ফারিয়ার টার্ম পরীক্ষা চলছে। কালকে পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র। পরীক্ষা থাকলেই আগের রাতে ফারিয়ার মাথায় দুই ধরনের চিন্তা জট পাকাতে শুরু করে! ভাগ্যিস, ‘পরীক্ষার পূর্বরাত্রি’ বিষয়ক রচনা এখন পর্যন্ত তাকে লিখতে হয়নি। তা না-হলে, পূর্বরাত্রের জটিল জটের কাহিনি পড়ে পরীক্ষকের মাথা আউলে যেত। যাহোক, সরলীকৃত করলে জটপরিস্থিতি এভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে: পরীক্ষার আগের রাতে যত ধরনের সমস্যা আছে অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়; এমনকি আন্তর্জাতিক, মহাজাগতিক- সবই ফারিয়ার মাথায় গিজগিজ করা শুরু করে। সেই সঙ্গে পরীক্ষার পরবর্তী দিনগুলোকে কিভাবে ভালো কাজের মাধ্যমে উজ্জ্বল করা যায়, সে বিষয়ক নানা ভাবনা তার মস্তিষ্কের নিউরন কাঁপিয়ে তোলে।
আজ অনেক কষ্টে এসব চিন্তাধারা মাথা থেকে ঝেড়েঝুড়ে ফারিয়া যতটা সম্ভব পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছে। একটু আগে মীরা ফোন করে জানিয়ে দিল, প্রশ্ন নাকি ফাঁস হতে পারে! কিন্তু ফারিয়ার বাবার কড়া আদেশ, প্রশ্ন সস্তায় বিলি হোক, রাস্তায় পড়ে থাকুক, বস্তায় ভরে কুরিয়ারে কেউ বাসায় পাঠিয়ে দিক, যা-ই ঘটুক না কেন, ফারিয়াকে সৎ থাকতে হবে। এটিই নাকি বড় শিক্ষা! তাই ফারিয়া পড়ায় মনোসংযোগ করেছে। এ মুহূর্তে রিভিশন দিচ্ছে আলোর চ্যাপ্টারগুলো। আলো নিয়ে বেশ কয়েকটি অধ্যায় আছে। কী অপূর্ব এক শক্তি এই আলো! মজার মজার বৈশিষ্ট্য আছে আলোর- প্রতিফলিত হয়, শোষিত হয়, প্রতিসরিত হয়; এসব কারণে নানা চমকপ্রদ ঘটনারও জন্ম হয়। এমনকি এখন আলোর মাধ্যমে তথ্য পাঠাচ্ছে মানুষ! আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, প্রায় চুলের মতো চিকন একটি ফাইবারের ভেতর দিয়ে সাগর পরিমাণ তথ্য আলোর পিঠে চড়ে প্রচণ্ড গতিতে যাওয়া-আসা করছে!
এত আনন্দ নিয়ে কখনো পড়েনি ফারিয়া। আজ পড়ে বেশ মজা পাচ্ছে। আলো ধরা বা ছোঁয়া যায় না; অথচ এটি না থাকলে পৃথিবীর অবস্থা হতো ভয়াবহ।
কর্মচঞ্চল পৃথিবী হতো প্রেতপুরী। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম-এ চোখ বুলিয়ে নেয়ার সময় ফারিয়ার মনে হলো, কী ক্ষুদ্র একটা অংশের আলোতে মানুষ দেখতে পায়! অংশটিকে বলা হয়, দৃশ্যমান আলোর ব্যান্ড। অথচ সেই ব্যান্ডের দু’পাশে আরও কত প্রকারের আলো আছে, যেসব আলোয় মানুষ কিছু দেখতে পায় না! যেমন- অবলোহিত বা ইনফ্রারেড, অতিবেগুনি বা আলট্রাভায়োলেট, এক্স-রে, গামা-রে ইত্যাদি। ফারিয়া মনে মনে ভাবে, পৃথিবীতে যদি এমন বস্তু থাকে যার থেকে দৃশ্যমান আলো প্রতিফলিত হয় না; বরং অন্য ব্যান্ডের আলো প্রতিফলিত হয়, তা হলে মানুষ বস্তুটি দেখতেই পাবে না! কারণ, মানুষের দর্শনক্ষমতা দৃশ্যমান আলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফারিয়ার মাথা ঝিম ধরে এলো। ঘাড়ের কাছে এঁটে আসছে বলে মনে হলো। বেশি পড়াশুনা করছে বলে এমন হচ্ছে কিনা কে জানে! সে চোখ বন্ধ করে মাথায় দুই হাত দিয়ে বসে রইল। নিজেকে সুস্থির করার জন্য ধ্যানমগ্ন থাকল কিছুক্ষণ। তারপর চোখ খুলতেই আঁতকে উঠল ভীষণভাবে। তার পাশে কিশোর এক ছেলে আপনমনে বসে আছে!
ছেলেটির গালে টোল খাওয়া, ঠোঁট পুরু আর মাথায় ঢেউ খেলানো চুল। ছেলেটি অবশ্য ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে নেই। আরও আশ্চর্যের বিষয়, তার পাশে খাটের ওপরেও বসে নেই। ছেলের মাথার চুল ওড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো সমুদ্রসৈকতে বসে আছে। আশপাশের পরিবেশ দেখতে না পেলেও তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ফারিয়া! তবে কি অন্য ব্যান্ডের আলোতে দেখা যায়, এমন জীবও সে দেখতে পাচ্ছে?
হয়তো আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই এমন জীব আছে, যাদের আমরা দেখতে পাই না! কারণ, তাদের থেকে কোনো দৃশ্যমান আলো আমাদের চোখে এসে পড়ে না।
ফারিয়া বুঝতে পারছে না ছেলেটি তাকে দেখতে পারছে কি না। দৃশ্যমান আলো বিচ্ছুরণ করে এমন প্রাণী কি এই ছেলে দেখতে পায় না? ফারিয়া ডাক দিল, ‘হ্যালো, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?’
ভাবলেশহীনভাবে যেন কোনো দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটি। ফারিয়া বুঝতে পারছে, এই অচেনা ছেলে তাকে দেখতে পাচ্ছে না। তার দিকে তাকিয়ে ফারিয়ার খুব মায়া হলো। কী এমন দুঃখ এই ছেলের যে এভাবে একাকী আপন মনে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! খুব মৃদুস্বরে আবারও ডাকল ফারিয়া, ‘অ্যাই, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?’
আকস্মিকভাবে ফারিয়া আর ছেলেটির মাঝের অদৃশ্য কোনো স্তর কেঁপে কেঁপে উঠল; অনেকটা টেলিভিশনে ঝিরঝিরে ছবি এলে যেমনটি দেখায়, তেমন দৃশ্যের অবতারণা হলো। সেই কম্পন যেন স্পর্শ করল ছেলেটিকে। সে এদিক ওদিক চোখ বোলাতে লাগল। ফারিয়ার দিকে চোখ যেতেই ভীষণভাবে আঁতকে উঠল! অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘হাই’।
ফারিহা হ্যাঁ হয়ে গেল। ছেলেটি তার কথা শুনতে পাচ্ছে! তার মানে সে প্যারালাল ইউনিভার্সের অন্য আলোকসংবেদী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে! বিস্মিত ফারিয়া ছেলেটির সম্বোধনের প্রত্যুত্তরে বলল, ‘কী নাম তোমার?’
‘আমার নাম ত্রলা।’
‘ত্রলা! কোথায় বসে আছ তুমি?’
‘আমি আছি সাইমুন গ্রহে। নাগা সমুদ্রেরসৈকতে বসে আছি।’
‘তোমার কি স্কুল নেই? পরীক্ষা দিতে হয় না তোমাদের?’
‘হ্যাঁ, স্কুলে যাই আমি। তবে এখন উৎসবের ছুটি।
মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে আমার। যখন মাকে মনে পড়ে, তখন আমি সাগরপাড়ে চলে আসি। আমাদের বাসা সৈকত থেকে খুব বেশি দূরে না।’
‘তোমার মা কোথায়?’
‘মা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। মা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। উৎসবের সময় পিঠা বানাতো আমার জন্য।’
‘আমি দুঃখিত।’
‘ঠিক আছে।’
‘কালকে আমার ফিজিকস পরীক্ষা। তা না হলে তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করতাম।’
‘তাহলে তো তোমার অনেক পড়া! আমি অবশ্য তোমাকে একভাবে সহযোগিতা করতে পারি।’
‘কিভাবে?’
‘ফিজিকসে তোমরা কী পড়ো?
‘সিলেবাসে আছে আলোকবিজ্ঞান, চৌম্বকবিদ্যা আর আপেক্ষিকতা।’
‘দারুণ। এসব বিষয়ে আমার জ্ঞান আছে। আমি তোমাকে আমার সব জ্ঞান ট্রান্সফার করে দিতে পারি।’
‘জ্ঞান ট্রান্সফার করা যায়?’
‘আমরা পারি। দেখি তোমার হাতটা এগিয়ে দাও।’
ফারিয়া কিছুটা ইতস্তত করে ডান হাত বাড়িয়ে দিল ত্রলার দিকে। অদৃশ্য স্তরটি আবার খানিক কেঁপে উঠল।
ফারিয়ার হাতের যে অংশ অন্য জগতে গেছে, সেই অংশে শীতল অনুভূতি তৈরি হয়েছে! তার হাত ধরল ত্রলা। বলল, ‘চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নাও। আমি আলোকবিজ্ঞান, চৌম্বকবিদ্যা আর আপেক্ষিকতার সব জ্ঞান তোমাকে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।’
ফারিয়া চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকল।
এভাবে কিছুক্ষণ পার হলো। তারপর ত্রলা বলল, ‘ট্রান্সফার শেষ। এখন দেখবে সহজেই সব পারছ।
কারণ, আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার খুব সমৃদ্ধ। আমি তোমার নিউরনে আলোকবিজ্ঞান, চৌম্বকবিদ্যা আর আপেক্ষিকতার জ্ঞান দিয়ে দিয়েছি। এসব বিষয়ে যেকোনো প্রশ্ন শুনলে তোমার মনে হবে তুমি আগে থেকেই জানো!’
‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’
‘ঠিক আছে, পড়ো তাহলে। পরীক্ষা ভালো হোক।’
ফারিয়ার কেন যেন গল্প করতেই ভালো লাগছে। তাই বিদায় নিতে মন চাইছে না। তবে সে কিছু বলার আগেই অদৃশ্য স্তরে আবার কম্পন শুরু হলো এবং মুহূর্ত পরই ছেলেটি মিলিয়ে গেল। পরীক্ষার পূর্বরাতে ফারিয়ার পড়ায় আর মন বসল না!

দুই.
ফলাফলের দিন সবার মার্কস নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেয়া হলো। ফারিয়া পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রে একশতে পেয়েছে একশ দশ! দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর অর্থাৎ বিরানব্বই পেয়েছে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল রাফাত। পদার্থবিজ্ঞান স্যার তার দশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কেন প্রথমবারের মতো একজন শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত দশটি নম্বর দিলেন, সেটির একটি সুন্দর ব্যাখ্যা লিখে নোটিশ বোর্ডে দিয়েছেন। ফারিয়াকে নিয়ে স্কুলজুড়ে হইচই পড়ে গেল। এ কী করে সম্ভব! আর কেউ না জানলেও ফারিয়া জানে, এই রেজাল্ট শুধু তার পড়ার কারণে নয়; ত্রলার জ্ঞান ট্রান্সফারের কারণে সম্ভব হয়েছে। সুখবরটা ত্রলাকে জানানো দরকার। বাসায় ফিরে ফারিয়া চোখ বন্ধ করে বা জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে- নানাভাবে চেষ্টা করেছে ত্রলার সঙ্গে দেখা করতে। তবে দুর্ভাগ্য, যে ছেলেটি ফারিয়াকে সৌভাগ্যময় রেজাল্ট উপহার দিল, তার সঙ্গে আর কখনোই দেখা হয়নি।

Share.

মন্তব্য করুন