ক্রিটাস গ্রহের সকালবেলা। এরিখ স্কুলে যাবার জন্য হাঁটা দিলো। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সে। রাস্তায় বিশাল হইচই! কী হয়েছে? কিসের এতো জটলা? এরিখ কাছে গিয়ে ভিড় ঠেলে যা দেখলো তা বলার মতো নয়। কয়েকজন পথচারী একটি ছোট ছেলেকে ধরে মারছে। ছেলেটি হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে, আমি মিশিগান স্কুলের সন্ত্রাসী হামলা বিষয়ে কিছুই জানি না আর আমার বাবা সামান্য রোবট নির্মাণ কারখানার শ্রমিক। আমি বা আমাদের পরিবার এর সাথে জড়িত নই।
মধ্যবয়সী গুণ্ডা টাইপের একটা লোক রেগে বললো, হুম, ভালোই তো বানিয়ে কথা বলতে পারিস? হামলার সময় তোর সন্দেহজনক আচরণগুলো আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে বুঝলি রে শয়তানের বাচ্চা!! লোকটির কথা থামিয়ে দিয়ে এরিখ বললো, যথেষ্ট হয়েছে!
আপনারা থামুন। আর ছেলেটিকে অমানুষের মতো মারছেন কেনো? ছাড়ুন ওকে। যা করার পুলিশ করবে। কারও সন্দেহজনক আচরণ দ্বারা এটা নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, সে অপরাধী। আচ্ছা, আপনারা কে বলু তো?
মধ্যবয়সী লোকটা প্রচণ্ড অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বললো, কেনো পুচকে খোকা? আত্মীয়তা করতে চাও নাকি?
এরিখ হেসে বললো, আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দিবো। তার আগে চলুন, থানায়, যা বলার পুলিশকে বলবেন! লোক তিনটি কথাগুলো শুনে লজ্জা পেয়েছে মনে হয়।
একজন ঢোক গিলে বললো : ঠিক আছে চলো তবে!
সবাই হাঁটতে শুরু করলো থানার দিকে। যেতে যেতে এরিখ লোকগুলোকে বললো, আচ্ছা বলুন তো এই এতো লোক থাকতে একে কেন সন্দেহ হচ্ছে আপনাদের? আরও তো লোক জড়িত ছিল? এরিখের কথার উত্তর দিয়ে মোটা লোকটা বললো, ওহ্ তুমি বুঝি কিছুই জানো না বাবা? আরে এতো মুসলমানের বাচ্চা! এরা হলো বিশ্বহারামি, এরাই তো আজ গোটা বিশ্বে সন্ত্রাস আর অশান্তি লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। ইসলাম ধর্ম একটা শয়তানি, স্বার্থপর আর বর্বর ধর্ম। এরিখ লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে বললো, শুনুন কাকু!
আপনার ধারণা ভুল। সন্ত্রাস কখনও নির্দিষ্ট ধর্ম থেকে আসে না। মানুষই ধর্মের অপব্যবহার করে। মানছি, এসব হামলায় অনেক কিছু এদের দ্বারা হচ্ছে তবে এরা প্রকৃত ধার্মিক নয় বরং ধর্মান্ধ মুসলিম। ইসলামে এসব নেই।
লোকটি বললো, হুম বুঝলাম তবে পৃথিবীতে গত কয়েক শতকে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে এগুলোর বেশির ভাগই কিন্তু মুসলমানদের দ্বারা হয়েছে তাই না?
এরিখ মন খারাপ করে বললো, তা ঠিক তবে এর জন্য পৃথিবীর নোংরা পরিবেশ দায়ী কারণ জন্ম থেকে কেউ অপরাধী হিসেবে জন্ম নেয় না। অপরাধের পিছনে অনেক কারণ রয়ে যায়। আমি একজন খ্রিষ্টান হয়েও এটা খুব ভালো জানি যে, পৃথিবীতে যতো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তার পিছনে কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক নয় বরং আমাদের মতো অমুসলিম বিশ্ব ও এর নেতাদের হাত ছিলো! হুম আমি পৃথিবী নামক গ্রহ নিয়ে অনেক বই পড়েছি। ওখানে এখনও সমস্যা লেগে আছে। আর এখন দেখি ক্রিটাস গ্রহেও এর প্রভাব পড়েছে। মনে হয় এবার মহাবিশ্বে গ্রহে গ্রহে মহাবিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে!
লোকটি হাসা শুরু করলো অবশ্য বাকি দু’জন চুপ। মনে হয় তারা কিছুটা হলেও কথাগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছে। লোকটি বললো, ও আরেকটা খবর। পৃথিবীতে নাকি রোবট বিপ্লব হয়েছে? রোবটকে মানুষের মতোই হুবহু ক্ষমতা দিয়ে নাকি তৈরি করেছে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা! আমি পেপারে পড়লাম সেদিন।
এরিখ কথাটা শুনে থমকে গেলো। কারণ, গতকাল বাবাও বলছিলো পৃথিবীর দখল নাকি মানুষের থেকে রোবটরা কেড়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছু রোবট বিজ্ঞানী ইতোমধ্যেই যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কি জানি বাপু? ঔ পৃথিবী নামক গ্রহটা যুদ্ধ করতে করতে আজ ধ্বংসের পথে। যার ফলাফল রোবট বিপ্লব।
যত্তসব রোবোটিকস- ফোবোটিকস, একটু বেশি বাড়াবাড়ি রকমের করে ফেলেছে তারা। অথচ পৃথিবীর অনেক আগেই ক্রিটাস গ্রহের বিজ্ঞানীরা অনেক উন্নতমানের রোবট তৈরি ও ব্যবহার করে আসছে। যা হোক এসব বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসি।
লোকটি তিনটি মাথা নাড়লো। এরিখ ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করায় জানা গেলো, ওর নাম মুসা। মিশিগান স্কুলের ছাত্র সে। থানায় চলে এলো সবাই। পুলিশের কাছে সব বললো এরিখ। পুলিশ অফিসার রেগে বললেন, আপনারা কাজটি ভালো করেননি! শিশুদের গায়ে হাত দেয়া ক্রিটাস গ্রহে নিষিদ্ধ। তাছাড়া কারও দোষ প্রমাণ না হতেই আপনারা সব বুঝতে পারলেন আশ্চর্য কাণ্ড?
লোকটি ঢোক গিলে বললো, স্যার, না মানে এসব হামলা তো মুসলমানদের কাজ। এই মিশিগানের স্কুলের একমাত্র মুসলিম ছাত্র। তাই আরকি!
পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বললেন, আরে মিঞা থামুনতো। কে বলেছে মুসলিম হলেই সন্ত্রাসী হবে? আপনারা কি ধোয়া তুলসীপাতা নাকি? তা এতই যদি ভালো তবে অমানুষের মতো শিশুটির গায়ে হাত দিলেন কেন? গায়ে হাত দিয়ে আপনারা প্রমাণ করলেন আপনারাও কিছুটা সন্ত্রাসী টাইপের! আরে পাপ তো পাপ! পাপের কি আর ধর্ম আছে নাকি? শুনুন, মিশিগান স্কুলের হামলা নিয়ে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ও তারা মাঠে নেমে পড়েছে। আপনাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আগে ভালো মানুষ হোন মিঞারা পরে না হয় পুলিশকে হেল্প করবেন। শিশুটির কাছে মাফ চান বলছি?
লোক তিনটি লজ্জিত হয়ে কাচুমাচু করে বললো, স্যার আমাদের ভুল হয়ে গেছে!
এবার মুসা নিজেই বললো, থাক পুলিশ অ্যাংকেল, উনারা আমার বাবার বয়সী। ভুল তো মানুষই করে। উনাদের ছেড়ে দিন। মুসার কথাগুলো শুনে পুলিশ অফিসার হতবাক হয়ে গেলেন। আর লোক তিনটি লজ্জিতভাবে মাথা নিচু করলো। অফিসার খুশিতে বললেন, দেখলে তো? এই শিশুটির কাছে তোমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। যাও তোমরা যার যার কাজে যাও। আর হ্যাঁ, মুসা চলো বাবা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি বাসায়।
মুসা হেসে বললো, ধন্যবাদ অ্যাংকেল, তার দরকার নেই। আমি এরিখ ভাইয়াসহ গল্প করতে করতে এটুকু হেঁটেই যাবো। এইতো আরেকটু এগিয়ে গেলে আমাদের বাসা।
অফিসার খুশি হয়ে করমর্দন করলেন। ওরা বিদায় নিলো। রাস্তায় দু’জনে অনেক গল্প করে অবশেষে যে যার বাড়িতে চলে গেলো। আর এরিখের মাথায় এখনও একটাই প্রশ্ন, পৃথিবীতে রোবট বিপ্লব? সেটা আবার কেমন? রোবট রেনেসাঁস নয়তো? হয়তোবা!
দুই.
কিছুক্ষণ পরপর চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর টেলিভিশনের চ্যানেল চেইঞ্জ করছেন মি. স্মিথ মানে এরিখের বাবা। অফিস থেকে ফিরেই নিউজ নিয়ে ব্যস্ত তিনি।
দেশ-বিদেশের বড় বড় চ্যানেলগুলো কিছুক্ষণ পরপর লাইফ আপডেট দিচ্ছে। সবখানে একটাই খবর। পৃথিবীতে নাকি রোবট বিপ্লব হয়েছে আর কিছু বিপ্লবী রোবট আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। উদ্বিগ্ন বিজ্ঞান মহল! শেষ পর্যন্ত কী যে ঘটবে ঈশ্বর জানেন? এরিখ রুমে ঢুকেই বাবাকে খেয়াল করলো। বাবাকে খুব চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। এরিখ মুচকি হেসে বাবার দিকে এগিয়ে গেলো।
– হুম বাবা, আজকাল তোমার কী হয়েছে বলতো? খালি খবরের কাগজ আর টিভির খবর নিয়ে ব্যস্ত থাকো?
– হ্যাঁরে এরিখ, সবতো জানিস। গোটা মহাবিশ্বে বর্তমান একটাই আলোচিত টপিক আর তা হলো পৃথিবী নামক গ্রহটার সমস্যা। সেটা হলো, রোবোটিকস প্রযুক্তি নিয়ে তাদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির ফলাফল মানে রোবট বিপ্লব।
এরিখ হেসে ফেললো। বললো, হুম বাবা, রোবোটিকস- ফোবোটিকস মানে বিজ্ঞানের অতিরঞ্জিত ব্যবহার। আসলে পৃথিবীর মতো এর মানুষগুলোরও মাথা দিন দিন গরম হয়ে গেছে। এর আগে এরাই অনলাইনের অতিরঞ্জিত ব্যবহারের কারণে বড় মাশুল দিয়েছে। তবুও শিক্ষা হয়নি। এ গ্রহে প্রচুর মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ হয়েছে গত কয়েক শতাব্দী ধরে। এরা পারমাণবিক শক্তিকে মানুষ ধ্বংসে ব্যবহার করেছে। আসলে বাবা এদের পাপের লেয়ারটা এতো দীর্ঘ হয়েছে যে এটা ধ্বংস হতেও সময় লাগবে!
– হুম তুই ঠিক বলেছিস এরিখ। আমারও তাই মনে হয়। যে কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার এর ক্ষেত্রে সীমা আছে। সেটা লঙ্ঘন করলেই বিপদ। বিজ্ঞানের জনপ্রিয় শাখাগুলোর একটি হলো, রোবোটিকস আর তারা আজ সেটা বানিয়ে ফেলেছে ফোবোটিকস মানে ফাইজলামি। রোবোটিকস নিয়ে ফাইজলামি আরকি! যা হোক, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
আমরা আর কী করতে পারি? আমি জানি, ক্রিটাস গ্রহ থেকে তারা কোনো হেল্প পাবে না। কারণ, পৃথিবীর লোকেরা খুব অহংকারী আর নিজেদের নিয়ে বড়াই করে। বুঝো এবার মজা! ডাইনিং রুম থেকে মিসেস স্মিথ চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, হ্যাঁরে এরিখ, তোরা কি খাওয়া-দাওয়া করবি না? উফ্! আর ভাল্লাগে না।
সারাদিন টিভি আর নিউজ। কার কী হয়েছে, কার কবে কী এগুলো নিয়ে ব্যস্ত তোমরা! ভালো খুব ভালো, শেষমেশ বাপবেটা মিলে আমায় জ্বালিয়ে মারো!
মায়ের এসব কথা এরিখকে খুব মজা দেয়। মা যে কী?
সেটা সেই ভালো জানে। মায়ের উত্তর দিয়ে এরিখ বললো, হুম যাই মা। খুব ক্ষুধা পেয়েছো। বাবা, তুমিও চলো।
– হুম, চল নাহলে আজ রক্ষা নেই। তোর মা বলে কথা! যা মেজাজ!!
এরিখ হেসে ফেললো। ওরা রুমে গেলো দুপুরের খাবারের জন্য।
তিন.
সকাল ১০টা। পৃথিবী গ্রহের মানুষেরা প্রত্যেকে আপন আপন কর্মক্ষেত্রে ছুটছে। কেউ গাড়িতে, কেউ অফিসে আবার কেউ বাসায় নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। জার্মানির ডেভিডসন রোবোটিকসের অফিসে পুলিশের ভিড়। কী হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তাদের কারখানায় তৈরি করা ৫টি হিউম্যানয়েড রোবট কারখানায় দায়িত্বরত কর্মী বিজ্ঞানীদের খুব করে পিটিয়ে পালিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে এও বলে গেছে, তারা খুব শিগগিরই এই কারখানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। এদিকে এ ঘটনার পর পৃথিবীর নামিদামি রোবট নির্মাণ কোম্পানি যেমন, জাপানের ‘হোন্ডা’ কোম্পানি তাদের জনপ্রিয় ‘আসিমো’ ব্র্যান্ডের রোবট নির্মাণ বন্ধ রেখেছে। হংকং এর ‘হ্যারিসন রোবোটিকস’ও তাদের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। হইচই পড়ে গেলো বিজ্ঞান মহলে। ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সমিতি’ জরুরি মিটিং ডেকেছে আজ সন্ধ্যা ৭টায় নিউইয়র্ক শহরে তাদের সদর দফতরে। মিটিং শুরু হলো। মিটিংয়ে পৃথিবীর নামিদামি বিজ্ঞানী ও রোবোটিকস এক্সপার্টরা অংশগ্রহণ করছেন। গোটা হলরুমে পিনপতন নীরবতা। সকল নীরবতা ভেঙে প্রথমেই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সমিতির প্রধান ড. ডেভিড গিলবার্ট তার ভাষণ শুরু করলেন, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সমিতির পক্ষ থেকে সকলকে শুভসন্ধ্যা! প্রিয় বিজ্ঞানী ও রোবোটিকস এক্সপার্ট ভাইবোনেরা আপনারা জানেন, আজ পৃথিবীর বিজ্ঞান মহল কঠিন দুঃসময় পার করছে। আমাদের প্রযুক্তির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা রোবোটিকস প্রযুক্তি। একসময় এই বিষয়টি শুধুই একটি কল্পনা ছিলো।
আপনারা ইতিহাস থেকে জানবেন যে, প্রয়াত বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক স্যার আইজাক অসিমভ তার সায়েন্স ফিকশন Robotaতে প্রথম রোবট বিষয়ে পৃথিবীকে ধারণা দেন। শিল্পক্ষেত্রে এর বাস্তব রূপ দেন আধুনিক রোবটিকসের জনক স্যার যোসেফ এফ এঞ্জেলবার্ন।
এরপর অনেক বছর কেটে গেলো। রোবট প্রযুক্তি আরও উন্নয়ন করতে করতে একসময় রোবট শুধু নিছক কোনো প্রযুক্তি নয় বরং মানুষের অনেক বিপজ্জনক কাজে সাহায্য, বিজ্ঞানের গবেষণা, মহাকাশ বা সমুদ্রে যাত্রা, হাসপাতালে রোগী দেখাশোনা সব করতে লাগলো রোবট। একসময় জাপানের বিখ্যাত হোন্ডা কোম্পানি হিউম্যানয়েড রোবট আসিমোকে তৈরি করে বিশ্বকে চমকে দিলো। পারকিনসন ডিজিজের মতো কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করেছিলো এই ‘আসিমো’ ব্র্যান্ডের রোবটগুলো। তা ছাড়া হ্যারিসন রোবটিকস এর তৈরি আইজাক টুবো কিংবা সোফিয়া রোবট হুবহু মানুষের অনুকরণ করতে লাগলো। ভালো কথা বর্তমান বিশ্বের সকল দেশে রোবটরা কোনো না কোনোভাবে মানুষের দাস হিসেবে কাজ করছে। কারণ, মানুষই তাদের স্রষ্টা। তাই বলে আজ এই রোবটরাই আমাদের সাথে বেইমানী করছে? প্রতিদিন তারা একটা না একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ছে! এইতো, কিছুক্ষণ আগে জার্মানির ডেভিডসন রোবটিকসের কারখানায় পাঁচটি বিপথগামী রোবট কারখানার কর্মী বিজ্ঞানীদের মারাত্মকভাবে আহত করে পালিয়ে গেলো। তুরস্কের এক হাসপাতালে কিছুদিন আগে এক নার্স রোবট এক রোগীকে খুব করে পিটিয়ে পালিয়ে গেলো!
সুইজারল্যান্ডের একটি ব্যাংক দখল করে ফেলেছে কয়েকটি মাফিয়া রোবট গ্যাং। কী হবে আর কী হচ্ছে?
প্রিয় ভাইবোনেরা, মনে রাখবেন অতীতেও আমরা অনেক সঙ্কট মোকাবিলা করেছি সকলের সুচিন্তিত পরিকল্পনায়। ধাপে ধাপে কাজ করে এগোতে হবে। তাই মাথা গরম করলে হবে না। প্রয়োজনে পৃথিবীর সকল রোবটগুলোর মধ্যে ইনস্টল করা অপারেটিং সিস্টেমগুলোর সফটওয়্যারগুলো নষ্ট করে দিলে এমনি এমনি সব রোবট তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলবে। তবে, এতে অনেক সমস্যা আছে। বললে তো আর সহজে হবে না। আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার জন্য মঞ্চে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, রোবোটিকস এক্সপার্ট ও হেনরি লুইস রোবটিকস-এর CEO জনাব ড. উইলিয়াম থমসনকে। প্লিজ স্যার!
ড. উইলিয়াম থমসন মঞ্চে এলেন। সবাইকে শুভেচ্ছা
জানিয়ে শুরু করলেন :
ধন্যবাদ সবাইকে, আমার পূর্বের বক্তা বলে গেলেন যে, পৃথিবীর সকল রোবটের মধ্যে ইনস্টল করা অপারেটিং সিস্টেমগুলো অচল করে দিলে রোবটগুলো আর কাজ করতে পারবে না। খুব ভালো, তবে কাজ মোটেও সহজ নয়। কারণ, পৃথিবীতে একটা দুটো রোবট নির্মাণ কোম্পানি নেই, হাজার হাজার কোম্পানির তৈরি করা হাজার হাজার মডেল। এদের অপারেটিং সিস্টেমগুলোও আলাদা আলাদা। তাই একদিনে এ কাজ সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তবে আমরা ধাপে ধাপে এগোতে পারি। এক্ষেত্রে সহজ উপায় হলো, সকল কোম্পানির লিস্ট তৈরি, সেগুলোর মডেলগুলোকে চিহ্নিতকরণ তারপর অপারেটিং সিস্টেমের কোডগুলো নষ্ট করে ফেলা। এটা করতে আমাদের কয়েক মাস লাগবে। তবে কোম্পানিগুলো যে আর্থিক লোকসানের শিকার হবে তার দায়ভার কে নিবে? হুম এটাই আসল পয়েন্ট। আসুন এবার আমরা দেখে নেই কিভাবে একটি রোবট মানুষের মতো হয়। ড. উইলিয়াম থমসন এবার বিশাল বড় মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের দিকে ক্লিক দিলেন। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো রোবোটিকসের ডেমো ভিডিও। তিনি বুঝাতে শুরু করলেন: হিউম্যানয়েড রোবট কতগুলো বৈশিষ্ট্য ও স্তরের মাধ্যমে কাজ করে। এগুলো হলো :
১. Artificial intelligence (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : এটা এমন জিনিস যা মানব মস্তিষ্কের মতই কাজ করে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের মতো আমরা নকল করে বিভিন্ন রকম লজিক সার্কিট বসিয়ে দিয়েছি। এগুলোতে ইলেকট্রন প্রবাহিত হলে কাজ করতে শুরু করে এবং প্রোগ্রামিং অনুযায়ী মানুষের আচরণ নকল করে। ফলে সে বুঝতে পারে ও উত্তর দিতে পারে।
২. Dexterity বা দক্ষতা: মানুষের যেমন কাজ করা বা বুঝার দক্ষতা আছে ঠিক রোবোটের প্রোগ্রামিং অংশ সে রকম কাজ করে।
৩. Tactility বা স্পর্শ অনুভূতি : আমরা ত্বক দিয়ে কিছু অনুভব করি। ত্বক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় তাই রোবটের হাত, মুখ ও পায়ে বিশেষ ধরনের সিলিকন দিয়ে মোড়ানো থাকে যা কোনো কিছু অনুভব করতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে মানুষের স্নায়ুর মতই এর মধ্যে থাকা কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কস লজিক সার্কিটে গিয়ে সিগন্যাল দেয়।
৪. Locomotion বা গন্তব্য: এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম অংশ সাহায্য করে। ফলে রোবোট ঠিকমত কোনটা কোন স্থান সেটা বুঝতে পারে।
৫. Visual Perception বা দেখার দক্ষতা : রোবোটগুলোর মানুষের আদলে চোখের জায়গায় বিশেষ ধরনের লেজার ক্যামেরা বসানো হয়। এর থেকে নির্গত রশ্মি বস্তুতে পড়ে ও সেটা কপি করে আবার আউটপুট আকারে দেখা যায়। এভাবে রোবোট দেখতে পায়।
৬. Automation বা স্বয়ংক্রিয়তা : মানুষের হাত, পা ও সকল অঙ্গ একটি বিশেষ নিয়মে মুভ করে। ঠিক রোবোটেরও যাতে অঙ্গ ঘুরানোর ক্ষমতা থাকে সে জন্য এটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নড়াচড়া করে।
৭. Fazi Logic বা বিশেষ ধরনের যুক্তি : বিজ্ঞানের মূল সূত্র হলো লজিক বা যুক্তি। মানুষই সেদিনই প্রথম বিজ্ঞান আবিষ্কার করে যেদিন সে লজিক বা যুক্তি দিয়ে ভাবতে শিখে। গুহার মানুষও গুহার দেয়ালে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো তারপর তো লিপি আবিষ্কার হলো। বিজ্ঞান মাত্রই যুক্তি ও গণিত। আর ফাজি লজিক হলো এমন এক ধরনের যুক্তি যা কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষের কী করতে হবে সেটা শেখায়। আমাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ হলো লজিক ইউনিট আরেকটি গাণিতিক ইউনিট। ঠিক হুবহু রোবোটের লজিক বোর্ডের একটি অংশ এরকম কাজ করতে পারে।
প্রিয় বিজ্ঞানী বন্ধুরা, এতক্ষণ যে বিষয়গুলো আলোচনা করলাম সেগুলো আমরা কমবেশি সবাই জানি তাই না? তবুও বললাম কারণ, রোবোটের অপারেটিং সিস্টেমের অংশ এগুলো। এই অপারেটিং সিস্টেমের জন্য তারা কাজগুলো করতে পারে। তার মানে এই নয় যে তারা মানুষের সমকক্ষ। আর যেহেতু, রোবোটগুলোকে লেজার ও রেডিও রশ্মির সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাই এদের এক মিনিটেই স্টপ করে দেয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো পৃথিবীর ৪৫% রোবোটের অপারেটিং সিস্টেম হ্যাক করেছে রোবোটরাই। তাই এ কাজ এখন খুব কঠিন। তবে কোম্পানিগুলোর তালিকা তৈরি করে এদের চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে হবে। আর বাকি ৫৫% রোবোটের অপারেটিং সিস্টেমগুলো নষ্ট করে দিলে তারা আর কাজ করতে পারবে না। আর বাকি থাকে কোম্পানিগুলোর লোকসান। কোম্পানিগুলো তো
অনেক আয় করেছে গত কয়েক শতাব্দী ধরে!
মানবতার স্বার্থে এটুকু করতে পারবে না তারা? সম্মানিত কোম্পানির প্রধানগণ, আপনারা কিছু বলুন। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, অবশ্যই পারবো। আমরা আমাদের শেষ চেষ্টাটুকুও বাদ দিবো না। গোটা হলে রুমে শোরগোল শুরু হয়ে গেলো।
অবশেষে বিজ্ঞান মহল একমতে পৌঁছাতে সক্ষম হলো যে, মানবতার স্বার্থে তারা এটুকু ত্যাগ স্বীকার করবে পাশাপাশি রোবোটিকস প্রযুক্তির অতিরঞ্জিত ব্যবহার ও নির্মাণ বন্ধ করে দেবে। সভা আজকের মতো শেষ হলো।
চার.
অবশেষে ২ মাস ধরে হ্যাক হয়া কোম্পানিগুলোর অপারেটিং সিস্টেমের তালিকা তৈরি করলো আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সমিতি। বাকি কোম্পানিগুলো তাদের অপারেটিং সিস্টেমগুলো নষ্ট করে ফেললো। ফলে অর্ধেক সমস্যা সমাধান হলেও বাকি থাকলো হ্যাকার রোবোটরা। বিশেষ ধরনের ন্যানো রেবোট তৈরি করলো বিজ্ঞানীরা। এগুলো মূলত বিস্ফোরক। পিপীলিকার মতো দেখতে এরা। হাজার হাজার ন্যানো পিপীলিকা রোবট পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো আর যেখানেই এসব হ্যাকার রোবোটরা অবস্থান করছে সেখানেই গিয়ে তাদের অজান্তেই বিস্ফোরিত হতে লাগলো। ফলে বাকি রোবোটগুলোও নষ্ট হয়ে গেলো। এভাবে বাকি সমস্যা সমাধান হলো। আর গোটা পৃথিবী স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। পৃথিবী নামক গ্রহটি আরেকবার শিক্ষা নিলো। তারপরও কথা থেকে যায়।
ইতিহাস বলে, এরা কখনও শিক্ষা হয়নি। এবারেও হবে তো নাকি আরও নতুন কোনো বিপর্যয় এর জন্য নিজেদের তৈরি করবে পৃথিবী নামক অহংকারী গ্রহটি?
আজও রাতে এরিখ ছাদে যায়। আর নিঃশব্দ নীলিমার দিকে তাকায়। হাজার হাজার নক্ষত্র মিট মিট কর জ্বলে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কোনো একটা উল্কাপিণ্ড কোথায় গিয়ে পড়তে দেখে। এবার টেলিস্কোপে চোখ রাখে সে। ক্রিটাস গ্রহের কাছে শত শত গ্রহ। কোনটা লাল, কোনটা নীল আবার কোনটা সবুজ। হুম এই সবুজ গ্রহটার নাম হলো পৃথিবী। এটি মহাবিশ্বের একমাত্র হিংসুটে, হীনমন্য গ্রহ। আর কেউ না হোক এরিখ সেটাই মনে করে। তবে আমাদের ক্রিটাস গ্রহ কি খুব ভালো? এতেও সমস্যা আছে। হয়তো এ কারণেই একদিন গ্রহে গ্রহে মহাবিশ্ব যুদ্ধ লাগবে। সেদিনই বা কবে? ততোদিনে কি এরিখ থাকবে নাকি হারিয়ে যাবে না ফেরার দেশে? ব্ল্যাকহোল যেমন অন্ধকারকে শুষে নেয় নিজেদের মধ্যে মহাবিশ্ব তেমনি একসময় নিজের চূড়ান্ত পরিণতি ডেকে আনবে।