ন্তরী অঝোরে কাঁদছে। অন্তরা বিষণ্ন মনে বসে আছে। মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের চিঁ-চিঁ শব্দে সাড়া দিচ্ছে। অন্তরা-অন্তরী ভেবে কোনো কূল পাচ্ছে না। কী করবে তারা। এই কাঁচা বাচ্চাদের কিভাবে সঙ্গে নেবে। ঘরে ফেরার পালা তো শুরু হয়ে গেছে। সাথীদের একটি দল ইতোমধ্যেই চলে গেছে।ওরা অতিথি পাখি। অনেকটা আমাদের দেশের সখা-সখী বা চখা-চখীর মতো। কেউ কাউকে ছাড়া বোঝে না। ওরা সাইবেরিয়ান দম্পতি। প্রচণ্ড শীত, বরফ আর তুষারপাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা শীত মৌসুমের শুরুতেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। ওদের কাছে স্বপ্নের দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের শীত ওদর খুবই উপভোগ্য। শুধু যে ওরা আসে তা নয়। ওদের মতো আফ্রিকার বহু প্রজাতির পাখি শীতকালে এদেশে আসে অতিথি হয়ে। অক্টোবরে আসতে শুরু করে, আবার মার্চের শেষের গরম পড়ার আগেই নিজ দেশে ফিরে যায়। অন্তরারা আসে ঝাঁকে ঝাঁকে, জোড়ায় জোড়ায়। এ দেশের সবুজ শ্যেমল মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ে ঠাঁই নেয়। নীল আকাশে, সবুজ ফসলের মাঠে ডানা মেলে। এবারও তার ব ̈ত ̈য় হয়নি। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে ফিরে যাবার বেলায়। ওদের ডিম দেয়ার সময় এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে। অন্তরী মার্চের প্রথমে ডিম দেয়ার তাগিদ অনুভব করে। অন্তরা কথাটা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এ কেমন কথা! এত আগে কেন? প্রকৃতি তাহলে বৈরী হলো! আমাদের ঘরে ফেরার কী হবে? প্রচণ্ড গরমে তো সব শুদ্ধ মারা পড়ব।কিন্তু করার কিছু নেই। অন্তরী ডিম দেয়ার প্র ̄‘তি নিতে থাকে। কিন্তু বাসা বাঁধবে কোথায়। চলনবিলে তো আর পাহাড় নেই। ওরা নীড় বানায় পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে। ভেজা মাটির দলা জোগাড় করে ওরা ̧হা বা পাহাড়ের ভাঁজে বাসা বানায়। শেষে একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে পায় অন্তরী। একটা পোড়াবাড়ির ভাঙা দালানের ভাঁজে নীড় রচনা করে। স্বপ্নের নীড়। অন্তরী মা হবে। আনন্দে নেচে ওঠে ওর মন। পরক্ষণেই ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে ভেবে আশঙ্কায় ভেঙে পড়ে। তারপরও আশায় বুক বাঁধে অন্তরী। নিশ্চয়ই দয়াময় আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবেন।: অনেক দিন তোমার সুরেলা কণ্ঠ শুনি না। একবার পিউ পিউ কলে গান করে ওঠো না! তোমার কণ্ঠ শুনে বাচ্চারা জানবে তুমি ওদের বাপি।: তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না অন্তরী। সামনে ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে। গ্রীষ্মের আর বেশি দেরি নেই। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এ দেশ গুলোতে তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমরা শীতের দেশের পাখি। এ গরম আমরা, না বাচ্চারা সইতে পারবে। সাথীরা প্রায় সবাই ফিরে গেছে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী করবে।: আমি মা, বাচ্চাদের ফেলে রেখে যেতে পারবা না। তুমি গেলে যাও গে।: একটু বোঝার চেষ্টা করো। সবাই মরার চেয়ে অন্তত দু’জনে বাঁচি।: আমি মা! আমি পারব না। আমাকে ও কথা বলো না। অন্তরী বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।ভোরে ঘুম ভেঙে দেখে অন্তরা নেই। অন্তরী একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে, যাক ভালোই হলো। অন্তত ও বেঁচে থাকবে। আমাদের কপালে যা থাকে তাই হবে।-অন্তরী বাচ্চাদের জন ̈ খাবারের খোঁজে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় অন্তরা যাত্রা ভঙ্গ করে বাসায় ফিরে আসে। অন্তরী স্বামীর ঘাড়ের পালকে মাথা গুঁজে হু হু করে কেঁদে ওঠে।: আর কেঁদো না। তোমাদের ছেড়ে যেতে পারলাম না। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়েও ফিরে এলাম। এখন বলো, বাচ্চারা সব কেমন আছে।অন্তরী আবার হু হু করে কেঁদে ওঠে।: দুশমন একটা বাচ্চা নিয়ে গেছে। আমি ওদের রেখে বাইরে গিয়েছিলাম। আমি ওকে রক্ষা করতে পারিনি। তুমি থাকলে হয়তো এমনটি হতো না। অন্তরার মুখে কথা নেই। শুধু মাথা নিচু করে বাচ্চা দুটোকে আদর দিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা চিঁ-চিঁ শব্দ তুলছে।সকালে হলুদবরণ রোদে বাচ্চা দুটো ডানা মেলে। ক’দিনেই বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠেছে।: এই দেখ দেখ! বাচ্চা দুটো না ঠিক তোমার গায়ের রঙ পেয়েছে। বুকের পালক গুলো কেমন কাঠবাদামি রঙের। পিঠটা কী সুন্দর নীল। লেজটা বড় হলে লালচেই হবে। তাই না!: হয়তো তাই হবে। রাতে কিছু ভেবেছ।: কী ভাবব বলো।: আমরা কিন্তু বাচ্চা দুটো ঠোঁটে তুলে নিয়ে রওনা দিতে পারি।: এটা কি সম্ভব!: হয়তো সম্ভব হয়তো বা না। চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা কী। আমরা যাত্রাবিরতি দেবো। বিশ্রাম নেব। বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে না! ̄স্বামীর কথায় অন্তরী একটু সাহস করে। ঠিক হয় সকালে খাবার সেরেই প্রথম প্রহরেই রওনা করবে ওরা। অন্তরা-অন্তরী উড়ছে। বাতাসের ঢেউ ভেঙে ভেঙে মেঘের রাজ্য পাড়ি দিয়ে। হঠাৎ আচমকা বাতাসে এক ঝাপটায় অন্তরী ভারসাম্য হারায়। ঠোঁট থেকে বাচ্চা পড়ে যায়। অন্তরা ওকে সামলাতে নিজের ঠোঁটের বাচ্চাটিও হারিয়ে ফেলে।দু’জনে উল্কার বেগে নিচে নামতে থাকে, বাচ্চাদের বাঁচাতে। হয়তো পাহাড়ের পাদদেশে গাছের কোনো পাতার ফাঁকে আটকে আছে। অন্তরা-অন্তরী দু’জনে অনেক ডাকাডাকি করে। খোঁজাখুঁজি করে। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে। অন্তরীর চোখে ঘুম আসে না, বাচ্চাদের বিয়োগ ব ̈থায়। মুখে কথা নেই। কণ্ঠে সুর নেই। অন্তরা আশার আলো জ্বালায়, “ছায়া-সুনিবিড় সবুজের দেশে কোনো এক গাছের পাতার ফাঁকে তোমার বাচ্চারা হয়তো বেঁচে আছে অথবা পাহাড়ের ভাঁজে গিরি ঝর্ণার পাড়ে খুঁজে পাব আমরা আমাদের সন্তানদের। আগামী শীতে আবার আমরা উড়াল দেবো ওই পাহাড়ে, স্বপ্নের বাংলাদেশে।অন্তরী আশায় বুক বাঁধে। ̄স্বপ্ন দেখে তার বাচ্চারা কত না বড় হয়েছে। পিউ পিউ বলে গান ধরেছে।

Share.

মন্তব্য করুন