারতলায় থাকতেন বাড়িঅলারা। নাদিরা ভাবী স্কুল শিক্ষিকা, একটু খিটখিটে মেজাজ তার। সারাক্ষণ বাড়ির সবার ওপর একটু কড়াকড়ি চড়াগলায় হুকুমটুকুম করতে ভালোবাসেন আর কী। অবশ্য পরে একদম চুপচাপ হয়ে গেছিলেন। তো এ বাড়িতে একটা তেরো-চৌদ্দ বছরের কাজের মেয়ে ছিল। সংসারের এ হেন কাজ নেই যা সে করত না। ভদ্রমহিলার একটা বিশেষ বাতিক ছিল। রোজ রাতে হলুদ মরিচ আদা রসুন জিরা ধনে বাটাতেন। বাসি মসলা বা কলে ভাঙানো গুঁড়ো মসলা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ফ্রেশ মসলা চাই। সারা দিনের কাজের শেষে সমিরন বসতো মসলা পিষতে। কোনো কোনোদিন রাত একটা দেড়টাও বেজে যেত। মিহি করে পেষা না হলেও চলবে না। আমরা কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম।
নিপুর মা ভাঙা গলায় স্বগতোক্তির মতো বলে বসলেন।
দিলশাদের মা একটু তেরছা হাসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ঐ মেয়েটি ছিল আশ্চর্য এক চরিত্র। এত খাটা-খাটনি করতো, তারপরও সুযোগ পেলেই একটু সাজার চেষ্টা করতো। গুনগুন করে গীত গাইত। প্রায়ই দেখতাম মুদির দোকান থেকে পাউরুটি ডিম কিনে উপরে ওঠার আগে একগোছা হাসনুহানা কানের উপর গুঁজে দিচ্ছে। মেয়েটি হাসনুহানা খুব ভালোবাসত। সেদিন দুপুরে অনেক মেহমান খেয়েছে। এক হাতে ডেকচি পাতিল প্লেট ডিশ সব ধুয়েছে। বোধ হয় ওর খুব ক্লান্তি লাগছিল। তবু মসলা পেষার ডিউটি বাতিল হতে পারে না। রাত বারোটার উপর হবে। একটু ইনুনিবিনুনি কান্না বাতাসে ভেসে এলো যেন! তারপরই যথারীতি হলুদ হেঁচার ঘটাং-ঘট তারপর লাগাতার মসলা পেষা-ঘস…ঘস। ওদিকে নাকি চুলায় পানি ফুটেছে। একসময় ফুটানো পানি নামাতে গেছে সমিরন। দুটো কলাবেনির ফুলের ফিতের প্রান্ত ঝুলে ছিল। ঘুমচোখে মেয়েটি অতশত খেয়াল করেনি। আগুন ধরে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিনথেটিকের ঝালরেও আগুন ধরে গেছে দাউদাউ করে। হতবুদ্ধি মেয়েটি কিচেন ডাইনিং দৌড়াদৌড়ি করেছে। আগুন আরো ভালো করে ওকে গিলে ফেলেছে। এ বলে দিলশাদের মা থামলেন। খুব দুঃখভরা গলায় বললেন, কী বলব, মেয়েটাকে পোড়া কাঠের তৈরি কঙ্কালের মতো লাগছিল। চিকিৎসার কোনো সুযোগ সে কাউকে দেয়নি। আমি সাত দিন কিছু খেতে পারিনি। নাদিরা ভাবী সেই থেকে কেমন যেন পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গেলেন। সেই থেকে রাত বিরেতে মসলা পেষার শব্দ হয়!
এবার নিপুর মা কেমন উদাসভাবে বলে উঠলেন, দুই তিন দিন হলো খাড়া দুপুরবেলায় একটা বারো-তেরো বছরের মেয়েকে দেখি হাসনুহানার ফুল ছিঁড়ছে। প্রথম দিন চেঁচিয়ে বলেছিলাম, বাগানে কে? ফুল ছিঁড়ছ কেন? কোনো উত্তর করে না মেয়েটি। পরে ভেবেছি হয়তো বাড়িঅলার কাজের মেয়েটেয়ে হবে। গতকালও দেখেছি লাল-হলুদ ছাপ দেয়া ফ্রক পরে একটা মেয়ে হাসনুহানা ছিঁড়ছে। আমার রাগ হলো। খাড়া দুপুরবেলা। আমি বললাম, কে তুমি? মেয়েটি নড়ে উঠল। একবার মুখ ফেরাল। কী বীভৎস সে মুখ! কালো কয়লা। চোখ দুটো শুধু তীব্রভাবে জ্বলছে। একসারি দাঁত ঝিকিয়ে মেয়েটি হেসে উঠল যেন। মনে হলো কোনো সুদূর থেকে ভেসে এলো যেন একটা খিনখিনে হাসির শব্দ। সে যেন গমগমে অদ্ভুত গলায় বলল, আমি… আমি। আমি ভাবলাম ঘুমচোখে কী সব ছাইভস্ম দেখছি। হ্যালুসিনেশন! প্রেসার বেড়েছে। তা ছাড়া চোখে চশমাটাও ছিল না। নিজের ওপরই ষোলআনা আস্থা নাই। তাড়াতাড়ি চোখে চশমা লাগিয়ে গ্রিলের ফোকরে তাকালাম। কই, কেউ নেই বাগানে।
নিপুর মা গুম মেরে গেলেন। নিপুর কপাল ঘামছে। দিলশাদের মা বললেন ফিসফিসে গলায় ‘যেদিন মসলা পেষার শব্দ হয়, সেদিন রাতে প্রচুর হাসনুহানা ফোটে।’
প্রচুর! গন্ধে বাতাস মাতাল হয়ে থাকে।
নিপুর মায়ের মুখ জুড়ে চিন্তিত রেখা ফুটে উঠেছে। এ পর্যন্ত বাড়িআলি ভাবীর দেখা পেলাম না! চারতলাটা ভাড়াও হচ্ছে না।
অপু হঠাৎ মনে পড়ছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল,
‘মা কাল বাদ আসর চারতলায় মিলাদ। বাড়িঅলা চাচা দাওয়াত দিয়ে গেছেন। তোমাকে বারবার যেতে বলেছেন।’

Share.

মন্তব্য করুন