পৃথিবীতে যতগুলো রহস্য নিয়ে এতদিন মানুষের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ও জিজ্ঞাসা ছিল, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল তার মধ্যে প্রধানতম। এটি এমন এক ধাঁধার নাম যা যুগের পর যুগ ধরে মানুষকে বিস্ময়ে রেখেছে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামটা প্রথম দেন ভিনসেন্ট এইচ গ্যাডিস, সেই ১৯৬৪ সালে। তিনি উত্তর আটলান্টিক সাগরের এক নামহীন জায়গায় অদ্ভুত সব হারিয়ে যাবার ঘটনা থেকে এ জায়গার নাম দেন বারমুডা ত্রিভুজ। জায়গাটার ক্ষেত্রফল লেখকভেদে প্রায় ১,৩০০,৩০০ থেকে ৩,৯০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার।
রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আটলান্টিক মহাসাগরের তিন প্রান্ত দিয়ে সীমাবদ্ধ ত্রিভুজাকৃতির একটি বিশেষ এলাকা যেখানে বহু জাহাজ ও বিমান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়। অনেকে এই জায়গাকে শয়তানের ত্রিভুজও বলে থাকেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল যে তিনটি প্রান্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ তার এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা আর এক প্রান্তে পুয়ের্তো রিকো এবং অপর প্রান্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপ অবস্থিত।
এই অঞ্চলের রহস্যের মূল কারণ হলো এখানে কোনও জাহাজ বা বিমান একবার প্রবেশ করার পরই তার বেতার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, দিকনির্দেশক কম্পাস ভুল দিকনির্দেশ করতে থাকে। এক সময় জাহাজটি বা উড়োজাহাজটি অদৃশ্য হয়ে যায়। যে জাহাজ বা বিমান একবার এর মধ্যে ঢুকেছে, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসবই যুগের পর যুগ ধরে ঘটছে এই রহস্যময় অঞ্চলকে ঘিরে।
সত্তরের দশকে খুব বিখ্যাত হয়ে যায় এ জায়গার নাম এবং এর ঘটনাগুলো। তখন থেকেই পাইলট আর জাহাজ চালকেরা নানা কাহিনী বলতে থাকেন এ জায়গা নিয়ে। পরে দেখা যায় বেশির ভাগই আসলে বানোয়াট কাহিনী। পঞ্চদশ শতকে যখন ক্রিস্টোফার কলম্বাস ইউরোপ থেকে আমেরিকা যান, তখন তার জার্নালে এ ব্যাপারে লিখেছিলেন। বর্তমান ফ্লোরিডা ও পুয়ের্তো রিকোর এ এলাকা যখন পার হচ্ছিলেন, তখন তার কম্পাসের কাঁটা ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল। সেখানে তিনি নাকি এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলেন। ১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর মারি সেলেস্ত নামের এক মালবাহী জাহাজ নিউ ইয়র্ক বন্দর থেকে যাত্রা করে। কিন্তু যেখানে মালামাল পৌঁছাবার কথা, সেখানে কোনো দিনই পৌঁছায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জাহাজখানা ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকায়। কিন্তু ১১ জন কর্মীর কেউ ছিল না জাহাজে। ব্যক্তিগত জিনিসপাতি, খাবার দাবার, দামি মালামাল, লাইফবোট সবই অক্ষত সে জাহাজে, শুধু মানুষগুলো উধাও। আরো অবাক ব্যাপার, প্লেটে খাবার ছিল, সেগুলোতে পচন ধরে গিয়েছিল যখন উদ্ধারকারীরা পৌঁছায়। কী এমন হয়েছিল যে খাবারের মাঝ থেকে উঠে যেতে হবে? ১৮৮১ সালে এলেন অস্টিন নামের একটি জাহাজ সমুদ্রে এক পরিত্যক্ত ভাসমান জাহাজ দেখতে পায়। জাহাজের ক্রুরা পরিকল্পনা করলো পরিত্যক্ত জাহাজের জিনিসপাতি নিয়ে নেবে।
এমন ভাবনা থেকে কয়েকজন নেমে পড়লো জাহাজটিতে। তারা ভাবছিল সেই জাহাজটিকে চালিয়ে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাবে। দুটো জাহাজ রওনা হলো একসাথেই। কিন্তু এলেন অস্টিন খুব শীঘ্রই নামহীন জাহাজটির খেই হারিয়ে ফেলল।
পরে যখন আবার খুঁজে পেলো, তখন দেখা গেল, জাহাজটি পরিত্যক্ত, তাদের নিজেদের ক্রুরাও উধাও! তখন এলেন অস্টিন থেকে বার্তা পাঠানো হলো, উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠাতে। যখন উদ্ধারকারী জাহাজ এসে পৌঁছাল, সে জায়গা অর্থাৎ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল থেকে এলেন অস্টিন ও নামহীন জাহাজ দুটোই উধাও। কোনো দিন তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কথিত আছে, অনেক জাহাজ নাকি এ দুটো জাহাজকে একসাথে ঘুরতে দেখেছে সমুদ্রে, তারা চেষ্টারত ছিল অন্য জাহাজদের পথভ্রষ্ট করতে।
১৯১৮ সালে একইভাবে কোনো চিহ্ন না রেখেই হারিয়ে যায় ইউএসএস সাইক্লপস, ব্রাজিলগামী সে জাহাজটি মার্কিন সরকার কর্তৃক ব্রিটিশদের সাহায্য করতে দেয়া হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। মার্চের ৪ তারিখে সেটিকে শেষবার দেখা যায় বারবাডোজের তীরে। ৩০৬ জন ক্রুও এর সাথে উধাও। ১৯৪১ সালেও ইউএসএস প্রোটিয়াস ও ইউএসএস নিরিয়াস একইভাবে নেই হয়ে যায়।
এবার আসা যাক প্লেনের কথায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া সবচেয়ে আলোচিত হলো ফ্লাইট নাইনটিন। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে মার্কিন নেভির পাঁচ সেরা অ্যাভেঞ্জার বম্বার একটি রুটিন মিশনে বের হয়। লেফটেন্যান্ট চার্লস টেইলর নিয়মিত কথা বলছিলেন রেডিওতে বেজের সাথে। কিন্তু হঠাৎ বাক্যের অর্ধেকেই সব চুপ হয়ে যায়। আর কোনোদিন সেই পাঁচ বিমানের দেখা মেলেনি। সেগুলোকে উদ্ধার করতে পাঠানো বিমানগুলোও ফেরেনি কোনো দিন। আর জায়গাটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। তদন্তে লেখা হয়েছিল ‘অজ্ঞাত কারণে’ তারা উধাও।
১৯৬৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ৬০০ ফুটের দানবীয় মেরিন সালফার কুইন জাহাজ তার শেষযাত্রায় রওনা দিল। ভেতরে ছিল ১৫ হাজার টন গলিত সালফার আর ৩৯ জন ক্রু। ফেব্রুয়ারির চার তারিখ পর্যন্ত জাহাজের অবস্থান জানতো সবাই, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। এরপর হঠাৎ অফ হয়ে গেলো রেডিও ট্রান্সমিশন।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছেন অনেকেই, কেউ কেউ দিয়েছেন আজব সব থিওরি। যেমন, কেউ বলেছেন এখানে শয়তানের আস্তানা, শয়তান টেনে নিয়ে যায় এসব জাহাজ আর বিমান। কেউ বলেন, এখানে আসলে এলিয়েনদের বেজ ক্যাম্প আছে; এ জন্যই এখানে অদ্ভুত আলো দেখা যায়।
এখানে ঢুকলে কম্পাস কখনো কখনো অদ্ভুত আচরণ কেন করে- সেটার পেছনে যুক্তি দেয়া হয়েছে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের। কেউ আবার বলেছেন এখানেই আসলে হারানো আটলান্টিস শহর আছে, পানির তলদেশে।
আরেক অদ্ভুত এক তত্ত্ব হলো এখানে সময় সুড়ঙ্গ আছে। যেমন, ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর অ্যান্ড্রোস আইল্যান্ড বাহামাস থেকে দক্ষিণ ফ্লোরিডার উদ্দেশে যাত্রা করেন পাইলট ব্রুস গার্নোন। তিনি বলেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকায় উড়ে যাবার সময় তিন মিনিটের জন্য তিনি নাকি ছিলেন ‘ইলেকট্রনিক ফগ’ নামের অদ্ভুত এক ধূসর কুয়াশায়।
তিনি যখন পামবিচে অবতরণ করলেন তখন দেখলেন প্লেনের সবার ঘড়িতে বেলা তিনটা আটচল্লিশ বাজে। অর্থাৎ মাত্র ৪৭ মিনিটে তিনি আড়াইশ মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রতিদিন তার এ ফ্লাইটে ৭৫ মিনিট লাগে অন্তত। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কুয়াশায় তিনি তিন মিনিটে হারিয়েছেন ২৮ মিনিট! ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চেষ্টা করেছে এ রহস্যের সমাধানের। ২০১৬ সালের ৪ মার্চ প্রকাশিত তাদের আর্টিকেল অনুযায়ী, ৭৫টির মতো বিমান আর প্রায় ৩০০-এর মতো জাহাজ হারিয়ে গেছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। অনেক বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন, আসলে মানবঘটিত ভুল, বৈরী আবহাওয়া আর দুর্ভাগ্যের কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। কিন্তু আসলে স্বভাবতই এ তত্ত্বগুলো সব ঘটনার ব্যাখ্যা দেয় না।
ইউএস কোস্ট গার্ড বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ব্যাপারে সবসময় অবিশ্বাসী। এমন ঘটনাও আছে, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছিল, জাহাজ ডুবির পর কোনো দেহ পাওয়া যায়নি, সেখানে আসলে কোস্ট গার্ডরা মৃতদেহের যথেষ্ট ছবি তুলে এনেছিল। তবে কয়েকটি ঘটনার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেগুলোতে যে আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কোনো প্রভাব আছে তারও প্রমাণ নেই।
তবে একটি মজার থিওরি দিয়েছিলেন কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্যাটেলাইট মিটিওরলজিস্ট ড. স্টিভ মিলার। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তিনি নাসার স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে সায়েন্স চ্যানেলের What on Earth প্রোগ্রামকে জানান, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকাজুড়ে জায়গায় জায়গায় ষড়ভুজ মেঘ দেখা যায়।
এখানে ঘণ্টায় ১৭০ মাইল গতি পর্যন্ত বায়ু বয়ে যায়। এই এয়ার-পকেটগুলোই জাহাজ বা প্লেন দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। কোনো কোনো মেঘ ২০ থেকে ৫৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। তবে তিনি জানান, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হলে আরো গবেষণা করা লাগবে। তবে বহুদিন পর্যন্ত জনপ্রিয় একটি তত্ত্ব ছিল মিথেন হাইড্রেট গ্যাস থিওরি। একটি মহাদেশের সীমারেখা থেকে পানির নিচে যতটুকু ভূমি বিস্তৃত হয় সোজা কথায় তাকে কন্টিনেন্টাল শেলফ বলে। সেখানে মিথেন হাইড্রেট প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল উপস্থিতি দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, এরকম জায়গা থেকে সৃষ্ট বাবল বা বুদবুদ পানির ঘনত্ব কমিয়ে বড় জাহাজকেও ডুবিয়ে দিতে পারে। নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে সৃষ্ট এ বুদবুদের কারণে জাহাজডুবি হয়ে থাকতে পারে, যেহেতু মহাদেশের সীমারেখার সাথেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। এক্ষেত্রে বিনা পূর্বাভাসেই দ্রুত জাহাজডুবি হতে পারে। কিন্তু প্লেন দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা এ থিওরি দিতে পারে না।
তা ছাড়া এ থিওরি ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে যখন একবিংশ শতকেই USGS থেকে জানানো হয়, গত পনেরো হাজার বছরে এ এলাকায় কোনো মিথেন হাইড্রেট গ্যাস নির্গত হয়নি। টঝএঝ থেকে ভূতত্ত্ববিদ বিল ডিলিয়নের ভাষ্যে আরো জানানো হয়, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আসলে একটি রূপকথা। ১৯৭৫ সালে Larry Kusche প্রকাশ করেন The Bermuda Triangle Mystery: Solved বইটি। তিনি যুক্তি দেখান যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নাম যিনি দিয়েছিলেন সেই গ্যাডিসও অন্য লেখকেরা আসলে অনেক জায়গায় অতিরঞ্জন করেছেন। এমনকি ভুয়া আর শোনা কথা থেকেও তারা কাহিনী নিয়েছেন। তিনি অনেক কাহিনীর অসঙ্গতি প্রমাণ করে দেন। আরো মজার ব্যাপার, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের শিকার বলে চালিয়ে দেয়া বেশির ভাগ ঘটনাই আসলে এ ত্রিভুজের বাইরে ঘটেছিল। তিনি কাহিনীগুলোর সত্যতা ঘাঁটতে গিয়ে দেখেন, আসলে অনেক কাহিনী আদৌ ঘটেনি।
তবে বহুল কথিত কম্পাসের ছোটাছুটির রহস্য এখনো অমীমাংসিত। অনেকের মতে, এ এলাকায় নিশ্চয়ই ম্যাগনেটিক অ্যানোমালি আছে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটা সত্য যে, চৌম্বক মেরুর সাথে কম্পাসের ছোটাছুটি নতুন কিছু নয়, জাহাজ চালকেরা বহু শতাব্দী ধরে এ সম্পর্কে অবগত। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কোনো রহস্য যদি নাও থাকে, তবুও অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে রহস্যের খোরাক হিসেবে জনমনে আগ্রহ জাগিয়ে গিয়েছে এ জলজ ত্রিভুজ।

Share.

মন্তব্য করুন