তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। জ্যৈষ্ঠ মাস। আকাশটা হঠাৎ করে কালো মেঘে ছেয়ে গেল। মনে হচ্ছে কিছু সময়ের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হবে। অন্য দিন হলে এ সময় অনেকটা আলোয় ভরে থাকত। কিন্তু এখন সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যেন ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল।
দুপুরের আগে গিয়েছিলাম দোস্ত জহিরদের বাড়ি। ওদের বাড়িটা দক্ষিণ পাড়ার বাজারের পাশেই। অনেক দিন ওদের বাড়ি যাই না। একটা দরকারও ছিল জহিরের সঙ্গে। প্রয়োজন সেরে এটা-সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে বেশ দেরি হয়ে গেল সেখান থেকে বের হতে। যখন বের হয়েছি, তখন আকাশ একদম পরিষ্কার। কোথাও এক টুকরো মেঘও ছিল না। হঠাৎ করে হুড়মুড়িয়ে কোথা থেকে যে মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
আকাশের দিকে তাকাচ্ছি আর তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছি। সঙ্গে ছাতাও নেই যে হঠাৎ বৃষ্টি থেকে রেহাই পাবো। জোরে পা চালিয়ে যেতে না পারলে এই কাকসন্ধ্যায় ভিজে চুপচুপ হতে
হবে। আমি কিছু বুঝতে না পারলেও পথ চলতি মানুষ ঠিকই যেন বুঝে নিয়েছে আসন্ন বৃষ্টির বিষয়। তা না হলে রাস্তায় কোনো লোকজন নেই কেন? একেবারে নির্জন। সাধারণত এরকমটা দেখা যায় না।
ওদিকে আবার বাড়ি ফিরতে দেরি হলে মায়ের কাছ থেকেও উত্তম-মধ্যম জুটতে পারে।
এই দুটো ভয় নিয়েই জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম আমি। যেটুকু রাস্তা পার হতে তিন কদম লাগে, সেখানে অনেকটা লাফিয়েই এক কদমে পার করতে লাগলাম।
এর মধ্যেই বেশ দমকা হাওয়া শুরু হয়ে গেল। ঝড়ও আসবে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য এ সময় কম-বেশি ঝড়বৃষ্টি হয়।আর একটু এগোলেই সামনে রয়েছে তিন রাস্তার মোড়। এমনিতে বেশ কিছু গাছপালায় ঠাসাঠাসি করে থাকায় দিনের বেলাতেই এই জায়গাটা সুনসান অন্ধকারে ছেয়ে থাকে। আর এখন তো দিন থাকতেই রীতিমতো রাত নেমে এসেছে।
সেখানে পৌঁছে দেখলাম, অদ্ভুত এক অন্ধকার জড়ো হয়েছে মোড়ে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ছাওয়া চারপাশ।
এদিক দিয়ে এটাই আমাদের বাড়ির যাতায়াতের একমাত্র পথ। রোজ যাই। আসি। অবশ্য রাতে একা কখনো যাওয়া-আসা করিনি।
মোড়ে গিয়ে আমার কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। অন্ধকারে তেমন করে কিছুই দেখতে পারছি না। কড়কড় করে মেঘ ডাকছে। এ সময় বিজলি চমকাল বেশ শব্দ করে। কানফাটা আওয়াজ। প্রাণটা কেঁপে উঠল কিছুটা। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে পুরো এলাকা ফকফকা হয়ে গেল। এক লহমায় সামনের সবটুকু দেখে নিলাম। বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ভাবলাম, একটা ভোঁ দৌড় লাগাব। এক দৌড়ে বাড়ি।কিন্তু এই সঙ্গে একটা অজানা ভয় আমাকে জেঁকে ধরল এ সময়। কেন জানি পা আর চালাতে পারলাম না। শরীর ঘেমে একাকার। চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম তীব্রভাবে। তবে আমার এই খেয়াল আছে, আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। এখান থেকে তেমন একটা দূরেও নয় আমাদের বাড়িটা। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই আমাদের বাড়ির উঠোন।
এ সময় হঠাৎ পেছন থেকে কেমন একটা খনখনে গলার আওয়াজ পেলাম। আওয়াজটা কানে এলো বটে কিন্তু বুঝলাম না কিছুই। থমকে দাঁড়ালাম আমি। অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো আশপাশে তাকালাম। নাহ, তেমন কিছুই দেখতে পেলাম না তখন।
মনের ভুল হতে পারে ভেবে সামনে পা বাড়ালাম। কয়েক পা সামনে যেতেই আবার এই খনখনে গলা। ভয়মেশানো সুর। এবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম। নাকিসুরে বলছে, ‘এঁই ইঁট্টু দিঁয়ে যাঁ নাঁ…।’
আমি তো রীতিমতো চমকে গেলাম। বনবন করে মাথা ঘুরতে লাগল। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম।
আমি কাকে কী দেবো? কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথাটাও ঠিক কাজ করছে না। আমার ভেতরে তখন পুরোপুরি একটা ভয় ঢুকে গেছে।
আমার তখন এমন অবস্থা, আমি টলতে টলতে মাটিতে পড়ে যাবো।
সামনে এগোতে চাইলেও আর পা উঠাতে পারছি না। যেন আস্ত একটা কাঠে পরিণত হয়েছি। অথবা আমার পায়ের তলায় গাছের মতো শেকড় গজিয়ে গেছে। পা স্থির হয়ে আছে। তার মানে চলার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছি তখন।
এই যখন অবস্থা, ঠিক তখনই সেই কণ্ঠস্বর আবার। আরো ভয়াল আওয়াজে। ‘এঁই ইঁট্টু দিঁয়ে যাঁ নাঁ…।’
তারপর ভেলকিবাজির মতো কেমন করে যেন আমার চোখের সামনে থেকে সমস্ত অন্ধকার নিমিষে দূর হয়ে গেল। চারপাশটা তখন আমার কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠল। সব দেখতে পারছি। এই সুযোগে আমি ইতিউতি তাকাতে লাগলাম। কেউ কোথাও আছে কিনা দেখতে চেষ্টা করছি।
কিন্তু না, কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। এরপর ঠিক আমার পেছনে আবারো সেই খনখনে গলা… ‘এঁই দ্যাঁখ এঁই দিঁকে। আঁমি এঁখানে। তোঁর পেঁছনে। ইঁট্টু দিঁয়ে যাঁ নাঁ ছ্যাঁমড়া…।’ আমি বোঁ করে পেছনে ঘুরলাম। তারপর যা দেখলাম, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখি, ভয়ালদর্শন এক জন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ইয়া লম্বা। কালো। একটা পাহাড় যেন। ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো বের করে মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আবার বলল সে, ‘বঁললাম নাঁ ইঁট্টু দিঁয়ে যাঁ। নাঁ দিঁয়ে চঁলে
যাঁচ্ছিস যেঁ বঁড়!! ইঁট্টু দিঁয়ে যাঁ নাঁ…।’ কথার মধ্যে ভয় ধরানো ভাব, আবার আকুতিও ঝরে পড়ছে।
এই বলে সে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমার তখন কী হলো জানি না। নিজেকে আর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলাম না। গোড়া কাটা গাছের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।
তারপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই।
পরে আমি নিজেকে অনেক লোকের ভিড়ে আমাদের বাড়িতে আবিষ্কার করলাম।শুনলাম, আমি সেই তিন রাস্তার মোড়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলাম। হানেফ দাদা ওই দিক দিয়ে আসছিলেন। রাস্তায় আমাকে পড়ে থাকতে দেখে ওখান থেকে গায়ে ধুলো-কাদামাখা অবস্থায় বাড়িতে তুলে এনেছেন।
জ্ঞান ফিরে এলেও আমি তখনো ভয়ে জড়সড়। আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। মনে হতেই আরো ভীত হয়ে আমি মায়ের কোলে ছোট্ট শিশুর মতো মুখ লুকালাম। মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, সেই ভয়ালদর্শন জন্তু আমার কাছে বারবার কী চাচ্ছিল? আমার কাছে তো তেমন কিছুই ছিল না সে সময়, যা সে আমার কাছে ওই ভাবে চাইতে পারে।
তাহলে? এই তাহলের উত্তর মা পরে দিয়েছিলেন আমাকে। ওই দিন হয়েছিল কিÑ দোস্ত জহিরের মা আমাকে অনেকটা জোর করেই ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন। খাওয়ার পর ইলিশ মাছের গন্ধ তো অনেকক্ষণ মুখে লেগে থাকে। ওই গন্ধ পেয়েই বেচারা ভূত আমার পিছু নিয়েছিল। আর ভীতিকর অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমার কাছে ক্ষণে ক্ষণে নাকিসুরে বলছিল, ‘এঁই ইঁট্টু দিঁয়ে যাঁ নাঁ…।’ মানে সে আমার কাছে মাছ চাচ্ছিল।ভূতেরা নাকি খুব ইলিশ মাছ পছন্দ করে। কেউ যদি একা বাজার থেকে ইলিশ মাছ কেনে, আর যদি ফিরতে তার একটু সন্ধ্যা হয়, ভূতেরা তখন একা ওই হাটুরের পিছু নেয়। সুযোগ বুঝে ভয় দেখিয়ে মাছ খেয়ে পালায়। ওরা এমনই পাজির পাজি।
ওই ঘটনার পর ওই রাতেই আমার বেদম জ্বর এসেছিল। সেই জ্বর বেশ কিছুদিন আমাকে ভুগিয়েছিল। কদিন ধরে একটু চোখ বুজলেই শুনতে পেতাম সেই নাকিসুরের আবদার, ‘এঁই ইঁট্টু দিঁয়ে যাঁ নাঁ…।’

Share.

মন্তব্য করুন