স্কুল থেকে ফিরে এসেই আবিদ মুখ গোমরা করে বসে আছে। আজ তার মর্নিং ক্লাস ছিলো। ক্লাস থ্রির মেধাবী ছাত্র আবিদ। ভালো ছবিও আঁকতে পারে সে। গতবছর জতীয় শিশু কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ফার্স্টও হয়েছিলো। সে কী আনন্দ তার। আবিদের বড় বোন হুমায়রা তার ক্লাস সিক্সের সহপাঠীদের কাছে গল্প করে বেড়ায়, ‘আমার ছোটো ভাই আবিদ একদিন অনেক বড় চিত্র শিল্পী হবে। তাকে টেলিভিশনে দেখা যাবে।’
হুরায়রার কথা শুনে অনেকেই টিপ্পনী কাটে, তাতে সে একটুও রাগ করে না, হুমায়রা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে- আবিদ সত্যি একসময় অনেক খ্যাতি অর্জন করবে। তার আঁকা ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হবে।
আবিদকে অনেকক্ষণ মুখ ভার করে বসে থাকতে দেখে মিসেস রাহেলা বিচলিত হয়ে উঠলেন- ‘কী হয়েছে বাবা, তোমার মন খারাপ? আপু কিছু বলেছে?’ আবিদ ডান বাম মাথা দুলিয়ে বলল না! আপু কিছু বলেনি।
আচ্ছা আম্মু তোমরা কী আমাকে অনেক ভালোবাসা?
রাহেলা খানম একটু হেসে বললেন, কী বলছো বাবা!
তোমাকে আমরা অনেক বেশি ভালোবাসি। আবিদ ফিক করে হেসে ফেলে। আম্মু আমার জন্মদিনের কথা মনে আছে তোমাদের? আমার বাবার জন্মদিন আমার মনে থাকবে না? খুব আছে। এ মাসের বাইশ তারিখ। আবিদ এবার একটু নড়েচড়ে বসলো! ‘আচ্ছা আম্মু, এ জন্মদিনে কিন্তু আব্বু বলেছিলো আমি যা চাইব তা-ই দিবেন আমাকে।’ আবিদের মা হাসিমুখ করে জানতে চাইলেন আবিদের কি চাই! সে যা চাইবে তাই পাবে।
আবিদ বলল অন্য কথাÑ ‘এখন বলব না! আব্বু আসলে সবাইকে একসাথে বলবো।’ মিসেস রাহেলা ছেলের কথা বলার ভাবার্থ কিছুই অনুমান করতে পারেন না! কী হয়েছে আজ ওর?
আবিদের বাবা জামিল সাহেব অফিস থেকে ফেরা পর্যন্ত আবিদ বিভিন্ন ছবি আঁকলো। নজরুলের একটা ছবি এঁকে হুমায়রা সহ টেপ দিয়ে ঘরের দেয়ালে সেটি লাগিয়ে দেয়। হুমায়রা তাকে অভয় দেয়, তুই না সত্যি অনেক বড় শিল্পী হবি। দেখিস… হুমায়রার কথায় আবিদ খুব লজ্জা পায়।
জামিল সাহেব বাসায় ফিরলেন সন্ধ্যার পর। ফিরেই জানলেন কী এক অজানা কারণে আবিদ আজ বায়না ধরেছে। সে তার আব্বুকে সে কথা বলতে চায়। জামিল সাহেব দেরি না করেই প্রথমে আবিদের কাছে গিয়ে বললেন- ‘কি হয়েছে বাবা?’ আবিদের বোন আর আম্মু ইতিমধ্যেই আবিদের পাশে ভীড় করেছে।
আবিদ আবদারের সুরে বলে, ‘আব্বু তুমি কী আমাকে জন্মদিনে যা চাইব তা দেবে?’ জামিল সাহেব খুব দৃঢ় কন্ঠে বললেন- ‘অবশ্যই দেব, কি চাও বলো তো!’
আবিদের মুখটা এবার ফুটন্ত গোলাপের মতো ঝলমল করে উঠল। সে বলা শুরু করল তার আবদারের কথা।
‘আব্বু, আমি এ জন্মদিনে আমার কিছু বন্ধুদের ডিনার করাবো। কমলাপুর বস্তিতে থাকে তারা।’
তোমার ক্লাসে পড়ে? আম্মু জিজ্ঞেস করলেন!’ আবিদ নিঃসংকোচ মনে বলল, ‘না আম্মু! তাদের পড়াশোনার সামর্থ নেই। ফুটপাতে এটা ওটা খুঁজে বেড়ায়। আমরা যাদেরকে টোকাই বলি। একদিন তাদের জন্য একটা ছবি এঁকে দিয়েছি, সেই থেকেই ওরা আমাকে বন্ধু বলে ডাকে। আব্বু ওরা তো ভালো খাবারদাবার খেতে পারে না আমাদের মতো, তাই ওদের দাওয়াত করব।
আরেকটা জিনিস চাইব! তারা যখন আমাদের বাসায় আসবে, যাওয়ার সময় একটা করে নতুন জ্যাকেট দিব। এখন প্রচণ্ড শীত হয় রাতে। তার নতুন জ্যাকেট পেলে খুব খুশি হবে।’
আবিদ কথাগুলো বলে চুপ করে থাকলো।
জামিল সাহেব চশমাটা হাতে নিয়ে দেখলেন তার চোখ অশ্রুতে ভিজে গেছে। এগিয়ে এসে জামিল সাহেব পরম মমতায় আবিদকে বুকে জড়ালেন। পেছনে হুমায়রা আর তার মা-ও দাঁড়িয়ে ছিলো।

Share.

মন্তব্য করুন