তরুণ ঈগল রেড টেইল ওকের সবচেয়ে উঁচু ডালে
এলোমেলোভাবে তৈরি তার বাসাটায় ঘুমিয়েছিল। বাসা তো নয়,
ডালপালার টুকরো আর পাখির পালকের এক ছোটখাটো জঙ্গল।
সুন্দর নয় মোটেই। ঈগলদের বাসা সুন্দর হয় না, তা সবাই
জানে। রেডেরও তার বাসা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এ সময়
তার শরীরের পালকগুলোর ওপর ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের প্রম
আলোর মিঠে উত্তাপ। আহ! কী আরাম। ঘুমের ঘোরটা কাটতে
চাইছে না। কিন্তু পর মুহূর্তেই তার সব আরাম মিলিয়ে যায়। শরীর
কাঁপছে তার। জেগে উঠে এক চোখ খুলে তাকায় সে। আরে
গোটা গাছটাই তো কাঁপছে। কী ব্যাপার! ভূমিকম্প শুরু হলো
নাকি! তারপর কী মনে হতেই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নিচে দৃষ্টি
ফেলে রেড টেইল। মুহূর্তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় তার
কাছে। দেখে জেমি বাড, তার হাতি বন্ধু ঘুম থেকে জেগে গেছে।
বিশাল দেহটা দিয়ে ওক গাছের কা-টায় ধাক্কা দিচ্ছে সে। ও, এই
ব্যাপার! দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি।
: এই কে রে! আমাকে বিরক্ত করছিস কেন? কৃত্রিম রাগে বাজখাঁই
গলায় চেঁচিয়ে ওঠে রেড টেইল।
বাতাসে গম্ভীর গলার জবাব ভেসে আসে নিচ থেকে-
: আমি জেমি বাড। রাতভর ঘুমিয়েছ। এখন ঘুম থেকে ওঠার
সময় রেড টেইল। উঠে পড়। ডানা মেল।
: আহা! ঘুম থেকে জাগানোর কি ছিরি! ভদ্রভাবে ডাকলেই তো
হয়। তা নয়, গাছে ধাক্কা, যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে।
হো হো করে হেসে ওঠে জেমি বাড। বলে-
: মেজাজ বিগড়ে গেল নাকি! যাক গে, গোসলের কথা ভুলে গেছ?
চল, সময় হয়ে গেছে।
আরে তাই তো। একটু লজ্জাই যেন পায় রেড। জেমির আবার সব
কিছু ঠিকমত করা চাই। দেরি করে না রেড টেইল। উড়ে এসে
ঝপ করে বসে পড়ে জেমির পিঠে। বলে-
: চল দেখি। গোসলটা সেরেই আসি।
বনের মধ্যে খানিকটা দূরেই একটা জলাশয়। সব সময় পানি
থাকে। বনের সব প্রাণীরই পানির উৎস এটা। তৃষ্ণার্ত হলে সবাই
এসে পানি পান করে এখানে। সকালের এ শান্ত সময়টায় বনের
প্রাণীরা সাধারণত পানি পান করতে আসে না। তাই দুই বন্ধু এ
নিরিবিলি সময়ে গিয়ে তাদের গোসলটা সেরে নেয়। ব্যস,
সারাদিনের ঝামেলা শেষ। গোসলের সময়টা বেশ আনন্দে কাটে
তাদের। জলাশয়ে এসে তাকে পিঠে নিয়ে পানিতে নামে জেমি।
তার পিঠ থেকে উড়ে প্রমে বারকয়েক জেমিকে ঘিরে পাক খায়
রেড। তারপর আবার এসে বসে তার পিঠে। আসলে জেমির
পিঠে বসেই গোসল সারে রেড। পানিতে নামে না সে। কোনো
কোনো পাখি অবশ্য জলাশয়ের পাড়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট দিয়ে গায়ে
পানি ছিটিয়ে গোসলের কাজ সারে। যেমন চড়ুই, শালিক। কিন্তু
তার মত বড় পাখিরা পানির কাছে তেমন যায় না। জেমি শুঁড় দিয়ে
পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয় তাকে। সারা গা ভিজে চুপচুপে হয়ে
গেলে রেড উড়ে গিয়ে কাছের উইলো গাছটার ডালে গিয়ে বসে।
কয়েকবার গা ঝাড়া দিতেই পালক থেকে ঝরে পড়ে সব পানি।
ওদিকে পানিতে ডুবে, গড়াগড়ি দিয়ে, শুঁড় দিয়ে পানি ছোড়ার
খেলা খেলে গোসল শেষ করে জেমি। তারপর সে উঠে আসে।
রেড উড়ে গিয়ে আবার বসে তার পিঠে। তারপর
দু’ বন্ধু বেরোয় খাবারের সন্ধানে।
গাছের ঝরাপাতা পড়ে বনের পথ ঢেকে গেছে।
তার উপর দিয়ে গদাই লস্করি চালে এগিয়ে চলে
জেমি। বন্ধুর পিঠে আরামে বসে থাকে রেড
টেইল। এ সময় তার মনে পড়ে যায় জেমির
সাথে প্রম দেখা হওয়ার সে দিনটির কথা।
জেমিকে চিনত না সে। কিন্তু অচেনা জেমিই
তাকে উদ্ধার করেছিল এক মহাবিপদ থেকে।
তারপরই তাদের মধ্যে পরিচয় হয়, তারা হয়ে
ওঠে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধুত্বটা এতই
গভীর যে একই আস্তানায় থাকে তারা। রেড
থাকে গাছের ওপরে, আর জেমি নিচে।
দুই.
সে ছিল শরতেরই এ রকম একটি দিন। রেড
টেইলের বয়স তখনো এক বছর হয়নি। ওড়ে না
তেমন। বাসা ছেড়ে দূরে কোথাও যায় না। তাই
খাদ্য-খাবারও ভালো কিছু জোটে না। কিন্তু
ভীষণ কৌতূহলী সে। একদিন ঠিক করল, বাসার
নিরাপদ আস্তানায় আর নয়, চারপাশে একটু ঘুরে
দেখতে হবে। পাখা মেলে ছোট ছোট উড়ালে
বনের পরস্পর লাগোয়া এক গাছ থেকে আরেক
গাছে এগিয়ে চলে সে। এক জায়গায় গিয়ে
দেখে, কাছের গাছটা বেশ খানিকটা দূরে।
রেডের মনে খুব সাহস। ভাবল, ডানার কয়েকটা
জোর ঝাপটায় অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারবে
দূরত্বটুকু। কিন্তু এটাই তার বাসার বাইরে প্রম
বড় উড়াল। অভিজ্ঞতা নেই, তা ছাড়া ডানায়
অত শক্তিও আসেনি। তাই অপর গাছটা পর্যন্ত
পৌঁছতে পারল না। একটা ডালের আগায় ধাক্কা
খেয়ে পড়ে গেল নিচের এক ঝোপের ওপর।
ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। সেটা ছিল বড় বড়
কাঁটাভরা গাছের একটা ঝোপ। রেডের দু’টি
ডানাই আটকে গেল ঝোপের কাঁটায়। অনেক
চেষ্টায় তা ছাড়াতে পারল সে। এখন দেখা দিল
আরেক সমস্যা। উড়তে গেলে ডানা মেলতে
হবে, কিন্তু তাহলে আবার তা কাঁটায় আটকে
যেতে পারে। কী করবে যখন ভাবছে, তখনি তার
মনে হল কাছেই কি যেন নড়ছে। ভয়ে গায়ের
পালকগুলো খাড়া হয়ে উঠল তার। এ যে
বিপদের পর বিপদ! মনে হয় কোনো মাংসাশী
জন্তু। বনবিড়াল, শিয়াল, এমনকি চিতাও হতে
পারে। এখনি উড়াল না দিলে মারাত্মক বিপদ
ঘটা অসম্ভব নয়। এমনকি জীবনটাও যেতে
পারে। জন্তুটা নিঃশব্দে বোধ হয় আরো কাছে
এগিয়ে আসছে। শুকনো পাতার উপর পায়ের
১৮ কিশোর পাতা মে ২০২০
ভাবছে, বেশ বড় বিপদ থেকে তাকে বাঁচিয়েছে সে। এ শক্তিশালী
প্রাণীটির উপকার সে ভুলবে না। তার সাথে বন্ধুত্ব করা দরকার।
তাতে তার নিজেরও উপকার হবে, আবার সুযোগ মত হাতির
উপকারের প্রতিদানও দেয়া যাবে। সে হাতির খুব কাছে নেমে
আসে। বলে-
: একটা কথা বলতে চাইছি। তুমি আমার যে উপকার করলে তা
কখনো ভুলতে পারব না। ঋণী হয়ে থাকলাম তোমার কাছে।
: ভালো কথা। তুমি বিপদে পড়েছিলে দেখে আমি সাহায্য
করেছি। এটা আমার কর্তব্য। তা, কী বলতে চাইছ তুমি? কিছু
চাও আমার কাছে?
: না, না। কিছু চাইছি না। বলছি যে তোমার এ উপকারের
বিনিময়ে কিছু করতে পারলে আমার ভালো লাগবে। তুমি যদি
রাজি হও…
: তুমি তো একটা পাখি। আমার কি উপকার করবে তুমি? প্রশড়ব
করে হাতি।
ততক্ষণে ভেবে ফেলেছে রেড টেইল কী বলবে সে-
: তোমাকে তো খাবার খুঁজতে হয়। মাঝে মাঝে আমি ওপর থেকে
তোমাকে খাবার খুঁজে দিয়ে সাহায্য করতে পারি। তাতে তোমার
একটু উপকার হতে পারে।
: তোমার কথা শুনে খুশি হলাম। তুমি ভালো। কিন্তু তোমার
সাহায্য আমার লাগবে না। তুমি যেতে পার।
: তুমি কি রাগ করলে ভাই? দেখ, আমাদের বাজপাখি সমাজের
নীতি হচ্ছে কেউ উপকার করলে তার প্রতিদান দিতে হয়।
তার কথা শুনে তরুণ হাতি হেসে ফেলে-
: তাই নাকি! তা আমাদের হাতিদেরও একটা নীতি আছে। তা কি
জান? সেটা হচ্ছে: নিজের শক্তিতে চল, নিজের ব্যবস্থা নিজে কর।
কারো উপকার করলে প্রতিদান চেয়ো না।
রেড টেইল বুঝল, হবে না। হতাশ হয়ে বলল-
: তোমার নামটা অন্তত বল। তোমাকে ভুলতে পারব না আমি।
: আমার নাম জেমি বাড।
: আমার নাম রেড টেইল। তুমি রেড বলে ডেক আমাকে। আবার
তোমার সাথে দেখা হলে খুশি হব। ধন্যবাদ।
: আমাকে তুমি জেমি বলে ডাকতে পার। তোমাকেও ধন্যবাদ।
জেমি খাবারের সন্ধানে রওনা হল, এদিকে আকাশে উড়ল রেড।
বড় গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে ওপরে উঠে গেল সে। একবার নিচে
তাকিয়ে দেখল ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে জেমি। এদিকে জেমি
ভাবছিল, বাজপাখিটা মন্দ নয়। তাকে খাবার খোঁজার ব্যাপারে
সাহায্য করতে চাইছিল। এটা তো ঠিক যে এখন আর বনে আগের
মত অঢেল খাবার পাওয়া যায় না। অনেক সময়ই পেট ভরে না।
এ অবস্থায় কেউ যদি নিজে থেকে খাবার খুঁজে দিয়ে সাহায্য করে,
মন্দ কী! আকাশের দিকে তাকায় সে। ঐ তো বাজপাখিটা উড়ছে।
জেমির মনে হল, তাকে তাকাতে দেখে রেডের চোখ দুটো যেন
খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠল।
রেডের মনে আছে, এর কয়েকদিন পর আকাশে উড়ে শিকার
খুঁজছিল সে। খরগোশ, বড় ইঁদুর, সাপ, বন মুরগি ইত্যাদি। সে
সময় তাকে দেখতে পায় জেমি। তাকে শুঁড় উঁচিয়ে ডাকে। দেরি
না করে নেমে আসে রেড। তখন খাবার খুঁজতে রেডের সাহায্য
অস্পষ্ট আওয়াজ উঠছে। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে
তাকে দেখতেও ভয় পাচ্ছে রেড টেইল। যদি
তার ওপর এখনি ঝাঁপিয়ে পড়ে! তারপর অনেক
কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে ঘাড় ফেরায় সে। আতঙ্কে
বড় বড় হয়ে যায় তার দু’চোখ। তার পিছনে
খানিকটা দূরে ঝোপের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে
একটি বিরাট বনবিড়াল। তাকে দেখছে লোলুপ
দৃষ্টিতে। হায়, মৃত্যু তার কাছে, কিন্তু উড়তে
পারছে না সে। রেড বুঝতে পারে, বড় বড়
কাঁটার জন্য তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছে
না শয়তান বনবিড়ালটা। আবার এই কাঁটায়
আটকে পড়ার ভয়েই সে উড়াল দিতে পারছে
না। অসহায়ভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে রেড
টেইল। ভীষণ বিপদ। এখন যে করেই হোক
তাকে উড়তে হবে- নইলে মরতে হবে। কিন্তু
ডানা নাড়াতেই তীক্ষè কাঁটার খোঁচা খেল সে।
ফলে আর ডানা ছড়াতে পারল না। মরিয়া হয়ে
আবারো চেষ্টা করতে যায় সে। তখনি এক
অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ে তার। দেখে, বন
বিড়ালের পিছনে কোত্থেকে যেন এসে দাঁড়িয়েছে
এক বিশালদেহী হাতি। রেড জানে হাতিরা খুব
বুদ্ধিমান প্রাণী। এ হাতিটা বয়সে তরুণ। রেডের
বিপদটা বোধ হয় অনুমান করতে পেরেছে সে।
বন বিড়ালটা প্রমে হাতির আগমন টের পায়নি।
কিন্তু হাতিটা হঠাৎ কান নাড়াতেই বাতাসে
আওয়াজ ওঠে। সে আওয়াজে চমকে পিছনে
ফেরে সে। তারপর হাতিকে দেখেই কেঁপে ওঠে
ভয়ে। বড় বড় লাফে ছুটে পালায় প্রাণ নিয়ে। এ
দিকে হাতিটা এগিয়ে এসে ঝোপের একেবারে
পাশে দাঁড়াল। কাতরে উঠল রেড টেইল-
: আমাকে মেরো না।
মাথা নাড়ল হাতি। স্থির দাঁড়িয়ে ছোট ছোট দুটো
চোখ দিয়ে দেখছে রেডকে। একটু পর বলল-
: আমি কাউকে মারি না। কিন্তু তোমার সমস্যা
কী?
: দেখ না, এই হতচ্ছাড়া কাঁটার কারণে এখানে
আটকে গেছি। ডানা মেলে উড়তে পারছি না।
: এই কথা! আচ্ছা, আমি শুঁড় বাড়িয়ে দিচ্ছি।
তুমি আমার শুঁড়ের উপর উঠে এস।
শুঁড় বাড়াল হাতি। কিন্তু রেডের কাছে তা
পৌঁছলো না। দু’তিনবার চেষ্টা করেও পারল না
সে। বিরক্ত হয়ে ধ্যাৎ বলে শুঁড় বাড়িয়ে ঝোপের
গোড়া ধরে টান দেয় বিশাল প্রাণীটা। ব্যস,
মুহূর্তেই উপড়ে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে
ঝোপটা। সেই ফাঁকে আকাশে উড়ল রেড
টেইল।
হাতির চারপাশে ধীরে ধীরে উড়ছে রেড টেইল।
মে ২০২০ কিশোর পাতা ১৯
করার কথাটা তোলে জেমি-
: তোমার প্রস্তাবটা মন্দ ছিল না। এখনো কি বহাল আছে ওটা?
তাহলে আমাকে সাহায্য করতে পার। তাতে খুশিই হব আমি।
সানন্দে রাজি হয়ে যায় রেড। অজানা-অচেনা হয়েও তার
মারাত্মক বিপদের মুহূর্তে এগিয়ে
এসে যে বন্ধু তার প্রাণ
বাঁচিয়েছে তার জন্য
কিছু করতে পারলে
সত্যিই ভালো
লাগবে তার।
হ া ি ত ে দ র
খাবার হচ্ছে
গাছ-পালার
পাতা, কিছু
ছোট গাছ ও
কোনো কোনো
ফলও তাদের
পছন্দ। শরীরের
আকারের কারণে
প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ
খাবার লাগে তাদের। আকাশে উড়ে
বেড়ায় রেড। মাইলের পর মাইল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার শ্যেন
দৃষ্টি থেকে নিচের কিছু বাদ যায় না। এ বনের এবং আশপাশের
এলাকায় কোথায় গাছপালা বেশি ও ঘন, সেটা তার ভালোই জানা
আছে।
তিন.
রেড আর জেমি এখন এক আস্তানাতেই থাকে। আস্তানা বলতে
তো বিরাট ওক গাছটা। রেডের বাসা সে গাছে। জেমি থাকে
নিচে। রাতের অনেকটা সময় নানা গল্প করে কাটে তাদের।
কখনো সামনের মাটিতে, কখনো জেমির পিঠে বসে থাকে রেড।
বলতে কী, রেডের নিরাপত্তার কথা ভেবেই জেমি এসে বন্ধুর সাথে
থাকে। কারণ, সেদিনের ঘটনার পর থেকে বন বিড়াল জ্যানিস
আর রেড পরস্পরের মারাত্মক শত্রু হয়ে গেছে। রেড সুযোগ
পেলেই ছোঁ মেরে তার খাবার কেড়ে নেয়। তাই ভীষণ খেপে
আছে জ্যানিস রেডের ওপর। দিনের বেলা কোনো সমস্যা নেই।
কিন্ত বন বিড়াল নিশাচর জন্তু। রেড তা নয়। রাতে সে ঘুমায়।
আর ঘুমের মধ্যে কেউ সতর্ক থাকতে পারে না। রাতের গভীরে
এসে জ্যানিস যে রেডের উপর হামলা করবে না, তা কে বলতে
পারে? সে ভয় থেকেই জেমি এখানে চলে এসেছে। রেড প্রমে
রাজি হয়নি। জেমি রেডের ওপর জ্যানিসের হামলার আশঙ্কার
কথা জানালেও সে তাকে ভয় পায় না বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে
চেয়েছে। কিন্তু জেমির চাপাচাপিতে শেষে মেনে নিয়েছে। জেমি
মনে করে যে, সে এখানে আছে জানলে বন বিড়ালটা এ রকম
ভয়ঙ্কর কিছু করার সাহস পাবে না। হাতিরা কখনো গভীরভাবে
ঘুমায় না আর তাদের ঘ্রাণশক্তিও প্রবল। বনের পশু হিসেবে
জ্যানিস তা জানে। এর মধ্যে একদিন কথায় কথায় রেড জানতে
পারে যে জেমি আকাশের তারা দেখতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু
বনের মধ্যে বড় বড় সব গাছ আকাশ ঢেকে
রাখে। তার ফাঁক দিয়ে রাতের তারাদের দেখা
পাওয়াই মুশকিল। তাই এক রাতে দু’জন বনের
কিনারে ফাঁকা জায়গায় চলে আসে। জেমির
পিঠে রেড। দুজন চেয়ে থাকে আকাশের দিকে।
সারা আকাশ জুড়ে রতেড়বর মত শোভা পাচ্ছে লক্ষ
কোটি তারা। নীরবে ¯িড়বগ্ধ আলো দিয়ে চলেছে।
মাঝে মাঝেই দু’ একটি তারা খসে পড়ছে
আকাশ থেকে। সেগুলো আসলে তারা নয়,
উল্কা।
: কি সুন্দর, তাই না? যদি আরো কাছে গিয়ে
দেখতে পেতাম! বলে জেমি।
: তারাগুলো সত্যিই সুন্দর। জবাব দেয় রেড।
: কিন্তু মাঝে মাঝে ওরা কেন যে খসে পড়ে, কে
জানে।
রেড কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আকাশে কিছু
একটা দেখে বলে-
: আরে দেখ দেখ! ওটা কী?
আর সব তারার চেয়ে বড় একটি তারার দিকে
সে দৃষ্টি আকর্ষণ করে জেমির। কয়েক সেকেন্ডের
মধ্যেই সেটা বিরাট আকার ধারণ করে। চলে
আসে তাদের খুব কাছে। হঠাৎ করে তাদের
চারপাশ যেন সবুজ আলোর বন্যায় ভেসে যায়।
সে আলোর অত্যুজ্জ্বল তীব্রতায় অন্ধ হয়ে যায়
তারা। এক সেকেন্ড পর মাটিতে যেন বজ্রপাত
ঘটে, ভীষণ এক আলোড়নে উপড়ে পড়ে বনের
কয়েকটি গাছ। রেড ও জেমি উভয়েই পড়ে যায়
মাটিতে।
খানিকটা পর ধাক্কাটা সামলে ওঠে রেড। ডানা
দুটো নেড়ে দেখে। না, ঠিকই আছে। এবার
জেমির দিকে তাকায়। তার বিশাল শরীরটা
মাটিতে পড়ে আছে। দু চোখ বন্ধ। একটা
মাঝারি সাইজের গাছ পড়ে আছে তার গায়ের
ওপর। জেমির শুঁড়ের উপর বসে তাকে ডাকতে
থাকে রেড। বেশ কয়েকবার ডাকার পর চোখ
খোলে জেমি-
: কী হয়েছে রেড? আমি এভাবে মাটিতে পড়ে
গেলাম কেন?
গায়ের ওপর থেকে গাছটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়
জেমি।
: বুঝতে পারছি না। আমার চোখে ধাঁধা লেগে
গেল কেন যেন। মাটিতে ছিটকে পড়লাম।
দুজন আকাশের দিকে তাকায়। দেখে, সেই বড়
তারাটি থেকে একটি সবুজ ধোঁয়ার রেখা নেমে
এসেছে নিচে, মিশেছে বনের পশ্চিম দিকের
উপত্যকায়। রেড জানে, বড় বড় পাথর খ-
আছে ওদিকটায়। বিস্মিত হয়ে তারা দেখল,
২০ কিশোর পাতা মে ২০২০
পালাতে হয়েছিল তাকে। তারপর হাতিটাকে দেখেছে আরো
কয়েকবার। ওই বাজপাখিটার সাথে। বাজপাখিটা মাঝে মধ্যেই
তার কাছ থেকে শিকার করা খরগোশ বা বন মুরগি ছিনিয়ে নেয়।
জ্যানিসের ঘোর শত্রু হয়ে উঠেছে সে। শিকার ধরার পর একটু
অসাবধান হলেই হয়। কোত্থেকে এসে চোখের পলকে ছোঁ মেরে
তার শিকার ছিনিয়ে নিয়ে যায় রেড টেইল, কিছুই করতে পারে না
সে। এমনিতেই বনে শিকারের যোগ্য প্রাণী কমে আসছে।
শিকারির সংখ্যা যত, সে তুলনায় শিকারের সংখ্যা কম। দিন
দিনই সে সংখ্যা কমছে। শিকার পাওয়া μমেই কঠিন হয়ে
পড়ছে। তার ওপর রেড টেইলের এই নিত্য মুখের খাবার কেড়ে
নেয়ার ঘটনা অসহ্য হয়ে উঠেছে।
এই তো সেদিনের কথা। আর সব বন বিড়ালের মতো বন মুরগি
জ্যানিসেরও সবচেয়ে প্রিয় খাবার। বড়সড় একটা পেয়ে গেলে
এক দুদিন আর শিকার না করলেও চলে। বন মোরগ তো শিকার
করাই যায় না। ওগুলো এত চালাক আর সতর্ক যে কাছে
পৌঁছনোর আগেই উড়ে যায়। বন মুরগিগুলো তাদের তুলনায়
একটু দুর্বল বলে মাঝে মধ্যে তাদের শিকার করা যায়। কিন্তু
তাদের শিকার করাও এখন খুব কঠিন হয়ে উঠেছে! বন মুরগি
পাখির মত উড়তে পারে না। কিন্তু মাটি থেকে উড়ে গাছের ডালে
গিয়ে বসতে পারে। জ্যানিস এগুলোকে বলে আধা পাখি। মাটিতে
খাবার খুঁজে ফেরে তারা। সারাক্ষণ মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাতে
থাকে। দশ গজ দূরেও সব স্পষ্ট দেখতে পায়। বন বিড়ালের
আগমনের আঁচ পেলেই হল। চোখের পলকে উড়ে গিয়ে কোনো
গাছের ডালে চড়ে বসে। ওড়ার সাথে সাথে যদি লাফ দেয়া যায়
আর ভাগ্য ভালো থাকে তবে তাদের নাগাল মেলে। টুঁটি কামড়ে
ধরে তাকে নিয়ে নিচে পড়ে বন বিড়াল। তারপর মহানন্দে চলে
ভোজ। তবে সে রকম ঘটনা এখন আর ঘটে না বললেই চলে।
বন বিড়ালরা লাফ দিয়েও তাদের নাগাল পায় না। কিন্তু সেদিন
পেয়েছিল জ্যানিস। বেশ বড় ছিল বন মুরগিটা। সবে ডিম পেড়ে
ঝোপ থেকে বেরিয়েছিল বোধ হয়। একটু দুর্বল ছিল তাই। তখনি
পড়ে জ্যানিসের চোখে। নিঃশব্দে কাছে পৌঁছে ধরে ফেলে তাকে।
গলা কামড়ে দফা রফা করে দেয়। টেনে নিয়ে যায় একটু ফাঁকা
জায়গায়। লোভনীয় শিকার পাবার আনন্দে একটুখানি অসতর্ক
হয়েছিল সে। মৃত বন মুরগিটাকে মুখ থেকে মাটিতে নামিয়ে রেখে
আয়েশ করে বসতে গেল সে। সেটাই হল ভুল। রেড যে
কোত্থেকে এল আর চোখের পলকে তার শিকারকে ছিনিয়ে নিল,
কিছুই বুঝতে পারল না সে। তার মনে হল , আকাশ থেকে একটি
ছায়া নেমে এল ও তা মিলিয়ে গেল। শুধু তার সামনে শিকারটা
আর নেই। তারপরই দেখতে পেল, শক্তিশালী দুই পায়ের নখে
বন মুরগিটাকে ধরে উড়ে চলেছে রেড। কয়েক মুহূর্ত পরই গাছের
আড়ালে হারিয়ে গেল সে। পেটের ক্ষুধা আর মুখের খাবার
হারানোর μোধে খানিকক্ষণ ধরে নিষ্ফল গর্জন করল জ্যানিস।
এতদিনে শয়তানটাকে নাগালে পেয়েছি- জ্যানিস বিড়বিড় করে
বলে। সবুজ আলো সেও দেখতে পাচ্ছে। সেদিকেই যাচ্ছে দু’
বন্ধু- বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। তারা সরাসরি এগিয়ে চালেছে
জায়গাটার দিকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগে যে একটা ছোট্ট
বাঁক আছে, তা বোধ হয় জানে না তারা। এ সুবিধাটাই নেবে সে,
সেখান থেকে সবুজ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। রেড
বলে-
: জিনিসটা কী তা জানি না, তবে ওখানেই
পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
: এটা কী হতে পারে, বলতো? জেমির গলায়
উদ্বেগ।
: জানি না। জেমির পিঠের ওপর দাঁড়ায় রেড-
চল যাই, দেখে আসি।
: কিন্তু ওখানে যাওয়াটা কি ঠিক হবে আমাদের?
আমরা তো বুঝতে পারছি না ওটা কী। আমার
মনে হয়, ওটার কাছে না যাওয়াই ভালো হবে।
: আরে ভয় পাওয়ার কী আছে? তুমি তো আরো
কাছে থেকে তারা দেখতে চেয়েছিলে তাই না?
ওটা আকাশ থেকে নিচে নেমে এসেছে। কাছে
গিয়ে দেখবে চল।
জেমি ইতস্তত করে রাজি হয়-
: ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, চল যাই। দেখি
ওটা কী।
: হ্যাঁ চল। আর আমি উড়ে না গিয়ে তোমার
পিঠে চড়ে যাই, যাতে দুজন এক সাথে
জিনিসটাকে দেখতে পারি।
বন থেকে ঢাল বেয়ে তারা নামে নিচের
উপত্যকায়। রাতের বেলা বলে ঠা-া পড়ছিল।
ঝিরঝির করে বইছিল বাতাস। কোথাও আর
কোনো প্রাণীর সাড়া নেই। মৃদু স্বরে কথা বলতে
বলতে এগিয়ে চলে রাতের দুই অভিযাত্রী।
কিছুক্ষণ পর সমতলে পৌঁছে যায় তারা। এগোয়
পশ্চিম দিকে। ঐ তো, খানিকটা দূরে বড় বড়
বোল্ডারের আড়াল থেকে বের হচ্ছে সবুজ
আলো। এ রকম আলো আগে কখনো দেখেনি
তারা।
চার.
অন্ধকারের ভেতরে একটি প্রাণী তীক্ষè চোখে লক্ষ
করছিল জোড় মানিককে। উপত্যকার মাঝামাঝি
একটি বড় বোল্ডারের আড়ালে বসে গলা বাড়িয়ে
তাদের দেখছিল বন বিড়াল জ্যানিস। আকারে
ছোটখাটো বাঘের সমান। শরীরে প্রচ- শক্তি।
ভীষণ হিং¯্রও সে। সামনের বাম পা জিভ দিয়ে
কয়েকবার চেটে নেয় সে। তারপর টান টান করে
শরীর। এখন তার শিকারের উপযুক্ত সময়।
খাবার খুঁজছে সে। জোড় মানিকের রেড
টেইলকে ভালো করেই চেনে সে। আর
হাতিটাকে আগে একবার দেখেছিল। বহুদিন
আগে কাঁটঝোপে আটকে পড়া রেডকে আরেকটু
হলেই শিকার করতে পারত জ্যানিস। কিন্তু
যমদূতের মত হাতিটা এসে পড়ায় প্রাণ নিয়ে
মে ২০২০ কিশোর পাতা ২১
ভাবে জ্যানিস। হাতিটা একটা ঝামেলা বটে। তাই তাদের আগেই
সেখানে পৌঁছে ওঁৎ পেতে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় সে। যখন তারা
বাঁকটায় পৌঁছবে, লাফিয়ে পড়বে সে রেড টেইলের ওপর।
হাতিটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হতচ্ছাড়া বাজপাখিটার গলা ও
মাথা চলে আসবে তার মুখের ভেতর। তখন শত ডানা
ঝাপটালেও লাভ হবে না। তাকে ধরার পর এক লাফে চলে যাবে
সে বোল্ডারের আড়ালে। কিছুই করতে পারবে না চলনে ধীর গজ
ব্যাটা।
কিন্তু জ্যানিস যা ভাবছিল তা হল না। সামনের বাঁকটা দেখে কী
যেন ভাবে রেড। অচেনা জায়গা। বলা যায় না, কোনো বিপদ
থাকতে পারে। জেমিকে বলে-
: আমি আগে গিয়ে জায়গাটা দেখি। তুমি আসতে থাক।
পাখা মেলে রেড। সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সে জায়গা
পেরিয়ে আরেকটু এগোতে হবে। তারও পরে বোল্ডারগুলো ছড়িয়ে
আছে। এদিকে বাঁক ঘুরে জেমি সামনে পৌঁছেছে। তার কাছে
ফিরে আসে রেড। জেমির পিঠের ওপর দাঁড়ায়। দুজন এগোয়
আবার।
বোল্ডারগুলোর কাছে পৌঁছে যায় জেমি ও রেড। সমতল থেকে
খানিকটা উঁচুতে জায়গাটা। দুজনে ওপরে উঠে কিনার থেকে উঁকি
দেয়। নিচে বিরাট একটা অগভীর গর্তের বুকে ছড়িয়ে আছে
অনেকগুলো পাথর। সবুজ আলো বেরিয়ে আসছে পাথরগুলোর
ফাঁক দিয়ে। এ আলো আকাশের তারার আলোর মত সোনালি নয়
কেন তারা বুঝতে পরল না।
: আমাদের কাছে নেমে গিয়ে ব্যাপারটা দেখা উচিত- বলে রেড।
: কী করব বুঝতে পারছি না- জেমির কণ্ঠে হতাশা।
: আচ্ছা, এটা ভুতুড়ে কিছু যে নয়, তা বুঝতে পারছ তো? বলে
রেড- ঠিক আছে, এখানে দাঁড়াও তুমি। আমি আবার উড়ে গিয়ে
দেখে আসছি।
: না, দরকার নেই। বিপদ ঘটে যেতে পারে।
জেমির কথা না শুনে উড়াল দেয় বাজপাখি। তার দিকে চোখ রেখে
অপেক্ষা করতে থাকল জেমি। এদিকে রেড টেইল সবুজ আলো
ছড়ানো জায়গাটার ওপর পৌঁছে। দেখে, কালো মত কিছু একটা
পড়ে আছে। তার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে সবুজ আলোর
দ্যুতি। কালো জিনিসটা বোধ হয় অন্য একটা পাথর। বিরাট।
তবে আর সব পাথরের মতই দেখতে এটা। ঠোঁট দিয়ে পাথরটা
ছুঁয়ে দেখল সে, তারপর ঠোকর দিল একটা। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ
উজ্জ্বল আলোর এক ঝলক দেখা গেল, আর প্রচ- একটা ধাক্কা
খেল সে। রেডের মনে হল, ধাক্কাটা তার শরীরের ভেতরে গিয়ে
প্রচ-ভাবে সব কিছু নাড়িয়ে দিল, তা ছড়িয়ে পড়ল তার শরীরের
রক্তে, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, পালকের নিচে ত্বকের প্রতিটি কোষে।
এ ধাক্কার বেগটা সামলাতে না পেরে অচেতন হয়ে পড়ে সে।
রেডের অবস্থা দেখে চিৎকার করে ওঠে জেমি। ছুটে যায় তার
কাছে। ভয় হল, মারা যায়নি তো! শুঁড় দিয়ে আলতো করে ঠেলা
দেয় জেমি। নাম ধরে ডাকে। বলে-
: ওঠো বন্ধু, ওঠো।
কোনো সাড়া দেয় না রেড। উদ্বিগড়ব জেমি তার বিশাল একটা কান
জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা ক্ষুদে বন্ধুর ছোট্ট বুকের কাছে নিয়ে যায়।
তার হৃদস্পন্দন শুনতে পায় সে। ওহ! বেঁচে
আছে রেড- স্বস্তির শ^াস ফেলে বলে সে। আবার
ডাকে-
: রেড! রেড! ওঠ রেড, ওঠ।
বারবার তাকে ডাকে জেমি। অবশেষে সাড়া
জাগে রেডের দেহে। চোখ খুলে তাকায়। জেমি
দেখে, বাজপাখির হলুদ চোখ দুটো সবুজ হয়ে
গেছে। ঠিক আকাশ থেকে পড়া পাথরের সবুজ
রঙের মত।
: কী হয়েছে জেমি? জিজ্ঞেস করে রেড।
জেমি পাথরটার দিকে তাকিয়ে বলে-
: এ জিনিসটা তোমাকে অচেতন করে ফেলেছে।
আমি তোমাকে সাবধান করেছিলাম। তবুও কেন
তুমি পাথরটা ছুঁতে গেলে রেড?
: আমি ভেবেছিলাম এটা বুঝি একটা সাধারণ
পাথর। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। এটা
আসলেই হয়ত একটি পৃক তারা বা তারার
অংশ। সূর্যের মত গরম, বজ্রঝড়ের মত। এটা
আমার সারা শরীরকে অসাড় করে দিয়েছে।
: এ জায়গাটা নিরাপদ নয়। চল আমরা এখান
থেকে যাই। বলে জেমি।
রেড নিেেজর পায়ের ওপর দাঁড়ায়। বলে-
: একটু থাম। আমার কেন যেন আগের চেয়ে
অন্য রকম লাগছে। বুঝতে পারছি না। অনেক
শক্তি অনুভব করছি। আমি কিছু একটা করার
চেষ্টা করছি…
জেমি বলে-
: রেড! এখান থেকে আমরা যাই চল। দেরি
করো না। চল।
: আমি ঠিক আছি এখন।
জেমি এদিক ওদিক চাইল। রেড টেইল কথা
বলল, কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছে না সে।
: কোথায় তুমি রেড! তোমাকে আমি দেখতে
পাচ্ছি না।
: তাই নাকি?
রেড জেমির ডান পায়ের কাছে মাটিতে নামল।
এখন দেখা যাচ্ছে তাকে। জিজ্ঞেস করল জেমি-
: আশ্চর্য! কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
: কোথাও না। তুমি কি আসলেই আমাকে
দেখতে পাওনি?
মাথা নেড়ে না বোঝাল জেমি।
: আচ্ছা, এবার দেখ তো!
রেড উড়ে গেল, তাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে
না। প্রশড়ব শোনা গেল-
: দেখতে পাচ্ছ আমাকে?
: না। জবাব দেয় জেমি।
রেড আবার নেমে আসে। দেখা যায় তাকে।
২২ কিশোর পাতা মে ২০২০
জ্ঞান ফেরাতে জেমির চেষ্টা, তারপর রেড টেইলের জ্ঞান ফেরা,
তাদের মধ্যকার কথাবার্তা, অদৃশ্য হওয়ার শক্তি লাভ করা ও বনে
ফিরে যাওয়ার পর কিছুটা সময় অপেক্ষা করে সে। পাথরটার
ভিতরে কী শক্তি আছে, ভাবতে লাগল জ্যানিস। খুবই গুরুত্বপূর্ণ
ব্যাপার। কিন্তু এটা দিয়ে তার কি কোনো সুবিধা হবে? হ্যাঁ হবে।
সে যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, তাহলে জঙ্গলের কোনো প্রাণীই
তাকেও দেখতে পাবে না। খাবার সংগ্রহের জন্য তখন আর এত
চিন্তা ও কষ্টও করতে হবে না। খুব সহজেই তা জোগাড় করতে
পারবে। অতএব সবুজ আলোর শক্তিটা তাকে পেতেই হবে। রেড
যেভাবে পেয়েছে, সেও সেভাবেই এ শক্তি অর্জন করবে। আর তা
পাওয়ার পর প্রমেই সে শিকার করবে ঐ মহাশত্রু
বাজপাখিটাকে।
লোভে চকচক করা চোখে জ্যানিস এগিয়ে যায় সবুজ আলোর
দিকে। উঁচু জায়গাটাতে ওঠার পর দাঁড়ায় গর্তের কিনারে। যে
কালো পাথরের নিচ থেকে উজ্জ্বল সবুজ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল,
নিঃশব্দ পায়ে এগোয় সেটার দিকে। কয়েক লাফে কাছে পৌঁছে
গন্ধ নেয় বিরাট পাথরটার। একেবারে মাটির মতই গন্ধ, আলাদা
কিছু নয়। পাথরটার ওপরে ওঠার জন্য ডান পা বাড়ায়। ভাবতে
থাকে, এ সবুজ আলোর শক্তি তার জীবনকে কী প্রচ- ভাবেই না
পাল্টে দেবে। অবশেষে উঠে দাঁড়ায় সে কালো পাথরটার ওপর।
থাবা বসায় পাথরের গায়ে। তৎক্ষণাৎ তার সারা শরীর এক ভীষণ
ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে। ছিটকে একপাশে গিয়ে পড়ে জ্যানিস।
রেড টেইলের বেলাতেও এমনি হয়েছিল। তার মানে ঐ শক্তি
পেতে যাচ্ছে সে। তার চোখ সবুজ হয়ে যাবে। তারপরই অদৃশ্য
হয়ে যেতে পারবে সে। খানিকটা পর সে উঠে দাঁড়ায়। চারপাশে
একটা পাক দেয়। একটি পা তুলে আনে চোখের সামনে। সব
ঠিকমতই দেখতে পায়। অর্থাৎ সে অদৃশ্য হয়নি। সফল হয়নি
তার চেষ্টা। নিজের ওপর রেগে যায় জ্যানিস। সে বুঝতে পারেনি
যে অদৃশ্য হওয়ার শক্তি সে ঠিকই পেয়েছে। এতে তাকে কেউ
দেখতে পাবে না, কিন্তু নিজের শরীরসহ আর সবাইকেই দেখতে
পাবে সে। বেশ রেগে গিয়ে একটা লাফ দিয়ে পাথরের মাথায়
গিয়ে সে নামে। আশ্চর্য হয়ে সে দেখে পাথরটা উপরে ও নিচে
দু’ভাগ হয়ে গেছে। গর্তের চারদিকে সৃষ্টি হয়েছে ফাটল। তাহলে
শেষ পর্যন্ত কি সে সেই শক্তি পেয়ে গেছে যা পেয়েছে বাজপাখিটা!
সে আবার তার শক্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। সামনের দু’পায়ের
থাবা দিয়ে সে মাটিতে আঘাত করে। কেঁপে ওঠে গর্তের
চারপাশের মাটি। একটা পাথর ভেঙে টুকরোগুলো বেগে ছিটকে
পড়ে চারদিকে। খুব খুশি হয় জ্যানিস। এটাকে কাজে লাগাবে
সে। তার চোখ জ¦লে ওঠে। রেড টেইল! এবার তোমাকে দেখে
নেব আমি।
ভোরের পূর্বাভাস পেয়ে রাতের আঁধার এক সময় হালকা হতে শুরু
করে। রেড টেইল ও জেমি অনেকটা রাত জেগে ছিল। এখন ওক
গাছের নিচে জেমি ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু রেডের চোখে ঘুম
আসেনি। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সকল শক্তি এসে তার মধ্যে জড়ো
হয়েছে। যে কোনো জায়গায় সে যেতে পারবে, কিন্তু কেউ তাকে
দেখতে পাবে না- এটা ভাবতেই শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে তার।
বুঝতে পারে, নতুন পাওয়া এ শক্তির উদ্দীপনাতেই তার চোখ
সবার আগে চোখে পড়ে তার সবুজ দু’চোখ।
উত্তেজিত হয়ে বলে-
: জেমি, আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি। আমি
যখন উড়ব, তখন আমাকে আর দেখা যাবে না।
জেমি শান্ত ভাবে বলে-
: শুধু তাই না, তোমার চোখও সবুজ হয়ে গেছে।
: ঐ পাথরটার মত, তাই না? আমার মনে হচ্ছে,
পাথরটা ছোঁয়ার পর আমি যে ধাক্কা অনুভব
করেছিলাম তখনি পাথরটা আমাকে এ শক্তিটা
দিয়েছে। খুব ভালো হয়েছে। আমি এখন অত্যন্ত
শক্তিশালী এক বাজপাখি। আমি এখন অদৃশ্য
হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা পেয়েছি।
: কী বলছ তুমি? এ রকম যদি হয় যে তুমি
অদৃশ্য হয়ে গেলে, কিন্তু আর আগের অবস্থায়
ফিরতে পারলে না, তখন কী হবে? আমি কোথায়
পাব তোমাকে? জেমির গলা করুণ হয়ে আসে।
দৃঢ়তার সাথে বলে রেড-
: এমনটা কখনো হবে না জেমি। এক প্রকৃত বন্ধু
কি আরেক প্রকৃত বন্ধুর কাছ থেকে সরে বা
লুকিয়ে থাকতে পারে? বল?
: আচ্ছা, কথাটা মনে রেখ। এখন চল, ফেরা
যাক।
: সে তো যাবো। কিন্তু আমি এ শক্তির অধিকারী
হলাম, তুমি হবে না? যাও, তুমিও গিয়ে ওই
পাথরটা ছুঁয়ে এস।
মাথা নাড়ে জেমি-
: অসম্ভব। ওই পাথরের ধারে কাছে যাবো না
আমি।
: প্লিজ জেমি, তোমারও এ শক্তি দরকার।
তাহলে আমরা দু’বন্ধু অনেক কিছু করতে পারব।
বনের সবাই আমাদের দেখে ভয় পাবে, অনুগত
হয়ে থাকবে। আর ওই শয়তান বন বিড়ালটা
কোনো দিন আমার কাছে আসতে পারবে না।
তার কথা শুনে হাসে জেমি-
: বাদ দাও তো, এ রকম শক্তি আমার লাগবে
না। আর আমি থাকতে বন বিড়ালটা এমনিতেও
তোমার কাছে আসবে না। তারপর তুমি তো
নতুন শক্তি পেয়েছ। অতএব আর চিন্তা করো
না। এখন চল, ফিরে যাই আমরা। দেরি হয়ে
গেছে অনেক।
কী আর করা। জেমির পিঠে বসে রেড। রওনা
হয় তাদের আস্তানার দিকে।
পাঁচ.
রেড ও জেমির পিছু লেগে থাকা জ্যানিস সবই
দেখতে ও সব কথাই শুনতে পেল। সবুজ
আলো, রেড টেইলের অচেতন হয়ে পড়া, তার
মে ২০২০ কিশোর পাতা ২৩
থেকে ঘুম পালিয়েছে। দরকার নেই ঘুম। শক্তি পরীক্ষা করতে চায়
সে। এর মজাই আলাদা। এমন একটা জায়গায় তার যাওয়ার
ইচ্ছা হল যেখানে এর আগে সে যেতে পারেনি। হ্যাঁ, এ রকম
একটি জায়গা আছে। মুনরক পর্বত। এ বনেরই লাগোয়া।
এক্কেবারে আলাদা জায়গা। পর্বতের পাদদেশে বিশাল বনে সিংহ,
চিতাবাঘ, বন বিড়াল, শিয়াল প্রভৃতি মাংসাশী প্রাণী আছে। গাছে
আছে অজগর। নিরাপত্তার অভাবে সেখানে সে যেতে ভয় পেয়েছে
এতদিন। হ্যাঁ, এখন সেখানেই যাবে সে। পর্বতটি কাছেই।
বিপজ্জনক। তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
মুনরক পর্বতে যাওয়ার আগে নিজের অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা
আবার পরীক্ষা করে নিতে চাইল রেড। বনের সবুজ ছাদের উপর
দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ উড়ল সে। নিচের দিকে সব কিছু খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখে বেশ খানিকটা সময় কাটাল। তারপর উড়তে উড়তে
একেবারে শেষ প্রান্তে চলে আসে সে। এ সময় খোলা মাঠে একটি
ঝোপের পাশে আয়েশ করে একটি বনমুরগি আহার করছিল একটি
শিয়াল। তার ওপরই প্রম পরীক্ষাটা চালানোর সিদ্ধান্ত নিল রেড
টেইল। নামতে নামতে শিয়ালের মাথার উপর চলে এল সে।
পাখির ডানার শব্দ পেয়ে কান খাড়া করে ধূর্ত প্রাণীটা, কিন্তু কিছু
দেখা যাচ্ছে না কোথাও। তাই আহার অব্যাহত থাকল তার। রেড
বুঝল, শিয়াল তাকে দেখতে পায়নি। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে।
এবার নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। মুনরক পর্বতের দিকে উড়াল দেয়
রেড।
জ্যানিস বনের সব জায়গায় রেড টেইলকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আজ
বাজপাখিটাকে উচিত শিক্ষা দেবে সে। এতদিন ভীষণ জ¦ালিয়েছে
তাকে এ পাখিটা। তবে রেড টেইল সাধারণ পাখি নয়। জ্যানিস
জানে, পাখি জাতির মধ্যে ঈগল সবার সেরা। শক্তি, সাহস,
বুদ্ধিতে অতুলনীয়। তেমনি ভয়ঙ্কর। তার সাথে লড়তে পারার মত
আর কোনো পাখি নেই। ঈগলকে সে জন্যই পাখির রাজা বলা
হয়। অন্য সব পাখি তো বটেই, কোনো প্রাণীকেই ভয় পায় না
ঈগলেরা। ঈগলের সংখ্য বেশি নয়। অন্য পাখিদের মত বোধ হয়
তারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে না। সবচেয়ে বড় গাছের অতি উঁচু
ডালে নয় তো পাহাড়ের চূড়ায় বাসা বাঁধে ঈগল। এ বনে অবশ্য
রেড টেইল ছাড়া আর কোনো ঈগল নেই। ভাগ্যিস নেই। এক
রেড টেইলকে শত্রু বানিয়েই তার যন্ত্রণার শেষ নেই, তার মত
আরো ঈগল থাকলে তাকে হয়ত পাগল হয়ে যেতে হতো নয়ত বন
ছাড়তে হতো। তার মনে একটু ভয়ও হয়। রেড টেইল শক্তিশালী
পাখি। আকারে বিরাট। বিশাল দুটি ডানার বিস্তার ভয় পাইয়ে
দেয়ার মতো। তেমনি সুতীক্ষè ও বড় তার নখর। বিভীষিকার
মতো। ওই নখর দিয়ে কোনো প্রাণীকে ধরলে তার আর ছাড়া
পাওয়ার আশা নেই। জ্যানিস নিজের চোখেই তা দেখেছে।
রেডের চোখের চাউনিও ভয়ঙ্কর। আর তেমনি ভয় ধরানো ডাক।
সে নিজে বন বিড়াল হলেও কম শক্তি রাখে না। চেনাশোনা
অনেকেই বলে, তাকে নাকি দেখতে অনেকটাই বাঘের মত লাগে।
হয়ত বাড়িয়েই বলে তারা। তবে সে নিজেও বোঝে যে স্বজাতির
দেহের আকারে সে অনেকের চেয়েই বড়। যথেষ্ট শক্তিও রাখে
দেহে। কিন্তু যত যাই হোক, বাঘ তো সে নয়। বাঘের সম্মান
তাকে কেউ দেয়ও না। ভাগ্য ভালো যে এ বনে বাঘ বা সিংহ
নেই। তাই সে ও তার দু’চারজন স্বজন এখানে
বেশ ভালোই আছে। কিন্তু যত ঝামেলা ওই
রেড। তার সাথে শত্রুতা করে জ্যানিসের ক্ষতি
ছাড়া কোনো লাভ হয়নি। এবার হিসাব মিটাবে
সে রেডের সাথে। তাকে বাগে পেলেই হয়। এক
থাবাতে তাকে ঘায়েল করবে, ঘাড়টা কামড়ে
ধরে ভেঙে দেবে এক ঝটকায়। তারপর চিবিয়ে
চিবিয়ে হাড়-মাংস খাবে।
অনেক সময় চলে গেল, কিন্তু কোথাও দেখা পেল
না রেডের। তখনি তার মনে হল, হঠাৎ পাওয়া
শক্তির কারণে সে কা-জ্ঞানই হারিয়েছে। এদিক
সেদিক না ঘুরে এই ভোর সকালে রেডের
আস্তানায়ই তো তাকে পাওয়ার কথা। অবশেষে
রেড টেইলের আস্তানা বিরাট ওক গাছ থেকে
একটু দূরে এসে থামে সে। তীক্ষè দৃষ্টিতে
চারপাশ দেখে নেয়। তারপর নিঃশব্দে এগোয়
গাছের দিকে। একেবারে গোড়ায় পৌঁছে
ডালগুলোর দিকে চেয়ে দেখে। অত উঁচুতে দৃষ্টি
যেতে চায় না তার। তবু হাল ছাড়ে না। না,
নিজের আস্তানায়ও নেই রেড টেইল। নিচে
হাতিটা ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু রেডের বন্ধু হিসেবে
হাতির উপর রাগ থাকলেও তাকে ঘাঁটাল না
জ্যানিস। তার দরকার রেডকে। কিন্তু এত
সকালে বাজপাখিটা গেল কোথায়? সে যদি
অদৃশ্য হয়ে গিয়েও থাকে তাহলেও আর কেউ
দেখতে না পেলেও তাকে ঠিকই দেখতে পাবে
জ্যানিস। এ দিকে সারা রাত তার ঘুম হয়নি।
ক্লান্ত লাগছে। তাই পরে রেড টেইলকে খোঁজা
যাবে, ভাবল সে। নিজের আস্তানার দিকে রওনা
হয় জ্যানিস।
জ্য্যানিসের আস্তানা বনের উত্তর প্রান্তে। সেখানে
এ বনের সীমানা শেষ। তারপর থেকে শুরু
হয়েছে মুনরক পর্বত এলাকা। এ পর্বত এলাকায়
একদিকে রয়েছে পর্বত, অন্যদিকে রয়েছে
বিশাল ঘন বন। বহু রকম প্রাণীর বাস সেখানে।
তাদের বনের কেউ ওই বনে যায় না, আবার ওই
বনের প্রাণীরাও এই বনে আসে না। আসলে
বনের প্রাণীদের মধ্যেও রয়েছে অলিখিত নিয়ম
যা সবাই মেনে চলে। তাই সাধারণত যার যার
বনেই তারা থাকে। জ্যানিসের খুব ইচ্ছা একবার
মুনরক পর্বতে যাওয়ার। কিন্তু নানা কারণে
যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
বনের প্রান্তে এসে একটি ঝোপের মধ্যে দাঁড়ায়
শিয়ালটাকে চোখে পড়ল জ্যানিসের। বেশিক্ষণ
হয়নি বোধ হয় বন মুরগিটাকে ধরেছে সে। বেশ
আরাম করে খেতে শুরু করেছে। জ্যানিসের মনে
হল, খাবারটা কেড়ে নেয় সে। বদমাশ শিয়ালটা
২৪ কিশোর পাতা মে ২০২০
মত ভীষণ শক্তিমান ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি বলে সে মনে করে।
কথাটা ঠিক। তবে সে সময়টা আসতে আর বেশি দেরিও নেই।
বিশাল দেহের প্রাণীটি তাকে নিয়ে ভাবে, এটা খুব ভালো লাগে
তার। যাহোক, সবুজ আলোর যে
শক্তির বলে সে এখানে
এসেছে সে শক্তিটা
এখন অনেকটা কমে
এসেছে বলে মনে
হচ্ছে রেডের।
আ শ পা শে র
এ লা কা টা
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
জরিপ করে
সে। এমন
একটা স্থান
খোঁজে যেখানে
সে নিরাপদ
থাকবে। অবশেষে
একটা জায়গা পছন্দ হয়
তার। একটু দূরে একটা বড়
বোল্ডারের পাশে অল্প খালি জায়গা। তার পিছনে পাহাড়ের ছোট
গুহা। জায়গাটা ভালোই মনে হয় তার। নিরাপদ। উড়ে গিয়ে
গুহাটার মুখে বসে রেড টেইল। ভেতরটা দেখতে থাকে। ঠিক সে
মুহূর্তে পিছন থেকে একটা ব্যঙ্গ ভরা কণ্ঠ শুনতে পায় সে-
: এ রকম জায়গায় তোমাকে দেখতে পাব বলে আশা করিনি রেড
টেইল। তা তুমি একা যে? তোমার প্রিয় বন্ধু ও সারাক্ষণের সঙ্গী
দৈত্যটা কই?
চমকে উঠে পিছন দিকে ঘোরে সে। মুখোমুখি হয় বন বিড়ালের।
জ্যানিস। রেডের একমাত্র শত্রু। তার উজ্জ্বল সবুজ দু’টি চোখে
হিং¯্রতা ফুটে উঠেছে, চেয়ে আছে তার দিকে। বন বিড়ালের চোখ
সবুজ হয় নাকি? কোত্থেকে এলো এটা? তবে এ নিয়ে ভাবার সময়
পায় না রেড। হিং¯্র চেহারার প্রাণীটা ধীরে ধীরে তার দিকে
এগোতে থাকে। রেড বেকায়দায় পড়ে যায়। তার পিছনে পর্বতের
গুহা, সামনে ভয়ঙ্কর শত্রু। উড়তে গেলেও এত কাছ থেকে ওটা
তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, আবার গুহার মধ্যে ঢুকলেও সে
আটকা পড়ে যাবে। কী করবে সে, বুঝে উঠতে পারে না। তার
সঙ্গিন অবস্থা বুঝতে পারে চতুর বন বিড়ালটা। বলে-
: রোজ কি আর খাবার নিজে থেকে মুখের কাছে হাজির হয়, বল?
তোমার কি মনে পড়ে সপ্তাহখানেক আগে তুমি একটা ধেড়ে ইঁদুর
শিকার করেছিলে? না, আমি বলতে চাচ্ছি না যে প্রায় সময়ই তুমি
আমার মুখের খাবার চুরি কর। তবে আমি একটু আরাম করে
কোনো শিকার খেতে পারি না তোমার জন্য। একটু অসাবধান
হয়েছি তো ছোঁ মেরে খাবারটা নিয়ে গেছ। তোমার ডানা আছে,
তাই চোখের পলকে উড়ে যেতে পার। সাধ্য কি আমার যে
তোমার নাগাল পাই? প্রচ- রাগ হয়েছে, কিন্তু কিছু করতে
পারিনি। যাও বা তোমার পিছু লাগতে যাব তখন ওই বোকা
হাতিটার কথা মনে হয়েছে। তোমার কোনো ক্ষতি করলে সে
কোন কৌশলে শিকারটা ধরল কে জানে। হঠাৎ
চমকে উঠল সে। আরে ওই তো রেড টেইল। শাঁ
শাঁ করে নেমে আসছে সে। শিয়ালের কাছ থেকে
শিকারটা কেড়ে নেবে নাকি! জ্যানিসের মেজাজ
খারাপ হয়ে যায়। তার শত্রু রেড টেইল তার
সামনে এসে এ রকম মাস্তানি করবে, এটা হতে
দিতে পারে না সে। তৈরি হয় জ্যানিস। রেড
শিকারটা কেড়ে নিতে গেলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে
পড়ে তার দফা রফা করে দেবে সে। কিন্তু তাকে
অবাক করে রেড। সে শিয়ালটার চারপাশে
কয়েকবার উড়ল ঠিকই, কিন্তু শিকারটা ছুঁল না।
শিয়ালটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে। এদিক ওদিক
চাইছে সে। ওপরের দিকেও তাকাচ্ছে, কিন্তু কিছু
দেখছে না সে। অথচ সে কিছু একটার অস্তিত্ব
থাকার সন্দেহ করছে। তখন বিষয়টা পরিষ্কার
হয় জ্যানিসের কাছে। রেড অদৃশ্য। তাকে সে
দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু শিয়ালটা দেখতে পাচ্ছে
না। আর রেডও বোধ হয় এটাই পরীক্ষা করতে
চাইছিল। ঘটনাটা কী দাঁড়ায় তা দেখার জন্য
ঝোপের আড়ালেই রইল জ্যানিস। আরো একটু
সময় শিয়ালটার মধ্যে সতর্কতা দেখল রেড।
তারপর রেড চলে গেল মুনরক পর্বতের দিকে।
শিয়ালটা এখন নিশ্চিন্ত মনে আহারে মনোযোগ
দিয়েছে। জ্যানিস বুঝতে পারে, রেড এখন
মুনরক পর্বতে গিয়ে নতুন করে শক্তির পরীক্ষা
চালাবে। ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে সে। এখন পিছু
নিতে হবে রেডের যদিও ততক্ষণে বেশ দূরে
চলে গেছে সে। কিন্তু কোথায় যাবে রেড? মুনরক
পর্বতে গিয়ে ঠিকই তাকে খুঁজে বের করবে
জ্যানিস। রওনা হয় সে।
মুনরক পর্বতে একটি পাথরের ওপর বসেছিল
রেড টেইল। এর আগে এতটা দূরে ওড়েনি সে।
তাই চেয়ে দেখছিল চারপাশটা। পর্বতে কোন
গাছপালা নেই। খালি পাথর আর পাথর। যেন
পাথরেরই রাজ্য। রুক্ষ পরিবেশ। ভালো লাগল
না তার। জেমির কথা মনে হল। আসার সময়
ওক গাছের নিচে ঘুমিয়ে ছিল জেমি। তাকে কিছু
বলে আসেনি বলে মনটা খারাপ লাগছিল তার।
এটা ঠিক, জেমিকে বললে তাকে সে আসতে
দিত না। সে চায় না রেড টেইল একা কোথাও
গিয়ে কোনো বিপদে পড়–ক। সব সময় বন্ধুর
সাথে থেকে তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে
চায়। কিন্তু রেড টেইল এভাবে বন্ধুর ওপর
নির্ভরশীল হতে চায় না। যথেষ্ট শক্তিশালী সে।
আছে প্রচ- সাহস। কাউকে ভয় পায় না সে।
তাকে নিয়ে জেমির দুশ্চিন্তা দেখে সে মনে মনে
হাসে। কারণ, সে এখনো পূর্ণ বয়স্ক বাজপাখির
মে ২০২০ কিশোর পাতা ২৫
আমাকে পায়ের নিচে পিষেই মেরে ফেলবে, অবশ্য যদি আমাকে
ধরতে পারে। এখন সে তোমার সাথে নেই। আজ তোমার রেহাই
নেই রেড। ওই ঘাড়টা ঠিকই মটকাব।
রেডের শ^াস-প্রশ^াস দ্রুততর হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারছে না
জ্যানিস তাকে দেখছে কী করে! ওড়ার কথা ভাবে সে। কিন্তু তার
আগে বন বিড়ালটাকে একটু অন্যমনস্ক করা দরকার। বলে-
: কী বলছ তুমি? আমি চুরি করেছি তোমার খাবার? মানে কী?
: হ্যাঁ, দিনের পর দিন আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছ তুমি।
কিছুই করতে পারিনি। সুযোগ খুঁজছি আমি বহুদিন ধরে।
অবশেষে আজ পেয়েছি তোমাকে। বনে তুমি আমার সবচেয়ে বড়
শত্রু। সেই যে কাঁটা ঝোপে আটকে পড়া অবস্থায় তোমাকে প্রম
পেয়েছিলাম। সেই প্রম দেখা হওয়ার দিনটাতেই তোমাকে শেষ
করে ফেলতাম। কিন্তু ওই নচ্ছার হাতিটা এসে গোল পাকিয়ে
দিল। যাকগে, ওই বনে তোমাকে আর কখনো দেখা যাবে না।
: বনটা কি তোমার? সব খাবারের তুমিই মালিক?
: না, তা নই বটে। কিন্তু তুমি আমার কাছ থেকে আমার শিকার
করা খাবার কেড়ে নিয়ে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছ। কী নাওনি?
আজ তোমার রেহাই নেই।
ততক্ষণে আকাশে উড়তে শুরু করেছে রেড। তা দেখে ক্ষেপে
ওঠে বন বিড়াল। থাবা দিয়ে মাটিতে জোরে আঘাত করে। প্রচ-
আওয়াজ, সে সাথে ভীষণ ভাবে কেঁপে ওঠে চারপাশ। পাথরের
টুকরোগুলো প্রবল বেগে ছিটকে ওঠে ওপরে। একটি পাথর গিয়ে
লাগে রেডের একটি ডানায়। মাটিতে আছড়ে পড়ে সে। প্রচ-
ব্যথায় তীক্ষè চিৎকার বেরিয়ে আসে তার মুখ দিয়ে। তারপরও
আবার উড়তে চেষ্টা করে। পারে না। ডানদিকের ডানাটা ভালোই
জখম হয়েছে। ভীষণ অবাক হয় রেড। বন বিড়ালটা নিজের
শক্তিতে কখনোই এ কাজটা করতে পারত না। প্রাণীটার সবুজ
চোখে তার চোখ পড়ে। তখুনি বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায় তার
কাছে। তার মানে ঐ পাথরটি থেকে এ বন বিড়ালটাও শক্তি
পেয়েছে। সে জন্যই সে দেখতে পাচ্ছে তাকে। সর্বনাশ! এখন
তার একটি ডানা জখম, জেমিও কাছে নেই। কিভাবে সে রক্ষা
পাবে হিং¯্র বন বিড়ালটার কাছ থেকে? এদিকে বন বিড়ালের
থাবার আঘাতে পাথরের টুকরো ছিটকে ওঠার সাথে সাথে একরাশ
ধুলোও উড়েছে। বন বিড়ালটা নিজেও ঐ ধুলো থেকে বাঁচার চেষ্টা
করছে। তাই এ মুহূর্তে রেডের ওপর থেকে নজর সরে গেছে
তার। সুযোগটা নেয় রেড। দ্রুত পায়ে গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ে
ধুলোর আস্তরণে নিজেকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করে। একটি ডানা
জখম হলেও কাজটি পারল সে। ফলে সে উড়তে বা জ্যানিসের
কাছ থেকে অদৃশ্য হতে পারল না, তবে ধুলো দিয়ে নিজেকে ঢেকে
ফেলতে সক্ষম হল। এবার নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল
সে।
ধুলো কমে এলে রেডের সন্ধান করতে থাকে জ্যানিস। সে তার
গন্ধ পাচ্ছিল, কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। তোকে আমি ছাড়ছি
না- রাগে গজগজ করতে রেডের উদ্দেশে বলে বন বিড়াল। তাকে
খুঁজতে থাকে জ্যানিস। মনে মনে বলে, কোথায় পালাবে? আমি
দেখেছি তোমার ডানা জখম হয়েছে। তাই কিছুতেই উড়তে
পারবে না তুমি। আর ওই কদাকার চেহারার শুঁড় উঁচিয়ে হুঙ্কার
দেয়া হাতিটাও এখন সাথে নেই। কেউ বাঁচাতে
পারবে না আজ তোমাকে। তোমার নিস্তার নেই।
এদিকে রেড মনে মনে জেমিকে ডাকছিল-
জলদি এস বন্ধু, বিপদে পড়েছি। বাঁচাও
আমাকে।
ছয়.
সকালে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙল জেমি।
দিনের শুরু হয়েছে। রোজকার মত গোসল সেরে
খাবারের সন্ধানে বেরোতে হবে। এখন উঠতে
হয়। কিন্তু রেড টেইলের কোনো সাড়াশব্দ পেল
না সে। এদিকে শরীর চুলকাচ্ছিল তার। উঠে
দাঁড়িয়ে ওক গাছের সাথে গা ঘষে সেরে নিল
কাজটা। তারপর চাইল উঁচু ডালের দিকে। হেঁড়ে
গলায় ডাকল-
: রেড!
কোনো জবাব নেই। আরো কয়েকবার ডেকেও
সাড়া মিলল না তার। কোথায় গেল রেড! উদ্বিগড়ব
হয়ে ওঠে জেমি। তাকে না জানিয়ে কোথাও
যেতে নিষেধ করেছে সে তাকে বহুবার। তবু সে
তা করল! এ সময় মুনরক পর্বতের দিক থেকে
প্রচ- এক আওয়াজ ভেসে আসে। আওয়াজটা
কিসের, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না জেমি। রেড
কি সেখানে গেছে? কিন্তু তার তো ওদিকে
যাওয়ার কথা নয়। হঠাৎ তার মাথায় আসে,
নতুন শক্তি পেয়েছে রেড। সেটা পরীক্ষা করতেই
মুনরক পর্বতে যায়নি তো! ঠিক তাই। নিশ্চয়ই
খারাপ কিছু ঘটেছে, বিপদে পড়েছে সে।
এক মুহূর্ত বিলম্ব করে না জেমি। সাথে সাথেই
সে রওনা হয় মুনরক পর্বতের দিকে। ছুটতে
ছুটতে সমতল পেরিয়ে যায় দ্রুত। এখন ওপরে
উঠতে হবে। কতটা উঁচুতে আছে রেড, তার
জানা নেই। কোথায় খুঁজবে তাকে, বুঝতে পারে
না। ওপরে ওঠার পথ খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ এক
জায়গায় নরম মাটিতে বন বিড়ালের পায়ের ছাপ
চোখে পড়ে তার। চকিতে তার মনে পড়ে যায়
কাঁটাঝোপে রেডের আটকে পড়া ও সেই হিং¯্র
বন বিড়ালটার কথা। হঠাৎ করেই সে সেখানে
গিয়ে না পৌঁছলে সেদিন বিপদ ছিল রেডের।
তারপর থেকেই রেডের সঙ্গে বনবিড়ালটার
শত্রুতা শুরু। রেড অনেকবার বন বিড়ালটার
অসতর্কতার সুযোগে তার খাবার ছিনিয়ে
নিয়েছে, চোখের পলকে উড়ে গেছে আকাশে।
মুখের খাবার কেড়ে নিলে কার বা মাথা ঠিক
থাকে? কিন্তু রেডের ধারে কাছে পৌঁছোয়, সে
সাধ্য জ্যানিসের নেই। অক্ষম আμোশে ফুঁসেছে
সে। জেমি অনেকবার রেডকে বলেছে, হোক
২৬ কিশোর পাতা মে ২০২০
তাকে। আর মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে রেডের হাতি বন্ধু কখন এসে
হাজির হয়েছে এখানে তা সে বুঝতেই পারেনি। এ তো মহাবিপদ
হল, ভাবে সে। কী করবে সে এখন! তবে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে
ওঠার কোনো সুযোগ পেল না জ্যানিস। বন্ধুর বিপদে পড়া দেখে
ক্ষেপে গেছে জেমি। আর এ জন্য দায়ী যে, সে তার সামনেই।
বিদ্যুৎ খেলে যায় তার প্রকা- শুঁড়ে। জ্যানিস কিছু বুঝে ওঠার
আগেই ভীষণ শক্তিশালী শুঁড়ে তাকে পেঁচিয়ে নেয় জেমি। পর
মুহূর্তে প্রচ- বেগে তাকে ছুঁড়ে দেয় শূন্যে। পাক খেতে খেতে সেই
পাথুরে পাহাড়ে কোথায় গিয়ে পড়ল জ্যানিস, বেঁচে রইল না মরল,
তা কে জানে।
রেডের দিকে ফেরে জেমি। শুঁড় দিয়ে সাবধানে তার গা থেকে
ধুলো সরায়। উঠে দাঁড়ায় রেড। তখনি জেমি দেখতে পায়, ডান
দিকের ডানাটা নাড়াতে পারছে না সে। বোধ হয় ভালোমতই
জখম হয়েছে। জিজ্ঞেস করে-
: কী অবস্থা ডানাটার?
: ভেঙে গেছে মনে হয়। ঠিক বুঝতে পারছি না।
: কিভাবে হল এটা? এ শয়তানটা তোমাকে খুঁজে পেল কিভাবে?
আর আমাকে না বলে তুমি এভাবে চলে এলে কেন?
: আমিও বুঝতে পারিনি। কল্পনাই করিনি যে বন বিড়ালটা এখানে
এসে হাজির হবে। আমি উড়ে এসে এখানে নামি। তারপর
জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়ে যায়। তাই গুহার সামনে নিশ্চিন্ত মনে
দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে হাজির হয় সে। তাকে দেখেই
বুঝতে পারলাম মারাত্মক বিপদে পড়তে চলেছি। এত কাছে এসে
গিয়েছিল ওটা যে উড়তেও সাহস পাচ্ছিলাম না। কথা কাটাকাটির
এক পর্যায়ে আমি উড়তেই থাবা দিয়ে নিচে আঘাত করে সে।
তখন প্রচ- আওয়াজ হল, ছিটকে ওপরে উঠল পাথরের
টুকরোগুলো। তারই একটা আমার ডানদিকের ডানায় লেগে পড়ে
গেলাম নিচে। আর উড়তে পারলাম না। তখন বাধ্য হয়ে ঢুকে
পড়ি এ গুহায়। ভাগ্য ভালো যে গুহাটার মধ্যে বহুকালের ধুলো
বেশ পুরু হয়ে জমেছিল। তড়িঘড়ি করে সেই ধুলো দিয়ে ঢেকে
ফেলি নিজেকে। তাই ও আর আমাকে খুঁজে পায়নি। ভয় ও
আতঙ্ক গ্রাস করেছিল আমাকে। মনে হচ্ছিল, বাঁচতে পারলাম না
বুঝি। আর একটু দেরি হলে অবশ্য তাই হতো। মনে মনে
তোমাকে খুব ডাকছিলাম। একটা কথা, এর আগে বন বিড়ালটা
কখনো আমার পিছু নিতে বা কাছে আসতে পারেনি। কিন্তু এবার
পেরেছে। তার কারণটা আমি অবশ্য বুঝতে পেরেছি।
: কী? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে জেমি।
: আমরা যখন সবুজ পাথরের কাছে গিয়েছিলাম তখনি যেভাবেই
হোক, আমাদের দেখতে পেয়ে পিছু নিয়েছিল বন বিড়ালটা।
আমাদের সব কিছুই সে লক্ষ করেছে। আমরা চলে আসার পর
সেও ওই সবুজ পাথরটার কাছে গিয়েছিল। তাই আমি যেমন শক্তি
পেয়েছিলাম, সেভাবে সেও শক্তি পেয়েছিল। তারপর থেকেই
হয়ত প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পিছু নিয়েছিল আমার। সকালে আমি
মুনরক পর্বতে আসার সময় বোধ হয় আমাকে দেখতে পায়।
তারপর অনুসরণ করে এখানে এসে পৌঁছে। মনে হচ্ছে, নতুন
শক্তি পেয়ে আমার মত তারও সাহস বেড়ে গিয়েছিল। আমি বন
বিড়ালটার সবুজ চোখ দেখতে পেয়েছি।
শত্রু- কিন্তু এভাবে একজনের মুখের খাবারটা
কেড়ে নেয়া উচিত নয়। রেড তার সব কথাই
শোনে, কিন্তু এ কথাটা নয়। জেমি যতবার এটা
বলেছে ততবারই সে তাকে জবাব দিয়েছে:
সেদিনের কথা ভুলে গেছ? তুমি না গেলে কী হত
বলতো? ওই শয়তান বন বিড়ালটাকে শান্তিতে
থাকতে দেব না আমি।
ব্যাপারটা বুঝে ফেলে জেমি। যেভাবেই হোক,
রেডকে দেখতে পেয়ে পিছু নিয়েছে বন
বিড়ালটা। কারণ, সেও প্রতিশোধ নেয়ার পথ
খুঁজছিল। তবে প্রচ- আওয়াজটা কিভাবে হল,
বুঝতে পারছে না সে। কে জানে, এতক্ষণে কী
হল। দ্রুত পর্বতে উঠতে শুরু করে জেমি।
বন বিড়ালটার পায়ের হালকা ছাপ ধরে এগিয়ে
চলে জেমি। মাঝে মাঝে শুধু পাথর। তাই তার
পায়ের ছাপ হারিয়ে ফেলল সে, আবার খুঁজে
পেল। অবশেষে পর্বতের এক জায়গায় পৌঁছে
দেখল, বেশ কিছু পাথর ছিটকে পড়েছে হঠাৎ
করে। তা দেখে ওপরের দিকে তীক্ষè চোখে
খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকে জেমি। এক
পলকের জন্য একটা পাথরের আড়ালে দুটি সবুজ
চোখ দেখতে পেল বলে মনে হলো তার।
এখানেই, তার মন বলল, এখানেই আছে রেড।
কিন্তু সে আকাশে ওড়েনি কেন? তার অর্থ আহত
হয়েছে সে। সম্ভবত আহত হয়ে লুকিয়ে আছে।
রেডকে পাগলের মত চারদিকে খুঁজতে থাকে
জেমি। কিন্তু পায় না। হঠাৎ তার মাথায় একটা
বুদ্ধি আসে। চট করে একটা ছোট পাথর শুঁড়ে
তুলে ছুড়ে দেয় যাতে সে শব্দে রেড তার
উপস্থিতির কথা বুঝতে পারে। এ কৌশলে কাজ
হয়। সাথে সাথে জেমির উপস্থিতি টের পায়
রেড। ধুলো ভরা মাথা উঁচু করে বাইরের দিকে
তাকিয়ে বন্ধুকে দেখতে পায়। খুশিতে ডাক ছাড়ে
দু’বার। দ্রুত জেমি পৌঁছে যায় গুহার সামনে।
গুহার ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে রেড। তার মানে
ঘটনা খুব খারাপ। তার হঠাৎ পাওয়া শক্তিটা
মনে হয় ফুরিয়ে গেছে। নইলে তার তো অদৃশ্য
থাকার কথা। কিন্তু জেমি এখন দেখতে পাচ্ছে
তাকে। এ সময় চোখাচোখি হয় দুজনের। কিছু
না বলে রেড ইঙ্গিত করে জেমির পিছন দিকে।
ঝট করে পিছনে ফেরে জেমি। এখন তার
সামনেই জ্যানিস। পাজি বন বিড়ালটা এখানে
এসেছে! তাকে দেখে মাথায় আগুন জ¦লে ওঠে
জেমির। ওদিকে দু দুটো বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে
গেছে জ্যানিস। তার প্রায় সামনেই একটু দূরে
গায়ে ধুলো মেখে তাকে বোকা বানিয়ে গুহার
মধ্যে লুকিয়ে আছে রেড, অথচ সে খুঁজে পায়নি
মে ২০২০ কিশোর পাতা ২৭
: হ্যাঁ, আমিও পর্বতের দিকে তাকিয়ে এক পলক তার সবুজ চোখ
দেখেছি। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারিনি।
রেড বলে-
: যাক, শয়তানটা বোধ হয় আর কখনো আমার পিছু নিতে পারবে
না। কিন্তু আমার ডানাটা যে রকম জখম হয়েছে, আমি আর
উড়তে পারব কিনা কে জানে। এমন আঘাত আর কখনো পাইনি।
: আচ্ছা! আস্তানায় ফিরে তোমার জখম ডানার চিকিৎসা করতে
হবে। আপাতত বেশ ক’দিন আর উড়তে পারবে না বোধ হয়।
যাকগে, আমি তো আছি। এখন আমার পিঠের ওপর এসে বস
দেখি।
: তোমার পিঠে কি উঠতে পারব? দেখি চেষ্টা করে।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ভালো ডানাটি দিয়ে জেমির পিঠে উঠতে
পারল না রেড। শেষে বুদ্ধি করে শুঁড়ের ওপর নিয়ে তাকে পিঠে
তুলে নেয় জেমি। বন্ধুর এমন অসহায় অবস্থা দেখে মন খারাপ
হয়ে যায় তার। বেশ কয়েকদিন আর ওড়াউড়ি করা হবে না তার।
শিকারও করতে পারবে না। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের
বাসাতেও যেতে পারবে না সে। জেমি শুঁড় দিয়ে তাকে বড়জোর
ওকের সবচেয়ে নিচের ডালটায় তুলে দিতে পারবে। জখম সেরে
না ওঠা পর্যন্ত কষ্ট করে সেখানেই কাটাতে হবে তাকে। এ সময়টা
তাকে দেখাশোনা করতে হবে জেমিকেই। সে না হয় করল। কিন্তু
রেডের খাবার কোথায় পাবে সে? ঈগলরা তো তার মত গাছ-পাতা
খায় না। ওরা হচ্ছে মাংসাশী। সমস্যা তো ভালো হবে দেখছি।
আচ্ছা, আগে তো আস্তানায় যাই, পরে এ নিয়ে চিন্তা করা যাবে,
ভাবে জেমি। বলে-
: চল, আমাদের আস্তানায় ফিরে যাই এবার।
: হ্যাঁ, চল। জবাব দেয় রেড।
সাত.
আকাশে সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে। দুই বন্ধু ফিরছে বনের মধ্যে তাদের
আস্তানায়। এখন আর তাদের মনে কোনো উদ্বেগ নেই। বদমাইশ
জ্যানিস আর কখনো রেডের ওপর হামলা করবে না। উচিত শাস্তি
পেয়েছে বন বিড়ালটা। এ ধরনের জন্তুগুলো আসলে বনের শান্তি
নষ্ট করে। এখন রেড নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে বলে স্বস্তি অনুভব
করে জেমি। তবে পর্বত থেকে নেমে আসতে সে একটু ক্লান্ত হয়ে
পড়েছে। এর আগে কখনো পাহাড়ে ওঠেনি সে। আরো কিছুটা
পথ হেঁটে সামনে একটি ঘন পাতাভরা গাছ দেখতে পেয়ে তার
নিচে থামে। এ মুহূর্তে গাছের ছায়াটা ভালো লাগে রেডেরও। দু’
একটা জন্তু খানিক দূর দিয়ে যেতে যেতে তাদের দেখল অবাক
হয়ে, তবে কাছে এলো না কেউ। তা দেখে বেশ মজাই পেল
রেড। জেমির কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে সবাই।
এদিকে মনের ভেতর একটা লজ্জার অনুভূতি টের পায়। জেমিকে
এভাবে না বলে বেরিয়ে পড়ে খুবই অনুচিত কাজ করেছে। সে
হয়ত কিছু মনে করেনি, কিন্তু তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কী
ভীষণ বিপদই না হতে যাচ্ছিল আজ। উদ্বিগড়ব জেমি যেভাবে
ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার খোঁজে মুনরক পাহাড়ে ছুটে গেছে, তার
কোনো তুলনা হয় না। জেমির মনটা যে তার চেয়ে অনেক বড়
তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলেই দেহের মতই তার মনটাও
বিশাল। নিজের নয়, বন্ধু রেডের নিরাপত্তার কথা
ভাবে সে। এ রকম বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা। এ
নিয়ে দু’ দুবার তার প্রাণ বাঁচাল জেমি। আর
কখনো এমনটা করবে না সে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা
করে। এদিকে রেড এতক্ষণে নিশ্চিত হয়েছে যে
সবুজ আলোর যে শক্তিটা হঠাৎ করে সে
পেয়েছিল, সেটা আর এখন নেই। সেই আগের
অবস্থায় সে ফিরে গেছে। এভাবে শক্তি পাওয়া ও
তা হারিয়ে ফেলার কোনো ব্যাখ্যা তার জানা
নেই। বস্তুত হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা
এটা। এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই আর। নরম
গলায় বলে রেড-
: জেমি, একটা প্রতিজ্ঞা করেছি আমি।
: প্রতিজ্ঞা? কী প্রতিজ্ঞা? কেন?
: আমি বুঝি প্রতিজ্ঞা করতে পারি না?
: হ্যাঁ নিশ্চয়ই পার। কিন্তু কী কারণে তাই তো
বুঝতে পারছি না।
: তুমি শুনবে কিনা তাই বল।
: বল, কী সেটা?
: প্রতিজ্ঞাটা হচ্ছে আর কখনো তোমাকে না বলে
আর সাথে না নিয়ে বনের বাইরে কোথাও যাব
না।
তার প্রতিজ্ঞার কথা শুনে হেসে ফেলে জেমি-
: ঠিক আছে, ঠিক আছে। করেছ যখন তখন
প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখ। একটা কথা। দুনিয়াটা
অনেক বড়। কত কী আছে এখানে।
আনন্দ-উল্লাস-খুশি-সুখ যেমন আছে তেমনি
বিপদ-আপদ-সমস্যা-দুঃখ আছে। সব সময় সব
কিছু একা সামাল দেয়া যায় না। সম্ভব না। তাই
একা একা না ঘুরে দুজন মিলে ঘুরলে ক্ষতি কী?
প্রয়োজনে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারি। এর
পর যদি দূরে কোথাও যেতে হয় তাহলে
একসাথেই যাব আমরা, কেমন?
জেমি আন্তরিকভাবেই কথাগুলো বলেছে বোঝা
যায়। তার কথায় খুশি হয় রেডও। ভাবতে থাকে
সামনের দিনগুলোর কথা। সে নিজে কোনো
ডরপুক প্রাণী নয়, তার ওপর জেমির মত বন্ধু
আছে তার। তেমন কোনো অসুবিধা হবে না
হয়ত।
গজগমনে এগোয় জেমি। পিঠে বসে দুলতে
থাকে রেড টেইল।
*লেখিকা এলাইস কুক (ঊষরংব ঈড়ড়শ)-এর জন্ম
১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের
মিশন ভিয়োজোতে। তিনি ইন্টারনেটে কিশোরদের
জন্য গল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার এ ছোট
উপন্যাসটির মূল নাম ‘মাইট অব দি মিটিওর
(গরমযঃ ড়ভ ঃযব সবঃবড়ৎ)’ ‘বন্ধু’ নামে তা অনুবাদ
করা হলো।

Share.

মন্তব্য করুন