সারাক্ষণে কনকনে বাতাস বইছে। একেবারে শরীর
জমে যাবার মতো অবস্থা। স্কুয়া পাখিদের তীক্ষè ডাক
শোনা যায়।
সে দেশের বিশাল প্রান্তরে দেখা যায় বরফের আচ্ছাদন।
সেই শক্ত চাঁই-এর মতো জায়গার কোথাও কোথাও
ফাটল রয়েছে। সেই ফাটলের নিচের টলটলে হিমশীতল
পানিতে থাকে ‘সিল’রা। তারা অনেকক্ষণ পর্যন্ত পানির
নিচে ডুবে থেকে শ্বাস নেয়ার জন্য মাঝে মাঝে ফাটলের
গর্ত দিয়ে ওপরে মাথা তোলে।
এস্কিমোরা সেই সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকে। তাদের
একটি ভীষণ প্রিয় কাজ হচ্ছে সিল শিকার। তারা এই
সিলকে শিকার করে হারপুন নামের এক ধরনের বল্লম
দিয়ে।
ফাটলের নিচ থেকে যখন সিলেরা মাথা তোলে তখন
তার সেই সুযোগটাকে ব্যবহার করে। সিলকে তাক করে
নিপুণ ভঙ্গিতে ছুড়ে মারে ধারালো হারপুন। হারপুনের
পেছনে দড়ি বাঁধা থাকে। আর হারপুনটা যখন শাঁ করে
গিয়ে সিলকে বিদ্ধ করে তখন দারুণ খুশি হয়ে ওঠে
এস্কিমো শিকারিরা। হারপুনের সাথে লাগানো দড়ি ধরে
জোরে টান দিয়ে বরফের আস্তরণের নিচ থেকে সিলকে
টেনে হিঁচড়ে তুলে আনে। থলথলে প্রাণী সিলের
শরীরের মাংস চাক চাক করে কেটে নেয়। সেই মাংস
হচ্ছে তাদের নিকট একটি সুস্বাদু খাবার।
সে অনেক কাল আগের কথা।
এক বুড়ো এস্কিমোর ভারী শখ ছিল সিল শিকারের।
সিল শিকারের জন্য সে অধীর হয়ে থাকত। হারপুন
নিয়ে সে প্রায় সময়ই বরফের ধুধু প্রান্তরে ছোটাছুটি
করত। কিন্তু দুঃখের বিষয়টা হলো যে বুড়ো লোকটি
কখনও সিল শিকার করতে পারত না। সিল শিকার
করার কোনো কৌশলই তার জানা ছিল না। এ বিষয়ে
একেবারেই অদক্ষ ছিল সে।
বুড়ো লোকটি বরফের ফাটলে ভুঁশ করে মাথা উঁচু করা
সিলকে দেখামাত্রই হারপুন ছুড়ে মারে কাঁপা কাঁপা
হাতে। কিন্তু সিলকে বিদ্ধ করতে সে সবসময়ই ব্যর্থ
হয়।
বুড়ো এস্কিমোর এভাবে সিল শিকার করতে না পারার
বিষয়টি এস্কিমো সমাজে ছিল কৌতুকের বিষয়। তারা
এ নিয়ে ঠাট্টা মশকারা করত। এতে আবার সবচাইতে
বেশি করে মজা পেত শিশুরা।
তারা বুড়োর এমনতর কা–কারখানা দেখে খিলখিল
করে হেসে উঠত। সিল শিকার করতে না পারলে বুড়ো
তিড়িং করে লাফাত। শিশুদের মজা আর ধরে না। তারা
দলবেঁধে বুড়োর পেছনে পেছনে ছুটতে থাকে।
হাততালি দিয়ে বলে, ‘দুরো দুরো, এই বুড়োটা সিল
শিকার করতে পারে না।’
এ দিকে এস্কিমো শিশুদের মুখে এমন কথা শুনে বেজায়
রকমের রেগে যায় বুড়োটা। চটেমটে যায়। রাগি বুড়ো
তখন দুষ্টু শিশুদের ধরতে চায়। কিন্তু ঐ রকম দুরন্ত,
চঞ্চল শিশুদের সাথে দৌড়ে বুড়ো পারবে কেন? বরফের
প্রান্তরে বুড়োর অমন ছুটোছুটি শুধু বৃা যায়। বুড়ো
কখনও ঐ শিশুদের আর ধরতে পারে না। এই দুঃখে
বুড়ো শুধু ছটফট করে।
একদিন হয়েছে কি- সেই লোভী বুড়োটা সিল শিকার
করার জন্য একটি বড় ফাটলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কোনোভাবেই সে কিছু করতে পারছে না। সিলকে
হারপুন বিদ্ধ করতে সক্ষম হচ্ছে না। আর সিলগুলোও
যেন বুড়োর সাথে মজার এক খেলায় মেতে উঠেছে।
সিলগুলো বারবার করে মাথা তুলছিল আর ভুঁশ ভুঁশ
করে ডুব দিচ্ছিল। বুড়ো জুলজুল করে তাকিয়ে দেখতে
পাচ্ছে যে কেমন করে সিলেরা হারিয়ে যাচ্ছে বরফের
নিচে। বুড়ো কিন্তু মোটেই দমে যাবার পাত্র নয়। সেও
মরিয়া হয়ে সিলদের লক্ষ্য করে চকচকে হারপুন ছুড়ে
মারছে। কিন্তু একবারের জন্যও তার ছুড়ে দেয়া বল্লম
সিলের শরীরকে বিদ্ধ করতে পারছে না। ফসকে যাচ্ছে।
অথচ এই বুড়ো লোকটি কিন্তু তার যুবা বয়সে প্রচুর
সিল শিকার করেছে। সিল শিকার তার কাছে ভয়ানক
নেশার মতো ছিল। তখন এস্কিমো সমাজে সিল শিকারি
হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। যে কারণে এই বার্ধক্যকালেও
সে হারপুন বাগিয়ে এমনভাবে ছুটোছুটি করে। তবে
শিশুদের কাছে সে এখন উপহাসের পাত্র। তাকে নিয়ে
রসিকতা করে। তাকে ‘দুয়ো’ দেয়। একটা বোকাটে
আর খ্যাপাটে লোক বলে মনে করে।
শেষ পর্যন্ত বুড়ো ঐ দুরন্ত শিশুদেরকে শায়েস্তা করার
জন্য মাথা খাটিয়ে একটা বুদ্ধি বের করল। সে শিশুদের
নিকটে গিয়ে ভালোমানুষির মতো বলল, ‘তোমরা কিন্তু
আবার ভেবো না যে আমি তোমাদের ওপরে রাগ
করেছি। আসলে মোটেও রাগ করিনি। তোমাদের কারো
প্রতি আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। আসলে আমি যে
তোমাদের অনেক বেশি ভালোবাসি। তোমরা হয়তো
আমার তোমাদের দিকে ছুটে যাওয়াটাকে দেখে ঘাবড়ে
যাও। ভাবো এই বুঝি আমি তোমাদেরকে খপ খপ করে
ধরে ফেলব। আমি তো চাই তোমাদের আদর সোহাগ
করতে। আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন কিন্তু তোমাদের
কথা ভেবে আমার মনটা উতলা হয়ে ওঠে।
বুড়োর এরকম নরম সুরের কথা শুনে শিশুদের দলটি
আশ্চর্য হয়ে যায়। এ তারা বুড়োর কাছ থেকে কী
শুনছে! সোহাগ যেন ঝরে পড়ছে।
বুড়ো ঝুঁকে শিশুদের মাথা উসুখুসু চুলগুলো টেনে দিয়ে
বলে, ‘বুঝতে পেরেছি আমি এখন একদম থুরথুরে বুড়ো
হয়ে গিয়েছি বলে আর সিল শিকার করতে পারি না।
সেই কৌশলটাওতো জানা নেই। আর তোমরাও
আমাকে শুধু শুধু রাগিয়ে দাও। আমি বুঝি এই বয়সে
মাথা ঠিক রাখতে পারি। তাইতো রেগে যাই।
শিশুদলের নেতা বলে, ‘আরে তুমি হলে গিয়ে একজন
মে ২০২০ কিশোর পাতা ১৩
বুড়ো মানুষ। তোমার তো মেলা বয়স হয়েছে। বুঝলে,
সিল শিকার করা কিন্তু তোমার কাজ না। আর তুমি
যেভাবে হারপুন বল্লমটাকে বাগিয়ে নিয়ে ছুটে যেতে
থাকো, সেটা দেখলেইতো আমাদের হাসি পায়। বুড়ো
তখন শিশুদের আরো বেশি
করে আদর করে। বলে, ‘এই
যে তোমাদের রোজ বরফের
ওপরে ছোটোছুটি করে খেলতে
দেখি তা দেখে আমার ভারি
কষ্ট হয়। ওভাবে দৌড়ে যাবার
সময় যদি হঠাৎ করে কারো পা
পিছলে যায় তাহলো তো
তোমরা অনেক ব্যথা পাবে
সোনা! আমি যে তোমাদের
এমন কষ্ট নিজ চোখে
একেবারেই দেখতে পারব না।
আমর বুকটা ফেটে যাবে।’
এক শিশু বলে, ‘এখানে সব
জায়গাতেই তো বরফ রয়েছে।
সমস্ত পথ-মাঠ-ঘাট কিনা বরফে
ঢাকা। আমরা তাহলে করবোটা
কী? তাহলে আমরা কি
খেলাধুলা ছেড়ে দেবো?’
এমন কথা শুনে মাথা নাড়ে
বুড়ো।
খেলাধুলা ছেড়ে দেবে মানে! এটা কখনও হতে পারে
না। এর ফলে তো ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে। শিশুরা
যদি খেলাধুলা ছেড়ে দেয় তাহলে তো সাংঘাতিক ক্ষতি
হয়ে যাবে। এটা কখনও হতে দেয়া যাবে না।
তোমাদের অবশ্যই খেলাধুলায় মত্ত থাকতে হবে। সর্বদা
খেলাধুলা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
শিশুদের দলটি বুড়োর কথায় মাথা নাড়ে। ওরা এ
কথাটি ভালো করেই বুঝতে পারছে যে বুড়োটা তাদের
ব্যাপার নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করছে। ভাবছে।
শিশুরা তখন ব্যাকুলভাবে জানতে চাইছে, ‘তাহলে বলো
আমরা খেলবোটা কোথায়?’
বুড়ো হাসি মুখে বলে, ‘কোথায় তোমরা খেলবে সেটা
জানতে চাইছ?’ আমি এখন তোমাদেরকে সেই
জায়গাটাকেই চিনিয়ে দিতে চাই যেখানটায় ছেলেবেলায়
আমরা খেলতাম। সেটা হলো গিয়ে স্বপেড়বর মতো সুন্দর
একটি জায়গা। যার চারদিকে রয়েছে পাহাড়। তাই তীব্র
শীতের বাতাস পাহাড়ে বাধা পায় বলে সেখানে ঢুকতে
পারে না। সেখানে মাথার ওপরে রয়েছে পাহাড়ের ছাদ।
যার জন্য সেখানে বরফ আর জমতে পারে না। সারা
দিন ধরে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করলেও পা পিছলে পড়ে
যাবার কোনো ভয় নেই।
বুড়ো এস্কিমোটা খুব উৎসাহের সাথে শিশুদের কাছে ঐ
রকম একটা স্বপেড়বর মতো জায়গার কথা শোনাচ্ছিল।
আর বুড়োর মুখে এমন সুন্দর একটি স্থানের কথা
শোনার পর শিশুরা উল্লসিত হয়ে ওঠে। তাদের আনন্দ
যেন আর ধরে না। তাদের চোখ-মুখ চিকচিক করছে।
বাস্তবে এ রকম জায়গাও আছে তা হলে!
ঐ বুড়োটা ছিল ভীষণ মিথ্যেবাদী আর মন্দ একজন
মানুষ। খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক ছিল সে।
বুড়োটা শিশুদের কাছে ডাহা মিথ্যে কথা শোনাচ্ছিল।
আর এরকম করে বলতে তার আটকাচ্ছিল না। গলা
কাঁপছিল না।
আসলে বুড়োর বর্ণিত সে রকম স্থান ছিল না। কিন্তু
সহজ, সরল শিশুরা বুড়োর ঐ রকম ভয়ঙ্কর মিথ্যে
কথাটা মোটেই ধরতে পারল না। তাদের মধ্যে কোনো
রকম অবিশ্বাস জাগল না। সন্দেহ হলো না। বুড়ো
তাদের চোখে স্বপড়ব ঘনিয়ে তুলছিল।
তারা এ কথা অতি সহজেই বিশ্বাস করে ফেলল যে
আসলেই বোধ হয় ঐ রকমের একটি জায়গার সন্ধান
বুড়োটা ভালো করেই জানে। যেখানটায় যাওয়ার জন্য
তাদের সকলের মন আকুলি-বিকুলি করে উঠল। তাদের
কাছে মনে হলো, আহা! কী যে মজা হবে সেখানে
একবার যেতে পারলে। বুড়োর ছলচাতুরী তাদের কাছে
অজানা রইল। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে বুড়োকে বলল,
‘আমাদেরকে তুমি ওখানে নিয়ে যাবে? আমরা সবাই যে
সেখানে যেতে চাইছি। এখনই যেতে চাইছি।’ বুড়ো
বুঝল শিশুদলটির আর তর সইছে না। তার ফাঁদে তারা
পা দিয়েছে।
বুড়ো হেসে বলে, ‘যেতে যদি চাও তাহলে এখনই চলে
এসো আমার সাথে। আমি তোমাদের অবশ্যই সেখানে
নিয়ে যাব। আমি চাইছি তোমরা যেন হাসিখুশিতে
ভরপুর থাকো।’
শিশুদের দলটি খুশিতে বাগবাগ হয়ে বলে, ‘আমরা
সবাই যাব তোমার সাথে।’
বুড়ো উচ্ছল শিশুদের দলটিকে নিয়ে পথ চলা শুরু
করল।
তারা পথ চলছে তো চলছেই। কিন্তু পথ যেন আর শেষ
হয় না। পথ ফুরোয় না। এভাবে চলতে চলতে তারা
তিনটি ছোট লাল পাহাড় পার হলো।
বুড়ো জানাল, পথ এখনও শেষ হয়নি। আরো সামনে
যেতে হবে।
এরপর দলটি একটি বড় পাহাড় পার হলো। এতোটা
লম্বা পথ চলার জন্য শিশুরা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
তাদের পা ব্যথায় টনটন করছে। শরীর অবশ হয়ে
আসছে।
শিশুরা তখন বুড়োকে জিজ্ঞেস করে, ‘আর কতো দূর
যেতে হবে দাদু? আর তো পারছি না।’
বুড়ো তাদের আশ্বস্ত করার জন্য বলে, ‘এইতো আমরা
এসে গেছি। সামনের পাহাড়টার ওপাশেই রয়েছে সেই
জায়গাটি।’
শিশুরা বুড়োর ছলচাতুরী বুঝতে পারল না। তারা
জানলই না যে বুড়োটা কী রকম ধাপ্পা দিয়ে তাদেরকে
এখানে নিয়ে এসেছে।
পাহাড়ের ওপাশে গিয়ে শিশুরা অবাক হয়ে দেখল
মস্তবড় একটা গুহা।
বুড়ো তাদের তাগাদা দিতে থাকে।
‘তোমরা সবাই এই গুহার ভেতরে ঢুকে পড়। শিগগির
করে।’
বুড়োর কথা শুনে তখন ভীষণ
ভয় পেয়ে যায় শিশুরা। কারণ
গুহাটিকে তাদের কাছে বেশ
ভীতিজনক বলে মনে হয়।
গুহার ভেতরটা ঘন অন্ধকার।
কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আর অন্ধকার মানেই তো হলো
ভয়।
টুকটুকে লাল জামাপরা একটি
মেয়ে আঁতকে ওঠে বলে, ‘ওমা!
এই গুহার ভেতরটাকে বিচ্ছিরি
লাগছে। কি ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তুমি না বলেছিলে যে
আমাদেরকে একটা ভীষণ সুন্দর
জায়গায় নিয়ে আসবে। সেটা
কি এটা?
বুড়ো থতমত খেয়ে বলে,
‘আরে না না। এটা কেন সেই
জায়গা হতে যাবে! এই
আঁধারটুকু পেরুলেই রয়েছে
আলো ঝলমলে এক মাঠ।
সেখানে সোনালি আলো ঝকমক করছে। এক টুকরো
বরফও যে সেখানে নেই। একবার তোমরা সেই
চমৎকার দৃশ্যটা ভাবো।’
ওপাশ থেকে একটি ছেলে বলে, ‘ও দাদু, আমার কেমন
জানি ভয় ভয় করছে। সামনের দিকে আর যেতে চাইছি
না। আমার বুক কাঁপছে।’
ছেলেটির কথা শুনে বুড়ো রেগে যায়। খনখনে গলায়
বলে, ‘ভিতু ছেলে। এটুকু অন্ধকারকে এমন ভয়
পাওয়ার কী আছে? আমি বুঝতে পারিনি যে এমন
একটা ভিতুর দলকে এখানে নিয়ে এসেছি। ভেবেছিলাম
তোমরা আলো ঝলমলে মাঠে যেতে চাও। সে জন্যই
তো এতো কষ্ট করে আসা। এখানে তোমাদের ভয়
পাওয়ার মতো কিছু নেই।
বুড়োর μমাগত তাগাদায় শিশুরা তখন গুটি গুটি পায়ে
গুহার ভেতরে ঢুকল। ঐ রকম জমাট বাঁধা অন্ধকারে
ঢুকতে তাদের বুক ঢিবঢিব করছে। শিশুরা গুহার
ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে বুড়ো এক কা- করল! বড়
একটা পাথর এনে ভালো করে বসিয়ে দিল গুহার মুখে।
পাথরটা বেশ শক্ত হয়ে লেগেছে। শিশুরা ওটাকে
কোনোভাবেই সরাতে পারবে না। বুড়ো এ রকম
ভয়ানকভাবে গুহার ভেতরে শিশুদের আটকে দিল।
তারা এখান থেকে আর বেরুতে পারবে না। বুড়ো ভাবে
দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলোকে সে এবার উচিত শিক্ষা দিতে
পারবে। তাদের কঠিন শাস্তি হয়েছে।
নিষ্ঠুর বুড়োটি শিশুদের গুহাতে আটকে রেখে চলে যায়।
এদিকে শিশুদের করুণ অবস্থা। ভয়ে আতঙ্কে তারা
অস্থির হয়ে পড়ল। বুড়োটা কিনা তাদের এমন ভয়ঙ্কর
অবস্থায় ফেলল।
শিশুরা বুঝল বুড়োকে উপহাস করার জন্য সে চটে গিয়ে
তাদের এমন শাস্তি দিয়েছে।
শিশুরা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তারা চিৎকার করে
বলে, ‘ও বুড়ো দাদা, তুমি আমাদের ক্ষমা কর। আমরা
আর সিল শিকার করতে না পারার জন্য তোমাকে নিয়ে
মশকারা করবো না। বাঁচাও আমাদের। এখান থেকে
বের করো।’
কে শোনে শিশুদের কানড়বা। বুড়োটা ততক্ষণে তার
বল্লমটাকে নিয়ে আবার সিল শিকার করার জন্য চলে
গেছে।
গুহার ভেতরে শিশুদের কানড়বা তখন আশ্চর্য শব্দ তুলে
ঘুরে বেড়ায়। গুহার দেয়ালে কানড়বার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়
গমগম করে। এতে আরো ভীতিজনক পরিবেশের সৃষ্টি
হয়।
গুহার উপরে ছিল একটা ছোট ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে
দিনের বেলায় গুহার ভেতরে অল্প আলো আসত।
শিশুদের কানড়বার শব্দ সেই ছাদের ফুটো দিয়ে বাইরে
যায়।
এক ঝাঁক পাখি গুহার উপর দিয়ে ডানা মেলে উড়ে
যাচ্ছিল। তাই সাঁই সাঁই করে উড়ছিল। উড়ো পাখিরা
শিশুদের কানড়বার শব্দ শুনতে পায়। পাখিদের দলনেতা
বাকি পাখিদের জানায় বিষয়টা বুঝতে। তারা তখন
আকাশ থেকে নেমে এসে গুহার ছাদে বসে। ফুটোর
পাশে বসে পাখিরা কান পাতে। তারা কানড়বার শব্দ শুনতে
পাচ্ছে। পাখিরা ফুটো দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে শিশুদের
দেখতে পায়। পাখিদের দলনেতা অন্য পাখিদেরকে
জানাল, এখানে শিশুদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে আটকে
রাখা হয়েছে। গুহার মুখটাকে পাথর দিয়ে ঢেকে ফেলা
হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো খারাপ লোক করেছে।
আমরা তো এ পাথরটিকে সরাতে পারব না। সে রকমের
শক্তি নেই আমাদের। আর সবচাইতে বড় বিপদ হলো
যে গুহার ভেতরে কোনো খাবার নেই। তার মানে শিশুরা
না খেতে পেয়ে মারা যাবে। পাখিরা শিশুদের এ রকম
অসহায় অবস্থা দেখে কষ্ট পায়। শিশুদের প্রতি তাদের
মায়া জন্মায়। পাখিদের দলনেতা বলে, ‘আমরা যখন
বিষয়টা জেনে গেছি তখন আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে।
এখন আর আমরা এই শিশুদেরকে এখানটায় ফেলে
রেখে উড়ে চলে যেতে পারি না। যতদিন শিশুরা এখানে
আটকে থাকবে ততদিন ওদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে
হবে। তোমরা এখন ওদের জন্য খাবার নিয়ো এসো।
দলনেতার কাছ থেকে এমন আদেশ পেয়ে পাখিরা
শিশুদের জন্য খাবার আনতে উড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর
খাবার এনে সেই ফুটো দিয়ে নিচে ফেলতে থাকে। নানা
রকমের ফল আর কাঠবাদাম ছিল খাবার। অভুক্ত শিশুরা
খাবার পেয়ে খুশি হয়।
এরপর থেকে প্রতিদিনই পাখিরা খাবার এনে শিশুদের
দেয়। আর সেসব খেয়ে বেঁচে থাকে শিশুরা।
আকাশপরীদের একটি দল উড়ে যাচ্ছিল ওই পথ দিয়ে।
শিশুদের কানড়বার শব্দ শুনে তারা নিচে নেমে আসে।
আকাশপরীরা অনায়াসেই প্রবেশ করে গুহার ভেতরে।
পরীদের রয়েছে আশ্চর্য রকমের এক ক্ষমতা। তারা
আলতোভাবে ভেসে যে কোনো স্থানে চলে যেতে পারে।
গুহার ভেতরের বন্দি শিশুদের দেখে পরীদের মনে মায়া
জন্মাল।
তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা বন্দিদশা থেকে ঐ
শিশুদেরকে মুক্ত করে দেবে। পরীরা সবাই মিলে তখন
গুহার মুখ থেকে পাথরটাকে সরিয়ে দেয়। শিশুরা তখন
সেই খোলা পথ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
এদিকে শিশুদের অভিভাবকরা উদ্বিগড়ব হয়ে তাদের
সন্তানদের খুঁজছিলেন। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে তারা
একসময় ঐ পাহাড়টার কাছে চলে আসেন। তারা
অনেকের কাছ থেকেই শুনেছিলেন যে একটা বুড়োর পিছু
পিছু শিশুদের একটি দল ওদিক পানে গেছে। শিশুদের
মা-বাবারা তখন চিনতে পারলেন সেই বুড়োকে- যে
লোকটি সিল শিকারের জন্য ঘুরত।
শিশুরা তখন গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। তারা
তাদের মা-বাবাকে দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
শিশুদের কাছ থেকে জানতে পারলেন শয়তান বুড়োটার
কুকীর্তি। শুনে সকলে দারুণ রেগে যান। তারা বললেন,
ঐ বুড়োকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। ওকে ধরতে হবে।
বুড়োর খোঁজে সবাই ছুটল। ভয়ানক বিপদ বুঝতে পেরে
বুড়ো পালাল। পালিয়ে আর যাবে কোথায়? উত্তেজিত
লোকজনের তাড়া খেয়ে বুড়ো পালিয়ে যাওয়ার সময়
হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। অমনি তার ওপরে
ঝাঁপিয়ে পড়ল এস্কিমোরা। তারা বুড়োকে বেদম মারতে
লাগল। এই মন্দ লোকটি তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের
মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বুড়োর এমন করুণ অবস্থা
দেখে পরীদের মনে দয়া হলো। বুড়োটাকে এখনই
বীভৎসভাবে হত্যা করা হবে। পরীরা এরকম মর্মান্তিক
মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে চায় না। তারা এসে ছোঁ মেরে
বুড়োকে উড়িয়ে আকাশে নিয়ে গেল।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল বুড়োটাকে আকাশের কোথায়
রাখবে। পরীরানীর কথা মতো তখন এক আশ্চর্যজনক
ঘটনা ঘটল। সেই বুড়োকে রূপান্তরিত করল। তাকে
একটা শুকতারা বানিয়ে রেখে দেয়া হলো আকাশের এক
কোনায়।
সেই থেকে বুড়োটা আকাশে শুকতারা হয়ে জ্বলছে।
(উত্তর মেরুর এস্কিমোদের লোককাহিনি)

Share.

মন্তব্য করুন