করোনাভাইরাস। সারা বিশ্বকে থমকে দেয়া এক আতঙ্কের নাম। যার প্রভাবে স্থবির হয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্ব। আর সেখানে খেলা চালানোর আশা করা তো দিবাস্বপ্ন। যেখানের মানুষের জীবন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, শুরু হয়েছে লাশের মিছিল; তাই খেলা বন্ধ হয়ে যায় সারা বিশ্বে। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বক্সিং, সাইক্লিং, মোটর রেস, গলফসহ এমন কোনো খেলা নেই যা বন্ধ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টানা এত দিন সারা বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গন বন্ধ থাকার ঘটনা আর ঘটেনি এর আগে।
মার্চের শুরুতে ইউরোপে শুরু হয় করোনার প্রাদুর্ভাব। সবার আগে মহামারী ভয়ঙ্কর রূপ নেয় ইতালিতে। ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্সেও শুরু হয় সংক্রমণ। ইউরোপের ক্রীড়াঙ্গনে হাইপ্রোফাইলদের মাঝে সবার আগে আক্রান্ত হন ইংল্যান্ডের ক্লাব আর্সেনাল এফসির কোচ মিকেল আর্তেতা। ইতালির ক্লাব জুভেন্টাসের ডিফেন্ডার দানিয়েল রুগানি করোনায় আক্রান্ত হলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোসহ ক্লাবটির সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। করোনা ধরা পড়ে স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ার ৫ ফুটবলারের শরীরে। একে একে স্থগিত হয়ে যায়, ইতালির সর্বোচ্চ ফুটবল লিগ সিরি আ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, স্প্যানিশ লা লিগা, জার্মানির বুন্দেসলিগা। আক্রান্ত হন জুভেন্টাসের আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড পাওলো দিবালাও।
১৬ মার্চ বাংলাদেশের সব খেলাধুলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। কয়েকটি ম্যাচ হওয়ার পরই স্থগিত হয়ে যায় ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট। মাঝপথে আটকে যায় প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ, মহিলা ফুটবল লিগসহ সব খেলা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক গেমস পিছিয়ে গেছে। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিক হবে ২০২১-এ। অলিম্পিক গেমস পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে অবশ্য অনেক নাটক হয়েছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) আসর পেছাতে চাইছিলো না, তারা আশা করেছিল জুন মাসের আগে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে যথাসময়ে শুরু করা যাবে অলিম্পিক গেমস। কিন্তু আগের দুই মাস ধরে যদি ক্রীড়াবিদরা অনুশীলনই করতে না পারেন, তবে তারা কিভাবে অলিম্পিকের মতো বড় গেমসে অংশ নেবে?
প্রতিবাদস্বরূপ কানাডা অলিম্পিকে না খেলার সিদ্ধান্ত নেয় সবার আগে। এরপর অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ অলিম্পিক পেছানোর জন্য চাপ বাড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রাজি হয় আইওসি। আগামী বছর জাপানের টোকিওতে হবে এ অলিম্পিক। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হলেও আসরের নাম থাকবে ‘টোকিও অলিম্পিক ২০২০’। অলিম্পিক ছাড়াও পিছিয়ে গেছে ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টেও। কাতার ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাইপর্বও স্থগিত হয়ে গেছে। কোপা আমেরিকার আসর হওয়ার কথা ছিল এ মাসে, সেটিও পিছিয়ে গেছে।
কোন খেলা নেই, স্পোটর্স চ্যানেলগুলোতে দেখানো হয়েছে পুরনো খেলা। সংবাদপত্রের খেলার পাতায় ছিল সব করোনা সংক্রান্ত খবর, কোনো খেলার খবর নেই। খেলাই চলে না, তাহলে খবর আসবে কোত্থেকে! তা বদলে কোন খেলোয়াড় করোনায় আক্রান্ত হলো, কেউ কোয়ারেন্টিনে গেল, কেউবা আবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল দরিদ্র মানুষের প্রতি- এ সবই ছিলো মাস দুয়েক ধরে সংবাদপত্রের খেলার পাতার আইটেম। তবে আশার কথা। সেই ধকল কাটিয়ে খেলায় প্রাণ ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে ক্রীড়াঙ্গনের কর্তাব্যক্তিরা। মে মাসের মাঝামাঝিতেই স্বল্প পরিসরে খেলাধুলা- বিশেষ করে কয়েকটি দেশে ফুটবল লিগ চালু হয়েছে। সবার আগে ফুটবল লিগ চালু করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।
মানুষের পাশে ক্রীড়াবিদরা
করোনভাইরাসের কারণে খেলাধুলা বন্ধ থাকলেও এ সময়টাতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের ক্রীড়াবিদরা। নিজ নিজ জায়গা থেকে তারা সহায়তা করেছেন দরিদ্র মানুষদের। আমাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান তার গত বিশ্বকাপের ব্যাটটি নিলামে তুলে সেই অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন মানুষকে। এ ছাড়া মুশফিকুর রহীমও তার প্রথম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি করা ব্যাটটি নিলামে তুলেছেন। তামিম ইকবাল অর্থসঙ্কটে থাকা প্রায় একশোজন ক্রিকেটারকে দিয়েছেন নগদ অর্থ। মাশরাফি বিন মর্তুজা তার নির্বাচনী এলাকায় একের পর এক কল্যাণমূলক কাজ করে গেছেন। এ ছাড়া রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদ, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, নারী ক্রিকেটার জাহানারা আলমসহ অনেকেই অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ক্রিকেট বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটাররা তাদের ১৫ দিনের বেতন দান করেছেন সহযোগিতা তহবিলে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন দীর্ঘদিন ধরে মতিঝিলে খাবার বিতরণ করেছে দরিদ্র মানুষের মাঝে। ফুটবলসহ অন্যান্য ক্রীড়াঙ্গনের মানুষরাও এগিয়ে এসেছেন এই দুর্যোগের সময়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানের সাবেক তারকা ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদির প্রতিষ্ঠান ‘শহীদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশন’ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দরিদ্র মানুষকে সহযোগিতা করেছে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলেও মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কয়েক লাখ পরিবারকে সহযোগিতা করেছে আফ্রিদির প্রতিষ্ঠান। বিতরণ করেছে সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি। আফগানিস্তানে একই ধরনের কাজ করেছে অলরাউন্ডার মোহাম্মাদ নবির দাতব্য প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটাররা তাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অর্থ দান করেছেন। অলরাউন্ডার সুরেশ রায়না একাই দিয়েছেন ৫২ লাখ ভারতীয় রুপি। পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা তাদের ১৫ দিনের বেতন দান করেছেন করোনা তহবিলে।
লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোসহ ফুটবল অঙ্গনের বড় তারকারা, রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, সানিয়া মির্জাসহ টেনিসের তারকারা এগিয়ে এসেছেন অসহায় মানুষের পাশে। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বক্সার আমির খান যেমন তার নতুন তৈরি একটি বিল্ডিং ছেড়ে দিয়েছেন করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতাল বানাতে। সারা বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গনের মানুষরা সবাই এগিয়ে এসেছিল এ লড়াইয়ে। এক সাথে সবাই লড়াই করেছেন করোনার বিরুদ্ধে। ‘কিক আউট করোনা’ নামে তহবিল সংগ্রহের একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছেন ইতালির সাবেক ফুটবলাররা।
মোটকথা, মাঠে যারা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, করোনার বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে তারা সবাই হয়েছেন একজোট। সবার একটাই আশা এ লড়াইয়ে জিতবে মানুষ। জয় হবে মানবতার। আবার দর্শকে মুখর হয়ে উঠবে স্টেডিয়াম। গর্জন শোনা যাবে লাখো দর্শকের।

Share.

মন্তব্য করুন