বিশ্বজয় করলো বাংলাদেশ। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে লাল-সবুজের দামাল ছেলেরা। প্রথমবারের মতো কোন বিশ্ব আসরের শিরোপা বাংলাদেশের। এখন আমরাও মাথা উচু করে বলতে পারছি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বসেরাতা যে পর্যায়েই হোক না কেন, এই অর্জনের মহাত্মই আলাদা। বয়স ভিত্তিক পর্যায়ে হলেও তাই এই শিরোপার গৌরব অনেক। বাংলাদেশের তরুণরাই এখন এই পর্যায়ের ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা দল। গত ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার সেনওয়েজ পার্কে ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আকবর আলীর দল।

এক নজরে যুব বিশ্বকাপ
চ্যাম্পিয়ন : বাংলাদেশ
রানারআপ : ভারত
তৃতীয় স্থান : পাকিস্তান
প্লেট পর্বের সেরা : ইংল্যান্ড
(প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়াদের লড়াই)
ম্যান অব দ্য ফাইনাল : আকবর আলী
ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট : জশসভি জইশওয়াল (ভারত)

আকবর দ্য গ্রেট
গ্রুপ পর্বের খেলা শেষে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আকবর আলী জানতে পারেন তার একমাত্র বড় বোনের মৃত্যু সংবাদ। পরিবার চায়নি দলের নেতৃত্ব যার কাধে তাকে এই দুঃসংবাদ দিয়ে মানসিকভাবে বিষণ্ণ করতে। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়ার যুগে খবরটা গোপন থাকেনি। আকবর যেভাবেই হোক জেনে যান, তার একমাত্র বোন জমজ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। চার ভাইয়ের একমাত্র বোন ছিলেন খাদিজা। আর আকবর পরিবারের সবচেয়ে ছোট হওয়ায় ছিলেন বোনের কলিজার টুকরা।
বোনের মৃত্যু শোক চেপে রেখেই আকবর দলকে নেতৃত্ব দিতে থাকে। বয়সে তরুণ হলেও দারুণ পরিণত মস্তিষ্কে বুঝতে পেরেছিল বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে নেতা নিজেই ভেঙে পড়লে দলও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাইতো শোক চেপে রেখে খেলে গেছে, যেমনভাবে ফাইনালে দলের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছে বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত।
ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে ১৭৭ রান তাড়া করতে গিয়ে উদ্বোধন জুটিতে ৫০ রান তোলা দলটির স্কোর এক পর্যায়ে হলে গেল ৪ উইকেটে ৬৫। ৮৫ রানে চলে গেল পঞ্চম উইকেট। দল তখন খাদের কিনারে। শিরোপার স্বপ্ন ম্লান হতে শুরু করেছে। এমন সময় দরকার ছিলো একটি সাহসী আর নির্ভরশীল একটি ইনিংস। আগের ম্যাচগুলোতে খুব বেশি ব্যাটিং করার সুযোগ না পাওয়া আকবর আলী দাড়িয়ে গেল আস্থার প্রতীক হয়ে। কঠিন বিপদের মুহূর্তে দারুণ ধৈর্যশীল একটি ইনিংস খেলে দলকে নিয়ে গেল জয়ের বন্দরে।
তার একটি ভুল, একটু ধৈর্যচুতি দলকে ফেলতে পারতো মহাবিপদে; কিন্তু আকবর সেটি হতে দেয়নি। সত্যিকারের নেতার মতো বোলার রাকিবুলকে নিয়ে ম্যাচ শেষ করেছে। দেশকে এনে দিয়েছে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ। তবে ভাইয়ের এই অর্জন দেখে যেতে পারেননি তার প্রিয় বড় বোন।

গল্প আছে আরো
অধিনায়ক আকবর আলী একা নন। পুরো দলটিই টুর্নমেন্টে খেলেছে দারুণ ‘টিম গেম’। তাইতো বাংলাদেশ দলের কেউ টুর্নামেন্টের সেরা বোলার বা ব্যাটসম্যান না হলেও দল হিসেবে তারাই সেরা হয়েছে। সেটি সম্ভব হয়েছে টিমওয়ার্কের কারণে। এক জনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে একেকদিন দলের প্রয়োজনে কেউ না কেউ দাড়িয়ে গেছেন। আবার আকবর আলীর মতো পারিবারিক গল্পও আছে অনেকের। এই যেমন কোয়াটার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলার পর সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও ৪০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান শাহাদাত হোসেন অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে এত দূর এসেছে। ২০১০ সালে তার বাবা আবদুস সবুর ক্যান্সারে মারা গেলে বড় ভাই আবুল হোসাইনের ওপর সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ে। তিনি ভাড়ায় গাড়ি চালাচ্ছেন। এই গাড়ি চালিয়েই ছোট ভাইকে ক্রিকেটের খুদে তারকায় পরিণত করেছেন। বড় ভাইয়ের অক্লান্ত শ্রমের মূল্য দিয়েছে শাহাদাত। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে টাইগার যুবাদের দলে।
কোয়টার ফাইনালে ৫ উইকেট নিয়ে দলকে জেতানো স্পিনার রাকিবুল হাসানও উঠে এসেছে সাধারণ এক পরিবার থেকে। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার রূপসী ইউনিয়নের জন্ম নেয়া এই তরুণ ছোট বেলা থেকেই পরিবারের সাথে থাকে ঢাকায়। পরিবারকে না জানিয়ে ভর্তি হয়েছিল একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। গাড়ি চালক বাবার সামর্থ নেই ছেলের পড়াশোনা ও ক্রিকেট কোচিংয়ের খরচ একসাথে জোগান দেয়ার। তবু অদম্য রাকিবুল থামেনি। নিজ উদ্যোগেই কিছু টাকা ম্যানেজ করে ভর্তি হয় একটি অ্যাকাডেমিতে।
চাঁদপুরের মাহমুদুল হাসান জয় মহল্লায় খেলতে গেলে বড় ভাইরা তাকে ব্যাটিং করার সুযোগ দিত না। শুধু ফিল্ডিং করেই বাড়ি ফিরতে হতো মন খারাপ করে।  সেখান থেকেই বড় ব্যাটসম্যান হওয়ার পণ করেছিল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে কী দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে দলকে ফাইনালে তুলেছে!
বাবা চাইতেন না ছেলে ক্রিকেটার হোক; কিন্তু তার প্রতিভা দেখে বিকেএসপিতে ভর্তি করান জয়ের এক আঙ্কেলের পরামর্শে। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দণ্ডপাল ইউনিয়নের নগড়পাড়ায় লোকেরা যাকে নিয়ে উৎসব করছে সেই পেসার শারিফুল ইসলাম এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। তাদের কাছে ক্রিকেট শেখা বিলাসিতা; কিন্তু শরিফুল সেই সীমাবন্ধতা জয় করেছে। এক মামা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন দিনাজপুরের একটি অ্যাকাডেমিতে। সেখান থেকেই শুরু স্বপ্নের বীজ বোনা। ফাইনাল সহ পরো টুর্নমেন্টে দারুণ বোলিং করেছে। তাকে মনে করা হচ্ছে জাতীয় দলের ভবিষ্যত পেসার। তৌহিদ হৃদয়ের মা জমি বন্ধক রেখে ছেলেকে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তির জন্য টাকা জোগাড় করেছিলেন। ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকার কারণে বাবা বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন তানজিদ হাসান তামিমকে। ফাইনালে ৩ উইকেট নেয়া নড়াইলের অভিষেকের বাবা চাননি ছেলে ক্রিকেটার হোক। এমনকি খুলনা স্টেডিয়ামে ছেলের ট্রায়াল দিতে যাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি।
এমন ছোট ছোট অনেক গল্পে ভরা পুরো বিশ্বকাপ দল। ও আরেকটা কথা বলা হয়নি এইসব বীর যুবারা কিন্তু লেখাপড়া বাদ দিয়ে খেলতে যায়নি।
এদের বেশির ভাগই মেধাবী শিক্ষার্থী। রংপুর শহরের জুম্মাপাড়ার ছেলে আকবর ক্রিকেটে মজে পড়ালেখা ভুলে যায়নি। দলের বেশির ভাগই বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- বিকেএসপির ছাত্র।
বিকেএসপির ভর্তিপরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেই তাদের ভর্তি হতে হয়েছে। ২০১৬ সালে বিকেএসপি থেকে মানবিক বিভাগে এ প্লাস পেয়েছে আকবর। সঞ্জিত সাহা এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই গোল্ডেন এ পাস পেয়ে ভর্তি হয়েছ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। মোহাম্মাদ প্রান্তিক নওরোজ নাবিল ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র হয়েও খেলার টানে চলে গেছেন বিকেএসপিতে।

Share.

মন্তব্য করুন