ভর দুপুর। সূর্যটা মাথার ওপর তির্যকভাবে এসে পড়েছে। জিদান আজকেই বিজ্ঞানে পড়েছে যে, এ অবস্থায় সূর্য বেশি তাপ দেয়। স্কুল মাঠে জিদান তখন খেলা নিয়ে ব্যস্ত। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুরা হলো তামিম, সৌরভ, হামিম, আকাশরা। প্রতিদিন টিফিনে তারা একসাথে খেলে। তাদের কাছে এ সময়টা সবচেয়ে কষ্টের ও আনন্দের। রোদে দৌড়-লাফঝাঁপে তারা যেমন ক্লান্তিতে একাকার হয়ে যায় তেমনি তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের সীমা থাকে না। সেই সকাল ১০টা হতে ক্লাস শুরু হয়ে শেষ হয় বিকাল ৪টায়। মাঝে ৩০ মিনিট  পাওয়া যায় টিফিনে। এ সময়টা তাদের কাছে অপার আনন্দের।
বাঁধা সময়ের এই কিছু সময়ই তারা একসাথে কাটাতে পারে। তারা আজ অনেকদিন পর খেলছে একসাথে। অল্পক্ষণ পর রোদের কারণে আর খেলা হলো না তাদের। বিগত কয়েক মাস যাবৎ পড়ালেখায় স্থির হতে পারছে না তারা। কিছুদিন পরপর নতুন নতুন ঝামেলা শুরু হয়। যার বেশির ভাগই হয়ে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারণে। তারা নানাভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের উপর খবরদারি বাঁধা সময়ের এই কিছু সময়ই তারা একসাথে কাটাতে পারে।
তারা আজ অনেকদিন পর খেলছে একসাথে। অল্পক্ষণ পর রোদের কারণে আর খেলা হলো না তাদের। বিগত কয়েক মাস যাবৎ পড়ালেখায় স্থির হতে পারছে না তারা। কিছুদিন পরপর নতুন নতুন ঝামেলা শুরু হয়। যার বেশির ভাগই হয়ে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারণে।
তারা নানাভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের উপর খবরদারি চালাতে চায়। চলতি মাসেই অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে, নিখোঁজ আছে আরো কয়েকশত। এ কথা উঠলো জিদানের মুখেই, ‘গতকাল দাদু বললো, পশ্চিম পাকিস্তান নাকি আমাদের দেশ দখল করতে চাইছে?’
সৌরভ বললো, ‘তাই তো দেখলাম খবরে। তারাও নাকি আমাদের সাথে একদেশ হয়ে থাকতে চায়। আমাদের বড় বড় শহরগুলো নাকি তাদের দখলে থাকবে।’
আকাশ চোখে মুখে রাগ ফুটিয়ে বললো, ‘বললেই হলো নাকি? এর আগে ’৫২তে তারা ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলো, পারে নি। এ বাংলা ভাষার জন্য কত জনই প্রাণ দিলেন বলে আফসোস করতে লাগলো।
জিদানের কথায় একরকম আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠলো, ‘আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। যে জাতির ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো বলে জীবন দিলো, সেই জাতির দেশ দখল করতে চাইলে তারা শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করবে।’
তার কথা শেষ না হতেই ক্লাসের ঘণ্টা বেজে উঠলো। ক্লাস যথাসময়ে শুরু হলেও তাদের মধ্যে থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হলো জিদানের মনে খালি একটা প্রশ্নই ঘোরাফেরা করছে যে, ‘বাঙালিরা কি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে?’ এই ভেবেই তার যত কল্পনা-জল্পনা।

দুই.
বাসার সকলেই নিয়মিত খবর শোনে এমন না, তবে বড় কোনো ঘটনা ঘটনে সবাই বেতারেই কান পাতে। দেশের অবস্থা এখন ভালো না। জিদানের দাদা, বাবা-মা ও ছোটো ভাই রাতুল সবাই বসে রেডিও শুনছে। অন্যরা খবর শুনে পরিস্থিতি আঁচ করতে পারলেও রাতুলের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। চোখে গোল চশমা আর হাবাগোবা চেহারার রাতুলও সবার সাথে কথার তাল মেলাতে ব্যস্ত। রেডিওতে শোনা যাচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তান হতে নাকি অনেক অনেক সৈন্য আধুনিক বড় বড় ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে আসছে, সাথে আরো নাম না জানা যন্ত্রদানব। এ কথা শুনেই সবাই ভয়ের চুপসে যায়। তাদের চেহারা অজানা আশঙ্কায় ছেয়ে গেলো হুট করে।
রাতুল শুধু এর ওর কাছে জানতে চাইছে, ‘যন্ত্র দানবটা কী?’ তার এ সব উদ্ভট প্রশ্ন সবার ভয় আর অসহায়ত্বকে আরো জোরে নাড়া দিতে লাগলো যেনো পাশের রুমেই পড়ছিলো জিদান। রেডিও চলাকালীন সময়ে তার পড়া থেকে ওঠা বারণ। সে যদিও পড়ার টেবিলে আছে, তবু তার মন কান সবই যেনো রেডিওতে আটকে আছে। ব্যাকু ল আগ্রহে সে কান পেতে রইল রেডিওর প্রতিটি শব্দে।
দেশের পরিস্থিতি খারাপ হলে তাদের স্কুল কেন, কোনো স্কুলই খোলা থাকে না। এসময় সারাদিন বাসাবন্দী পড়াশোনারও চাপ নেই তেমন। এ সময়টাতে সারাদিন গল্পের বই পড়ে কাটানো আর রাতুলের সাথে খেলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। জিদানের কাছে এ সময়টাই সবচে বিরক্তিকর। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার তাড়া থাকে না, খাবার শেষ করে স্কুলে যাবারও তাড়া নেই। তবে তখন তার বন্ধুদের জন্য মন খারাপ হয়। সবার সাথে আড্ডা, দুষ্টুমি, খেলাধুলা আরো কত কিছু করে তাদের সময় কাটে এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে।

তিন.
পরেরদিন ভোর হতেই শুরু হলো মায়ের হাঁকডাক। মুখ হাত ধুয়ে হুজুরের কাছে আরবি পড়া শেষ হতেই নাস্তার জন্য ডাক এলো। সবাই নাস্তা করছে। জিদানের মনে হচ্ছে সে ছাড়া আর কেউই নেই, কারো মুখে কোনো কথা নেই। দাদু জিদানকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সোজা বাসায় চলে এসো স্কুল ছুটির পর, এদিক ওদিক যাওয়ার দরকার নেই।’
জিদান কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ল। পরিস্থিতির কথা ভেবে জিদানের সাথে গেলো তার বাবা। অন্যসময় জিদান এতে সায় দিতো না। কিছুটা জেদি স্বভাবের হওয়ায় সে একাই আসা যাওয়া করতো। এবার জিদানের কোনো অমত ছিলো না বলেই বাবা তাকে নিয়ে গেলেন। দোকানপাট সবেমাত্র খোলা শুরু করেছে। মনে হচ্ছে না দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভাব পড়েছে কিনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের পাশ দিয়ে যেতেই শাহবাগ মোড়ে বড়সড় জটলা। পূর্ব পাকিস্তানের নানা বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের কারণে এ প্রতিবাদ মিছিল। সবাই-ই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর নানা বয়সের মানুষ। এক ছাত্রের জোরালো বক্তৃতায় জিদান শুনলো, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার অনিয়ম ও দুঃশাসনকে প্রতিরোধ করার জন্যই এ প্রতিবাদ। এই মার্চ মাস জুড়েই বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকা-সহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। কোনো না কোনো ঘটনার রেশ ধরে বাঙালিদের উপর চালাচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন।’ জিদান আরও শুনলো, ‘পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনো ভাবেনি আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবো, একের পর এক চাপ সৃষ্টি করে দমিয়ে রাখতে চাইছে আমাদের, এখনই সময় জেগে ওঠার।’ বক্তৃতার শেষে তুমুল স্লোাগান উঠলো মিছিলে আর করতালিতে।
জিদানের স্কুলে যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ বিশ মিনিট। এ বিশ মিনিটে প্রায় তিনটি মোড় অতিক্রম করতে হয়। সে দেখলো প্রতিটি মোড়ে মোড়ে ব্যানার, ফেস্টুন আর মশাল নিয়ে জড়ো হয়ে নানা বয়সের মানুষেরা আন্দোলন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নানা শ্রেণীপেশার মানুষ এখানে বক্তৃতা করছেন আর সবাইকে সজাগ করছেন মুক্তির বিষয়ে। জয়বাংলা স্লোগান তো আছেই সবার মুখে মুখে।
এসব দেখতে দেখতে কখন যে স্কুলের গেটে এসে রিকশা থামলো সে টেরই পেল না। বাবার মৃদু ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফিরে পেলো জিদান। জিদানের বাবা জানেন যে, দেশের এ পরিস্থিতি ছেলেকে ভাবায়। সারাদিন এসব ভেবেই সে দিন কাটায়। তিনিও ছেলের এসব চিন্তাভাবনায় বাধা দেন না।
তাইতো নতুন নতুন নানা ইতিহাস ও আন্দোলনের বই ও পেপারকাটিং ছেলেকে নিয়ে দেখেন আর আলোচনা করেন।
ছেলেটাও হয়েছে এমন জেদি ও একরোখা।
আসার সময় বললেন, ‘ছুটির সময় নিতে আসবো। একা বের হবে না কিন্তু।’
জিদান নীরবে মাথা নেড়ে ক্লাসের দিকে চললো।
অন্যদিন ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে চিৎকার চেঁচামেচি আর হইহট্টগোল লেগে থাকতো। কে কোথায় বসবে এটা নিয়েই বাগ্বিতণ্ডা লেগে থাকতো এমনকি হাতাহাতিও হতো। একজনের ব্যাগ দিয়ে অন্যজনের সিট মোছা এমন সব দুষ্টুমি ছিলো
নিয়মমতো। তবে আজকে ছিলো তার ব্যতিক্রম। কোন চিৎকার চেঁচামেচি নেই। উপস্থিতিও হাতেগোনা। মনমরা হয়ে বসে আছে এদিক-ওদিক। যারা এসেছে সবাই-ই জিদানের কাছের। ক্লাসের অন্যদের অনুপস্থিতি সে টের পাচ্ছে না। তবে সবাই মুখ গোমড়া করে আছে।
জিদানের একমাত্র হিন্দু বন্ধু হলো দুর্জয়। সে বললো, ‘দেশে তো দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের তো আর বুঝি রক্ষে নেই।’
রবিন অভয় দিয়ে বললো, ‘ভয় কি বন্ধু। গত ৭ই মার্চে তো বঙ্গবন্ধু ঘোষণাই দিলেন আমাদের প্রস্তুত হতে। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তারা প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। মুক্তিফৌজ গড়ে তুলেছে নাকি অনেক জায়গায়। ’
এতেও দুর্জয়ের ভয় কমলো না, সে বললো, ‘আমাদেরই তো বেশি ভয়। মিলিটারিরা তো হিন্দুদের দেখতেই পারে না।’
জিদান এক ফাঁকে বললো, ‘বাঙালিরা এক হয়ে লড়তে শিখেছে।
এ পর্যন্ত যত হত্যাকা- তারা ঘটিয়েছে হিন্দু হোক মুসলিম হোক সবাই একজোটে আন্দোলনে গেছে। আমরা সব ধর্মাবলম্বী এক মায়ের বুকেই বাস করি। বাঁচলে একসাথে বাঁচবো, মরলেও একসাথে দেশের মাটিতেই মরবো।’
দুর্জয় হতাশার সুরে বললো, ‘তাও হয়তো বেশিদিন থাকা হবে না আর। কলকাতায় পিসিরা থাকেন। সবাই ওখানে যেতে তাড়া দিচ্ছে। কাল পরশু হয়তো রওনা দিতে পারি।’
এককথায় যেনো সবার চেহারায় ঐ অন্ধকার নেমে এলো। জিদান যেতে বারণ করতে গিয়েও পারেনি। কারণ সে জানে প্রাণের মায়া সবারই আছে। হয়তো সামনে এমন পরিস্থিতি আসলে তাদেরও দেশ ছাড়তে হতে পারে। আর কথা বাড়ালো না সে। সে ভাবতে লাগলো, ‘কি এমন কারণে দেশে এ বিপর্যয় এলো, বন্ধু হারাতে হলো। আজ হোক কাল হোক সবাই আস্তে আস্তে দেশ ছাড়বে, এমনকি তারাও।’
তৃতীয় ক্লাসের পর আচমকা নোটিশ এলো কাল হতে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতি ভালো হলে আবার ক্লাস শুরু হবে। সেদিনের মতো সবাই দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায় বাড়ি ফিরলো। আসার আগে সবার সাথে হাত ও বুক মিলিয়ে এলো। সবার একটাই কথা শিগগিরই দেখা হবে। জিদান গেটে এসে দেখলো বাবা দাঁড়িয়ে আছে।
স্কুল হতে ফেরার পথেও সে দেখলো জটলা আরো বেড়েছে। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে স্লোগানে স্লোগানেপ্রকম্পিত হচ্ছিলো চারপাশ। এসব দেখে জিদানের মনে ভারি আনন্দ হলো। এই ভেবে যে, সবাই আন্দোলনে আসছে, মিলিটারিদের নির্দেশ ভেঙে। তাহলে তো দেশে স্বাধীনতা কেউ আর আটকে রাখতে পারবে না। খুব শিগগিরই তার ক্লাসে ফেরা হবে। আবার বড় মাঠে খেলা হবে। সে অনেকদিন ভাবছে, স্কুলের পেছনে যে রেল লাইনটা আছে সেটা নাকি কোনো এক বড় নদীর উপর দিয়ে গেছে। তার ইচ্ছা, ঐ রেললাইন হয়ে নদীতে যাবে। নদীর পাড়ে গোসল সেরে তবেই ফিরবে বন্ধুদের সাথে।

চার.
রাতে পড়া শেষ করে সে প্রতিদিন গল্পের বই পড়ে তবে আজ পড়লো না। তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কবে দেশ স্বাধীন হবে আর কবে সে ক্লাসে ফিরে যেতে পারবে। একসাথে একঝাঁক ভয় আর আনন্দ তার চারপাশ ঘিরে ধরেছে। মায়ের অনেকবার ডাকাডাকির পর সে উঠে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুমে তলিয়ে গেলো।
আচমকা মায়ের তীব্র ঝাঁকুনিতে সে জেগে ওঠে বসে পড়লো। অন্ধকারে কিছু বুঝে ওঠার আগে তার মুখ আলতো করে চেপে মা ফিসফিসিয়ে বললো, ‘শহরে মিলিটারি এসেছে।’ জিদানের বুঝতে বাকি রইল না। রাস্তায় ভারি অস্ত্রশস্ত্রের গড়গড় আওয়াজ আর প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। তারা সবাই জড়সড় হয়ে উঠে পড়লো ছাদের চিলেকোঠায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তাদের পাশেই। সেখানকার ছাত্রাবাস আর শিক্ষকদের আবাসিক ভবন হতেই আসছে এ গোলাগুলির শব্দ। একের পর এক অস্ত্র সজ্জিত ভারী সাঁজোয়া রাস্তাময় পায়চারি করছে। এ দিকে মা ও রাতুল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ভয়ে। জানালার ছোট ছিদ্র দিয়ে তারা দেখতে পেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বস্তিতে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে আর চারদিকে মানুষের ছুটোছুটি। এদিক ওদিক পালিয়েও নিস্তার পাচ্ছে না কেউই।
অজস্র গুলির শব্দ আর গোলাবারুদে তাদের কানে যেনো থাবা বসাচ্ছিল। নারী-পুরুষ ও নানা বয়সের মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছিলো পরিবেশ, তারা যেনো ছুটছে মৌমাছির মতো দিগ্বিদিক হয়ে। যাকেই দেখছে, মুহূর্তেই গুলি চালাচ্ছে মিলিটারিরা।
জিদানের মনে পড়লো দুর্জয় ও সজীবের কথা- ওরা তো ঐ এলাকায় থাকে, তাদের দু’জনের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন।
এ মুহূর্তে তাদের জন্য বুক ফেটে কান্না আসছে জিদানের। যেভাবে আকস্মিক আক্রমণ চালাচ্ছে। এতে মনে হয় না মিলিটারির হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে।
পরিবারের সবাই দোয়া-দরুদ পড়ছে। থেমে থেমে জিকিরও করছে। জিদান তার ছোট ভাইয়ের কাছেই বসে ছিলো জড়িয়ে ধরে।
রাতুলের নিঃশ্বাসের সাথে প্রতিটি বুকের স্পন্দন সে শুনতে পাচ্ছিলো। পাশে মা কাঁদছেন। মা যে স্কুলে পড়ান ওখানকার অনেকে ঢাকা বশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই থাকে। সে কথাগুলো তিনি বলছেন আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
হঠাৎ এক গোলার আঘাত তাদের পাশেই হলো বলে মনে হলো। এবার আর কারো মুখে কথা নেই, কান্নাও নেই। এখন শুধু অপেক্ষা করছে কখন মিলিটারি এসে তাদের বাড়িতে আক্রমণ করবে। আশপাশের বিল্ডিং হতে মানুষের আর্তনাদে ভেসে আসছিলো। কোনো কিছুই যেনো তাদের আটকে রাখতে পারছে না। অনেকক্ষণ যাবৎ এ ধ্বংসলীলা চলার পর থামতে শুরু করলো গোলাগুলির শব্দ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। জিদানদের ভাগ্য ভালোই বলা চলে। তার ঠিক পাশের রাস্তা থেকেই মিলিটারি তাদের ট্যাঙ্ক সরিয়ে বড় রাস্তা ধরে চলে গেলো।
পরিস্থিতি কিছুটা হালকা হয়ে এলে তারা যেনো
প্রাণ ফিরে পেলো। দাদুর হাতে সেই রেডিও ছিলো আগে থেকেই, এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে তিনিও ভুলে গিয়েছিলেন রেডিও চালানোর কথা। অবস্থা শান্ত হয়ে এলেই রেডিও চালালেন তিনি।
চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেলো শহরের অনেক জায়গাতেই গণহত্যায় লিপ্ত হয় মিলিটারিরা।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস ও বস্তিতে এই রাতেই এ গণহত্যা চালানো হয় যাতে তারা নির্মমতার সর্বশেষ রূপ দেখায়। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীকে তুলে নিয়ে যায় এবং অনেককে হত্যা করে নির্মমভাবে।
জিদানসহ পুরো পরিবারই যেনো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। জিদানের প্রশ্নে সবাই মুখ তুলে তাকালো, ‘মিলিটারিরা কেন এ হত্যাকা- চালালো বাবা? এত বুদ্ধিজীবীদের কেন তুলে নিয়ে গেলো?
জিজ্ঞাসু চোখে জিদান বাবার দিকে তাকালো।
বাবার উত্তর দেয়ার আগে দাদুই বললো, ‘তারা চায় না বাঙালি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারুক।
স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিরোধ যেনো আমরা গড়ে না তুলতে পারি। পৃথিবীর বুকে যেনো স্বাধীন দেশ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি। তাই তাদের এ গণহত্যা। তারা চেয়েছিলো এ গণহত্যার মাধ্যমেই বাঙালি জাতির মেরুদণ্ ভেঙে দিতে।
রাতুল বললো, ‘আমরা কি তাদের পরাজিত করতে পারবো, দাদু?’
দাদুর উচ্ছ্বসিত জবাব, ‘অবশ্যই পারবো। শেখ সাহেবকে তুলে নিয়ে যাবার আগেই তো তিনি ঘোষণা করে দিলেন স্বাধীনতা। রেডিওতে বলেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন হতে নাকি প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। ’

পাঁচ.
ঘরের মধ্যে হঠাৎ জিদানের কান্নার শব্দ ও তার মায়ের আহাজারির রোল উঠলো। তার বাবা সকালে আবাসিক এলাকা ঘুরে এলেন, জানতে পারলেন দুর্জয় আর সজীবের পুরো পরিবারই গণহত্যার শিকার হয়েছে। আর রবিনের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা বিজ্ঞানী তাকেও তুলে নিয়ে গেছে গতরাতেই। জিদানের বাবার একজন বন্ধু কিছুদিন আগেই কানাডার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার পেয়েছিলেন সপরিবারে যাওয়ার। ওখানে আমন্ত্রণ পেলেও যাননি। তিনি চেয়েছিলেন, এ দেশটাতেই থাকতে। জাতির ভাগ্যোন্নয়নে কিছুটা হলেও অবদান রাখতে তাই তো কাজ করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তার ইচ্ছেটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।
জিদান আর কাঁদছে না। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। কারো সাথে কথাও বলছে না। চোখ লাল হয়ে আছে। যেনো টকটকে রক্তের রঙ ঠিকরে বেরুচ্ছে। সে ভাবছে তার বন্ধুদের কথা। সে কখনো ভাবেনি গতকালের দেখাটাই তার বন্ধুদের সাথে শেষ দেখা হবে।
তারাও এ দেশের মানুষ। তাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কেন এমন হলো?
সে আরো ভাবতে লাগলো, ‘দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। তারা আবার ক্লাসে ফিরবে। বন্ধুদের নিয়ে স্কুলের পেছনের রেললাইন ধরে বহুদূর হেঁটে গিয়ে নদীর পাড়ে গোসল করবে। শুধু থাকবে না দুর্জয় আর সজীব।’

ছয়.
দেশে তখন তুমুল যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিটারিদের যুদ্ধ হয়েছে। সেক্টরও গঠন হয়েছে ১১টা। ভাগ হয়ে যুদ্ধ করতে। ২৫শে মার্চের গণহত্যা যেনো নতুন রূপ দিলো বাঙালি ঐক্যের। দলে দলে মানুষ যোগ দিতে লাগলো মুক্তিবাহিনীতে। প্রতিটি ঘর থেকেই জোয়ানরা যুদ্ধে যাচ্ছে। শহরের মানুষজন ঘরবাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে। অনেকে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে ভারতের শরণার্থী শিবিরে।
সেদিন রাতে সিদ্ধান্ত হলো যুদ্ধ যেহেতু শুরু হয়ে গেছে, এখানে আর থাকা যাবে না। মিলিটারিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
বাড়ছে লাশের মিছিল।
গ্রামের দিকে এখনও মিলিটারিরা পৌঁছায়নি, তাই আপাতত গ্রামে গিয়ে ওদিক থেকে ভারত সীমান্ত যাওয়া যাবে। রাতেই সব দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছিলো জিদানের মা-বাবা।
পরদিন খুব ভোরে টেবিলে রাখা ছোট্ট চিরকুটে চোখ গেলো জিদানের মায়ের। সেখানে লেখা-
‘মা,
আমার জন্য দোয়া করো।
তোমার ছেলে যুদ্ধে গেলো।’
মায়ের মুখে ভাষা নেই। দৃষ্টি চলে গেলো খোলা দরজার দিকে সোজা রাস্তা ধরে। যে পথে তার ছেলে যুদ্ধে গেলো, যে পথে একটি জাতির মুক্তি এলো।

Share.

মন্তব্য করুন