করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ জিসানের। স্কুল আর কোচিংয়ের ব্যস্ততা নেই। তবে বাসায় নিয়মিত ক্লাসের লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ যেমন ছোটদের বিশ্বনবী সা. সহ নবী-রাসূলদের জীবনী পড়ে ফেলেছে জিসান। বইগুলো জোগান দিয়েছে তার বন্ধু জিহাদ। ওরা একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। জিহাদদের বাড়ি জিসানদের একই মহল্লায়।
সন্ধ্যা হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মাগরিবের আজান ভেসে আসছে পাশের মসজিদ থেকে। জিসানের আব্বা অফিস থেকে বাসায় ফিরে জিসানকে বাসায় না পেয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেলেন। এখন সময়টা ভালো নয়, সবার হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা, সেই সময়ে জিসান বাইরে থাকবে কেন? জিসানের আব্বা এহসান আলী চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন তার স্ত্রী শিরিন বানুর সঙ্গে। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন- তুমি ছেলের দিকে লক্ষ রাখতে পারো না। এখন সময়কাল খারাপ। সারাদেশে করোনা আতঙ্কে মানুষ ঘর হতে বের হতে পারছে না। বিশ্বজুড়ে মানুষ মরছে লাখে লাখে। এই সময় তোমার ছেলে ঘরের বাইরে থাকবে কেন? কেন তুমি ওকে সামলাতে পারো না? অভিযোগের পাহাড় তার। এহসান আলী রাগে কাঁপছেন। শিরিন বানু তাকে শান্ত হতে বলছেন। স্বাভাবিক হতে বলছেন। কিন্তু তিনি স্বাভাবিক হতে পারছেন না।

শিরিন বানু স্বামীর কাছে যেয়ে বলল, মাগরিবের সময় অযথা চেঁচামেচি শুরু করেছে কেন? তুমি তো জানো, আমাদের জিসান তেমন ছেলেই নয়, যে কোন অঘটন ঘটিয়ে বসবে।
এহসান আলী তার স্ত্রীর কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। বরং ছেলের উচ্ছন্নে যাওয়ার পিছনে তাকেই বেশি করে দুষলেন।
মাগরিবের আজান শেষ হলো। ধীরপায়ে বাসায় ফেরে জিসান। আব্বাকে দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে সে। না জানি তার কপালে কী লেখা আছে, জিসান ঘামছে। জিসানকে দেখে এহসানের রাগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। মেঘের মত গর্জন করে এহসান আলী বলেন, ‘দাঁড়াও’-
জিসান আর এগোতে পারে না। এবার রীতিমত কৈফিয়তের ভঙ্গিতে এহসান আলী বলতে শুরু করেন-
এই দুর্যোগ মুহূর্তে তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তোমার না বাসার বাইরে যাওয়া বারণ? জিসান বলল- জিহাদদের বাসায় গিয়েছিলাম।
কেন, জিহাদদের বাসায় গিয়েছিলে কেন?
একটা জরুরি কাজ ছিল।
কি এমন জরুরি কাজ তোমার?
আমাদের একটা জরুরি মিটিং ছিল আব্বা। ছেলের কথা শুনে আরো রেগে যান এহসান আলী। তিনি বলেন, এই বয়সে আবার তোমাদের কিসের মিটিং? যেখানে সরকার করোনার প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সেখানে তুমি আইনের বেড়াজাল ভেঙে কেন মিটিং করতে গেছ? আর কিসের এমন মিটিং ছিল তোমার?জিসান নিরুত্তর।
এহসান আলী শিরিন বানুকে বললেন-
‘জানিতো তোমার আশকারায় ছেলে গোল্লায় গেছে। তোমার ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। জিসানের আম্মা ওকে জিজ্ঞাসা করো নইলে কিন্তু আমি ওকে আস্ত রাখবো না।
এবার শিরিন বানুও রেগে যেয়ে জিসানকে বলল-
কি হলো, তোমার কথা কানে যাচ্ছে না, বলতে পারছো না, তোমার কিসের মিটিং ছিল? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তুমি আমাদের এমন অবাধ্য সন্তান হবে ভাবতেও পারিনি।
এবার জিসান বলল- তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না আম্মা। আমি তোমাদের মোটেও অবাধ্য সন্তান নই।
‘তাহলে সব কিছু খুলে বলছো না কেন? কেন আমাদের আবছা অন্ধকারের মধ্যে ফেলে রেখেছো?’
জিসান বলল- ‘সব আমি তোমাদের খুলে বলবো, আগে মাগরিবের নামাজটা আদায় করে নেই।’
রাগে- ক্রোধে এমন অন্ধ হয়ে ছিলেন, নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল ছিল না এহসান আলীর। শিরিন বানুরও একই অবস্থা। জিসানের কথায় সম্বিত ফিরে পায় এহসান আলী। সত্যিতো তাদের বড় একটা ভুল হয়ে যাচ্ছিল। সবাই ওজু করে নামাজ পড়তে যায়।

জিসান ভাবলো, আল্লাহই সব কিছুই সমাধানের মালিক। তাঁর রহমত হলে কঠিন বিপদ থেকেও মুক্তি সম্ভব। জিসান নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে বলল, হায় পাক পরোয়ার দেগার তুমি আমার আব্বা-আম্মার দিলকে নরম করে দাও, তারা যেন জিসানকে ভুল না বোঝে। জিসান নামাজ শেষ করে মুুনাজাতে অনেকক্ষণ চোখের পানি ছেড়ে কাঁদলো।
মিটিং আহ্বান করেছে স্বয়ং জিসানই। স্থান জিহাদদের বাসা। এক এক করে জিহাদ, জিসান ছাড়াও আরিফ, শোভন, পলাশ, লিয়াকত, কবীরসহ আরো অনেকেই মিটিংয়ে সমবেত হলো। জিসানের সভাপতিত্বেই মিটিং শুরু হলো। মিটিংয়ে উপস্থিত সদস্যবৃন্দ সবাই জিসানের সহপাঠী। কেউ কেউ আবার তার চেয়েও বড় ক্লাসে পড়ে।আলোচনায় একটি বিষয়ই স্থান পেল। আর তাহলো করোনাকালে অসহায়-দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো। জিসানদের বাসার পাশেই একটি বস্তি আছে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো তারা সেই বস্তির অসহায় মানুষদের আর্থিক সহযোগিতা করবে। না হলে সামর্থ্য অনুযায়ী চাল-ডাল আর আলুর প্যাকেট তুলে দেবে তাদের হাতে।
শোভন বলল- আমরা টাকা পাবো কোথায়?
পলাশ তার মতামত উপস্থাপন করে বলল, আমরা সবাই এক শ’ করে টাকা দিয়ে একটি ফান্ড তৈরি করতে পারি।
তোতন বলল, তাতে খুব বেশি হলে হাজার দুয়েক টাকা হতে পারে। তাতে তো কিছুই হবে না।
লিয়াকত বলল, আমরা ছাত্র মানুষ। আমাদের হাতে তো বেশি টাকা পয়সা থাকার কথা নয়। আর গার্জিয়ানদের বললেও তো তারা পজিটিভ নাও নিতে পারেন।

আরিফ বলল, ‘আমরা কি তাহলে অসহায় মানুষের পাশে এসে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারবো না?’
কবীর বলল, ‘খালি হাতে যেয়ে আমরা তাদের পাশে কিভাবে দাঁড়াবো?’
জিহাদ সবাইকে সাহস জুগিয়ে বলল, তোমরা ভয় পেয়ো না বন্ধুগণ। বিপদে ধৈর্য্য হারাতে নেই। আর সবকিছুর ফয়সালা মাবুদের হাতেই। এখন আমাদের আজকের এই আয়োজনের সভাপতি জিসানের কাছ থেকে কিছু কথা শুনতে চাই।
জিসান সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘বন্ধুগণ, তোমাদের সব কথা আমিও শুনেছি, সবাই খুব যুক্তি ও তর্কের কথা বলেছ। আসলে আমরা সবাই কেউ সিক্স অথবা সেভেনের ছাত্র। আমাদের হাতে তেমন ক্যাশ ক্যাপিটাল থাকার কথাও নয়। আবার আমরা অসহায় মানুষের পাশেও দাঁড়াতে চাই।’
সবাই বলল, কিভাবে?

জিসান সাহস নিয়ে বলল, পথ একটা খোলা আছে- সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো জিসানের দিকে এবং তারা বলল-
দয়া করে সেই পথের কথাটা আমাদের বলো। এবার জিসান বলল, বন্ধুগণ পথটা হচ্ছে, সামনে আমাদের পবিত্র ঈদ। এই ঈদে আমরা কেউ নতুন জামা-প্যান্ট-জুতা নেবো না। আমরা গার্জিয়ানদের কাছে সেই পরিমাণ অর্থের জন্য আবেদন বা আবদার করবো।
পলাশ বলল,
‘তারা যে আমাদের এই আবেদন রাখবেন এর কোন গ্যারান্টি আছে?
জিসান বলল, তাদের ভালোভাবে বুঝাতে পারলে তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন। আর কেউ যদি বোঝাতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা সবাই মিলে যাবো তার কাছে।
সবাই বললো, জিসানের প্রস্তাবটি মন্দ নয়। চেষ্টা করলে অবশ্যই আমরা ভালো ফল পেতেও পারি। মিটিংয়ের কাজ শেষ করে যে যার মত বাসায় ফিরে গেল।

ছেলের গল্প শুনে এহসান আলী রীতিমত ‘থ’ বনে গেলেন। তিনি বললেন, যে কাজটি আমরা করতে পারলাম না, সেই কাজটি আমাদের ছেলেরা করতে যাচ্ছে। তাও আবার অভিনব পন্থায় ঈদের কেনাকাটার খরচ বাঁচিয়ে।এহসান আলী বললেন, আমি না বুঝে তোমাকে অনেক বকেছি, এখন দেখছি, তুমি মন্দ কিছু করনি। যাও আমি তোমাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি। তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে বস্তিবাসীদের পাশে যেয়ে দাঁড়াও।
শিরিন বানু আনন্দে কেঁদে ফেলল। গর্ব ভরে বলল- বলেছিলাম না, আমাদের জিসান কোন অন্যায় কাজ করতে পারে না। তুমি তো আমার কথা শুনতেই চাওনি।
জিসানের চোখে পানি, এ পানি আনন্দের। এশার আজান ভেসে এলো পাশের মসজিদ থেকে। জিসান ওজু করে নিলো।
সে নামাজে আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করবে। আল্লাহ তার মুখ রেখেছেন, সে এখন তার সাথীদের নিয়ে করোনায় আক্রান্ত অসহায় মানুষের পাশে যেয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে।

Share.

মন্তব্য করুন